মুহাররম ১৪৪৫ হিঃ

কিশোর পাতা

বইয়ের পাতা.. জীবনের পাতা...

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

আমাদের জ্ঞান এত সীমাবদ্ধ কেন? প্রশ্নটা উঁকি দেয় অনেকের মনে, কিন্তু উত্তরের উদয় ঘটে খুব কম মানুষের হৃদয়ে।

জ্ঞান অর্জনের জন্য আমাদের সাধনা, অতীতের জ্ঞানসাধকদের মত না হলেও শোরগোলপূর্ণ সময়ের বিচারে একেবারে কম নয়। কিন্তু বাস্তবতা এই যে, অতীতের জ্ঞানসাধক যারা তাদের জ্ঞান যেন সমুদ্র, যার কূল নেই, কিনারা নেই এবং তলদেশের নাগাল নেই। অথচ আমাদের জ্ঞান!  যেমন বিস্তার নেই, তেমনি নেই গভীরতা!  কারণ আমরা জ্ঞান অর্জন করি শুধু কিতাবের পাতা থেকে এবং বইয়ের লেখা থেকে। তাঁরাও জ্ঞান অর্জন করতেন কিতাবের পাতা থেকে, তবে তার চেয়ে অনেক বেশী অর্জন করতেন জীবনের পাতা থেকে।

কিতাবের পাতায় আছে শুধু কালো কালির বর্ণ ও বর্ণমালা। জীবনের পাতায় আছে আকাশ ও পৃথিবী, পাহাড় ও ঝর্ণা, নদী ও সাগর, মেঘ ও বৃষ্টি, রঙ ও রঙধনু, সবুজ বাগান, ফুল ও ফল, বসন্ত এবং কোকিল ও বুলবুলি! 

জীবনের পাতায় আছে মরুভূমি ও মরূদ্যান, আছে পাখী ও পাখীর গান। জীবনের পাতায় শিক্ষার উপকরণ অসংখ্য। 

আরেকটি কথা, কিতাবের পাতায় যে জ্ঞান তার সাধরণ উৎস হলো বুদ্ধি ও মস্তিষ্ক, যা খুব বেশী হলে তোমার বিবেক ও মানবতাবোধকে পরিপুষ্ট করে। পক্ষান্তরে জীবনের পাতা আমাদের দান করে হৃদয় থেকে নিসৃত এবং আত্মার গভীর থেকে উৎসারিত জ্ঞান, যা মানুষকে নিয়ে যায় মানবতার স্তর অতিক্রম করে ঊর্ধ্বজগতে পরম সত্তার অনেক নিকটে।

কিতাবের পাতায় নিমগ্ন থাকো,  তোমার প্রাপ্তি ও তৃপ্তি কম হবে না; জীবনের পাতায় আত্মসমাহিত হও, তোমার হৃদয় ও আত্মার বিস্তার সৃষ্টির বিস্তারকেও অতিক্রম করবে। তোমার প্রাপ্তি হবে বিপুল, আর তৃপ্তি হবে অপরিসীম।

কিতাবের পাতায় কালো কালির হরফে আকাশের কথা, চাঁদ ও তার জোসনার কথা, ঝিলমিল তারকার কথা পড়ো। তারপর জোসনা রাতে আকাশের বুকে মেঘের ভেলায় ভেসে যাওয়া চাঁদকে দেখো, জোসনার শুভ্রতা গায়ে মাখো; আবার কোন আঁধার রাতে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি তারার যে মেলা, সেখান থেকে যে বার্তাটি আসে মানুষের কাছে তা অনুধাবনের চেষ্টা করো, আমার কথার মর্ম অবশ্যই তুমি উপলব্ধি করবে।

বইয়ের পাতায় কতবার পড়েছি ফুলের সৌন্দর্য ও সুবাসের কথা। ফুল ও বসন্ত এবং কোকিল ও বুলবুলি কী বার্তা নিয়ে আসে আমাদের জন্য, অনেক পড়েছি, অনেক শুনেছি, বুদ্ধি দিয়ে যুক্তি দিয়ে তা বোঝারও চেষ্টা করেছি, এমনকি হৃদয়ের গভীরে তার শাশ্বত আবেদনটিও অনুভবের কিছু চেষ্টা করেছি, কিন্তু...

বসন্তের আহ্বানে ফুলের বাগানে গিয়ে, ফুলের সুবাস নিয়ে এবং ফুলের স্পর্শ গ্রহণ করে, কোকিলের কুহু কুহু তান এবং বুলবুলির মধুর কণ্ঠের গান শুনে হৃদয় ও আত্মা যে সমৃদ্ধি অর্জন করেছে এবং অন্তর্সত্তায় পরম সত্যের যে সান্নিধ্য অনুভব করেছে তার সত্যি কোন তুলনা নেই।

সাগর-মহাসাগরের কত বিবরণ পড়েছি!  সাগর অভিমুখে বহমান নদীর স্রোত সম্পর্কে কত তথ্য ও তত্ত্ব জেনেছি, অস্বীকার করবো না, তাতে জ্ঞানের পরিধি যথেষ্ট বিস্তৃত হয়েছে। কিন্তু...

একবার পদ্মা-মেঘনার পারে গিয়ে, একবার দজলা-ফুরাতের তীরে দাঁড়িয়ে ক্ষণস্থায়ী জীবনের যে সত্য অনুভব করেছি! একবার আমদের দেশের দক্ষিণে যে সাগর তার তীরে দাঁড়িয়ে, একবার আরব-সাগরের পারে গিয়ে, দুই সাগরের ঢেউয়ের উচ্ছ্বাসে জীবনের অন্য এবং অনন্য যে রূপটি অবলোকন করেছি তা আমাকে তথ্য ও তত্ত্বের কোন জ্ঞান দেয়নি সত্য, তবে আমার ভিতর থেকে কে যেন আকুতি নিবেদন করেছে, দূর অদৃশ্যের পরম সত্তার সমীপে ‘জীবন-নদীর স্রোতের টানে যাই যদি ভেসে যাই/সাগরে পড়ার আগে তোমার দু’হাত যেন কাছে আরো কাছে পাই।

কিতাবের পাতা থেকে এবং বইয়ের কালো কালো লেখা থেকে হৃদয় ও আত্মার এ আকুতি আমি অর্জন করতে পারিনি, কেউ পেরেছে বলে শুনিনি।এর কারণ আর কিছু না! শুধু এই যে, নদী ও তার স্রোত, সাগর ও তার ঢেউ বইয়ের পাতায় এবং জীবনের পাতায় দু’টি ভিন্ন চিত্র ও অবয়ব তুলে ধরে। একটিতে থাকে জীবনের বাইরের রূপ; একটিতে থাকে জীবনের ভিতরের রূপ।একথাগুলো নদী ও সাগরের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি সত্য চাঁদ ও জোসনার ক্ষেত্রে; আকাশে তারার মেলা এবং সন্ধ্যার আঁধারে জোনাকির মেলা উভয়ের ক্ষেত্রে।

একই রকম সত্য, বাগানে ফুলের সমাবেশ, ঘাসের সবুজ গালিচা, বসন্তে কোকিল-বুলবুলির গান এবং ভোরে সান্ধ্যায় পাখীর কোলাহল, এগুলোর ক্ষেত্রেও।এমনকি মরুভূমি ও মরূদ্যান, জল ও মরীচিকা, অরণ্যের গভীরতা ও পর্বতের গম্ভীরতা, মেঘের কোলে রোদের হাসি এবং বৃষ্টিধোয়া প্রকৃতির পটে রঙধনুর উদ্ভাস, এগুলোর ক্ষেত্রেও তা একই রকম সত্য।

বইয়ে পাতায়, বর্ণমালার বর্ণনায় এগুলোর যে ছবি তুমি পাবে তার চেয়ে অনেক ভিন্ন প্রতিচ্ছবি তোমার সামনে উদ্ভাসিত হবে যখন জীবনের পাতা থেকে চোখের তারায় এবং হৃদয়ের মণিকোঠায় তুমি এগুলোর প্রকৃত রূপটি ধারণ করার চেষ্টা করবে।

এখনো কি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না আমার কথা! তোমাকে দোষ দেবো না! কারণ আমাদের বুদ্ধি, আমাদের মস্তিষ্ক এবং আমাদের চোখ চিরকাল অভ্যস্ত কিতাবের পাতায় কালো কালির বর্ণমালায়! জীবনের পাতার সঙ্গে, পরম সত্তার অদৃশ্য তুলির আঁচড়ে আঁকা প্রকৃতির চিত্রগুলোর সঙ্গে না চোখ পরিচিত হয়েছে, না আমাদের হৃদয় ও আত্মা অন্তরঙ্গতা অর্জনের সুযোগ পেয়েছে! তোমাকে আমি দোষ দেবো না, তবে একবার অনুরোধ জানাবো, বন্ধুর কাছে বন্ধু যেমন অনুরোধ জানায়! একবার মিনতি জানাবো, চাঁদ ও তার জোসনা, আকাশের তারা এবং সন্ধ্যার জোনাকি যেমন মিনতি জানায়; তোমার কাছে মিনতি জানাবো; কিতাবের পাতা থেকে, বইয়ের বর্ণমালা থেকে কখনো যদি চোখ তোলার অবসর হয়, তোমার সামনে অবারিত এই যে বিশাল প্রকৃতি, প্রকৃতির এই যে বিপুল সজ্জা, একবার তাকাও বাইরের ও ভিতরের উভয় দৃষ্টিকে একত্র করে প্রকৃতির এই বিপুল সজ্জার দিকে একবার তাকাও এ বিশ্বাস নিয়ে যে, প্রকৃতির এ বিপুল সজ্জা অদৃশ্যে চিরবিরাজমান পরম সত্তার পক্ষ হতে তোমার জন্য ভালোবাসার উপহার! *

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা