সফর ১৪৩১ হি:(১৫)

প্রথম পাতা

সম্পাদকীয়:ভূমিকম্প এবং বিবেকের কম্পন

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 স্মরণকালের ভয়াবহ এক ভূমিকম্প সম্প্রতি আঘাত হেনেছে পৃথিবীর পশ্চিম গোলার্ধে। ক্যারিবিয়ান দ্বীপরাষ্ট্র হাইতির রাজধানী ‘পোর্ট-অ- প্রিন্স’ প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পের আঘাতে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে এবং হাজার হাজার মানুষ ধ্বংসস্তূপের নীচে চাপা পড়েছে। সর্বশেষ খবরে নিহতের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে আড়াই লাখ। ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপকাতয় গোটা বিশ্ব এখন হতবাক। আমরা হাইতির অসহায়-বিপন্ন জনগণের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করছি এবং দুর্গত মানবতার পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিশ্বসম্প্রদায়, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের প্রতি আকুল আবেদন জানাচ্ছি। কেননা মানব-পরিচয়ে মানবতার সাহায্যে এগিয়ে আসাই হচ্ছে ইসলামের মহান শিক্ষা।

ভূমিকম্প এমন এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ যার সামনে মানুষ সম্পূর্ণ অসহায়। যুগে যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বহু ভূমিকম্প হয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে বহু সমৃদ্ধ সভ্যতা ও জনপদ নিশ্চি‎হ্ন হয়ে গেছে; এমনকি নদী ও সাগর-মহাসাগরের গতিপথ পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়েছে। দূর অতীতের কথা বাদ দিলেও নিকট অতীতে রাশিয়ার স্পিটাক শহর নিমিষে ধুলায় মিশে গিয়েছিলো; চীনের সিচুয়ান প্রদেশেও ঘটেছে নযিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞ। ইরান, তুরস্ক, পাকিস্তান ও ভারতে ভূমিকম্পের আঘাতে বারবার জীবনযাত্রা স্তব্ধ হয়েছে।

হাইতির ভূমিকম্প আবার প্রমাণ করে গেলো যে, সত্যি সত্যি আমাদের পায়ের নীচে মাটি নেই। এখানে ‘আমাদের’ মানে বিশেষ কোন দেশ বা জনপদ নয়, বরং গোটা পৃথিবী এবং সমগ্র মানবজাতি। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গর্বে গর্বিত মানুষ এখনো জানে না, ভূমিকম্পের রহস্য কী এবং তা রোধ করারই বা উপায় কী? এমনকি এখনো সে ভূমিকম্পের আগাম হুঁশিয়ারি প্রদানের সামর্থ্যটুকু অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু আফসোস, ভূমিকম্পের কাঁপুনি বা ঝাঁকুনি কোন কিছুতেই আমাদের গাফলতের ঘুম ভাঙ্গে না। যারা দুর্যোগের খবর প্রচারের বাণিজ্য করে তাদের কথা না হয় থাক, আমাদেরও তো গাফলতের অবস্থা এই যে, আমরা খবর পড়ি, খবর শুনি এবং ধ্বংসযজ্ঞের ভয়াবহ দৃশ্য দেখি, অথচ শিক্ষা গ্রহণ করি না। ভূমিকম্প নদী-সাগরের গতি পরিবর্তন করে ফেলে, আমাদের জীবনের গতি পরিবর্তন করতে পারে না, এমনকি পারে না বিবেকের ভূমিতে সামান্য কম্পনও সৃষ্টি করতে। এত কিছুর পরো আমরা যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহর সমীপে সমর্পিত হই না, এটা কি আমাদের দম্ভ, না মূর্খতা! আমরা কেন বুঝি না, এই জনপদও আল্লাহ না করুন, যে কোন সময় হতে পারে প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পের ‘লীলাক্ষেত্র’!

এটা ঠিক যে, সম্ভাব্য যে কোন দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষার জন্য জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার; এক্ষেত্রে অবহেলা বা অসতর্কতা প্রদর্শনের কোন অবকাশ নেই। তবে মুসলিম হিসাবে আমরা বিশ্বাস করি যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের জাগতিক কারণের পিছনে ঊর্ধ্বজাগতিক কারণও রয়েছে। চৌদ্দশ বছর পূর্বে আল্লাহর পেয়ারা হাবীব তাঁর প্রিয় উম্মতকে এই মহাভবিষ্যদ্বাণীর মাধ্যমে সতর্ক করে গিয়েছেন যে, যখন আমানতের খেয়ানত বেড়ে যাবে, মানুষ মা-বাবার অবাধ্য হবে এবং বন্ধু আপন হবে, মসজিদে শোরগোল হবে, ইতর ও পাপাচারীরা সমাজের নেতা হবে, মানুষকে সম্মান করা হবে তার অনিষ্টের ভয়ে, নাচ-গান ও মদপান ব্যাপক হবে তখন মানুষ যেন অপেক্ষা করে লাগাতার বিপদ-দুর্যোগের এবং ভূমিকম্পের।’ আরো বলা হয়েছে, কিয়ামত কায়েম হবে না, যতক্ষণ না ঘন ঘন ভূমিকম্প ঘটবে।

মুসলিম হিসাবে আমাদের আরো বিশ্বাস, প্রাকৃতিক সকল দুর্যোগ এবং প্রকৃতির সকল শক্তি একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহর আদেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যা কিছু হয়, মানুষের কর্মফলে হয় এবং আল্লাহর হুকুমে হয়। আল্লাহ চান মানুষ যেন সতর্ক হয় এবং ফিরে আসে। কোরআন বলছে- ‘ছড়িয়ে পড়েছে দুর্যোগ (ও গোলযোগ) স্থলে ও জলে মানুষেরই কর্মফলে, যেন আস্বাদন করান তিনি তাদেরকে তাদের কিছু কর্মফল, যাতে তারা ফিরে আসে।’

সুতরাং মানবসৃষ্ট বা প্রাকৃতিক যে কোন দুর্যোগ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো সকল প্রকার অনাচার-পাপাচার থেকে তাওবা করা এবং আল্লাহর ইচ্ছে ও সন্তুষ্টির সামনে সমর্পিত হওয়া। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন, আমীন।

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা