জুমাদাল আখেরা ১৪৩১হিঃ (১৬)

হযরত আলী নাদাবীর পাতা

মাযা খাসিরাল আলামু বিনহিতাতিল মুসলিমীন-এর ধারাবাহিক অনুবাদ

মুসলিম উম্মাহর অধঃপতনে বিশ্বের কী ক্ষতি হল ?

পর্ব: ১৪

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট
রোমকজাতির অভ্যুদয় ঃ ইতিহাসের অনিবার্য ধারায় রোমকজাতি গ্রীকদের স'ান দখল করে নিলো এবং শক্তি ও প্রতিপত্তিতে, সাম্রাজ্যের বিস-ারে, সমরকুশলতায়, সৈনিকতায় ও শাসনব্যবস'ায় গ্রীকদের ছাড়িয়ে গেলো, তবে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শনে; শিল্প-সাহিত্য ও কাব্যপ্রতিভায় এবং নাগরিক সভ্যতা ও সুশীলতায় ্‌গ্রীকদের সমকক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ হলো। সমকালীন অন্যান্য জাতি, এমনকি রোমকদেরও মোকাবেলায় এসব ক্ষেত্রে গ্রীকদের শ্রেষ্ঠত্ব ও অগ্রগামিতা ছিলো স্বীকৃত। এর স্বাভাবিক যে কারণটি আমরা চি‎হ্িনত করতে পারি তা এই যে, রোমকরা তখনো ছিলো তাদের সামরিকতার যুগে। তাই বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে গ্রীকদের সামনে তারা ছিলো অবনত এবং তাদেরই উচ্ছিষ্টভোজী। গ্রীকদের জ্ঞান ও দর্শন এবং চিন-া ও বুদ্ধিবৃত্তিরই তারা ‘খোশাচর্বন’ করেছে দীর্ঘকাল। লেকী বলেন- ‘গ্রীকদের ছিলো বিপুল জ্ঞানসম্পদ, যা তারা যুগ যুগের সাধনায় সৃষ্টি করেছে এবং তার সমৃদ্ধিসাধন করেছে। অথচ রোম তখনো সামরিকতার স-রেই পড়ে ছিলো। জাতীয়ভাবে যেমন তাদের কোন জ্ঞানসম্পদ ও সহিত্যকর্ম ছিলো না, তেমনি তাদের ভাষাসম্পদও ভাব ও চিন-া এবং উচ্চাঙ্গ অনুভব ও মর্ম প্রকাশে সক্ষম ছিলো না। জ্ঞানগত দৈন্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক পশ্চাদপদতার কারণে স্বাভাবিকভাবেই গ্রীকদের কাছে তারা মার খেলো এবং রাজনৈতিক ও সামরিক বিজয় অর্জন করেও গ্রীকসভ্যতার কাছে নতি স্বীকার করে নিলো। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রে গ্রীক-প্রতিভার জাদুপ্রভাব তাদের আচছন্ন করে রেখেছিলো। তাই দেখা যায়, গ্রীকভাষাই ছিলো রোমের প্রাচীন ঐতিহাসিকদের লেখার ভাষা। রোমান কবিগণ ল্যাটিন ভাষায় কাব্যচর্চা শুরু করার পূর্বপর্যন- গ্রীকই ছিলো জ্ঞান-গবেষণা ও গ্রন'নার ভাষা। রোমকদের এ অনুকরণ ও আনুগত্য শুধু জ্ঞান ও গবেষণা এবং ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না, বরং ভাব ও স্বভাব, নীতি ও নৈতিকতা, সমাজ ও সামাজিকতা, আবেগ ও প্রবণতা এবং সাধারণ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই গ্রীকসভ্যতা রোমান সভ্যতার উপর আধিপত্য বিস-ার করেছিলো। ফলে গ্রীকদের অনুকরণ-আনুগত্যকেই রোমকরা আভিজাত্য ও চৌকশতার প্রতীক বলে মনে করতো। এভাবেই গ্রীকদের দর্শন ও সংস্কৃতি এবং চিন-া-চেতনা ও মনমানস রোমকদের আচ্ছন্ন করে ফেলেছিলো, বরং আরো সত্য করে বলতে গেলে তাদের মন-মসি-ষ্ক ও রক্ত-মাংসে তা মিশে গিয়েছিলো। অবশ্য রোমকরা তাদের ইউরোপীয় প্রবণতা ও প্রকৃতির কারণে স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যে গ্রীকদের থেকে খুব একটা আলাদা ছিলো না, বরং উভয় জাতির মধ্যে বিরাট সাদৃশ্য ছিলো। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়নির্ভর বিশ্বাস, অতিজীবনবাদিতা, ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও সংশয়, ধর্মীয় রীতি-নীতি ও আচার-ব্যবস'ার প্রতি নিস্পৃহা, উগ্র জাতীয়তাবাদ ও স্বদেশপ্রেম এবং অন্যান্য বিষয়ে গ্রীক-রোমক উভয় জাতি ছিলো একই কাতারে। সর্বোপরি শক্তি ও শক্তিমানের প্রতি আনুগত্য ছিলো পূজার সমতুল্য। ইতিহাস থেকে বোঝা য়ায় যে, স্বধর্মে রোমকদের বিশ্বাস তেমন প্রগাঢ় ছিলো না এবং তা হওয়ার উপায়ও ছিলো না। কেননা সেখানে ধর্মের নামে যে অলিকতা ও পৌত্তলিকতার ছড়াছড়ি ছিলো তাতে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও সংশয়-সন্দেহ সৃষ্ট হওয়া ছিলো অনিবার্য। ফলে জ্ঞান ও বুদ্ধির চর্চায় তারা যতই অগ্রসর হচ্ছিলো এবং চিন-া-চেতনায় যতই তাদের উৎকর্ষ ঘটছিলো, যুক্তবর্জিত ধর্মবিশ্বাসে ততই তারা শ্রদ্ধাহীন হয়ে পড়ছিলো। আর এ বিষয়ে তো প্রথম দিন থেকেই তাদের সিদ্ধান- ছিলো যে, জীবন-নীতি ও রাজনীতিতে ধর্ম-দেবতার কোন ভূমিকা নেই। সিরিরো বলেন- ‘নাট্যমঞ্চে অভিনেতারা যখন অক্ষৃত্তি করতো, জাগতিক বিষয়ে দেবতাদের কোন ভূমিকা নেই, শ্রোতারা তাতে উল্লাস প্রকাশ করতো।’ সাধু অগাস্টিন বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন- প্রতিমাপূজক রোমানরা উপাসনা-মন্দিরে দেবতাদের পূজা করতো, আবার নাট্যমন্দিরে দেবতাদের উপহাস করে রচিত নাটক মহাউৎসাহে উপভোগ করতো। রোমানধর্মের আধ্যাত্মিক প্রভাব তার অনুসারীদের উপর এতই শিথিল এবং অন-রে ধর্মীয় ভাব ও আবেগ এতই শীতল হয়ে পড়েছিলো যে, কখনো কখনো নির্দ্বিধায় দেবতাদের অবমাননা করা হতো। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সম্রাট অগাস্টাস-এর নৌবহর যখন ডুবে গেলো তখন ক্রোধে আত্মহারা হয়ে তিনি সমুদ্রদেবতা নেপচুনের মূর্তি ভেঙ্গে ফেলেছিলেন। একইভাবে জিরমিনেক্স-এর মৃত্যুতে মানুষ দেবতাদের বলির বেদিগুলো ভাঙ্গচুর করেছিলো। মোটকথা, রোমান জাতির চরিত্র ও নৈতিকতা এবং শাসন-প্রশাসন ও সমাজজীবনে ধর্মের কোন প্রভাব ছিলো না এবং তাদের চিন-া-চেতনা, আবেগ- উচ্ছ্বাস ও ঝোঁক-প্রবণতার উপর ধর্মের কোন নিয়ন্ত্রণ ছিলো না। তা আধ্যাত্মিক শক্তিতে বলীয়ান এমন কোন ধর্ম ছিলো না, যা হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত হয়ে আত্মার জগতকে শাসন করবে, বরং তা ছিলো নিছক কিছু রীতি-প্রথা ও আচার-আনুষ্ঠানিকতা। শাসকশ্রেণী ও রাজপুরুষদের স্বার্থের দাবী ছিলো শুধু নামে ও রসমে ধর্মকে টিকিয়ে রাখা, তাই তা টিকে ছিলো। লেকী বলেন- আত্মকেন্দিকতাই ছিলো রোমান ধর্মের মূল ভিত্তি। ব্যক্তিজীবনে মানুষ সুখে শানি-তে এবং বিপদ-দুর্যোগ থেকে নিরাপদে থাকুক, এছাড়া এ ধর্মের আর কোন লক্ষ্য ছিলো না। এর জ্বলন- প্রমাণ এই যে, রোমে অসংখ্য বীর-প্রতিভার আবির্ভাব ঘটেছে এবং বহু নায়কপুরুষ জন্মলাভ করেছেন, কিন' এমন কোন আধ্যাত্মিক সাধক পুরুষের আবির্ভাব ঘটেনি, যিনি তার আত্মদমন ও নির্মোহ জীবন দ্বারা জাগতিক ভোগ-বিলাসে ডুবে থাকা মানুষকে প্রভাবিত করতে পারেন। সমগ্র রোমান জাতির ইতিহাসে ত্যাগ ও আত্মত্যাগের যা কিছু উদাহরণ আমরা পাই, তার একটিও ধর্মের ভিত্তিতে নয়, বরং জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। সমসাময়িক জাতিবর্গের মধ্যে, এমনকি পরবর্তী যুগেও রোমানজাতির যে পৃথক বৈশিষ্ট্য ছিলো তা হচ্ছে তাদের সাম্রাজ্যবাদী স্বভাব এবং জীবনের প্রতি আগাগোড়া জড়বাদী ও বস'বাদী দৃষ্টিভঙ্গি। বস'ত এই জড়বাদ ও বস'বাদই ছিলো রোমানজাতির ধর্ম এবং তাদের পরিচয়-প্রকৃতি। আজকের ইউরোপ রোমানদের কাছ থেকে এটাই উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছে। জার্মান নও মুসলিম পণ্ডিত মুহম্মদ আসাদ তার সুবিখ্যাত ও সুসমৃদ্ধ গ্রন' ‘সঙ্ঘাতের মুখে ইসলাম’-এ বিষয়টি খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন- রোমানসাম্রাজ্যের উপর যে চিন-া-চেতনা ও স্বভাবপ্রবণতার নিরঙ্কুশ প্রভাব ছিলো তা হচ্ছে সাম্রাজ্যের অনুকূলে সর্বপ্রকার শক্তি ব্যবহার করা এবং অন্যান্য জাতিকে রোমানস্বার্থের সেবাদাসে পরিণত করা। রোমান শাসক ও প্রশাসকগণ অভিজাত সমাজের আরাম-আয়েশ ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য যে কোন ধরনের যুলুম-অত্যাচার ও শোষণ-নিপীড়নে দ্বিধাবোধ করতো না। পক্ষান-রে রোমান শাসনের যে সুবিচার- খ্যাতি শোনা যায় সেটা ছিলো শুধু রোমকদের জন্য। আর এই নীতি ও চরিত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে শুধু জীবন ও সভ্যতার নিছক বস'বাদি ধ্যান-ধারণার উপর, যদিও তাদের বস'বাদিতাকে বুদ্ধিবৃত্তিক রুচি দ্বারা পরিমার্জিত করা হয়েছিলো, তবে তা সর্বপ্রকার আত্মিক মূল্যবোধ থেকে ছিলো অনেক দূরে। ধর্ম ও ধার্মিকতা রোমকরা কখনোই নিষ্ঠা ও আন-রিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেনি। তাদের সনাতন উপাস্য দেবতারা ছিলো গ্রীকদের অলিক কল্পকথারই উপচ্ছায়ামাত্র। তারা শুধু নিজেদের সামাজিক বন্ধন ও জাতীয় ঐক্য টিকিয়ে রাখার জন্য দেবতাদের প্রতি বিশ্বাসকে ব্যবহার করেছিলো। পক্ষান-রে বাস-ব জীবনে তাদের কোন প্রকার হস-ক্ষেপ তারা অনুমোদন করেনি। দেবতাদের শুধু অনুমতি ছিলো যে, জিজ্ঞাসিত হলে তারা ‘সেবক’ ও গণকদের যবানিতে গায়ব সম্পর্কে কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করবে, কিন-ু মানুষের উপর নৈতিক ও চারিত্রিক কোন বিধি-বিধান প্রবর্তন করার অধিকার তাদের ছিলো না। রোমান প্রজাতন্ত্রে নৈতিক অধঃপতন গণতান্ত্রিক শাসনের শেষ দিকে রোমে নৈতিক অবক্ষয়, পাশবিক স্বেচ্ছাচার ও অবাধ ভোগ-বিলাসের এমন ঢল নেমে এলো যে, তার তোড়ে সবকিছু ভেসে গেলো এবং গোটা জাতি পাপাচারের কাদাজলে ডুবে গেলো এবং ঐসকল নৈতিক বিধি-বিধান ও চারিত্রিক বন্ধন তছনছ হয়ে গেলো যা একসময় রোমানদের স্বভাব-বৈশিষ্ট্য বলে মনে করা হতো। সমাজজীবনের ভিত্তিমূল এমনভাবে কেঁপে উঠলো যে, গোটা ইমারতই যেন ধ্বসে পড়ার উপক্রম হলো। ডক্টর ড্রেপার তার ‘ধর্ম ও বিজ্ঞানের সঙ্ঘাত’ গ্রনে' এর সুন্দর চিত্র এঁকেছেন এভাবে- ‘রোমান সাম্রাজ্য যখন সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তির চরমে উপনীত হলো এবং সভ্যতার উন্নতি ও অগ্রগতি চূড়ান- সীমায় পৌঁছলো তখন রোমান জাতি নৈতিক অবক্ষয় ও ধর্মীয় অধঃপতনের একেবারে শেষ সীমায় পৌঁছে গেলো। আমোদ ও প্রমোদ ও ভোগবিলাসে তারা সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো এবং স্বেচ্ছাচারের চূড়ান- করে ছেড়েছিলো। তাদের নীতি ও দর্শন যেন ছিলো এই- জীবন শুধু ভোগের জন্য, যেখানে মানুষ আয়েশ থেকে ফুর্তিতে এবং ফুর্তি থেকে স্ফূর্তিতে গড়াগড়ি খাবে। এভাবে জীবনটা ছিলো তাদের কাছে ভোগ-উপভোগের এক অন-হীন ধারা। সংযম ও উপবাসের ছিটেফোঁটা যা কিছু পালন করা হতো তারও উদ্দেশ্য ছিলো ভোগের চাহিদা আরো চাগিয়ে তোলা এবং সেটাকে আরো দীর্ঘায়ু করা। তাদের টেবিল সাজানো হতো মণিমুক্তাখচিত স্বর্ণ ও রৌপ্যপাত্র দ্বারা। সুদর্শন পরিচারক ঝলমলে পোশাকে সেবাকার্যে নিয়োজিত থাকতো। রোমের নগ্ন সৌন্দর্যের প্রতীক গায়িকা ও নর্তকীদের দল, শ্লীলতা ও সম্ভ্রম থেকে যারা ছিলো মুক্ত, পুরুষদের মনোরঞ্জনে সদা প্রস'ত থাকতো। তাদের লাস্যতা ও নৃত্যগীত পুরুষের আমোদ-প্রমোদের জন্য ছিলো যেন ঘৃতাহুতি। সুবিশাল ক্রীড়াঙ্গনে বিভিন্ন খেলা-ধূলার আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান ছিলো রোমকদের চিত্তবিনোদনের আরেকটি মাধ্যম, তবে সবচে’ বীভৎস ব্যাপার ছিলো মানুষে মানুষে, পশুতে পশুতে, এমনকি মানুষ ও হিংস্রপশুর মধ্যে লড়াই, যা রক্তাক্ত মৃত্যু পর্যন- চলতে থাকতো, আর পাশবিক উল্লাসে দর্শক তা উপভোগ করতো। বিশ্বজয়ের গর্বে গর্বিত এ জাতি বুঝতে পেরেছিলো যে, যদি তাদের পূজা লাভ করার উপযুক্ত কিছু থেকে থাকে তাহলে সেটা হচ্ছে শক্তি। কারণ শক্তি দ্বারাই একজন মানুষ অনায়াসে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলতে পারে, সাধারণ মানুষকে যা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তিলে তিলে অর্জন করতে হয়। বাহুবলে যুদ্ধজয়ের ফলেই তো বিত্ত-সম্পদের উপর অধিকার অর্জন এবং রাজস্ব নির্ধারণ ও আহরণ সম্ভব হয়। সুতরাং শক্তির চেয়ে বড় উপাস্য আর কী হতে পারে! আর রোমসাম্রাজ্যের অধিপতি ও সম্রাটই হলেন সেই সর্বজয়ী শক্তির একক প্রতীক। রোমের সভ্যতা ও নাগরিকতায় সেই রাজশক্তির বাহ্যস্ফূরণ অবশ্যই দেখা যেতো, কিন' সেটা ছিলো চাকচিক্যের প্রতারণা, যেমন আমরা দেখতে পেয়েছি গ্রীক সভ্যতার পতনযুগে। রোমে খৃস্টধর্ম ঐ সময় এমন একটি বিরাট বিপ্লবাত্মক ঘটনা ঘটেছিলো যার সুদূর প্রসারী প্রভাব সম্পর্কে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করা প্রত্যেক দায়িত্বশীল ঐতিহাসিকের কর্তব্য। সেটা হলো প্রতিমাপূজক রোমের সিংহাসনে খৃস্টধর্মের অধিষ্ঠান। ঘটনাটি এভাবে ঘটেছিলো যে, কনস্টান্টাইন, যিনি ধারাবাহিক ঘটনার অনিবার্যতায় আগেই খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, ৩০৫ খৃস্টাব্দে তিনি রোমের সিংহাসনে সমাসীন হন। ফলে হঠাৎ করেই প্রতিমাপূজার উপর খৃস্টধর্মের বিজয় অর্জিত হয় এবং এমন এক বিশাল সম্রাজ্য ও অপ্রতিহত রাজশক্তি তার হাতে চলে আসে, যা আগে সে কল্পনাও করতে পারেনি। কনস্টান্টাইন সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন বস'ত খৃস্টধর্মের অনুসারীদের অতুলনীয় ত্যাগ ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে এবং রক্তের নদীর উপর তৈরী তাদের লাশের সেতু পার হয়ে । কৃতজ্ঞ সম্রাট তাদের এ অবদানের পূর্ণ প্রতিদান দিয়েছিলেন এবং সাম্রাজ্যশাসনে তাদের পরিপূর্ণ অংশীদার করে নিয়েছিলেন। খৃস্টধর্মের আত্মবিপর্যয় কিন' এই সামরিক ও রাজনৈতিক বিজয় ছিলো প্রকৃতপক্ষে খৃস্ট- ধর্মের জন্য চরম আত্মবিপর্যয়ের সূচনা। অস্ত্র-যুদ্ধে জয়লাভ করলেও আন-ধর্ম যুদ্ধে তারা পরাস- হয়েছিলো এবং এক বিরাট সাম্রাজ্যের দখল অর্জন করলেও একটি মহান ধর্ম তাদের হারাতে হয়েছিলো। কেননা রোমের মূর্তিপূজকরা এবং স্বয়ং খৃস্টের অনুসারীরা খৃস্টধর্মকে বিকৃত করে ফেলেছিলো। আর সবচে’ ভয়াবহ বিকৃতি ঘটেছিলো স্বয়ং কনস্টান্টাইন দ্য গ্রেট-এর হাতে, যিনি খৃস্টধর্মের রক্ষক ও পতাকাধারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ড্রপার লিখেছেন- বিজয়ী ও ক্ষমতলাভকারী দলের সঙ্গে যারাই যোগ দিলো তারা বড় বড় পদ ও রাজমর্যাদার অধিকারী হতে লাগলো। ফলে ধর্মের বিষয়ে যাদের বিন্দুমাত্র উৎসাহ ছিলো না এবং খৃস্টধর্মের প্রতি কখনো কোন আন-রিকতা ছিলো না তারাই খৃস্টধর্মের সেবক সেজে সামনের কাতারে চলে এলো। প্রকাশ্যত খৃস্টান, অথচ অন-গর্ত- ভাবে মূর্তিপূজক এই সুবিধাবাদী-দের দুষ্টপ্রভাবে খৃস্টধর্মে ভয়াবহরূপে শিরক ও মূর্তিপূজার অবাধ অনুপ্রবেশ ঘটতে লাগলো। কনস্টান্টাইন নিজেই ছিলেন তাদের সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষক। তাই তিনি এই কপর্ট ও মতলবী ধার্মিকদের প্রতিহত করার কোন ব্যবস'াই গ্রহণ করেননি। বাস-বতা ছিলো এই যে, কনস্টান্টাইন সারা জীবন কাটিয়েছেন স্বেচ্ছাচার ও পাপাচারের মধ্যে। যদিও ৩৩৭ খৃস্টাব্দে জীবনের সায়া‎হ্নকালে কিছুটা ধর্মমুখী হয়েছিলেন এবং গীর্জার রীতি-নীতি ও বিধি-বিধান অল্প-বিস-র পালন করেছিলেন। যদিও খৃস্টান সমপ্রদায় তখন কনস্টান্টাইনকে ক্ষমতায় আনার মত শক্তির অধিকারী ছিলো, কিন-ু তারা প্রতিমাপূজার মূলোৎপাটন করতে সক্ষম হয়নি, বরং উভয় ধর্মের দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের ফল এই হয়েছিলো যে, বিপরীতমুখী দু’টি বিশ্বাসের মৌলিক উপাদানের মিশ্রণ ঘটেছিলো এবং একটি নতুন ধর্মের উদ্ভব ঘটেছিলো, যেখানে খৃস্টধর্ম ও প্রতিমাপূজার সমান সমান প্রভাব ছিলো। এক্ষেত্রে ইসলাম ছিলো খৃস্টধর্মের ঠিক বিপরীত, কারণ ইসলাম মূর্তিপূজার মূলোৎপাটন করে ছেড়েছিলো এবং বিভিন্ন জাতির মাঝে আপন আকীদা-বিশ্বাসকে অবিকৃত ও নির্ভেজালরূপে প্রচার করতে সক্ষম হয়েছিলো। বস'ত রোমের এই সম্রাট, যিনি ছিলেন আগাগোড়া বস'বাদী ও বাস-ববাদী, যার কাছে ধর্ম- বিশ্বাসের চেয়ে রাজস্বার্থের মূল্য ছিলো অনেক বেশী, তাই তিনি দ্বন্দ্বরত খৃস্টান ও মূর্তিপূজক উভয় পক্ষের স্বার্থের বিচারে উভয় ধর্মের মধ্যে কোনভাবে সমন্বয়সাধন করাকেই উপযুক্ত ও যুক্তিযুক্ত মনে করেছিলেন। এমন কি আপন ধর্মের প্রতি অনুগত খৃস্টানরাও তার পরিকল্পনায় আপত্তির কিছু দেখতে পায়নি। সম্ভবত তাদের বিশ্বাস ছিলো যে, প্রাচীন পৌত্তলিক বিশ্বাসের মিশ্রণ গ্রহণের মাধ্যমে এই নতুন ধর্মটি সমৃদ্ধি ও প্রসার লভা করবে, তারপর চূড়ান- পর্যায়ে খৃস্টধর্ম পৌত্তলিকতার আবিলতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বরূপে ফিরে আসতে সক্ষম হবে। চরম বৈরাগ্যবাদ কিন'প্রতিমাপূজা ও পৌত্তলিকতার পরাগায়নের ফলে খৃস্টধর্ম এমনই বিকৃত হয়ে পড়েছিলো এবং তার নিজস্ব সৌন্দর্য ও আত্মশক্তি এমনই বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিলো যে, অধঃপতনশীল রোমকজাতির মধ্যে এ ধর্ম কোন পরিবর্তনই আনতে পারেনি এবং তাদের মুমূর্ষু জাতিসত্তায় নবপ্রাণের সঞ্চার ঘটাতে সক্ষম হয়নি, যাতে জীবনের অঙ্গনে তারা ধার্মিকতা ও পবিত্রতার কিছুটা ছায়া ও ছোঁয়া লাভ করতে পারে এবং এ জাতির ইতিহাসে একটি সমুদ্ভাসিত অধ্যায়ের উদ্বোধন হতে পারে। তা তো হলোই না, বরং এ ধর্মের জঠরে অভাবিতপূর্ব এমন এক চরম বৈরাগ্যবাদের জন্ম হলো মানবতা ও সভ্যতার জন্য যা মূর্তিপূজারী রোমকদের পাশবিকতার চেয়ে নিকৃষ্ট ছিলো। খৃস্টজগতে এ বৈরাগ্যবাদ এমনই এক সর্বগ্রাসী উন্মাদনার রূপ ধারণ করেছিলো যা কল্পনা করাও এযুগে সম্ভব নয়। এখানে আমরা ‘ইউরোপের নৈতিকতার ইতিহাস’ গ্রন' থেকে কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরছি এবং বলাবাহুল্য যে, তা হচ্ছে ‘অনেক বেশী থেকে অতি অল্প’। সাধু-সন্ন্যাসীদের সংখ্যা অতি- মাত্রায় বেড়ে গেলো এবং সমাজে তাদের প্রভাব ও প্রতাপ সকল সীমা ছাড়িয়ে গেলো। ইতিহাসের পরস্পরবিরোধী বর্ণনা থেখে তাদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা এখন যদিও সম্ভব নয়, তবু নীচের বিবরণ থেকে কিছুটা আন্দায করা যায় যে, সন্ন্যাস আন্দোলন ও তার বিস-ার সমকালীন সমাজে কী ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিলো। ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, সেন্ট জারূমের আমলে স্টার-উৎসবে প্রায় পঞ্চাশ হাজার সাধু-সন্ন্যাসীর সমাবেশ ঘটতো। খৃস্টীয় চতুর্থ শতকে নেতৃস'ানীয় একজন সাধুর অধীনে পাঁচ হাজার সাধু-সন্ন্যাসী ছিলো, আর সাধু সেরাপীনের অধীনে ছিলো দশ হাজার। পক্ষান-রে চতুর্থ শতকের শেষ দিকে অবস'া ছিলো এই যে, সাধু-সন্ন্যাসীদের সংখ্যা মিশরের মোট জনসংখ্যাকেও প্রায় ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। দীর্ঘ দুই শতাব্দী পর্যন- সন্ন্যাস- ব্রতের নামে আত্মপীড়ন ও দেহ- নির্যাতনই ছিলো ধর্ম ও নৈতিকতার সর্বোত্তম আদর্শ। ইতিহাসে এ বিষয়ে বহু অবিশ্বাস্য ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। আলেকাজন্দ্রিয়ার সাধু ম্যাকারিউস নাকি দীর্ঘ ছয়মাস একটি নোংরা জলাভূমিতে বাস করেছেন, যাতে বিষাক্ত মাছি ও কীটপতঙ্গ তার নগ্ন -দেহ দংশন করতে পারে। অধিকন' সারাক্ষণ তিনি এক মন ভারী লৌহদণ্ড বহন করে বেড়াতেন। তার শিষ্য সাধু ইউসিবিউসের লৌহদণ্ডের ওজন ছিলো দুই মন। কথিত আছে, তিনি একাধারে তিন বছর একটি পরিত্যক্ত কূপে বাস করেছেন। বিখ্যাত সাধু যোহন সম্পর্কে বলা হয়, তিন বছর তিনি এক পায়ে দাঁড়িয়ে উপাসনা করেছেন। এ দীর্ঘ সময় না তার ঘুম ছিলো, না বসে একটু বিশ্রাম। চরম ক্লানি-র সময় পাথরের গায়ে শুধু হেলান দিতেন। এটাই ছিলো তার আরাম ও বিশ্রাম। কারো আবার পছন্দ ছিলো বিবস্ত্রতা, লজ্জা ঢাকা হতো মাথার লম্বা চুল দিয়ে, আর চলাফেরা ছিলো চতুষ্পদ জন'র মত হাতে ও পায়ে ভর দিয়ে। সাধু-সন্ন্যাসীরা সাধারণত শহরে ও জনপদে থাকতেন না, বন-জঙ্গলে, গুহা-গহ্বরে হিংস্র জীবজন'র সাথে বাস করতেন। পরিত্যক্ত কুয়া ও কবরস-ানও ছিলো অনেকের ‘বাসস'ান’। ঘাস-পাতা ও বৃক্ষের ছাল-বাকলই ছিলো তাদের জীবন ধারণের অবলম্বন। তদের মতে শরীরিক পরিচ্ছন্নতা ছিলো আত্মার পবিত্রতার জন্য ক্ষতিকর। গোসল বা অঙ্গ ধোয়া ছিলো বড় ধরনের পাপ। ধার্মিকতা ও বৈরাগ্যের যিনি যত উর্ধ্বস-রে উপনীত হতেন তিনি তত বেশী ময়লা-আবর্জনায় মেখে থাকতেন। সাধু এ্যাথিনিউস গর্ব করে বলেন, সাধু এ্যানি'নিউ সারা জীবনে একবারও পা ধোয়ার পাপ করেননি, আর সাধু আব্রাহাম দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর কখনো পায়ে ও হাতে মুখে পানির ছোঁয়া নেননি। সাধু আলেকজ্যান্ডার দুঃখ করে বলেন, একটা সময় ছিলো, যখন মুখ ধোয়াও পাপ ছিলো, আর এখন আমরা গোসল করি হাম্মামে! কোথায় আমাদের ধার্মিকতা ও সন্ন্যাসব্রত! আরেকটি ভয়াবহ পরিসি'তি ছিলো এই যে, সাধু-সন্ন্যাসীরা জনপদে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতো এবং শিশুদের অপহরণ করে সুরক্ষিত মঠে বা মরুভূমিতে নিয়ে যেতো। কখনো বা প্রকাশ্যে মায়ের কোল থেকে সন-ান ছিনিয়ে নেয়া হতো এবং বৈরাগ্যবাদ ও সন্ন্যাসব্রতের তালিম দেয়া হতো। মা-বাবা, এমনকি নগরপ্রশাসনেরও কিছু করার ক্ষমতা ছিলো না। সমাজপতিরাও তাদের সমর্থন যোগাতো। আর যে সব সন-ান মা-বাবাকে ত্যাগ করে বৈরাগ্য ও সাধুব্রত গ্রহণ করতো সাধারণ মানুষ তাদের সাধুবাদ জানাতো এবং তাদের নামে শ্লোগান দিতো। খৃস্টসমপ্রদায়ের ইতিহাসে বহু সাধু-সন্ন্যাসী ‘অপহরণ-খ্যাতি’ অর্জন করেছিলেন। কথিত আছে, মায়েরা সাধু এ্যামব্রোজকে দেখা- মাত্র ছেলে নিয়ে দৌড় দিতো এবং ঘরে গিয়ে দুয়ারে খিল দিতো। সন-ানের উপর পিতা ও পরিবার- প্রধানের যে অধিকার, তা সাধু- পাদ্রীদের হাতে চলে গিয়েছিলো। কোন সাধু-পাদ্রী কোন পরিবারের সন-ান দাবী করে বসলে কারো তাতে বাধা দেয়ার ক্ষমতা ছিলো না। চরিত্র ও নৈতিকতার উপর বৈরাগ্য -বাদের প্রভাব এই পড়েছিলো যে, বীরত্ব ও পৌরুষের যাবতীয় গুণ ও বৈশিষ্ট্য এখন দোষণীয় ও নিন্দনীয় বলে গণ্য হতে লাগলো। সাধু-সন্ন্যাসীদের চরিত্রে নির্দোষ আনন্দ-বিনোদন, মহত্ত্ব ও উদারতা এবং আভিজাত্য ও সাহসিকতার নামগন্ধও ছিলো না। সজীবতা ও প্রাণচাঞ্চল্যের পরিবর্তে ছিলো নির্জীবতা ও স'বিরতা এবং সহানুভূতি ও সহমর্মিতার পরিবর্তে ছিলো নির্দয়তা ও নির্লিপ্ততা। ফলে পারিবারিক ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে পড়েছিলো। পরিবার ও নিকটাত্মীয়দের প্রতি নির্দয়তা ও নিষ্ঠুরতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলো। সাধু-সন্ন্যাসীরা, ধর্মচিন-ায় যাদের হৃদয় হতো কোমল এবং চোখ হতো অশ্রুসিক্ত, পিতা-মাতা ও সন-ানের প্রতি তাদেরই হৃদয় হতো দয়াশূন্য এবং চোখ হতো অশ্রুশূন্য। পরিবারের বড়দের প্রতি সম্মান ও সম্ভ্রম সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গিয়েছিলো। পারিবারিক দায়দায়িত্ব মানুষ একেবারে ভুলে গিয়েছিলো। মা-বাবা ও স্ত্রী-সন-ানের প্রতি উপেক্ষা ও নির্দয়তার ঘটনা তখন এত বেশী ঘটেছিলো যে, তা অনুমান করাও এখন সম্ভব নয়। পরকালের চিন-ায় যাদের চোখ থেকে অশ্রু ঝরতো তারা নির্দ্বিধায় মা-বাবার মনে এবং স্ত্রী-সন-ানদের মনে কষ্ট দিতো। একবারও ভেবে দেখতো না যে, তাদের অনুপসি'তিতে পরিবারের কী দুর্দশা হতে পারে। পরকালে মুক্তির আশায় তারা তো আত্ম-পীড়নের নিষ্ঠুর সাধনায় মগ্ন হতো, এদিকে তাদের পোষ্যপরিজন প্রাণধারণের জন্য দুয়ারে দুয়ারে দয়া ভিক্ষা করতো। তাদের একমাত্র চিন-া ছিলো, নিজেদের পরকালের মুক্তি। এ বিষয়ে কোন ভ্রূক্ষেপ ছিলো না যে, ফেলে আসা পরিবারে তাদের মা-বাবা ও স্ত্রী-সন-ান বাঁচবে কী মরবে! এ প্রসঙ্গে লেকী এমন কিছু ঘটনা লিখেছেন যা পড়তে গিয়ে কান্না সম্বরণ করা সত্যি কঠিন। নারীদের ছায়া থেকেও তারা দূরে থাকতো। তাদের ধারণা ছিলো, কোনভাবে কোন নারীর ছায়াও যদি তাদের পড়ে যায়, তাহলে এত দিনের আত্মপীড়েনর নিষ্ঠুর সাধনা মাটি হয়ে যাবে। এমনকি কন্য-জায়া ও জননীর সঙ্গে কথা বলাও ছিলো আত্মিক কলুষতার কারণ। এ প্রসঙ্গেও লেকী এমন অকল্পনীয় সব ঘটনা লিখেছেন যা পড়ে কখনো হাসি আসে, কখনো আসে কান্না। ভোগবাদের বিরুদ্ধে বৈরাগ্যবাদের ব্যর্থতা কেউ যেন মনে না করে যে, নিষ্ঠুর আত্মপীড়নের এ চরম বৈরাগ্যবাদ ও সন্ন্যাস-আন্দোলন রোমকদের লাগামহীন ভোগবাদ ও বস'বাদি- তাকে কিছুমাত্র নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিলো এবং তাদের সর্বগ্রাসী পাশবিকতা ও জৈবিকতার মুখে সামান্য বাঁধ দিতে পেরেছিলো। না, মোটেও তা পারেনি এবং তা পারা যায় না। কারণ তা মানব- স্বভাবের সম্পূর্ণ পরিপন'ী এবং ধর্ম ও সমাজ-সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাসও তা প্রত্যখ্যান করে। বস'ত যে জিনিসটি সর্বগ্রাসী ভোগবাদ ও বস'বাদ এবং পাশবিকতা ও জৈবিকতাকে নিয়ন্ত্রণে এনে মানবজাতিকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবন উপহার দিতে পারে তা হলো এমন এক নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় ব্যবস'া যা সুস' মানব- স্বভাবের সঙ্গে পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ, যা মানুষের স্বভাব ও ফিতরতকে আমূল পরিবর্তনের চেষ্টা করে না, বরং সঠিক খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে, যা ‘ইযালা’ করে না, ‘ইমালা’ করে, অর্থাৎ মিটিয়ে ফেলে না, ঘুরিয়ে দেয় (অকল্যাণ থেকে কল্যাণের অভিমুখে)। ইসলাম এটাই করেছে এবং এটাই ছিলো ইসলামের নবী হযরত মুহম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তারীকা ও সুন্নাহ। আরবরা ছিলো স্বভাব- সাহসী ও যুদ্ধপ্রিয় জাতি। তো তিনি তাদের এই স্বভাবসাহস ও শৌর্যবীর্যকে মিটিয়ে ফেলেননি, বরং সর্বনাশা গোত্রীয় সঙ্ঘাত ও প্রতিশোধ-প্রতিহিংসা থেকে জাযবায়ে জিহাদের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের অন-রে তিনি আল্লাহর দ্বীনকে বুলন্দ করার, আল্লাহর পথে জিহাদ করার এবং বিজয়ের গৌরব, কিংবা শাহাদাতের মর্যাদা লাভের দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করে দিয়েছিলেন। তদ্রূপ বদান্যতা ও মহানুভবতা ছিলো আরবদের স্বভাব, কিন' তা ব্যয় হতো গর্ব ও গৌরব এবং যশ ও খ্যাতি অর্জনের পিছনে। তিনি তাদের এই স্বভাববদান্যতা ও মহানুভবতাকে শুধু আল্লাহর সন'ষ্টির জন্য আল্লাহর পথে ব্যয় করার আকুতিতে রূপান-রিত করেন। মোটকথা জাহেলিয়াতের যুগে তাদের যা কিছু নৈতিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিলো, ইসলামের স্বচ্ছ সুন্দর জীবন- ব্যবস'ার পরিমণ্ডলে তিনি তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন এবং সেগুলোকে উপকারী ও কল্যাণকর বানিয়েছেন। জাহিলিয়াতের পরিবর্তে তাদের তিনি ইসলামের পূর্ণাঙ্গ একটি নেযাম ও ব্যবস'া দান করেছেন এবং স্বভাব ও চরিত্রের অভিপ্রকাশের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিকল্প এবং সর্বোত্তম বিকল্প দান করেছেন। তাদের সামনে তিনি বড় বড় দায়দায়িত্ব ও কর্মযজ্ঞ যেমন রেখেছেন তেমনি নির্দোষ আনন্দ-বিনোদনের মাধ্যমে দেহমনের সজীবতা লাভের ব্যবস'াও দিয়েছেন। কেননা মানুষের স্বভাব ও প্রকৃতি- যেমন ইসলামী উম্মাহর বরেণ্য আলিম ইমাম ইবনে তায়মিয়া বলেছেন- উপযুক্ত বিকল্প ছাড়া কোন কিছু ত্যাগ করতে প্রস'ত নয়। কোন কিছু ত্যাগ করতে তখনই সে প্রস'ত হবে যখন উত্তম কোন পরিবর্ত তাকে দান করা হবে। মানুষ কিছু না কিছু করার স্বভাব নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে। কর্ম ও কর্মব্যস-তাই হলো তার স্বভাবের দাবী, নিষ্কর্মতা ও নির্জীবতা তার স্বভাবের বিরোধী। আম্বিয়া আলাইহিমুস-সালামও প্রেরিত হয়েছেন স্বভাব ও ফিতরতের পরিবর্তন ঘটানোর জন্য নয়, বরং স্বভাব ও ফিতরতকে পূর্ণতা দান করার জন্য। হাদীছ ও সীরাতের কিতাবে এর উদাহরণ পাওয়া যাবে। মদীনায় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুভাগমনের সময় তাদের আনন্দ-বিনোদনের দু’টি উৎসবদিবস ছিলো। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এ কিসের দিন? তারা বললো, জাহিলিয়াতের যুগে আমরা এ দিন দু’টিতে আনন্দ-বিনোদন করতাম। তিনি বললেন, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে এর বিনিময়ে আরো উত্তম দু’টি দিন দান করেছেন, ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ঈদের দিন আবু বকর (আমার ঘরে) দাখেল হলেন। তখন আমার কাছে দুই আনছারী তরুণী ছিলো এবং তারা সেই গীত গাচ্ছিলো যা বুগাছ যুদ্ধের দিন আনছাররা গেয়ে ছিলো। আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, তারা তেমন কোন গায়িকা ছিলো না। আবুবকর গান শুনে বললেন, আল্লাহর রাসূলের ঘরে শয়তানের গীত!? তখন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে আবুবকর, প্রত্যেক সমপ্রদায়ের জন্য উৎসবের দিন রয়েছে, আর এটা হলো আমাদের উৎসবের দিন। অন্য বর্ণনায় আছে, তিনি বললেন, হে আবুবকর, তাদেরকে তাদের অবস'ার উপর ছেড়ে দাও; কারণ আজ ঈদের (উৎসবের) দিন। পক্ষান-রে রোমান খৃস্টধর্ম স্বভাব ও ফিতরতের বিলুপ্তির ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছিলো এবং আগাগোড়া এমন একটি স্বভাববিরোধী ব্যবস'া প্রবর্তন করতে চেয়েছিলো, বাস-বে যা কিছুতেই সম্ভব নয়। মানুষের উপর খৃস্টধর্ম এমন একটি গুরুভার চাপিয়ে দিয়েছিলো যা বহন করার শক্তি মানুষের ছিলো না। রোমকদের চরম বস'বাদিতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে মানুষ প্রথমে এর প্রতি কিঞ্চিৎ আকৃষ্ট হয়েছিলো এবং ইচ্ছায়, অনিচ্ছায় তা মেনে নিয়েছিলো, কিন' খুব দ্রুতই মোহমুক্তি ঘটেছিলো এবং বিদ্রোহ দিয়েছিলো। মানুষের, অন্যায়ভাবে অবদমিত স্বভাব ও প্রকৃতি রুখে দাঁড়িয়ে চরম প্রতিশোধ গ্রহণ করেছিলো। স্বভাব ও ফিতরতের দাবী ও চাহিদা অস্বীকার করে খৃস্টধর্মের প্রবর্তিত এই অতিবৈরাগ্যবাদ মানুষের দৃষ্টি ও দৃষ্টিভঙ্গি এবং চরিত্র ও নৈতিকতায় কোন পরিবর্তনই আনতে পারেনি এবং পারেনি মানবসভ্যতাকে ধ্বংসের গহ্বরে পতন থেকে রক্ষা করতে। ফলে সকল খৃস্টানজনপদে ভোগবাদ ও বৈরাগ্যবাদের বিপরীতমুখী দু’টি আন্দোলন পাশাপাশি অবস'ান করছিলো, বরং সঠিকভাবে বলতে গেলে, বৈরাগ্যবাদ পড়ে ছিলো মরুভূমিতে ও নির্জন উপাসনাগৃহে, শহর-নগরের গতিময় জীবনের উপর যার কোন প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ ছিলো না। পক্ষান-রে নগর- জনপদে ছিলো লাগামহীন ভোগবাদেরই অপ্রতিহত প্রভাব। সে যুগে খৃস্টজগত ভোগবাদ ও বৈরাগ্যবাদের মাঝখানে কেমন খাবি খাচ্ছিলো এবং তার নৈতিক অধঃপতন কী মর্মানি-ক পর্যায়ে উপনীত হয়েছিলো তার একটি বাস-ব চিত্র ঐতিহাসিক লেকী এভাবে এঁকেছেন- মানুষের চরিত্রে ও সমাজজীবনে অবক্ষয় ছিলো চরমে। চারদিকে ছিলো ভোগবিলাস, জৈবিকতা ও পাপাচারের জোয়ার। রাজসভায় এবং অভিজাত শ্রেণীর জলসায় ছিলো চাটুকারিতা ও তোষামোদের নগ্ন প্রতিযোগিতা, আর ছিলো সাজ-অলঙ্কার ও বেশভূষার বাড়াবাড়ি প্রদর্শনী। অন্যদিকে কিছু লোক লোকালয় ছেড়ে নির্জনে ডুবে ছিলো বৈরাগ্যবাদের আত্মপীড়নের নিষ্ঠুর সাধনায়। এভাবে জীবন ও সমাজ একই সময়ে চরম বৈরাগ্যবাদ ও চরম ভোগবাদের দোলায় দোল খেয়ে চলেছিলো। আশ্চর্যের বিষয় তো ছিলো এই যে, যেসব জনপদে সাধু-সন্ন্যাসীর আবির্ভাব বেশী ঘটেছিলো সেখানেই অনাচার ও পাপাচারের বাজার ছিলো বেশী গরম। মানুষের জীবনে তখন পাপাচার ও কুসংস্কার একাকার হয়ে গিয়েছিলো, আর পাপাচার ও কুসংস্কারই হলো মানুষের মহত্ত্ব ও আভিজাত্যের বড় শত্রু। সাধারণ বিবেক ও চেতনা এতটাই নির্জীব হয়ে পড়েছিলো যে, লোকলজ্জা ও নিন্দা-কলঙ্কের কোন ভয় আর অবশিষ্ট ছিলো না। ধর্মভীতি হয়ত বিবেককে কিছুটা নাড়া দিতে পারতো, কিন' তাও চাপা পড়ে ছিলো এই বিশ্বাসের নীচে যে, প্রার্থনা মুছে ফেলে পাপের সকল কালিমা। প্রতারণা ও মিথ্যাচারের বাজার এমনই গরম ছিলো যে, সিজারদের আমলেও তা ছিলো না। অবশ্য যুলুম-নির্যাতন ও নগ্নতা-বেহায়াপনা ছিলো সে যুগের চেয়ে কম, তবে মুক্তবুদ্ধি ও চিন-ার স্বাধীনতা এবং জাতীয় চেতনা ও উদ্দীপনার ক্ষেত্রেও ছিলো অবক্ষয়। গীর্জায় ধর্মনেতাদের ভোগবাদ খৃস্টধর্ম বৈরাগ্যবাদের যে নেতিকবাচক ব্যবস'া প্রবর্তন করেছিলো তা মানবস্বভাবের সঙ্গে সঙ্ঘর্ষপূর্ণ অবশ্যই ছিলো, তবে নতুন ধর্মের নিজস্ব প্রভাব ও আধ্যাত্মিক শক্তির কারণে এবং তার সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য কার্যকারণের আনুকূল্যে কিছু কালের জন্য তা ফিতরত ও প্রকৃতিকে দাবিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলো। কিন' অল্প সময়ের মধ্যেই মানুষের স্বভাব ও প্রকৃতি এর বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিলো এবং সেটাই ছিলো স্বাভাবিক। কারণ যা স্বভাববিরোধী তার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। এমনকি একসময় দেখা গেলো, ধর্মের প্রাণকন্দ্র খোদ গীর্জায়ও সেই বস'পূজা ও ভোগবাদের অনুপ্রবেশ শুরু হয়েছে, যার বিরুদ্ধে ছিলো বৈরাগ্যবাদের আন্দোলন। হতে হতে গীর্জাই একসময় জাগতিক কেন্দ্রগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ালো। শুধু তাই নয়, অনাচার, পাপাচার ও নৈতিক অবক্ষয়ের ক্ষেত্রে ভোগবাদের প্রবক্তাদেরও তারা ছাড়িয়ে গেলো, যার কারণে সরকার একসময় ধর্মীয় ভোজসভার প্রচলিত রীতি নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হলো। অথচ সেগুলোর উদ্দেশ্য ছিলো খৃস্ট- সমপ্রদায়ের মধ্যে প্রীতি ও সমপ্রীতির জোরদার করা। একই ভাবে শহীদান ও ধর্মীয়পুরুষদের স্মৃতিসভা ও মৃত্যুবার্ষিকীর উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হলো। কেননা সেগুলোই তখন হয়ে উঠেছিলো ধর্মের নামে অনাচার ও পাপাচারের আখড়া। বড় বড় পাদ্রীদের বিরুদ্ধেও বড় বড় নৈতিক অপরাধের অভিযোগ উঠতে শুরু করেছিলো। সাধু জ্যারূম বলেন- গীর্জার পাদ্রীদের ভোগবিলাস ও প্রবৃত্তিপরায়ণতার তুলনায় অভিজাত, বিত্তশালী ও রাজপুরুষদের স্বেচ্ছাচার ও ভোগবাদিতাও ছিলো নস্যি। স্বয়ং ধর্মপ্রধান পোপ মারাত্মক নৈতিক স্খলনের শিকার হয়ে পড়েছিলেন। অর্থলোভ ও সম্পদলিপ্সা এমনভাবে পেয়ে বসেছিলো যে, ধর্মীয় পদ ও পদমর্যাদাকে তারা সাধারণ পণ্যের মত নিলামে তুলেছিলেন। স্বর্গের টিকেট ও ক্ষমার সার্টিফিকেট বিক্রি করে দেদার পয়মা কামানো হতো। আইনভঙ্গ করার অনুমোদনপত্র এবং হালাল-হারামের সনদ জারি করা হতো যেমন কাগুজে মুদ্রা বা ডাকটিকেট জারি করা হয়। ঘুষ ও সুদের কারবার ছিলো যাকে বলে ‘ওপেন সিক্রেট’। অপচয় ও অপব্যয় ছিলো এমন যে, পোপ সপ্তম ইনোসেন্ট তার পোপীয় মুকুট পর্যন- বন্ধক রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। আর পোপ দশম লিউ সম্পর্কে কথিত আছে, তিনি পূর্ববর্তী পোপের রেখে যাওয়া সমস- সম্পদ এবং নিজের অংশের সম্পদ শেষ করে ফেলেছিলেন। এখানেই শেষ নয়, বরং ভাবি পোপের আয়ও আগাম উশুল করে তাও উড়িয়েছিলেন। এভাবে তিন পোপের সম্পদ লেগেছিলো তার একার ভোগে। এক পরিসংখ্যানমতে, সমগ্র ফ্রান্সের আমদানিও পোপ সাহেবের ভোগচাহিদা চরিতার্থ করার জন্য যথেষ্ট হতো না। মোটকথা, গীর্জার ইতিহাস এবং গীর্জাপতিদের জীবনাচার ছিলো কোরআনের নিন্মোক্ত আয়াতের বাস-ব ব্যাখ্যা- ‘হে ঈমানদারগণ, ইহুদী ও ঈসায়ীদের বহু ধর্মনেতা ও সাধু অন্যায়ভাবে লোকের সম্পদ আত্মসাৎ করে, আর আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে ফিরিয়ে রাখে।’ গীর্জা ও রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব একাদশ শতাব্দীতে গীর্জা ও রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে তা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। প্রথম দিকে অবশ্য গীর্জারই জয়জয়কার ছিলো। পোপের তাপ ও প্রতাপ তখন এমনই একচ্ছত্র ছিলো যে, ১০৭৭ খৃস্টাব্দে পোপ হিল্ডার ব্রান্ড সম্রাট চতুর্থ হেনরীর উদ্দেশ্যে তলব জারি করেন, যেন তিনি ক্যানোসা দুর্গে তার বরাবরে হাজিরা দেন। উপায়ান-রহীন সম্রাটও তলব কবুল করে অবনত মস-কে ও নগ্নপদে পোপের দরবারে হাজির হন, আর তিনি সম্রাটকে দর্শন দিতে অস্বীকার করেন। পরে বিশিষ্টজনের সুপারিশে পোপ তাকে দেখা দেন। ‘অনুতপ্ত’ সম্রাট পোপের হাতে তওবা করেন, আর তিনি কৃপাবশত সম্রাটের অপরাধ ক্ষমা করেন। সময়ের সঙ্গে এ দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের তীব্রতা বাড়তেই থাকে। তবে জয়-পরাজয়ের পাল্লা ছিলো দু’দিকেই। কখনো গীর্জার দিকে, কখনো রাষ্ট্রের দিকে। বিজয়ের হাসি কখনো হাসতেন পোপ, কখনো সম্রাট। শেষ পর্যন- গীর্জার প্রভাব ও প্রতাপ দুর্বল হয়ে আসে এবং ধর্ম ও গীর্জার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ও সম্রাট চূড়ান- বিজয় অর্জন করেন। দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের এ দীর্ঘ সময় জনসাধারণ যুগপৎ ধর্ম ও রাজনীতির নিপীড়ন এবং গীর্জা ও রাষ্ট্রের দ্বৈত দাসত্বের শিকার ছিলো। ধর্মীয় ক্ষমতার অপব্যহার ও ইউরোপীয় সভ্যতার দুর্ভাগ্য গীর্জার অধিপতি হিসাবে পোপ মধ্যযুগে এমন সীমাহীন ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির অধিকারী ছিলেন যা স্বয়ং রোমসম্রাটেরও ছিলো না। এ কারণে তাদের পক্ষে সহজেই সম্ভব ছিলো ধর্মের ছায়াতলে ইউরোপকে জ্ঞান ও সভ্যতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তারা যদি ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করতেন তাহলে ইউরোপ জাগতিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে সত্যি সত্যি বিরাট উন্নতি ও অগ্রগতি অর্জন করতে পারতো। ড্রেপার লিখেছেন- রোমের পোপগণ বিষয়াসক্তি ও প্রবৃত্তিপরায়ণতার শিকার না হলে তাদের এতটা শক্তি-সামর্থ্য ছিলো যে, তাদের এক ইশারায় ইউরোপ একযোগে এমন উন্নতি ও অগ্রগতি লাভ করতো যে, পৃথিবী অবাক হয়ে যেতো। তাদের প্রতিনিধিগণ অবাধে ইউরোপের সব দেশে যাতায়াত করতে পারতেন এবং যেখানেই যেতেন সাদর সম্বর্ধনা লাভ করতেন। একদিকে আয়ারল্যান্ড থেকে বোহিমিয়া পর্যন-, অন্যদিকে ইটালি থেকে স্কটল্যান্ড পর্যন- যে কোন অঞ্চলের যে কোন সমপ্রদায়ের সঙ্গে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মতবিনিময় করতে পারতেন। এবং আন-র্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয়ে হস-ক্ষেপ করতে পারতেন। কারণ তাদের ভাববিনিময়ের ভাষা ছিলো অভিন্ন। প্রত্যেক দেশেই তারা এমন বিচক্ষণ ও চৌকশ মিত্র ও সহযোগী পেয়েছিলো যারা একই ভাষায় কথা বলতো এবং রাষ্ট্রিয় বিষয়ে যে কোন সহযোগিতা প্রদানে প্রস'ত ছিলো। কিন' খৃস্টধর্মের দুর্ভাগ্য এবং যে সকল জনগোষ্ঠী খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলো তাদেরও দুর্ভাগ্য যে, গীর্জার অধিপতি ও ধর্মনেতাগণ তাদের বিপুল ক্ষমতার অন্যায় ব্যবহার করেছেন। জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় চেতনার অনুকূলে ব্যবহার না করে তারা তা ব্যক্তিস্বার্থে কাজে লাগিয়েছেন। ফলে ইউরোপ যেমন ছিলো তেমনি মূর্খতা ও কুসংস্কার এবং পাপাচার, অনাচার ও প্রবৃত্তিপূজার আবর্তেই ডুবে থাকলো এবং উন্নতি ও অগ্রগতির পরিবর্তে নগর-সভ্যতা ধীরে ধীরে অধঃপতনেরই শিকার হতে থাকলো। দীর্ঘ একহাজার বছরেও মহাদেশ ইউরোপ এবং পাঁচশ বছরেও ইংল্যান্ডের জনবসতি দ্বিগুণ হতে পারেনি। কোন সন্দেহ নেই যে, এর পিছনে সবচে’ বড় ভূমিকা ছিলো পাদ্রী ও সাধু-সন্ন্যাসীদের। কারণ তারা অব্যাহতভাবে অবিবাহিত জীবনের মাহাত্ম প্রচার করে চলেছিলেন। তদুপরি গীর্জা এ বিষয়ে খুবই তৎপর ছিলো যে, কোন অবস'াতেই মানুষ যেন চিকিৎসকের চিকিৎসা নিতে উৎসাহ বোধ না করে। কারণ ঝাড়ফুঁকের মাধ্যমে গীর্জার লোকদের যে রোযগার হতো তাতে ভাটা পড়তে পারে এবং আধুনিক চিকিৎসাব্যবস'া ও চিকিৎসকসমাজ গীর্জার অর্থিক স্বার্থের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ফল এই হলো যে, ইউরোপজুড়ে ব্যাপক রোগ-ব্যাধি ও ভয়াবহ মহামারি দেখা দিতো এবং মানুষ বিনা চিকিৎসায় বা অপচিকিৎসায় মারা যেতো। বরং বলা যায়, কখনো কখনো যেন মৃত্যুর ধুম লেগে যেতো। এনিয়াস সিলভিয়াস চৌদ্দশ ত্রিশ খৃস্টাব্দে তার বৃটেন সফরের যে বিবরণ লিখেছেন তা থেকে সেখানকার নাগরিক অবক্ষয় এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যপীড়িত জীবন সম্পর্কে কিছু্‌টা অনুমান করা যায়। ধর্মগ্রনে'র বিকৃতি ও পরিণাম এ সময় গীর্জার কর্ণধাররা চরম মূর্খতার পরিচয় দিয়ে এমন এক ভয়ঙ্কর অপরাধ করলেন, যার কারণে তারা যে ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন তার ভিত্তিমূলে যেমন আঘাত লাগলো, তেমনি তাদের নিজেদের অসি-ত্বও বিপন্ন হয়ে পড়লো। সেই অপরাধ এই যে, উপসি'ত প্রয়োজন ও সাময়িক স্বার্থের তাড়নায় তারা পবিত্র ধর্মগ্রনে' হস-ক্ষেপ করলেন এবং তাতে বিভিন্ন ঐতিহাসিক, ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক তথ্য ও তত্ত্বের অনুপ্রবেশ ঘটালেন যা ঐ সময়ের জ্ঞান-গবেষণার বিচারে স্বীকৃত ছিলো। কারণ মানুষের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা তখন ঐ সীমা পর্যন-ই উপনীত হয়েছিলো এবং সেটাকেই চূড়ান- সত্য বলে ধরে নিয়েছিলো। কিন' প্রকৃতপক্ষে সেটা মানবজ্ঞানের শেষ সীমা ছিলো না। কারণ মানুষের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার মূল কথাই হচ্ছে পরিবর্তনশীলতা ও ক্রমোন্নতি। মানুষের জ্ঞান হচ্ছে সদা উদ্যমী ও আগুয়ান এক অভিযাত্রী, যে কখনো কোন স'ানে হয়ত থামে, কিন' কখনো থেমে থাকে না। সুতরাং মানবজ্ঞানের অসি'তিশীল ভিত্তির উপর কখনো স'ায়ী কোন ইমারত তৈয়ার করা যায় না। এমন কিছু করলে ভিত্তির তল থেকে বালু সরে যায় এবং পুরো ইমারত ধ্বসে পড়ে। গীর্জার কর্ণধাররা নির্বোধের মত সেই মারাত্মক ভুলটিই করে বসেছিলেন। তারা যা করেছেন হয়ত খোশনিয়তেই করেছেন এবং ভেবেছেন যে, এভাবে আসমানী কিতাব ও ধর্মগ্রনে'র মাহাত্ম ও অলৌকিকত্ব আরো সুপ্রতিষ্ঠিত হবে এবং তার জনপ্রিয়তা আরো সমৃদ্ধ হবে। কিন' পরবর্তীকালে দেখা গেলো, এ নির্বুদ্ধিতাই তাদের জন্য মহাবিপর্যয় ডেকে এনেছে এবং এটাই ছিলো ঈমান ও বিজ্ঞান এবং ধর্ম ও যুক্তির সঙ্ঘাতের মূল কারণ, যেখানে ধর্ম, (যাতে ছিলো মানবজ্ঞানের মিশ্রণ) বারবার পরাস- হয়েছে এবং শেষ পর্যন- চূড়ান-রূপে পরাভূত হয়েছে, যার পর ইউরোপের মাটিতে গীর্জা ও ধর্ম আর কখনো মাথা তুলে এবং কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। তার চেয়ে মর্মানি-ক বিষয় এই যে, অপরাধ করলো গীর্জা, কিংবা খুব বেশী হলে খৃস্টধর্ম, কিন' এর প্রতিক্রিয়ায় ইউরোপ ধর্ম নামে যা কিছু আছে সবকিছুরই প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়ে পড়লো এবং এভাবে একটি ধর্মহীন ও ধর্মবিদ্বেষী ইউরোপ আত্মপ্রকাশ করলো। ধর্মনেতারা আসমানি কিতাবে শুধু হস-ক্ষেপ করেই ক্ষান- হলো না, বরং যে সকল ঐতিহাসিক, ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক তথ্য ও তত্ত্ব লোকমুখে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলো এবং তাওরাত ও ইঞ্জিলের প্রাচীন ভাষ্যকারদের আলোচনায় এসেছিলো সেগুলোকে তারা মূল ধর্মগ্রনে' সংযোজন করে অলঙ্ঘনীয় ধর্মীয় পবিত্রতা দান করলেন। ফলে তা খৃস্টধর্মের প্রত্যেক অনুসারীর মৌল ধর্মবিশ্বাসসের অপরিহার্য অংশে পরিণত হলো এ সকল ভৌগলিক তথ্য, যার সপক্ষে আসমানি কোন সনদ ছিলো না, খৃস্টীয় ভৌগলিক সত্য বা ঈযৎরংঃরধহ ঃড়ঢ়ড়মৎধঢ়যু নামে অভিহিত হলো। এবং তাতে শুধু সন্দেহ প্রকাশ করার অর্থ ছিলো ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। ধর্ম ও বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব এবং গীর্জার নিষ্ঠুরতা গীর্জা এ মহানির্বুদ্ধিতা এমন এক সময় করেছিলো যখন ইসলাম ও মুসলিম বিজ্ঞানীদের প্রভাবে ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধির আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটেছিলো। ইউরোপের চিন-া- নায়ক ও বিজ্ঞানীগণ প্রথমেই ধর্মের অন্ধ আনুগত্য এবং গীর্জার বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্বের শিকল ছিন্ন করে ফেললেন; তারপর তারা ইতিহাস, ভূগোল ও বিজ্ঞানের তথাকথিত ধর্মগ্রন'ীয় তথ্য ও তত্ত্বগুলো বিনা প্রমাণে ‘ঈমান বিলাগায়ব’ বলে মেনে নেয়ার দাবী প্রত্যাখ্যান করলেন এবং যুক্তি-প্রমাণের আলোকে সুস্পষ্ট ও জোরালো ভাষায় সেগুলোর সমালোচনা করলেন। সেই সঙ্গে তারা তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা দ্বারা অর্জিত তথ্য ও তত্ত্ব প্রকাশ করতে শুরু করলেন, যা ছিলো ‘গীর্জার সত্যের’ সঙ্গে সঙ্ঘর্ষপূর্ণ। আর তাতেই যেন গীর্জার কেয়ামত কায়েম হয়ে গেলো। ধর্মনেতারা- ইউরোপে তখন যারা ছিলেন ক্ষমতার মূল নিয়ন-া- বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের ধর্মদ্রোহী আখ্যা দিলেন এবং খৃস্টধর্মের নামে তাদের হত্যা করার এবং সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার বৈধতা ঘোষণা করলেন। গীর্জার পক্ষ হতে ঈড়ঁৎঃ ড়ভ ওহয়ঁরংরঃরড়হ বা তদন- আদালত গঠন করা হলো, পোপের ভাষায় যাদের দায়িত্ব ছিলো, ‘ঐসব অবিশ্বাসী ও ধর্ম- দ্রোহীদের ধরে এনে শাসি- দেয়া যারা ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন শহরে ও জনপদে এবং লুকিয়ে আছে বাড়ীঘরে ও গুহায়-গহ্বরে।’ বলাবাহুল্য যে, আদালত ও তার পেয়াদারা রাত-দিন এক করে, আরাম-ঘুম হারাম করে খুব উৎসাহের সাথেই তাদের দায়িত্ব পালন করেছিলো। ইউরোপের সর্বত্র গুপ্তচর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো, যারা ঘরের গোপন কুঠুরি থেকে এবং পাহাড়ের গুহা থেকে ‘গীর্জার গোনাগার'দের ধরে আনতো। অবস'া এমনই ভয়াবহ ছিলো যে, মনের চিন-া এবং নাকের শ্বাস-প্রশ্বাসেরও যেন হিসাব নেয়া হতো। গীর্জা ও তার আদালত দস'রমত কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছিলো, যাতে এমন কেউ পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে না পারে যার মসি-ষ্ক গীর্জার বিরুদ্ধে চিন-া করে এবং যার হৃদয় গীর্জার বিরুদ্ধে স্পন্দিত হয়। জনৈক খৃস্টান পণ্ডিতের ভাষায়, ‘এটা একেবারেই অসম্ভব ছিলো যে, কোন মানুষ খৃস্টান হবে, আর সে তার বিছানায় স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করবে।’ অনুমান করা হয় যে, গীর্জার তদন- আদালতেতগু যাদের সাজা হয়েছিলো তাদের সংখ্যা তিন লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। আর আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিলো বত্রিশ হাজার। বিশ্বাস করুন, তাদের সংখ্যা ছিলো বত্রিশ হাজার এবং তা গীর্জার কাছ থেকেই প্রাপ্ত হিসাব। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া এই হতভাগ্যদের মধ্যে ছিলেন সুপ্রসিদ্ধ বিজ্ঞানী ব্রুনো, গীর্জার চোখে যার সবচে’ বড় অপরাধ, তিনি জগতের একাধিকতায় বিশ্বাস করে বলতেন, ‘পৃথিবীর বাইরেও প্রাণীর বসবাস আছে।’ তদন- আদালত এই সুপারিশসহ তাকে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের হাতে সোপর্দ করে যে, তাকে যেন লঘু শাসি- দেয়া হয় এবং তার শরীরে একফোঁটা রক্তও যেন বাইরে বের না হয়, যার ইঙ্গিতার্থ, তাকে যেন আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকে শুধু এ কারণে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় যে, তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে।’ ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া ধর্মের নামে সঙ্ঘটিত এ চরম নিষ্ঠুরতা গীর্জার শেষরক্ষা করতে পারেনি। কারণ দেয়ালে যখন পিঠ ঠেকে গেলো তখন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলো এবং মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতিশীল চিন-ার প্রবক্তারা রুখে দাঁড়ালেন। সাধারণ মানুষও তাদের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হলো। মুক্তবুদ্ধির অধিকারী প্রগতিশীল লোকদের বিদ্রোহ প্রথমে ছিলো গীর্জার নির্যাতন ও নিপীড়ন এবং ধর্মনেতাদের প্রাচীনবাদিতার বিরুদ্ধে। কিন' শেষ পর্যন- তারা ঐ সকল বিশ্বাস ও সংস্কৃতি, জ্ঞান ও শিক্ষা এবং নীতি ও নৈতিকতার প্রতিও বিদ্বেষী হয়ে ওঠে যার সঙ্গে গীর্জা ও ধর্মনেতাদের যোগসূত্র ছিলো। শুধু তাই নয়, ইউরোপের বুদ্ধিজীবী ও বিদগ্ধ সমাজ প্রথমে তো শুধু খৃস্টধর্মের বিরুদ্ধে, কিন' পরবর্তীতে ধীরে ধীরে ধর্মমাত্রেরই বিরুদ্ধে ঘৃণা ও শত্রুতা পোষণ করতে শুরু করে। ফলে প্রগতিশীলদের যে যুদ্ধ ছিলো খৃস্টান ধর্মনেতা-দের (আরো সঠিকভাবে, সাধু পোল-এর ধর্মমতের) বিরুদ্ধে সেটাই আশ্চর্যজনকভাবে বিজ্ঞান ও ধর্মের যুদ্ধে পরিণত হলো। মুক্তবুদ্ধির প্রবক্তারা চিন-া ও যুক্তি ছাড়াই এ সিদ্ধানে- পৌঁছে গেলেন যে, ধর্মমাত্রই বিজ্ঞানের বিরোধী এবং বুদ্ধি ও ধর্মের অবস'ান দুই বিপরীত প্রানে-। সুতরাং বিজ্ঞান ও ধর্মের সহাবস'ান কিছুতেই সম্ভব নয়। একটির অভিমুখী হলে অন্যটির পিছনমুখী হওয়া অনিবার্য। যুক্তি ও বুদ্ধিতে যে বিশ্বাস করবে, ধর্ম ও ধর্মগ্রনে' তাকে অবিশ্বাস করতেই হবে। যখনই তাদের সামনে ধর্মের (যে কোন ধর্মের) প্রসঙ্গ আসতো, তাদের অন-রে সেই সব পবিত্র ও নির্দোষ রক্তের স্মৃতি ভেসে উঠতো যা ধর্মের নামে প্রবাহিত হয়েছে, ভেসে উঠতো জ্ঞান ও বিজ্ঞানের সাধনায় নিবেদিতপ্রাণ সেই সকল মহাত্মাদের স্মৃতি যারা গীর্জার পাদ্রীদের নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার বলি হয়েছেন। তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠতো জল্লাদরূপী সেই সব নরপশুদের বীভৎস চেহারা যাদের চোখ থেকে ঠিকরে বের হতো শুধু প্রতিহিংসার আগুন, যাদের হৃদয় ছিলো দয়া-মায়া, ক্ষমা ও মমতাশূন্য এবং যাদের মসি-ষ্ক ছিলো বুদ্ধি ও যুক্তি থেকে বঞ্চিত। তাই মানুষরূপী ঐ পশুদের প্রতি তাদের হৃদয়ে জমে উঠেছিলো সারা দুনিয়ার ক্রোধ ও বিদ্বেষ এবং ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা। শুধু তাদের বিরুদ্ধেই নয়, বরং তারা যে ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে তারও বিরুদ্ধে, এমনকি অন্যান্য ধর্মেরও বিরুদ্ধে। এ অন্ধ ধর্মবিদ্বেষই ছিলো তাদের জীবনের মূলমন্ত্র। এমনকি পরবর্তী বংশধরদের জন্যও তারা তা উত্তরাধিকাররূপে রেখে গিয়েছিলো। চিন-ানায়কদের চিন-ার দৈন্য ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী এ সকল বুদ্ধিবাদী ও চিন-ানায়কের প্রতি আমরা এখন শুধু করুণাই করতে পারি যে, তাদের মধ্যে এতটুকু ধৈর্য ও সি'রতা ছিলো না এবং এই পরিমাণ অধ্যয়নমনস্কতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা ছিলো না যাতে তারা ধীর-শান- মসি-ষ্কে গভীর চিন-া-পর্যালোচনার মাধ্যমে ধর্ম ও ধর্মব্যবসায়ীদের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে এবং নির্ধারণ করতে পারে যে, ধর্মের দায়-দায়িত্ব কতটুকু, আর ধর্মনেতাদের মূঢ়তা, মূর্খতা, স্বেচ্ছাচার ও ভ্রান- প্রতিনিধিত্ব কতটা দায়ী। তাহলে ধর্মকে কাঁধের জোয়াল ভেবে ছুঁড়ে ফেলার পরিসি'তি সৃষ্টি হতো না এবং মানবসভ্যতারও এত বড় সর্বনাশ হতো না। কিন' তাই ঘটলো যা ঘটা উচিত ছিলো না। গীর্জার প্রতি তাদের ক্রোধ ও প্রতিহিংসা এতই চরম তাদের এবং অসি'রতা ও ক্ষিপ্রতা এমনই বাঁধভাঙ্গা ছিলো যে, ধর্মের বিষয়ে সুস' চিন-ার কোন সুযোগই তাদের ছিলো না। অবশ্য ইতিহাস বলে, দেশে দেশে যুগে যুগে এটাই ছিলো অধিকাংশ বিপ্লবী ও বিদ্রোহী দলের স্বভাবপ্রবণতা। সুতরাং এক্ষেত্রেও ইতিহাসের সিদ্ধান- এটাই যে, এ অঘটনের জন্য প্রথম দল যদি হয় প্রধান আসামী এবং অবশ্যই তারা তাই, তবে সে জন্য ধর্মকে কাঠগড়ায় এনে ধর্মনেতাদের শাসি- ধর্মের উপর চাপানো এবং জীবন ও সভ্যতার অঙ্গন থেকে ধর্মকে নির্বাসিত করা ছিলো দ্বিতীয় দলের অনেক বড় অবিচার এবং এ অবিচার ছিলো তাদের নিজেদের প্রতি ও গোটা মানবজাতির প্রতি। বস'ত তাদের মধ্যে সত্যের প্রতি এতটা আত্মনিবেদন এবং স্বজাতি ও মানবজাতির প্রতি এই পরিমাণ কল্যণকামনা ছিলো না যাতে তারা ধর্মের প্রয়োজন অনুভব করতে পারে। সর্বোপরি এতটা চিত্তঔদা- র্যও ছিলো না যাতে তারা ইসলাম ধর্মের প্রতি আগ্রহী ও অনুসন্ধিৎসু হতে পারে, যে ধর্মের অনুসারী ছিলো তাদেরই সমসাময়িক জাতিবর্গ, যে ধর্ম খুব সহজেই বিপর্যয়কর এ দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত থেকে তাদের মুক্তি দিতে পারতো। কারণ ইসলামের মূল কথাই হলো কোরআনের ভাষায়- ‘তাদেরকে ন্যায় ও কল্যাণের আদেশ করে এবং অন্যায় ও অকল্যাণ থেকে বাধা দেয় এবং মানুষের জন্য উত্তম ও উৎকৃষ্ট বস'কে হালাল সাব্যস- করে এবং মন্দ ও নিকৃষ্ট বস'কে হারাম সাব্যস- করে এবং অন্যায়- অনাচারের যে বেড়ী ও শেকল মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তা তাদের থেকে নামিয়ে দেয়।’ কিন' জাহিলিয়াতের সমপ্রদায়- প্রীতি এবং ক্রশেডযুদ্ধের অন-হীন উন্মাদনা খৃষ্টীয় পাশ্চাত্য ও ইসলামী প্রাচ্যের মাঝে বিভেদের এমনই এক দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর তৈরী করে দিয়েছিলো যে, শানি-র ধর্ম ইসলামের সুমহান শিক্ষা ও আদর্শের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করারও তাদের সুযোগ হয়নি। তদুপরি একদিকে ছিলো ইসলাম ও ইসলামের নবীর বিরুদ্ধে গীর্জা ও পাদ্রীসমাজের অব্যাহত বিষোদ্গার ও অপপ্রচার, অন্যদিকে ছিলো আখেরাত ও পরকাল এবং মৃত্যু ও মৃত্যুপরবর্তী জীবন সম্পর্কে চরম নিস্পৃহা এবং নতুন ধর্ম সম্পর্কে অতলস্পর্শী জ্ঞান আহরণের কষ্ট স্বীকারে অনীহা। সেই সঙ্গে এটাও বিবেচনায় রাখুন যে, ইউরোপের বুকে ইসলামের প্রচার-প্রসারের বিষয়ে মুসলিম জাতিও চরম অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। অথচ মুসলিম বিশ্বে বিভিন্ন রাষ্ট্রের উত্থান এবং ইউরোপীয় রাষ্ট্রবর্গের সঙ্গে সমতা ও সমসাময়িকতার সম্পর্কের কারণে কাজের খুব অনুকূল সুযোগ ছিলো, কিন' আমরা তা কাজে লাগাইনি। মোটকথা সঙ্গত অসঙ্গত বিভিন্ন কারণে ইউরোপ ইসলামের সঙ্গ ও সান্নিধ্য থেকে এবং ইসলামের সঞ্জিবনী সুধা থেকে বঞ্চিত রয়ে গিয়েছিলো। অথচ তাদের জীবনে তখন ইসলামকে গ্রহণ করার তেমনই প্রয়োজন ছিলো, সর্পবিষে আক্রান- ব্যক্তির যতটা প্রয়োজন হয় প্রতিশেধক গ্রহণ করার। বস'বাদের দিকে ইউরোপ কারণ এটা হোক বা সেটা, যা আশঙ্কা করা হয়েছিলো তা শেষ পর্যন- ঘটেই গেলো এবং জড়বাদ ও বস'বাদ শব্দদু’টি যত ব্যাপক অর্থ ও মর্ম ধারণ করে সেই ব্যাপকতা নিয়েই ইউরোপ জড়বাদ ও বস'বাদের দিকে ধাবিত হলো। বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি, বুদ্ধিবৃত্তি ও মনস-ত্ত্ব, নীতি ও চরিত্র, সমাজ ও সামাজিক বন্ধন, জ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্য, শাসন ও রাজনীতি- এককথায় জীবনের সকল অঙ্গনে জড়বাদ ও বস'বাদের নিরঙ্কুশ প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো। বস'বাদের দিকে ইউরোপের অভিযাত্রা যদিও পর্যায়ক্রমেই হয়েছে এবং প্রথমে তার গতি ছিলো ধীর, তবে তার প্রতিজ্ঞা ছিলো সুদৃঢ় এবং পদক্ষেপ ছিলো সুসংহত। দার্শনিক ও বিজ্ঞানীগণ এই ‘নিশ্চিত ভিত্তি’র উপর সৃষ্টিজগত সম্পর্কে চিন-াভাবনা শুরু করলেন যে, স্রষ্টা ও নিয়ন-া এবং পরিচালক ও ব্যবস'াপক বলে কোন সত্তার অসি-ত্ব নেই। প্রকৃতি ও বস'জগতের ঊর্ধ্বে এমন কোন শক্তি নেই যার পরিচালনা ও ব্যবস'াপনায় সবকিছু চলছে। তারা জগত ও প্রকৃতির যাবতীয় আবর্তন-বিবর্তনের আগাগোড়া যান্ত্রিক ব্যখাা-বিশ্লেষণ উপস'াপন করতে লাগলেন এবং এর নাম দিলেন নিরপেক্ষ ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা। পক্ষান-রে স্রষ্টার অসি-ত্বের প্রতি বিশ্বাসকে স্পর্শ করে এমন যে কোন চিন-া-গবেষণাকে অবজ্ঞাভরে তারা অভিহিত করলো প্রাচীন ও অবৈজ্ঞানিক বলে, যা জ্ঞান ও যুক্তির ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। চিন-া-গবেষণা ও বিচার-পর্যবেক্ষণের যে পথ ও পন'া তারা গ্রহণ করেছিলো তার স্বাভাবিক পরিণতি এই ছিলো যে, গতি ও শক্তি এবং বস' ও পদার্থ ছাড়া অন্য সবকিছুর অসি-ত্ব তারা অস্বীকার করলো, যা ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য ও পরীক্ষাযোগ্য নয় এবং যা মাপ ও পরিমাপ, কিংবা গণনা ও আয়তনের অধীনে আসে না। এর স্বাভাবিক ও যৌক্তিক পরিণতি এই হলো যে, আল্লাহর অসি-ত্ব এবং ঊর্ধ্বজাগতিক সকল সত্য কাল্পনিক বিষয় বলে সাব্যস- হলো, যার পক্ষে জ্ঞান ও যুক্তির কোন সমর্থন নেই। এ সকল দার্শনিক ও বিজ্ঞানী স্বাভাবিক কারণেই দীর্ঘকাল আল্লাহর অসি-ত্ব অস্বীকার এবং ধর্মের প্রতি প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণা করার দুঃসাহস করেনি। তাছাড়া শুরু সবাই অস্বীকারবাদী ছিলোও না, তবে জ্ঞান-গবেষণার ক্ষেত্রে যে চিন-াপদ্ধতি ও অবস'ান তারা গ্রহণ করেছিলো ধর্মের সাথে তার সঙ্গতি রক্ষা করা কিছুতেই সম্ভব ছিলো না, যার ভিত্তিই হলো ঈমান বিলগায়বের উপর এবং অহী ও নবুয়তের উপর; আখেরাত ও পরকালই যার আবর্তনকেন্দ্র। অথচ এগুলোর কোনটিই তো ইন্দ্রিয় শক্তি দ্বারা অনুভবযোগ্য নয় এবং মাপ, পরিমাপ, গণনা ও আয়তন দ্বারা প্রমাণযোগ্য নয়। তাই ধর্মবিশ্বাসের প্রতি তাদের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও সংশয়-সন্দেহ দিন দিন বেড়েই চলেছিলো। (চলবে, ইনশাআল্লাহ)
শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা