গত জলসার মত এবারও সভাপতি সাহেবের হাতে ছিলো ছোট্ট একটি কৌটা। সবক’টি মেয়ে ভয়ে ভয়ে তাকালো সেদিকে। বিষয়টি বুঝতে পেরে সভাপতি সাহেব তাদের আশ্বাস দিয়ে বললেন, ভয় নেই; আজ মাকড়সা নেই।
কথাটা যেন মেয়েদের বিশ্বাস হতে চায় না, আবার অবিশ্বাসই বা করে কীভাবে! সভাপতি সাহেব বলে কথা! সম্পাদক ভাইয়ার ছেলে না! চেয়ারে বসে ঝিমুতে পারে, হাঁটতে হাঁটতে ঘুমুতে পারে, কাঁদতে কাঁদতে হাসতে পারে, আবার হাসতে হাসতে কাঁদতে পারে, এমনকি তিনি চন্দ্রবিন্দু ছাড়াও ‘হাটতে’ পারেন এবং ‘কাদতে’ পারেন, সবই পারেন, কিন্তু মিথ্যা কথা! তওবা! তাই মেয়েরা সভাপতি সাহেবের কথাটা একশ ভাগের প্রায় নববই ভাগই বিশ্বাস করে ফেললো। বাকি রইল কয় ভাগ? দশ ভাগ, আর দশে থাকলো কী? তালব্য-শ। তো মেয়েরা তালব-শওয়ালা দশভাগ দন্ত্য-সওয়ালা সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন করলো, তবে ওটাতে কী আছে হুযূর!
সভাপতি সাহেব কিছু না বলে শুধু মিটিমিটি হাসছেন। এই ফাঁকে চলো আমার দেখে নেই বিশ্বাস শব্দটির বানান। তা তুমি বিশ্বাস করো আর নাই করো, তালব্য-শ এর নীচে কিন্তু আছে ছোট্ট একটি ‘ব’। যখন ছোট ছিলাম, ভাবতাম, বিশ্শাস লিখতে হয় এভাবে। যা লজ্জা পেয়েছিলাম!
এই থামো, থামো! সভাপতি সাহেব কী যেন বলছেন!
সভাপতি (রহস্যপূর্ণ হাসি হেসে)ঃ রাখো না, এত তাড়া কিসের! আগেই যদি সব জানা হয়ে গেলো তাহলে আর মজা কিসের?
এখন শুধু জেনে রাখো যে, এই কৌটায় আছে খুব মজার একটি পুরস্কার। বানান পরীক্ষায় যে সেরা হবে সে-ই পাবে এই পুরস্কার, অন্যরা পাবে শুধু বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ও দীর্ঘ নিঃশ্বাস।
সুমাইয়াঃ হযূর, দীর্ঘশ্বাস ও দীর্ঘ নিঃশ্বাস জিনিসটা একটু বুঝিয়ে বলুন তো!
সভাপতিঃ ভালো, না জানলে জিজ্ঞাসা করে নেয়া খুব ভালো। আচ্ছা শোনো, তোমরা তো জানো যে, আমরা সবাই আল্লাহর কুদরতে বাতাসের উপর বেঁচে আছি। নাক দিয়ে বাতাস টেনে ভিতরে নেই, তারপর পর নাক দিয়ে বাইরে বের করে দেই। তো প্রথমটা হলো শ্বাস, দ্বিতীয়টা হলো নিঃশ্বাস। অর্থাৎ আমরা শ্বাস গ্রহণ করি, আর নিঃশ্বাস ফেলি।
লম্বা করে শ্বাস নিলে হবে দীর্ঘশ্বাস, আর লম্বা করে নিঃশ্বাস ফেললে হবে দীর্ঘ নিঃশ্বাস। তো যারা পুরস্কার পাবে না তাদের তো খুব কষ্ট হবে। আর কষ্টের সময় মানুষ লম্বা লম্বা শ্বাস নেয় এবং লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে। এজন্যই দীর্ঘশ্বাস, আর দীর্ঘ নিঃশ্বাসের কথা বললাম। যাক গে, এখনই তোমরা দীর্ঘশ্বাস নেয়া এবং দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলা শুরু করে দিয়ো না। কারণ পুরস্কারটা পেতেও তো পারো! এখন শুধু বানানটা দেখে নাও।
এবার বলো, তোমরা পরীক্ষার জন্য প্রস্ত্তত?
(সবাই একসঙ্গে)ঃ জ্বি প্রস্ত্তত।
সভাপতিঃ আচ্ছা সুমাইয়া, রহস্যপূর্ণ বানান বলো তো?
সুমাইয়াঃ দন্ত্য-স, দীর্ঘ উকার, রেফ এবং মূর্ধন্য-ণ
সভাপতি (মুখটা মলিন করে)তুমি দেখি পেরে ফেললে! লক্ষণ তো ভালো নয়! আচ্ছা বলো তো রসহস্যপূর্ণ একসঙ্গে না আলাদা?
সুমাইয়া (একটু চিন্তা করে)ঃ মনে হয় আলাদা। কারণ একসঙ্গে থাকলে তো মাঝখানে ফাঁক হবে না, তাহলে রহস্যটা পূর্ণ হবে কীভাবে!
সভাপতি (দু’টি চন্দ্রবিন্দু দিয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন)ঃ
হলো না, হলো না, তুমি পুরস্কার পেলে না! এক কাজ করো, তুমি একটা দীর্ঘশ্বাস নাও।
আচ্ছা, এবার বলো তো, ‘প্রস্ত্তত’-এর বানান বলার জন্য কে কে প্রস্ত্তত?
(অনেক ক্ষণ পরে) শফীক (অন্যরা চুপ)ঃ মাঝখানে মনে হয় কয়েকটা হরফ একসঙ্গে জট পাকিয়েছে; কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। হযূর, দয়া করে আপনিই বলে দিন।
সভাপতি (বিজ্ঞের হাসি হেসে)ঃ জানতাম, পারবে না। সুতরাং তুমিও পুরস্কার পেলে না। আসলে এখানে একসঙ্গে আছে আড়াইটা হরফ। যথা, দন্ত্য-স + ত + হ্রস্বউকার। আকার, ইকার, উকার, এগুলো তো আর পুরো হরফ নয়, এগুলো হচ্ছে অর্ধেক হরফ।
সুমাইয়া (অবাক হয়ে)ঃ আমাদের সভাপতি হুযূরের কত্ত জ্ঞান!
সভাপতি (খুশির ভাবটা লুকোনোর চেষ্টা করে)ঃ থাক, সামনাসামনি প্রশংসা করা ভালো নয়। আচ্ছা, ভালো কথা, প্রশংসা বানান বলো দেখি, আরেফীন!
আরেফীন (ভেবে পাচ্ছে না, আগে কোন ‘স’ বলবে, হঠাৎ তার মাথায় এলো এক বুদ্ধি)ঃ হুযূর, প্রশংসা বানান হলো দন্ত্য-স ও তালব্য-শ।
সভাপতিঃ কেন?
আরেফীনঃ কারণ সংশোধন, সংশয় ও প্রশংসা, অর্থাৎ সংশ, সংশো, সংশা, এরা হলো তিন ভাই। তাই এদের বানানও হবে একরকম।
সভাপতি সাহেব (মনে মনে আরেফীনের বুদ্ধির তারিফ করে)ঃ আচ্ছা ঠিক আছে, লোগাত খোলো।
লোগাত খোলা হলো এবং দেখা গেলো সংশয় ও সংশোধনে দন্ত্য-স আগে তালব্য-শ পরে, কিন্তু প্রশংসায় তালব্য-শ আগে, দন্ত্য-স পরে। বেচারা আরিফীন, এত বুদ্ধি খাটিয়েও কাজ হলো না দেখে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।
আচ্ছা, এ প্রসঙ্গে আরেকটি প্রশ্ন, কে বলতে পারে, প্রসঙ্গ বানান কী?
সুমাইয়াঃ হুযূর, আমরা তো সবে বানান শিখতে শুরু করেছি। এত কঠিন প্রশ্ন কীভাবে পারবো!
শফীকঃ দন্ত্য-স এর পরে লাঙ্গলের মত ওটা যে কী!
সভাপতি (হুঁ বোঝা গেছে, পুরস্কার আর পেতে হচ্ছে না)ঃ আরে চাষা, ওটা লাঙ্গল নয়। ওটা হলো গিয়ে ঙ+গ সংযুক্ত।
সভাপতি সাহেব বানানে প্রাপ্ত- বয়স্ক, কিন্তু বয়সে অপ্রাপ্তবয়স্ক। তাই তার গোঁফ ছিলো না। তবু তিনি তার কাল্পনিক গোঁফে তা দিয়ে এবং সবার দিকে একবার খোশমেজাযে তাকিয়ে বললেন, ‘তাহলে কী হলো! এই কৌটার পুরস্কারটির একমাত্র হকদার হলাম, আমি, এই বানান জলসার মহামান্য সভাপতি।’ সবাই আর কী বলবে, মাথা নেড়ে সায় দিতেই হলো। সভাপতি সাহেব ধীরে ধীরে কৌটার ঢাকনা খুললেন। দেখা গেলো ভিতরে শুয়ে আছে ইয়া বড়া এক চমচম! দেখে কেউ নিলো দীর্ঘশ্বাস, কেউ ফেললো দীর্ঘ নিঃশ্বাস, আর সভাপতি সাহেবের জিহবা থেকে পড়লো এক ফোঁটা জল এবং তাতে ছিলো একটি চন্দ্রবিন্দু!