শাবান ১৪৩৯ হিঃ (৩/৪)

কিশোর পাতা

আমাকে / তোমাকে

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

আ   মা   কে

আমার ভিতরের আমাকে যেদিন চিনলাম সেদিন সত্যি আমার বিস্ময়ের কোন সীমা ছিলো না!

চিনলাম মানে একটু একটু করে চিনতে শুরু করলাম। খুব অস্পষ্ট আবছা একটা ছবি। যেন কুয়াসার অনেক গভীর থেকে দেখা! যেন চুপচাপ বসে আছে একটা পাখী! কত যেন বিষণœ, কত যেন দুঃখী!

তাকিয়ে আছে কোন্ দিকে? আকাশের দিকে। যেন আকাশের সীমানা ভেদ করে যেতে চায় সে দৃষ্টি আরো দূরে, হয়ত অসীমের গন্তব্যে!

আশ্চর্য! পাখীটা একবারও তাকায় না মাটির দিকে! কত সন্দর পৃথিবী! যেন সবুজের গালিচামোড়া! কত বাগান, কত গাছ, কত ফুল! এখানেও তো আছে কত পাখী! পাখীর গান, কলতান!! তবু পৃথিবীর প্রতি তার নেই কোন আকর্ষণ! পৃথিবীর সঙ্গে, পৃথিবীর সবুজ গালিচার সঙ্গে, বাগান, ফুল, পাখী, গান, এগুলোর সঙ্গে কি তার কোন মমতার বন্ধন নেই! ঊর্ধ্বলোকের প্রতি তার কিসের আকর্ষণ! অসীমের সঙ্গে কিসের বন্ধন!

কুয়াসার গভীর থেকে আবছা হয়ে দেখা দেয়া পাখীটার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি, আর ভাবছি, আমার দেহখাঁচায় কোত্থেকে এলো এ পাখী?! কে সে? কোন জগতের বাসিন্দা সে?! আমার সঙ্গে তার কিসের বন্ধন?

***

তারপর একদিন মনে হলো ছবিটা একটু স্পষ্ট হলো। কুয়াসার মোটা চাদর একটু যেন হালকা হলো! পাখীটাকে আগের চেয়ে অনেক যেন কাছের, অনেক যেন আপন মনে হলো!!

একই রকম বিষণœ অবয়ব! একই রকম দুঃখী চেহারা!! এমন কেন, পৃথিবীর দিকে একটু কি তাকাতে পারে না, এবং আমার দিকে! একটু কি গান গাইতে পারে না, পৃথিবীর বাগানের পাখীগুলোর মত, এবং আমার জন্য!! পাখীটার জন্য আমার কেন এমন করে ‘মনকেমনকরে’?! কেন এমন করে মায়া ও মমতার অনুভূতি জাগে! বুকের প্রতিটি স্পন্দন যেন তাকে কামনা করে, তার একটুখানি সান্নিধ্য লাভের আকুতি জানায়! আমি অবাক হয়ে ভাবি, হৃদয়ের স্পন্দন যাকে এমন করে অনুভব করে, এমন করে যার সান্নিধ্য কামনা করে, সে আমার কে হতে পারে?!

কেউ যদি হবে, আমার দিকে তাকায় না

কেন? একটু গান গায় না কেন?

আচ্ছা, আমি যদি ডাকি, শোনবে পাখীটি আমার ডাক?! বোঝবে আমার ভাষা, আমার বর্ণমালা, আমার কণ্ঠস্বর?

তখনো এ প্রশ্নের উত্তর ছিলো না আমার কাছে।

কৌতূহল তো ছিলোই, পাখীটার পরিচয় জানার জন্য; কেন এত বিষণœ, কেন এত দুঃখী, তা জানার জন্য। এখন যেন কৌতূহলের সঙ্গে যুক্ত হলো আশ্চর্য এক বেদনা ও যন্ত্রণা, পাখীটার একটু সঙ্গ লাভের জন্য!! বেদনা, তবে বড় মিষ্টি বেদনা! যন্ত্রণা, তবে বড় মধুর যন্ত্রণা!! অপার্থিব এক মাদকতা সৃষ্টি করে হৃদয়ের গভীরে, এমন মিষ্টি বেদনা, এমন মধুর যন্ত্রণা!!

***

অনেক দিন পর হঠাৎ এক গভীর রাতে, যখন আমার চারপাশের পৃথিবী ছিলো নিঝুম! কোথাও কোন শব্দ ছিলো না, ছিলো শুধু নৈশব্দের আশ্চার্য এক ভালো লাগা! আমার সামনে মোমের আলো। কারণ তখনো বিদ্যুতের আলো আমাদের জীবনে এত অন্ধকার নিয়ে আসেনি। এখন বিদ্যুতের আলো জীবনকে এত অন্ধকার করে ছেড়েছে যে, কখনো যদি বিদ্যুতের অভাবে মোমের বাতি জ্বালি, সেই আলোটা আর পাই না! তখন মোমের আলো বড় ¯িœগ্ধ ছিলো। চারপাশের সবকিছু মনে হতো স্বপ্নময়। তখন মোমের আলোকে মনে হতো জোসনার আলো। মোমের আলোর সঙ্গে জোসনার কী যে এক পার্থিব বন্ধন ছিলো! যেমন বিদ্যুতের চোখধাঁধানো আলোর সঙ্গে রয়েছে জোসনার, বোঝানো যায় না, তবে অনুভব করা যায়, এমন একটা অপরিচয় এবং অনাত্মীয়তা!!

আমার সামনে ছিলো মোমের ¯িœগ্ধ আলো, যে আলোতে হৃদয়টাও হয়ে ওঠে ¯িœগ্ধ ও মোলায়েম।

আমার চোখে ঘুম ছিলো না। নৈশব্দের ভালোলাগায় হৃদয় ও আত্মা যখন আপ্লুত হয় তখন সর্বসত্তা যেন কামনা করে, একটু জেগে থাকি! দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, অথচ খুব কাছে আছে, ইচ্ছে হয় এমন অশরীরী কিছুকে অনুভব করি!!

 সেই নিঝুম রাতে, সেই নৈশব্দের ভাবতন্ময়তার অপূর্ব মুহূর্তে ইচ্ছে হলো কলমের একটু স্পর্শ গ্রহণ করি! এমন স্বর্গীয় মুহূর্তে কলমই তো হতে পারে হৃদয় ও আত্মার সর্বোত্তম সঙ্গী!

কলমের স্পর্শ সবসময় আমাকে অন্য এক জগতে নিয়ে যায়। সেই জগতের সবকিছু এখান থেকে ভিন্ন! সেখানে ঈর্ষা নেই, বিদ্বেষ নেই! হীনতা, দীনতা, কপটতা, কার্পণ্য নেই। নোংরা ও অসুন্দর কিছু নেই। আছে শুধু আলো ও ভালো! আছে শুধু শুভ ও কল্যাণের আকুতি, সবার জন্য, আপন-পর সব মানুষের জন্য।

ঐ নিঝুম রাতে, নৈশব্দের সেই স্বর্গীয় মুহূর্তটিতে যখন কলম হাতে নিলাম, কলমের স্পর্শে খুব আলতো করে দূরের সেই আলোকিত জগতের স্পর্শ পেলাম। তখন এমনকি নিজেকেও মনে হলো, আমি অনেক ভালো, অনেক পবিত্র। আমি শুধু মানুষের কল্যাণ কামনা করি, কারো অকল্যাণ কামনা করি না, করতে পারি না!

এমন সময় আমার কলমে ঝর্ণার কুলকুল সঙ্গীত শোনা যায়। এমন সময় আমার কলম থেকে ঝিরিঝির শিশিরের মত শব্দরা ঝরতে থাকে। তখন আমি কিছু লিখি না, আমি শুধু কলমের স্পর্শ অনুভব করি, আর একটি অপার্থিব সুখের অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকি। কোন অদৃশ্যের আলোকরেখা অনুসরণ করে কলম নিজেই যেন লিখতে থাকে। সেই লেখার সঙ্গে আমি অনন্তকালের বড় মধুর একটি বন্ধন অনুভব করি।

ঠিক তেমনি একটি লেখা আজো আমি উপহার পেলাম আমার কলমের কাছ থেকে। আর তখন ঠিক তখন! শুনতে পেলাম আশ্চর্য মোলায়েম, আশ্চর্য রকমের বিষণœ ও করুণ একটি কণ্ঠস্বর! পৃথিবীতে আমার পরিচিত যত কণ্ঠ ও কণ্ঠস্বর আছে তার থেকে একেবারে ভিন্ন! শুধু মনে হলো, এ কণ্ঠস্বর তো আগে আমি শুনেছি কোথাও! পৃথিবীর সীমানা থেকে বাইরে হয়ত ঊর্ধ্বজগতের কোন এক রহস্যলোকে!!

সেই কণ্ঠস্বরে আমার সর্বসত্তা যেন অপার্থিব এক আনন্দে শিহরিত হলো! নিজের অজান্তেই যেন তাকালাম চারপাশে! নাহ, কেউ তো নেই। আমি একা।

আবার শুনি সেই অপার্থিব কণ্ঠস্বর! না, তুমি একা নও, এই যে আমি তোমার সঙ্গে, তোমার ভিতরে।

অবাক হয়ে তাকালাম আমার ভিতরে, সেই পাখীটির দিকে। এখন একফোঁটা কুয়াসা নেই! সবকিছু শুভ্র স্বচ্ছ! এত স্পষ্ট করে আর কখনো দেখিনি। পাখীটি তাকিয়ে আছে আমার দিকে! আমার ভিতরে অপূর্ব একটি আকুতি যেন দোলা দিলো, ইচ্ছে হলো আরেকটিু কাছে যাই পাখীটির। কিন্তু পারি না। কিসের যেন অদৃশ্য এটা আড়াল রয়েছে আমার ও পাখীটির মাঝে। জানি না এ কিসের আড়াল! আমার ক্ষুদ্রতার! আমার সীমাবদ্ধতার!! হয়ত।

কে তুমি অচীন পাখী?! আমাকে চেনো না! আমিই তো তোমার ভিতরের তুমি?

এত দিন কথা বলো নি কেন আমার সঙ্গে? বলেছি তো, রাতের নির্জনতায় তোমাকে অনেক ডেকেছি তো! কিন্তু তোমাকে একান্ত করে পাইনি, যেমন পেয়েছি আজকের নিঝুম রাতে, নৈশব্দের অপার্থিব পরিবেশে! তুমি তো ব্যস্ত থাকো বাইরের তোমাকে নিয়ে, তাই আমাকে দেখতে পাও না, আমার ডাক শুনতে পাও না।

তুমি এত বিষণœ কেন? কিসের দুঃখ তোমার?

আমার দুঃখ তো তোমাকে নিয়েই। যখন দেখি, তুমি কল্যাণ থেকে দূরে থাকো, বিভিন্ন কালিমায় নিজেকে লিপ্ত করো তখন আমি খুব কষ্ট পাই, খুব দুঃখ হয়। আমি তোমাকে ডাকি। ডেকে সতর্ক করি, কিন্তু তুমি আমার ডাক শোনো না, শুনতে চাও না।

এখন থেকে আমি তোমার সঙ্গে থাকবো, তোমার ডাকে সাড়া দেবো।

তাহলে আমার কোন দুঃখ থাকবে না। আমি তোমাকে নিয়ে যেতে চাই সেই আলোর জগতে যেখান থেকে আমি এসেছি তোমাকে সঙ্গ দিতে, আলো ও কল্যাণের পথ দেখাতে।

তোমাকে

কখনো কি দেখেছিলাম তোমাকে, যখন আমরা ছিলাম মহাকালের ওপারে আলোর জগতে! তুমি কি চিনতে আমাকে? আমি কি চিনতাম তোমাকে? তোমার কি মনে পড়ে আমাদের অশরীরী সময়ের কোন স্মৃতি?! আমি কিন্তু দেখতে পাই আমার ভিতরে, ঠিক হৃদয়ের মধ্যখানে কিসের যেন একটা ঝাপসা ছবি! ঠিক ছবি নয়, তবু মনে হয়, কোন প্রিয়তমের মুখের ছবি। হয়ত তোমারই মুখের ছবি! তোমার শরীরের নয়, হয়ত তোমার আত্মার! কিছু একটা তো হবে! কোন না কোনভাবে, কখনো না কখনো, কোথাও না কোথাও তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিলো, অন্তরঙ্গতা ও হৃদ্যতা ছিলো; আত্মার সঙ্গে আত্মার একাত্মতা ছিলো। নইলে এত স্পষ্ট করে এমন সোনালী বর্ণে কীভাবে আঁকা হলো তোমার ছবি আমার বুকে, আমার হৃদয়ের সবুজ পাতায়?!

***

এমন কেন মনে হয়, আত্মার জগত থেকেই তোমাকে চিনি আমি?! হয়ত খুব কাছাকাছি, কিংবা একেবারে পাশাপাশি ছিলাম সেখানে আমরা। তোমার ঠোঁটের মধুর হাসি, সেই হাসির উদ্ভাস ও রিণিঝিনি এত কেন পরিচিত মনে হয় আমার কাছে?! কেন মনে হয়, তোমার এই মধুর হাসিটির সঙ্গে কোথায় যেন আমার পারিচয় ছিলো?

যখন আমরা আত্মার জগতে ছিলাম কাছাকাছি, কিংবা পাশাপাশি, হয়ত তখন আমাকে তুমি এমনই একটি মধুর হাসি উপহার দিয়েছিলে! নইলে এখনো কেন দেখতে পাই তোমাকে স্বপ্নের জগতে! সেই মধুর হাসিটি এখনো যেন উদ্ভাসিত তোমার দুই ঠোঁটের মাঝে! এখনো যেন বাজে আমার কানে সেই হাসির রিণিঝিনি!

আমি কি তোমাকে বলেছিলাম, এখানে এই আত্মার জগতেই থেকে যাই আমরা দু’জন। তুমি কি বলেছিলে আমাকে, আমি চাই, আমরা পৃথিবতি যাই, পৃথবীর পুষ্প-উদ্যানে আমরা পথ চলবো পরস্পরের হাত ধরে!

আমি কি বলেছিলাম, আমার যে ভয় করে, পৃথিবীর লোকারণ্যে তোমাকে যদি হারিয়ে ফেলি! যদি আর খুঁজে না পাই তোমাকে!!

আমার কিছু মনে পড়ে না! শুধু মনে পড়ে, কোথায় যেন দেখেছি তোমাকে! তোমার অশরীরী সত্তাকে!! তোমার মুখে মধুর হাসিটির সঙ্গে যেন যুগ যুগ থেকে আমার পরিচয়!! পৃথিবীর সীমানা

ছাড়িয়ে যেন অন্যকোন লোকে, অন্যকোন বন্ধন ছিলো আমাদের মধ্যে। সেই বন্ধনের অপার্থিব আকর্ষণে এখনো আমি বিচরণ করি তোমার হাত ধরে স্বপ্নের উদ্যানে!

আমার কলমের ঝরণায় এ কি তোমারই হাসির কল্লোল! কিংবা আমার জন্য তোমার কল্যাণ-পার্থনার সঙ্গীত!! কবে জানবো তোমাকে আমি পরিপূর্ণরূপে! কবে আসবে তুমি আমার কাছে, আমার পাশে!! পৃথিবীর পুষ্পোদ্যানে জোসনার আলো গায়ে মেখে কবে আমরা হাঁটবো একে অন্যর হাত ধরে!! কবে আমরা জানবো, দু’টি ফুল থেকে কীভাবে অঙ্কুরিত হয় একটি ফুলের কলি?!! কবে আসবে সেই শুভক্ষণটি আমাদের জীবনে!! কবে বলতে পারবো তোমার কানের কাছে মুখটি রেখে, আমি ভালোবাসি তোমাকে?!!

১২/৭/৩৯ হি.

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা