মুহাররম ১৪৪৫ হিঃ

হযরত আলী নাদাবীর পাতা

যারা বছীরত ও গায়রাতের অধিকারী, আযাদ ইসলামী ভূখণ্ডে তাদের দায় ও দায়িত্ব

পাকিস্তানে আলী মিয়াঁর বয়ান

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 

(এই ভাষণ আঞ্জুমানে ইশা‘আতে কোরআনে ‘আযীম-এর পক্ষ হতে দেয়া সম্বর্ধনার জবাবে মসজিদে ফোরকানিয়া [হায়দারাবাদ কলোনি, করাচি] শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সামনে করা হয়েছে।)

খোতবায়ে মাসনূনের পর; আম্মা বাদ!

সম্মানিত হাযিরীন!

আস্-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ্

আমি আমার বক্তব্যের শুরু করতে চাই মিশরবিজেতা প্রসিদ্ধ ছাহাবী হযরত আমর ইবনুল আছ রা,-এর একটি ঐতিহাসিক বাক্য দ্বারা যা অত্যন্ত প্রজ্ঞাপূর্ণ ও শিক্ষণীয়। আমি মনে করি, প্রতিটি মুসলিম সমাজ ও জনপদে এ বাক্যের বার্তা ও মর্ম সঠিকভাবে উপলদ্ধি করা কর্তব্য। হযরত আমর ইবনুল আছ রা.-এর নেতৃত্বে মিশরের বিজয় যখন সম্পন্ন হলো এবং মিশর যখন খেলাফাতে রাশেদার মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত হলো তখন যাবতীয় পরিবেশ পরিস্থিতির ইঙ্গিত এদিকেই ছিলো যে, মিশর চিরকাল মুসলিম উম্মাহর নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। কিবতী রাজত্ব দম হারিয়ে ফেলেছিলো, আর সেখানে প্রতিরোধ ও মুকাবেলার কোন শক্তি অবশিষ্ট ছিলো না। খেলাফাতে রাশেদার কেন্দ্র মদীনা তাইয়েবা ও জাযীরাতুল আরবের সঙ্গে এর ভৌগোলিক নৈকট্য ছিলো। তাতে এ নিশ্চয়তা ছিলো যে, খেলাফাতের কেন্দ্র থেকে মিশরকে তদারকির আওতায় রাখা যাবে। সুতরাং মিশরের ভূমিতে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর ভবিষ্যত সম্পূর্ণ নিরাপদ।

ইতিহাসের সাক্ষি এই যে, যেসমস্ত দেশ ও ভূখণ্ড ছাহাবা কেরাম জয় করেছেন সেগুলো এখনো কোন না কোনভাবে ইসলামের ছায়াতলে রয়েছে। পক্ষান্তরে এমন বেশ কিছু উদাহরণ রয়েছে যে, যেসমস্ত দেশ ও ভূখণ্ড পরবর্তী বিজেতারা জয় করেছেন, আর ঐ বিজয়ী বাহিনীতে ছাহাবা কেরাম শামিল ছিলেন না, সেগুলো একসময় না একসময় ইসলামের রহমতের ছায়া থেকে বঞ্চিত হয়ে গিয়েছে। এমন কয়েকটি দেশ ও অঞ্চলের উদাহরণ এখানে দেয়া যেতে পারে যেখানে মুসলিম শাসনের মযবূত বুনিয়াদ রাখা হয়েছিলো, কিন্তু কয়েক শতাব্দী পরে তা ইসলামের মানচিত্র থেকেই হারিয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমার পড়াশোনা ও অধ্যয়ন যতদূর বিস্তৃত তাতে পূর্ণ আস্থার সঙ্গে বলতে পারি যে, যেসমস্ত দেশ, জনপদ ও ভূখণ্ড সরাসরি ছাহাবা কেরামের জিহাদের মাধ্যমে বিজিত হয়েছে তা কখনো সম্পূর্ণরূপে ইসলামের নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হয়নি। তো হযরত আমর ইবনুল আছ রা.-এর পক্ষে এ কথা বিশ্বাস করার এবং এ বিষয়ে আশ্বস্ত হওয়ার পূর্ণ সুযোগ ছিলো এবং রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও সামরিক যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান ছিলো যে, মিশরে বড় কোন বিপরীত বিপ্লব ও পরিবর্তনের আশঙ্কা নেই। মিশরের বিজয় সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিলো। ছাহাবা কেরাম ও অনুগামী মুসলিমদের কদম মিশরের মাটিতে মযবূতভাবে জমে গিয়েছিলো। মসজিদের পর মসজিদ তৈরী হচ্ছিলো। মিশরের বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য, যার শেষ সম্রাট হেরাক্লিয়াস, তিনিও ততদিনে দুনিয়া ছেড়েছেন। এটা তো ছিলো হযরত আমর ইবনুল আছ-রা এর যামানায়। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অধিকৃত ভূমি, যার মধ্যে শাম ও ফিলিস্তীনের অঞ্চলও ছিলো, ইসলামের ছায়াতলে এসে গিয়েছিলো। কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলা হযরত আমর ইবনুল আছ রা.কে ঈমানী ফিরাসাত দান করেছিলেন। অর্থাৎ ঈমানের নূরের কল্যাণে মুমিনের কলবে সৃষ্ট এমন এক অন্তর্জ্ঞান ও দিব্যদৃষ্টি যার সামনে সত্য-অসত্য স্পষ্ট হয়ে যায়। এই ফিরাসাত ছাহাবা কেরাম হাছিল করেছিলেন নবীর প্রত্যক্ষ ছোহবত দ্বারা। পক্ষান্তরে এর কিছু না কিছু হিছ্-ছা প্রত্যেক মুমিনেরই হাছিল হতে পারে ছোহবতের পরম্পরা দ্বারা। যেমন হাদীছ শরীফে এসেছে:

اِتَّـقـوا فِراسـة الْـمُؤْمِنِ، فَإنَّـه يَـنْـظُرُ بِـنُـور الله

মুমিনের ফিরাসাত সম্পর্কে হুঁশিয়ার থেকো, কেননা সে আল্লাহ্র নূরের সাহায্যে সবকিছু দেখে।

মুমিনের মধ্যে বাছারাত বা বাহ্যদৃষ্টি তো থাকেই, তার সঙ্গে আল্লাহপ্রদত্ত বাছীরাত বা অন্তর্দৃষ্টিও অর্জিত হয়। তো হযরত আমর ইবনুল আছ রা. ঐ ঈমানী ফিরাসাতের সাহায্যে একটি বাক্য বলেছিলেন যা ইতিহাস হুবহু তাঁরই ভাষায় সংরক্ষণ করে রেখেছে। সেই বাক্য ও মন্তব্য মুসলিম উম্মাহর জাতীয় সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য এতই মূল্যবান, এমনই নির্ধারক যে, কেউ যদি আমাকে বলে, আয়াতুল কুরসী এবং অন্যান্য বরকতী আয়াতের পরে এমন কোন বাণী ও বাক্য আমাকে বলুন যা সুশ্রী হস্তাক্ষরে লিখিয়ে প্রত্যেক মুসলিমঘরের দেয়ালে টানিয়ে রাখা হবে। কেউ যদি আমার কাছে এরূপ আব্দার করে তাহলে আমি এ বাক্য ও বক্তব্যটিরই পরামর্শ দেবো।

মিশরের বিজয় ও নিয়ন্ত্রণ পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর যখন প্রাচীন মিশরের সবচে’ প্রাচীন মসজিদ ফুছতাত নামে নির্মিত হয়ে গিয়েছিলো, এমনকি পুরো একটা শহরও এই নামে আবাদ হয়ে গিয়েছিলো। বেশকিছু ছাহাবা কেরাম, যাদের নাম হাদীছে আসে, সেখানকার বাসিন্দা হয়ে গিয়েছিলেন, ঐ সময় হযরত আমর ইবনুল আছ রা. পুরো ইসলামী লশকর এবং সেখানে বসবাস গ্রহণকারী মুসলিমদের উদ্দেশ্য করে যে কালোত্তীর্ণ বাক্যটি বলেছিলেন, সেই বাক্যটি দিয়েই আমি আজ  আমার আলোচনা শুরু করছি।

দেয়ালে বাণী ও বক্তব্য ঝুলিয়ে রাখার অভিজ্ঞতা খুব সুখকর বা উৎসাহব্যঞ্জক প্রমাণিত হয়নি। কারণ বরাবর চোখের সামনে থাকা এবং নিয়মিত দেখতে থাকার কারণে তা সাদামাটা ও গুরত্বহীন হয়ে যায়। বরং আলাদা করে নযরেও পড়ে না। তাই দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখার স্থলে যদি সম্ভব হতো তাহলে বলতাম, হৃদয়ের ফলকে তার ছাপ স্থায়ী করে নাও।

এবার শুনুন হযরত আমর বিন আছ রা.-এর সেই অমর বাণী ও বাক্য। তিনি বলেছিলেন, ভুলে যেয়ো না যে-

أَنْتُـمْ فِـي رِبـاطٍ دائِـمٍ لِكَـثْـرَةِ الأعْـدآءِ حَـوْلَـكُـمْ، وَ لِـتَـشَـوُّفِ الْـقُـلُوبِ إلَـيْـكُـمْ

তোমরা স্থায়ী ‘রিবাত’ সতর্ক প্রহরার অবস্থায় রয়েছো। কারণ তোমরা শত্রুবেষ্টিত। তোমাদের চারপাশে শত্রুর আধিক্য। আর তাদের অন্তর তোমাদের প্রতি প্রলুদ্ধ। একথা সবসময় তোমাদের মনে রাখতে হবে যে, তোমরা রণাঙ্গনে যুদ্ধপরিস্থিতির মধ্যে রয়েছো এবং তোমরা ইসলামী সারহাদ ও সীমান্তের মুহাফিয-রক্ষক। দুশমন তোমাদের গাফলত ও অসতর্কতার প্রতীক্ষায় ওত পেতে আছে। তাদের শিকারী দৃষ্টি তোমাদের প্রতি নিবদ্ধ, আর তাদের বুক তোমাদের প্রতি বিদ্বেষে পরিপূর্ণ।

একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার বলছি, যাতে অন্তরে তা গেঁথে যায়। আবারো বলছি; চিন্তা করুন, মিশর কিন্তু দখলে এসে গিয়েছে। ফেরআউনী ছাপ ও মাসীহি প্রভাব মুছে ফেলা হয়েছে। পুরো ভূখণ্ডে ইসলামী বিধান ও আইন প্রবর্তন করা হয়েছে। মসজিদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি লাভ করছে। ছাহাবা কেরাম একের এক বসতি গ্রহণ করছেন। ইসলামগ্রহণের ধারাও অব্যাহত রয়েছে এবং থাকবে (ইনশাআল্লাহ্)।

মানুষ যে দলে দলে শুধু ইসলাম গ্রহণ করছে তাই নয়, বরং আরবী ভাষাও গ্রহণ করছে। খুব কম দেশ ও জনপদেই এমন হয়েছে যে, ওখানকার ভূমিপুত্ররা নিজেদের উন্নত ও সমৃদ্ধ ভাষা ত্যাগ করে আরবীভাষা গ্রহণ করে নিয়েছে, আর মূল ভাষা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। এটাও ছাহাবা কেরামেরই বৈশিষ্ট্য ও কল্যাণ যে, তারা মিশর জয় করেছেন তো মিশরের ভাষা আরবী হয়ে গিয়েছে। লিপি ও বর্ণ আরবী হয়ে গিয়েছে। শামের এলাকা যখন বিজিত হলো তখন ওখানকার ভাষা যাই ছিলো, সূরীয় বা হিব্রু, তার স্থান আরবী ভাষা এমন-ভাবে দখল করে নিলো যে, সেগুলো বিলুপ্তই হয়ে গেলো। ওখানকার ঈসাঈরাও আরবী-ভাষা গ্রহণ করে নিলো এবং তাতে দক্ষতা অর্জন করতে লাগলো।

বেশকিছু কোরআনী শব্দ এমন রয়েছে যার সঠিক ও নিখুঁত তরজমা করা খুব মুশকিল। রিবাত তেমনি একটি শব্দ, যার তরজমা শুধু একটি প্রতিশব্দ দ্বারা তুলে আনা প্রায় অসম্ভব। অবরোধ, প্রতিরোধ, সীমান্তের প্রহরা, নিরন্তর নিমগ্নতা, এসবই রিবাতের ভাব ও মর্মের অন্তর্ভুক্ত। একারণেই মসজিদে এক নামায আদায়ের পর পরবর্তী নামাযের ইন্তিযারে থাকা, এর জন্যও রিবাত শব্দটি ব্যবহার করে বলা হয়েছে:

فَذالِكُمُ الرِّباطُ؛ فَذالِكُمُ الرِّباطُ

তো এটাই হলো তোমাদের রিবাত; এটাই হলো তোমাদের রিবাত।

রিবাত শব্দের মধ্যে শারীরিক ও সামরিক দিক থেকে এবং সেই সঙ্গে আত্মিক ও চিন্তাগত দিক থেকেও সর্বদা সতর্ক থাকার ভাব ও মর্মও এসে পড়ে।

তো হযরত আমর ইবনুল আছ রা. মুসলমানদের মধ্যে এ অনুভূতি জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন যে, মিশরের আদি জনগোষ্ঠী যখনই ফারাওঁদের নির্মিত আহরাম ও পিরামিড দেখবে, তাদের প্রিয় মিশরের সবুজশ্যামলতা ও সম্পদপ্রাচুর্য চোখের সামনে দেখতে পাবে, একটা চাপা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে তাদের মনে এ স্মৃতি জাগ্রত হবে যে, কখনো এখানে আমাদেরও রাজত্ব ছিলো! সুতরাং হে মুজাহিদগণ, এদিক থেকে তোমরা কখনো অসতর্ক, উদাসীন হয়ো না।

তাছাড়া তোমরা বত্রিশটি দাঁতের মাঝখানে একটি জিহ্বার মত। সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশ তখনো উত্তর অংশটি বিজিত হয়নি ছড়িয়ে আছে, দেখো, সেখানে মিশরই একমাত্র দেশ যা ইসলামের কব্যায় এসেছে। তো এই বিশাল মহাদেশের সাগরে মিশর একটি ইসলামী দ্বীপমাত্র। সুতরাং তোমরা যদি সতর্ক সাবধান না থাকো তাহলে এ দেশে ইসলামের নিরাপদ থাকা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

যে কোন আযাদ ও স্বাধীন মুসিলম দেশ ও ইসলামী ভূখণ্ডের অধিবাসীদেরও সর্বদা এই ‘ছাহাবী-উপদেশ’ স্মরণ রাখা এবং সে অনুযায়ী দিনরাতের সার্বক্ষণিক সতর্কতা অবলম্বন করা অবশ্যকর্তব্য। প্রত্যেক ভূখণ্ডে এবং প্রতিটি জনপদে তাদের অব্যাহতরূপে রিবাতী যিন্দেগী ও সান্ত্রিজীবন যাপন করতে হবে। ঐ সমস্ত বিষয় থেকে তাদের বেঁচে থাকতে হবে যা গাফলাত ও অসতর্কতা সৃষ্টি করে এবং শত্রুর সামনে সুযোগ এনে দেয়।

একটা কথা আপনাদের মনে রাখতে হবে যে, ফিতনা ও দুর্যোগ শুধু বাইরে থেকেই অনুপ্রবেশ করে না, বরং ভিতর থেকেও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, উঠতে পারে। আর ভিতরের ফিতনা কখনো কখনো বাইরের ফিতনা থেকে অনেক বেশী খতরনাক ও বিধ্বংসী এবং অনেক বেশী সুদূরপ্রসারী পরিণাম-পরিণতি বহন করে আনতে পারে। উদাহরণ হিসাবে নিজেদের মধ্যে বিরোধ, মতবিরোধ ও অন্তর্দ্বন্দ্বের কথাই ধরুন। আপনাদের সবারই জানা আছে যে, স্পেন বা উন্দুলুস নামের যে সোনার দেশটি মুসলমানদের হাতছাড়া হলো সেটা কোন বহিঃশত্রুর হামলার কারণে হয়নি। ইতিহাসে কোথাও স্পেনের উপর প্রতিবেশী ফ্রান্সের বা জার্মানির হামলার কথা আসেনি। মুসলিম সম্প্রদায় নিজেরাই ভিতর থেকে গুটিয়ে এবং বিক্ষিপ্ত হয়ে আসছিলো। তদুপরি আসল ফিতনা ছিলো তাদের মধ্যে ভিতর থেকে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা হিজাযী, ইয়ামানী, আদানানী ও কাহতানী অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং নিছক তাজ ও তখতের জন্য চাচা-ভাতিজার আত্মঘাতী লড়াই।

আরেকটি ফিতনাও উন্দুলুসের পতন ও বিপর্যয়ের কারণ হয়েছিলো, আর তা এই যে, তাদের সমস্ত আগ্রহ ও মনোযোগ নির্মাণশিল্প ও ললিতকলার চর্চা-সাধনায় নিবদ্ধ ছিলো। মদীনাতুয্-যাহরা ও আলহামরা প্রাসাদের সাজসজ্জা ও সূক্ষ্ম রুচির কারুকাজ দেখলে এখন স্বপ্নের মত মনে হয়। এর বাইরে দিনরাত তারা ডুবে ছিলো কবিতা ও সাহিত্য নামের কল্পনার জগতে। ওখানকার আদি জনগোষ্ঠীর সামনে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরা; নিজেদের উন্নত জীবন ও কর্ম দ্বারা তাদের ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করা, এগুলো তাদের চিন্তার মধ্যেই ছিলো না। তাছাড়া তারা প্রতিবেশী অঞ্চল, তথা উত্তরের দিকে অগ্রসর হওয়ার কথা ভাবেনি, কিংবা ভাবার সুযোগই পায়নি। তারা শুধু নিজেদের ক্ষমতা ও রাজত্ব জ্ঞানে, শিল্পে ও সম্পদে সুসমৃদ্ধ করে যাচ্ছিলো, আর ঐ মহাসত্য ভুলে গিয়েছিলো যা হযরত আমর ইবনুল আছ রা. এই ছোট্ট অথচ অর্থপূর্ণ বাক্যের মাধ্যমে তাদের সামনে রেখে গিয়েছিলেন যে, তোমাদের চারপাশে অমুসলিম ভূখণ্ডের সমুদ্র ছড়িয়ে আছে। সুতরাং তোমাদের নিশ্চিন্ত থাকা বুদ্ধিমানের কাজ নয় যে, এই বিশাল বিস্তৃত সমুদ্রে এই ছোট্ট ইসলামী দ্বীপ নিরাপদ থাকবে; চারপাশের ঢেউ এই দ্বীপভূমিতে এসে আছড়ে পড়বে না।

তারা উত্তরের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করেনি। যখন তাদের উপর চাপ বাড়তে লাগলো তখন তারা দক্ষিণের দিকে শুধু সরে আসতে লাগলো। এমনকি একসময় তারা জাবালুত্-তারিক প্রণালী পর্যন্ত এসে গেলো। তারপর এক ঝাপটায় সেখান থেকে মরক্কোর ভূমিতে এসে আছড়ে পড়লো। অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন দুর্বলতা যখন কোন জনপদে ছড়িয়ে পড়ে তখন সেগুলো ঐ সমাজ ও জনপদকে ঘুণে ধরা কাঠের মত ভিতর থেকে খোকলা করে ফেলে। অনক সময় দেখা যায়, বিরাট বটবৃক্ষ, সবার অলক্ষে ভিতর থেকে উইপোকা সেটাকে ধরে ফেলেছে। বাইরে থেকে তো মনে হয়, একই রকম দাঁড়িয়ে আছে, সজীব জীবন্ত। পুরো একটা মেলা বসে যায় সেই বটবৃক্ষের ছায়ায়। কিন্তু বাস্তবতা এই যে উইপোকা ভিতর থেকে সেটাকে একেবারে খোকলা করে ফেলেছে। ফলে একটা মাত্র হাওয়ার ঝাপটায় বিশাল বৃক্ষ ভূপাতিত হয়ে যায়।

হযরত আমর ইবনুল আছ রা.-এর এ অছিয়ত ও উপদেশ, ছোট বড় সমস্ত ইলামী দেশ ও মুসলিম জনপদকে বুকের সঙ্গে লাগিয়ে রাখতে হবে, এমনকি পবিত্র হিজাযভূমি ও আরবউপ -দ্বীপকেও, ‘জীবননির্দেশিকা’ রূপে এ সতর্কবাণী গ্রহণ করতে হবে যে:

أَنْـتُـمْ فِـي رِباطٍ دائِـمٍ

তোমরা সার্বক্ষণিক প্রহরার অবস্থায় রয়েছো। তোমাদের এই সদাজগ্রত প্রহরা থেকে কখনো নিষ্কৃতি নেই। এ বিষয়ে কখনো তোমরা চিন্তুামুক্ত হয়ো না এবং এ আয়েসী ভাবনায় লিপ্ত হয়ো না যে, আমরা তো নিরাপদ আছি! যে অন্তর্দর্শী কবি একথা বলেছেন, সত্যই বলেছেন:

مکتب عشق کا دیکھا یہ نرالا دستور

اس کو چھٹی نہ ملی جس کو سبق یاد ہوا

প্রেমের পাঠশালায় এ বড় অদ্ভুত নিয়মরীতি/সবক যার ইয়াদ হলো, নেই তার ছুটি!

এটাই বাস্তব সত্য যে, কোন দেশে ও জনপদে মুসলিম উম্মাহর জন্য ‘ছুটি’ বলতে কিছু নেই, একেবারেই নেই! মুসলিম উম্মাহর কাঁধে যে মহাদায়িত্ব অর্পিত হয়েছে এবং তার সামনে যে সমস্ত কঠিন ও জটিল পরিস্থিতি রয়েছে তাতে ‘ছুটি’ ধারণার কোন বৈধতাই নেই। কেউ মনে করবে যে, আমি এখন ছুটিতে আছি, এর কোন সুযোগই নেই।

দেখুন, এখানে সূক্ষ্ম একটি বিষয় আছে; একটা হলো ছুটির সময়, আরেকটা হলো ছুটির মানসিকতা! তো ছুটি বা অবসর যাপন করার চেয়ে বেশী বিপদের বিষয় হলো ছুটি বা অবসরের মানসিকতায় আক্রান্ত হওয়া। অর্থাৎ এই ধারণা ও মানসিকতায় লিপ্ত হওয়া যে, এখন আমার উপর বড় কোন দায়িত্ব নেই। আমি এখন এমন কোন নাযুক স্থানে বা অবস্থানে দাঁড়িয়ে নেই যে, প্রতি মুহূর্তে টানটান সতর্কতার মধ্যে থাকতে হবে। এই ছুটিমানসি-কতা ও অবসরপ্রবণতা আরো বেশী ভয়ের কারণ। এমনকি একজন মানুষ কোন দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে, কিন্তু সে ভাবছে, এটা শুধু নিয়মরক্ষার দায়িত্ব; তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় না। একটু জিরিয়ে নিতে, বা  চায়ের কাপে চুমুক দিতে তেমন কোন ক্ষতি নেই। দায়িত্বে অনুপস্থিতির চেয়ে দায়িত্বের মধ্যে থেকে দায়িত্ব- শিথিলতার এ মানসিকতা খুবই খতরনাক ও ভয়াবহ।

ইতিহাসের পাতায় আপনি দেখতে পাবেন যেখানে যেখানে ইসলামের ‘অপসরণ’ ঘটেছে; মুসলিম উম্মাহ্ বে-দখল  হয়েছে, সবার আগে সেখানে এ মানসিকতা ও প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে; অর্থাৎ আরামপ্রিয়তা, অলসতা, আদর্শ থেকে এবং দায়িত্ব থেকে বিচ্যুতি। এক কথায় মেহনত করার পরিবর্তে মেহনতের ফল ভোগ করার মানসিকতা সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ এ মানসিকতা যে, যথেষ্ট মেহনত করা হয়েছে; মাথার ঘাম পায়ে অনেক ঝরেছে, ব্যস, এখন আরাম করার এবং মেহনতের ফল ভোগ করার সময় এসে গিয়েছে। ছাহাবা কেরাম যিন্দেগির একেবারে শেষ পর্যন্ত মানসিকতার এ দুষ্ট ক্ষত থেকে মুক্ত ছিলেন। জীবনের অনিবার্য ব্যস্ততায় নিয়োজিত থেকেও সবসময় তাঁরা এজন্য প্রস্তুত থাকতেন যে, ক্ষেত্র থেকে, ফ্রন্ট থেকে ডাক আসবে, আর তাঁরা ছুটে যাবেন। তদুপরি সেখানে দায়িত্বে নিয়োজিত অবস্থায় তাঁরা সর্বক্ষণ সতর্কতা ও জাগ্রত অবস্থার মধ্যে থাকতেন। মুসলিম উম্মাহ্র জীবনে এটা তো পরবর্তী সময়ের উপসর্গ যে, আশ্বস্তি ও নিশ্চিন্ততা এবং আরামপ্রিয়তা ও অবসরপ্রবণতা তাদের মধ্যে বাসা বেঁধেছে। কোরআনুল কারীমে এটাকেই إخلاد শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে:

أخْـلَـدَ إلى الأرْضِ وَاتَّـبَـعَ هَواه ভূমিলগ্ন হয়ে বসে পড়েছে, আর প্রবৃত্তির পিছনে লেগে পড়েছে। এ দুষ্ট মানসিকতা ও অসুস্থ প্রবণতা মুসলিম উম্মাহর জন্য বেহদ খতরনাক যে, অনেক কাজ করে ফেলেছি। এখন কিছু আরাম ও বিশ্রামের প্রয়োজন। এখন তো পিছনের মেহনত থেকে ফল ভোগ করার সময়। এখন ঘর-বাড়ি তৈরী করো, ফুলবাগিচা ও ফলবাগিচা লাগাও। ফুলের সুবাস এবং ফলের রস ভোগ করো। ছেলে মেয়ের বিয়ে শাদি খুব ধুমধামের সঙ্গে করো, যাতে মানুষ দেখে বুঝতে পারে, আল্লাহ্র দেয়া কত কিছু আমাদের কাছে রয়েছে! অনেক মেহনত করেছি, সারা জীবন তো আর মেহনতের জন্য নয়! জীবনের একটা সময় তো আরামের জন্য, বিশ্রামের জন্য এবং দায় ও দায়িত্ব থেকে মুক্ত অবস্থায় নিশ্চিন্তে যাপনের জন্য হবে!

আমি আবারো বলছি মেরে পেয়ারে ভাই, মুসলিম উম্মাহ্র জন্য এবং যারা এমন কোন ইসলামী ভূখণ্ডে বাস করে যেখানে বাইরের ও ভিতরের বিপদঝুঁকি সবসময় বিদ্যমান, এ অশুভ মানসিকতা তাদের জন্য শাব্দিক অর্থেই আত্মঘাতী।

ভাই ও বন্ধুগণ, আরেকটি বিষয়; আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, এখানে সমাজজীবনে পর্দাহীনতা খুবই ব্যাপক। হিন্দুস্তানের তুলনায় পাকিস্তানে পর্দাহীনতা ও নগ্নতা অনেক বেশী। বিবাহ-শাদীতে এখানে ইছরাফ ও অপচয় অনেক বেশী। জীবনযাত্রার মান এখানে এত উঁচুতে উঠে গিয়েছে এবং বিবাহ-শাদীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জটিলতা এত বেড়ে গিয়েছে যে, তা থেকে বহু নৈতিক বিচ্যুতি দেখা দিয়ে থাকবে। ভিতরের অবস্থা তো আমি বাইরে থেকে আসা মানুষ জানবো কীভাবে, তবে আশঙ্কা হয় যে, এটা বহুমুখী নৈতিক বিচ্যুতির কারণ হয়ে থাকে। সম্পদের অযথা ব্যয়, নিজের আভিজাত্য, বড়ত্ব ও গুরুত্ব যাহির করার চিন্তা, জীবযাত্রার মানের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতি, প্রয়োজন ও জরুরতের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকা এবং সেগুলোকে জীবনের অপরিহার্য অংশ বলে ধরে নেয়া, এগুলো হচ্ছে সেই সব খারাবি যা রোম ও পারস্যের জীবন, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে অভিশাপে পরিণত করেছিলো। ‘বসন্তগালিচা’র বিবরণ মাওলানা শিবলী রহ.-এর আলফারূকে বা মাওলানা আব্দুল হালীম শর্র-এর তারীখে ইসলামে পড়ুন; মনে হবে, জাগ্রত অবস্থায় স্বপ্নের কথা পড়ছি।                                                 

মনে হবে, আলফে লায়লার কাহিনী, বা পরিস্তানের আফসানা! সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভারসাম্যহীন উন্নতি-অগ্রগতির পরিণামেই জীবনে এসমস্ত বিষয়ের অনুপ্রবেশ ঘটে এবং জীবন জীবন্ত অভিশাপে পরিণত হয়। ইসলামী উম্মাহ্র জীবন যখন নীতি ও মূলনীতি এবং আদর্শের সরল রেখা থেকে বিচ্যুত হয় তখন এমনই হয়। এমনকি অধিকাংশ জাতি ও সম্প্রদায়েরও পতন ও অধঃপতন তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির খারাবি থেকেই ঘটেছে। লেকি’র ‘ইউরোপে নৈতিকতার ইতিহাস’ পড়ুন, পরিষ্কার দেখতে পাবেন রোমান সভ্যতা ও সংস্কৃতি কতটা বিকৃতির শিকার হয়েছিলো, কতটা স্বভাববিরুদ্ধ পথে চলে গিয়েছিলো। মুসলিম উম্মাহ্র তো এগুলো থেকে বাঁচার একান্ত প্রচেষ্টা থাকা দরকার।

আল্লাহর ফযলে আপনাদের নিজ নিজ হালকা ও প্রভাব-বলয় রয়েছে। সুতরাং এক্ষেত্রে আপনাদের পক্ষ হতে সর্বপ্রথম প্রয়োজন হলো অনুগামীদের জন্য বাস্তব নমুনা তুলে ধরা। কখনো কখনো নিজের উত্তম আচরণ ও আদর্শ নমুনা মানুষের সামনে প্রকাশ করাও জরুরি হয়ে পড়ে:

إن تُـخْـفُوها فَـهُوَ لَـكُـمْ وَإنْ تُـبْـدُوها فَـنِـعِـمَّـا هِيَ

যদি তোমরা তা গোপন করো তাহলে তা তোমাদের জন্য ভালো, আর যদি তোমরা তা প্রকাশ করো তবে তো তা খুবই ভালো। আপনাদের পক্ষ হতে এ ধরনের নমুনা ও আদর্শগত আচরণ মানুষের সামনে আসা দরকার। যেমন, অমুক বড় মানুষ নিজের ছেলে বা মেয়ের শাদি খুব অনাড়ম্বরভাবে করেছেন; অমুক আলেম, বিদ্বান, নেতা কাউম ও মিল্লাতের ফায়দার জন্য ব্যক্তি স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছেন।

আমাদের এখানে হিন্দুস্তানে এরূপ উদাহরণ যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে। মানুষ তা দেখে ও শুনে অনুপ্রাণিত হয়। বিভিন্ন সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে সুন্নাতের তারীকা এবং ছাহাবা কেরামের নমুনা যিন্দা করা উচিত। আমি মনে করি, পুরো রামাযানুল মোবারাক রাতের পর রাত জাগরণ করা খুব সহজ; বরং তাতে এক ধরনের স্বাদ, আনন্দ ও লয্যতও রয়েছে। কিন্তু উপরে যে উদাহরণ ও  নমুনা কায়েম করার কথা বললাম তা ঐ রাত্রিজাগরণের চেয়ে অনেক বেশী কঠিন। আপনি দিনের পর দিন রোযা রাখতে পারেন, রাতজেগে যিকির-ইবাদত করতে পারেন, ফি বছর হজ¦-ওমরা করতে পারেন, কিন্তু যদি সমাজের সামনে সুন্নত যিন্দা করার একটা নমুনা কায়েম করতে পারেন, আর মানুষ তা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় তাহলে, বিশ্বাস করুন, ঐ সব নফলিয়্যাতের চেয়ে এর মর্যাদা আল্লাহ্র নিকট অনেক বেশী।

অনেক ভাই আছেন, প্রতিবছর নফল হজ¦ করছেন, মাঝখানে ওমরাও করে আসছেন, কিন্তু যদি তাকে বলা হয়, আপনি ছেলের বা মেয়ের শাদি শরীয়তমতে সাদাসিধাভাবে করুন, সেটা কিন্তু করতে পারবেন না। তাহলে ঘটনা কী? আসলে আমরা বিভিন্ন ভাবে নফসের লয্যতের পিছনে ছুটছি! দুনিয়াদাররা একভাবে, দ্বীনদাররা অন্যভাবে। ওরা সরাসারি দুনিয়ার নামে, আমরা দ্বীনের আবরণে; চলছি কিন্তু উভয়ে নফসের তাকাযা ও খাহেশাতের পিছনে। ওদের খাহেশাত পাশবিক ভোগের মধ্যে, আমাদের খাহেশাত নফসের চাহিদামত ইবাদতের মধ্যে। এজন্যই, নফল ইবাদতে প্রচুর আগ্রহ, অথচ সুন্নাতের অনুসরণে আগ্রহ নেই।

ইমাম গাযালী রহ. বড় হিকমত ও প্রজ্ঞার অধিকারী আলিম, দার্শনিক ও মনস্তত্ত্ববিশারদ। তিনি একটি ঘটনা লিখেছেন, একবার এক রাঈস ও তাজির ব্যক্তি তার প্রিয় শায়খের কাছে গিয়ে আরয করলেন, হযরত, হ্জ্বের ইরাদা আছে, দু‘আর দরখাস্ত। শায়খ বললেন, কেন হজ্বে যাচ্ছো? কী নিয়ত? কী মকছদ? তাজির লোকটি বললো, ছাওয়াবের নিয়ত। শায়খ বললেন, যদি ছাওয়াবের অন্য কোন আসান পথ তোমাকে বলি, কবুল করবে? লোকটি বললো, কেন নয়, ছাওয়াবই তো উদ্দেশ্য!

শায়খ বললেন, দেখো, কয়েকটি বয়স্কা মেয়ে ঘরে বসে আছে, যাদের শাদি এজন্য হচ্ছে না যে, মা-বাবার কাছে প্রয়োজনীয় অর্থ নেই। তুমি হজ্বের রাহাখরচ থেকে কিছু কন্যাদায়গ্রস্ত মা-বাবাকে দিয়ে আসো। কয়েকজন ঋণগ্রস্ত শরীফ মানুষ আছে, যারা লজ্জার কারণে লুকিয়ে থাকে। তুমি তাদের করয আদায় করে দাও। কিছু অসুস্থ মানুষ রয়েছে, অর্থের অভাবে যারা চিকিৎসা করতে পারে না। তুমি তাদের সাহায্য করো।

লোকটি তখন কাচুমাচু করে বলে, হযরত, আসলে হজ্বের জন্য মনটা ছুটে গিয়েছে। হজ্বের শাওকে দিল উতালা হয়ে আছে। তাই হজ্বেরই ইরাদা।

নফসিয়্যাতের মাহির ঐ হাকীম শায়খ তখন তিরস্কারের স্বরে বললেন, মিয়াঁ, এটা কেন বলো না যে, ভ্রমণের শখ চেপেছে! মানুষ দুনিয়ার তরীকায় ভ্রমণের শখ পুরা করে, তুমি দ্বীনের তরীকায় ভ্রমণের শখ পুরা করতে চাও। কাফেলায় বেশ মজা মৌজ করে সময় পার হবে! কেনাকাটা হবে, বিশাল সামানের বোঝা হবে! এই হবে, সেই হবে! ...

তো ভাই, হরকিসিমের নফল ইবাদত করা তো সহজ, বরং তাতে নফসের কিছু চাহিদাও রয়েছে; কিন্তু যদি বলা হয়, সুন্নাত মত এমন কোন কাজ করুন যাতে সবাই অনুপ্রাণিত হয় এবং ঐ বিষয়ে আপনাকে অনুসরণ করে, তখন বিভিন্ন অজুহাত-বাহানায় পিছিয়ে যায়। কখনো লোকনিন্দার ভয়। মানুষ কী বলবে? মানুষ কী ভাববে? হয়ত বলবে, পয়সা নেই, তাই খরচ করতে ভয়! হয়ত ভাববে, পয়সা তো আছে, তবে কিনা কিপটেমিতে পেয়েছে, তাই...!

কিন্তু যা সত্য তাই আপনাকে বলছি। আপনার নফল ইবাদতের খুব বেশী প্রয়োজন নেই সমাজের। প্রয়োজন কিছু সাহসী নমুনা ও উদাহরণ সমাজের সামনে তুলে ধরার। আর মনে রাখতে হবে, সমাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হুকুমত ও সরকার যে ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত হয় সেটা হচ্ছে সমাজ-ভূমি; সমাজের ইসলামী আখলাক ও আদর্শ চরিত্রের ভূমি। সেই সমাজ-ভূমি যদি তৈয়ার না হয় তাহলে কোন কিছুরই ভরসা নেই। হুকুমতের বিশাল ইমারত মুহূর্তে ভূমিসাৎ হয়ে যেতে পারে যখন তখন।

ব্যস, কথা আর বেশী নয়:  أنْتُـمْ فِـي رِباطٍ دائِـمٍ এটাকে যিন্দেগির দস্তূরুল আমল এবং জীবনের কর্ম-নির্দেশিকারূপে গ্রহণ করুন। আপনি মুসলিম উম্মাহর পক্ষ হতে এমন মহাগুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নিযুক্ত রয়েছেন যে, সর্বক্ষণ আপনাকে সতর্ক সাবধান থাকতে হবে। হয়ত চোখের পলক ফেললেন, ওদিকে যুদ্ধের ময়দানের নকশা বদলে গেলো। সুতরাং পলক ফেলার, একটু চোখ বন্ধ করারও সুযোগ নেই। সদাজাগ্রত প্রহরীর মত উম্মাহর ঈমান ও আকীদা এবং চিন্তা-চেতনা ও আমল-আখলাকের হিফাযত করুন।

এখানে বেশ কিছু ব্যক্তিত্ব এমন আছেন যারা আল্লাহর ফযলে দেশে শীর্ষস্তরে গণ্য হয়ে থাকেন, যাদের অবস্থান প্রথম কাতারে। যে সমস্ত বিদ‘আত ইবাদতের নামে দ্বীনের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে সেগুলোর বিরুদ্ধে আল্লাহ্র ফযলে যথেষ্ট কাজ হয়েছে, হচ্ছে এবং হতে থাকবে। আমি ঐ সমস্ত কাজের প্রয়োজন বা গুরুত্ব মোটেও অস্বীকার করছি না। তবে যে সমস্ত বিদ‘আত পশ্চিমা সভ্যতা ও সংস্কৃতি এবং হিন্দুয়ানি রসম-রেওয়াজের পথ ধরে আমাদের সমাজে ঢুকে পড়েছে সেগুলো নির্মূল করার চেষ্টা করুন। বক্তৃতা, বিবৃতি, দাওয়াতি সফর, গণমাধ্যমের প্রচার প্রচারণা, মোটকথা যতগুলো পথ ও পন্থা এবং কর্মকৌশল রয়েছে, অবলম্বন করুন। আমি আশা করি, হিকমতের সঙ্গে যদি কাজ করা হয় তাহলে দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গও আপনাদের সাহায্য করবেন। সারা দেশে যেন অনুভূত হয় যে, বিরাট কোন আন্দোলন-আলোড়ন চলছে। দীর্ঘ সময় ধরে এটা অব্যাহত থাকা চাই, সেই সঙ্গে নিজেদের জীবন ও কর্ম দ্বারা নিজেদের দাওয়াতের প্রতি বিশ্বস্ততা প্রমাণ করুন, ইনশাআল্লাহ্ সফলতা আসবে। আল্লাহ্ যেন আমাদের তাওফীক দান করেন। আমিও যেন কোন না কোনভাবে এর আজর ও ছাওয়াবের ভাগিদার হতে পারি। ওয়াস্সালাম। *

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা