মুহাররম ১৪৪৫ হিঃ

বাতাসের তালব্য শ !

বানানের জলসা

ভু .. ল .. হ .. লে .. ভ .. য় .. নে .. ই! / ই.. নে .. ক্ষা .. র .. লে .. হ .. ল .. ভূ

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

পুষ্পের এবং তার বানান জলসার ঘুমটা বড় দীর্ঘ হয়ে গেলো, যেন আছহাবে কাহাফের ছোটা ভাই! একে একে প্রায় চারবছর। এর মধ্যে বানান জলসার একটা দু’টো মেয়ে, শুনতে পেলাম বিয়ের পিড়িতে বসে গিয়েছে, ওদিকে বানান জলসার সভাপতি হুযুরের...! তার চেয়ে বড় কথা, সভাপতি হুযূরের আব্বাহুযুরের আরেকটা দাঁত নাকি পড়ে গিয়েছে! বুড়ো মানুষের বুড়ো দাঁত, পড়ে গেলেও তাতে চন্দ্রবিন্দু ছিলো। এমনকি ঐ যে শিশুদের দুধের দাঁত, পড়ে গেলেও চন্দ্রবিন্দু, না পড়লেও চন্দ্রবিন্দু।

তো আল্লাহর শোকর, জীবনের উপর দিয়ে এতগুলা ঝড় বয়ে যাওয়ার পরো পুষ্প আবার প্রকাশ পেতে চলেছে, আর বানানের জলসাটাও আবার সাজতে শুরু করেছে! এর মধ্যে শোনা গেলো একটা ‘নিখোঁজ সংবাদ’! তাহলে তো চিন্তার কথা! কী নিখোঁজ হলো, কে নিখোঁজ হলো! আচ্ছা, এই যে ছেলেরা, এই যে মেয়েরা! এখানেই ভালো করে জেনে নাও, নিখোঁজ হলেও চন্দ্রবিন্দু লাগে, আর তা খোঁজ করতে গেলে তো চন্দ্রবিন্দু ছাড়া উপায়ই নেই। যতই ‘খোজ’ চন্দ্রবিন্দু ছাড়া, সভাপতি হুযূর বলে দিয়েছেন, খুঁজে পাওয়াই যাবে না!

যাক, এবার শোনো, কোন জিনিসটা নিখোঁজ হলো। বানান জলসার সভাপতি হুযূরের চেয়ার, যাকে হুযূরের হুকুমে আমরা বলি কুরসি! কী সাঙ্ঘাতিক কথা! সভাপতি হুযুরের কানে এবং নাকে কথাটা পৌঁছার আগেই যে করেই হোক কুরসিটা খুঁজে পেতেই হবে! সুতরাং খোঁজ, খোঁজ; রীতিমত চন্দ্রবিন্দু দিয়ে খোঁজ! তবে কিনা এখানে ছোট্ট একটা সমস্যা দেয়া দিয়েছে। সমস্যা নিয়ে এখন অবশ্য কোন সমস্যা নেই! সবাই জেনে গিয়েছে, ‘দু’টো দন্ত্য-স, আর একটা য-ফলা। আর ‘অবশ্য’টা তো অবশ্যই তালব্য-শ।সমস্যাটা হয়েছে ‘সাঙ্ঘাতিক’-এ।  ছেলেদের মধ্যে শফীকের দাবী হলো, দন্ত্য-স, এর উপর চন্দ্রবিন্দু দিতেই হবে। কারণ শব্দটা যে ‘সাঁঙ্ঘাতিক’! মেয়েদের মধ্যে সুফিয়া বেঁকে বসলো রীতিমত চন্দ্রবিন্দু দিয়ে! ওর এককথা! বরং দু’কথা। প্রথম কথা হলো দন্ত্য-স নয় তালব্য-শ। দ্বিতীয় কথা, চন্দ্রবিন্দু দেয়া যাবে না কিছুতেই। কারণ শব্দটা যে ‘শাঙ্ঘাতিক’! এমনকি প্রয়োজন হলে মামলা করবো চন্দ্রবিন্দু ঠেকাবো। সুফিয়ার কেন জানি বিশ্বাস, সভাপতি হুযূরের আদলতে মামলা হলে রায় তার পক্ষেই আসবে। এই তো চারবছর আগে, যখন সে আরো চারবছর ছোট ছিলো, বানানের শেষ জলসায় সভাপতি হুযূরকে কত্তো বড় মিষ্টটা খাওয়ালো! সেটা কি ভুলে যাওয়ার কথা! এক্কেবারে ঘরে তৈরী মিষ্টি! যেমন চিনি, তেমন মূর্ধণ্য-ষ।

আচ্ছা, এবার শোন নিখোঁজ হলো কে! আমাদের সবার প্রিয় কলিম মুন্সী! সভাপতি হুযূর যখন থাকেন না, বা ঘুমিয়ে থাকেন, তখন কলিম মুন্সীই তো জলসাটা চালিয়ে যায় এবং বেশ মুন্সিয়ানার সঙ্গেই চালিয়ে যায়। সভাপতি হুযূরের অনুপস্থিতিটা বলতে গেলে বুঝতেই দেয় না। কথাটা অবশ্য হুযূরের কানে গেলে সর্বনাশ এবং তালব্য-শওয়ালা সর্বনাশ! কলিম মুন্সী নিখোঁজ! খুব মারাত্যক কথা তো! ভারি বিপদের কথা তো! তবু আফিফের বানানজ্ঞান মোটেই শিথিল হলো না। সুলতানাকে বাধা দিয়ে বললো, আপু! মারাত্মক-এর বানানটা ঠিক করো, ত+য-ফলা নয়, বরং ত+ম সংযুক্ত।‘সংযুক্ত’ শব্দটার উপর আফিফ একটু যেন বেশী জোর দিলো। বানানটা এই কিছুদিন হলো সে সংশোধন করেছে। কীভাবে! কার কাছ থেকে! জলসা তো বন্ধ ছিলো! কেন! আফীফের আম্মা তো আব্বা হুযূরের কাছে বানান শিখেছেন!

জাহানারা ছোট্ট মেয়ে বানান জলসা শুরু হচ্ছে, খবর পেয়ে আজই প্রথম এসেছে, বোঝা যায়, যথেষ্ট বুদ্ধিমতি। তা বুদ্ধির আলামতটা কী দেখলে! প্রথম কথা হলো, পরীক্ষা করার জন্য সুলতান ওকে জিজ্ঞাসা করলো, যথেষ্ট-এর বানান বলো! তখন সরাসরি উত্তর না দিয়ে জাহানারা জানতে চাইলো, তোমার সন্দেহটা কোথায়? য-এ, না মূর্ধণ্য-ষ এ? তার চেয়ে বড় কথা, মতি ও মতী-এর পার্থক্য ওর বেশ জানা, অথচ বানান জলসার অনেকেরই এখনো তা জানা নেই! তো জাহানারা হাসিমুখে সবাইকে জ্ঞান বিতরণ করে বললো, ....

রায়হানার একটা ভালো গুণ জলসার ছেলে মেয়ে সবার নযরে এলো। ওর মধ্যে কোন অহঙ্কার (ঙ+ক) নেই। কথা বলে বেশ স্পষ্ট, তবে বিনয়ের সঙ্গে। আর তার জানার ইচ্ছা অনেক। যা জানে না, তা অন্যের কাছ থেকে জেনে নিতে তার কোন লজ্জা-সঙ্কোচ নেই। যেমন দেখো, সংশোধন শব্দের বানান ওর ঠিকমত জানা ছিলো না। মানে হলো, একটা দন্ত্য-স, আর একটা তালব্য-শ, এতটুকু জানা ছিলো, জানা ছিলো না শুধু, আগে কোনটা পরে কোনটা? দন্ত্য-স আগে, না তালব্য-শ আগে!

নাযরানার কথা তোমাদের মনে আছে না! ঐ যে শান্তশিষ্ট মেয়েটি। কথা বলে মিনমিনিয়ে, তবে বেশ পাকা পাকা! একেবারে প্রথম দিন থেকে বানানজলসার নিয়মিত সাথী। নাযরানার বানানজ্ঞান প্রশংসা করার মত। কথা বলার ভঙ্গিটা কিছুটা সভাপতি হুযুরের মত। জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব! তো নাযরানার কাছেই জানতে চাইলো রায়হানা, বড় আপু তুমি না কত ভালো! বুঝিয়ে দাও না, সংশোধনে আগে দন্ত্য-স, না তালব্য-শ! কেউ যদি বানান জানতে চায়, নাযরানার মুখে সুন্দর একটা হাসি ফুটে ওঠে! বানানের জ্ঞান বিতরণ করতে পেরে যেন খুব খুশী! তবে জ্ঞানটা সে বিতরণ করে মূর্ধণ্য-ণ দিয়ে।

তো নাযরানা খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে বললো, আমার যদ্দুর মনে পড়ে, সংশোধনে আগে দন্ত্য-স, পরে তালব্য-শ। তারপর ধরো, প্রশংসা ও সংশয়; এখানেও আগে দন্ত্য-স, পরে তালব্য-শ। কিন্তু সাবধান, যে কোন সংসার কিন্তু গড়ে ওঠে দুটো দন্ত্য-স দিয়ে! সংসারে তালব্য-শ এনেছো কি আগুন জ্বলেছে, সে আগুন নেভানো কঠিন! এই তো সেদিন মাহমূদের মা সংসার-খরচ লিখতে গিয়ে তালব্য-শ দিলো। দিবি তো দে, একটা না, একেবারে আস্ত দু’টো ‘শংশার’ ভাবো তো, কী সর্বনাশ! সেই তালব্য-শওয়ালা সর্বনাশ! মাহমূদের বাবা তো রেগে আগুন। পুরো সংসার জ্বলে পুড়ে সারখার হয় আর কী! মাহমূদের মা তখন আর কী করে! ভরা বালতি মাথায় ঢেলে দিলেন, তখন গিয়ে আগুনটা নিভলো, তবে মাহমূদের মাকে কসম করতে হলো, সংসারে আর কখনো তালব্য-শ আসবে না!

যাক, রায়হানার জিজ্ঞাসা তো ছিলো শুধু সংশোধন সম্পর্কে, কিন্ত নাযরানার অভ্যাসটাই হলো কথা লম্বা করে বলা, সভাপতি হুযূরের ভাগিনী বলে কথা! তবে যারা মন দিয়ে কান পেতে শোনে তাদের বেশ উপকার হয়।

***

বানান নিয়ে কথা বলছিলো মোটে এই তিনচারজন ছেলে মেয়ের। বাকিরা বসে ছিলো মুখ ভার করে। তাদের চিন্তা বলো বা দুশ্চিন্তা, সেটা ছিলো ঐ নিখোঁজ সংবাদ! সভাপতিহুযূরের কুরসি নিখোঁজ! তার উপর নিখোঁজ কলিম মুন্সি! একটা কথা কী! কলিম মুন্সী যদি নিখোঁজ না হতো, সভাপতি হুযূরের কুরসিটা ঠিকই তালব্য-শ দিয়ে তালাশ করতো এবং চন্দ্রবিন্দু দিয়ে খোঁজ করতো; আর যেখানেই থাক, ঠিকই বের করে আনতো! মুন্সীর সঙ্গে তো থাকে নাকি একটা ভূতের বাচ্চা! তিনচার বছর আগে তো ছিলো! এখন আছে কি না, জানি তো না! আর থাকলেও এখন তো বড় হয়ে গিয়েছে কম করে হলেও চারবছর। ভূতের বাচ্চাটা এখন কলিম মুন্সীর কথা শোনবে কি না কে জানে!

***

এই রকম, সেই রকম, পাঁচরকম কথা হচ্ছে; কেউ প-এর মথায় চন্দ্রবিন্দু দিচ্ছে, কেউ দিচ্ছে না! মাথা তো আর ঠিক নেই তখন!...হাঁ, ঠিক তখন এলো ব্রেকিং নিউজ! আরে শোনো, ব্রেকিং নিউজ মানে কঠিন কিছু না! আচমকা বড় ধরনের কোন খবর এলে লোকে বলে ব্রেকিং নিউজ! তো ব্রেকিং নিউজটা সবার সামনে বেশ বুক ফুলিয়ে, মুখে লম্বা হাসি ঝুলিয়ে প্রচার করলো, কলিম মুন্সীর ছোট ভাই হালিম মুন্সী! তার আবার বানান টানানের খুব একটা বালাই নেই! জলসার ধারে কাছেও আসে না কোন দিন, সাদামাটা কৃষক মানুষ! কে নাকি একবার জিজ্ঞাসা করেছিলো, কৃষকে কোন্ স! হালিম মুন্সী বিরক্ত হয়ে বলেছিলো, আরে মিয়া, হালটা ঠিকমত ধরতে পারলেই হলো, স তুমি যেটাই দেবে দাও! তো এই হলো কলিম মুন্সীর ভাই হালিম মুন্সী। তবে ভাই বলে কথা! নিখোঁজ ভাইয়ের জন্য তারো তো মনটা আনচান! সরা দেশ খুঁজলো, গোটা মুল্লুক চষলো, মূর্ধন্য-ষ ছাড়াই, তবু পেয়ে গেলো ভাইকে! সেই নিঝুম চরে, যেখানে আচে শুধু হরিণ, না আছে অন্য কোন প্রাণী, না আছে মানুষ! হরিণের মাথায় যেমন বাহারি শিং লেজে তেমনি সুন্দর মূর্ধন্য-ণ।

হালিম মুন্সী আরো জানালো, কলিম মুন্সীর মাথায় নাকি চেয়ার! নিশ্চয় সভাপতি হুযূরের চেয়ার। হালিম মুন্সীর অবশ্য জানার কথা নয়। তাজ্জবের পর তাজ্জব! কলিম মুন্সী নিঝুম দ্বীপে গেলো কীভাবে এবং কেন? তারপর সভাপতি হুযূরের চেয়ার কলিম মুন্সীর মথায় কেন! রহস্যটা না হয় জানা গেলো না, খোঁজটা তো পাওয়া গেলো! শোকর আলহামদু লিল্লাহ!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা