মুহাররম ১৪৪৫ হিঃ

হযরত আলী নাদাবীর পাতা

হযরত মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নাদাবী রহ-এর মধ্যপ্রাচ্যসফরের রোযনামচা

ডাক দিয়ে যায় মুসাফির!- ৭

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

আরববিশ্ব ও ভারতবর্ষের দ্বীনী চেতনা           

মুসলিম উম্মাহ্র, বিশেষ করে আরব ও হিন্দ-এর দ্বীনী চেতনা ও জাগৃতি সম্পর্কে আলোচনা উঠলো। এ বিষয়ে আমি বললাম, ভারতবর্ষের মুসলিমানের মধ্যে আরববিশ্বের তুলনায় দ্বীনী জাযবা এবং ধর্মীয় চেতনা অনেক বেশী প্রবল ও দৃঢ়মূল। অন্তরে দ্বীনের প্রতি আযমত ও ভক্তিশ্রদ্ধা লালনের ক্ষেত্রে- আমাকে মাফ করুন- বলতেই হচ্ছে আরবের চেয়ে হিন্দুস্তান অনেক এগিয়ে। আরবজাহানের অবস্থা তো এই যে, দ্বীন ও শরীআতের প্রতি তাদের আচরণ অনেকটা যেন খাবারের প্রতি আহার-তৃপ্ত মানুষের অনাগ্রহের মত; কিংবা ঐ শিশুর মত যার প্রতিপালন হয়েছে কোন দ্বীনী পরিবারে পূর্ণ ধর্মীয় পরিবেশে। বুঝ হওয়ার পর থেকেই যে তার চারপাশে দেখতে পায় দ্বীনী কিতাব এবং কোরআন-হাদীছ। ফলে এগুলো তার কাছে এতই পরিচিত ও সচরাচর মনে হতে থাকে যে, দ্বীন ও ইলমের প্রতি আদব ও ভক্তিশ্রদ্ধার অনুভূতি তার অন্তরে দুর্বল হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় বলাই বাহুল্য যে, দ্বীনের প্রতি, ইলমের প্রতি যথাযোগ্য আদব-ইহতিরাম ও কদর-মূল্যায়নের পরিচয় সে দিতে পারবে না। ঠিক এ অবস্থাটাই হয়েছে আরব জাহানে, যারা দ্বীনের আসল দাঈ ও ধারক-বাহক, রক্তে ও বংশে যারা খাঁটি আরব। দ্বীন ও শরীআতের প্রতি, কোরআনের প্রতি এবং মুহাম্মাদে আরাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তারা তাকায় প্রতিদিন দেখে অভ্যস্ত দৃষ্টিতে, যাতে না থাকে আলাদা আকর্ষণ ও ভয়-সমীহ, না আলাদা ভক্তিশ্রদ্ধা। পক্ষান্তরে ভারতবর্ষের মুসলিমানের অবস্থা হলো এই যে, দ্বীনের প্রতিটি বিষয় এবং ইসলামের প্রতিটি বৈশিষ্ট্যের প্রতি তারা তাকায়, যেন দুর্লভ ও মহামূল্যবান কোন বস্তু দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর হাতে এসেছে। ফলে বংশীয় ও বনেদি মুসলিমের তুলনায় দ্বীন-ইসলামের প্রতি তারা অনেক বেশী আবেগপ্রবণ, জাযবাতী ও সংবেদনশীল হয়ে থাকে। দ্বীনের প্রতিটি বৈশিষ্ট্যের প্রতি তারা এমন নিবেদিত হয়, ইসলামের প্রতিটি অভিপ্রকাশকে তারা এমন যত্ন ও ইহতিমামের সংঙ্গে ধারণ করে এবং লালন করে যা আরবদেশে কল্পনাও করা যায় না।

এ আলোচনার পর আমি তার সামনে তুলে ধরলাম, হিন্দুস্তানে নতুন যে দ্বীনী দাওয়াত ও মেহনত  শুরু হয়েছে এবং তার সুফলরূপে আম মুসলিমানের মধ্যে নতুন যে চেতনা ও জাগৃতি সৃষ্টি হয়েছে, তার সংক্ষিপ্ত চিত্র। এরপর আমি তাকে পড়ে শুনালাম মাযা খাসিরা-এর ঐ অংশটি যা 'মুহম্মদে আরাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন আরব-জাহানের রূহ ও প্রাণ' শিরোনামে লেখা হয়েছে। বক্তব্যটি তিনি মনোযোগের সঙ্গে শুনলেন, পছন্দ করলেন এবং একাত্মতা প্রকাশ করলেন।

 

মিম্বারুশ-শারক (প্রাচ্যের মঞ্চ) পত্রিকা সম্পর্কে

জনাব গায়াতীর সামনে আমি তার সম্পদনায় প্রকাশিত পত্রিকা মিম্বারুশ্-শারক (প্রাচ্যের মঞ্চ) এর প্রসঙ্গ উত্থাপন করলাম। তিনি বললেন, পত্রিকাটি আমি জেনেভা থেকে প্রকাশ করেছিলাম। সেখানে আমি দীর্ঘ সাতাশ বছর বসবাস করেছি। তবে আল্লাহ্র শোকর যে, আমি আমার দ্বীনের উপর, আমার তাহযীব ও সংস্কৃতির উপর পূর্ণ অবিচল ছিলাম। ওখানকার পরিবেশ পরিমণ্ডল এবং পাশ্চাত্যের সভ্যতা-সংস্কৃতির জীবাণু আমার মধ্যে অনুপ্রবেশ করতে পারেনি। অথচ জেনেভা হলো ইউরোপের অতি উন্নত শহরগুলোর একটি।

জেনেভার দীর্ঘ প্রবাসজীবন থেকে যখন আমি মিশরে ফিরে এলাম তখন ড. যাকী মুবারাক আলআহরাম পত্রিকায় আমার সম্পর্কে লিখেছিলেন, 'আমি এমন এক মিশরীয়কে জানি যিনি দীর্ঘ সাতাশ বছর জেনেভায় ছিলেন, তারপর নিজের আযহারী চিন্তাচেতনা ও আরবচরিত্র সঙ্গে করেই মিশরে ফিরে এসেছেন। আমাদের আশা ছিলো যে, দেশে ফিরে তিনি জাতি ও সমাজের ভরপুর খেদমত করবেন এবং নিজের অগাধ জ্ঞান ও দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলো ছড়াবেন, কিন্তু সে আশা পূর্ণ হয়নি।'

একই ভাবে আমার পত্রিকা 'মিম্বারুশ্-শারক'ও তার নীতি ও আদর্শের উপর অবিচল ও নিরাপোশ ছিলো। একারণেই তার প্রচার ও পাঠকপ্রিয়তা ঐ পরিমাণ হয়নি যা অনেক পরে প্রকাশিত কোন কোন পত্রিকার ক্ষেত্রে হয়েছে। আমাদের বন্ধু আমীর শাকীব আরসেলান পরিহাস করে বলতেন, 'তোমার পত্রিকা পাঠকপ্রিয়তার পরিবর্তে আখেরাত -প্রিয়তা অর্জন করেছে!'

আলী আলগায়াতী আরো বললেন, অন্য অনেকের মত আমিও বহুকাল থেকে প্যান ইসলামিজম (বিশ্ব ইসলামী ঐক্য) চিন্তায় বিশ্বাসী। এ বিষয়ে একবার আমি বাদশাহ আবদুল আযীয ইবনে সাঊদের সঙ্গে কথা বলেছি এবং তার সামনে বিশ্ব ইসলামী ঐক্য এবং ইসলামী সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের মহাশক্তির বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তিনি শুধু বললেন, সালমান ফারসী-এর ঘটনা থেকে সেটাই প্রমাণিত হয়।

মিম্বারুশ্-শারক সম্পর্কে আমি আমার মতামত ব্যক্ত করে বললাম, এ পত্রিকার জন্য বেশী ভালো হবে ফিকহের জটিল আলোচনা এবং স্থানীয় বিতর্ক ও মতবিরোধগুলো এড়িয়ে চলা। দ্বীনী চেতনা ও চরিত্রের আহ্বান ও দাওয়াতকেই লক্ষ্য নির্ধারণ করা এবং এর উপর অবিচল থাকাই হলো সময়ের প্রয়োজন। ...

তিনি আমার এ চিন্তার সঙ্গে একমত হলেন এবং স্বাগত জানালেন। আমি বললাম, যতদিন মিশরে আছি, আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবো। তিনি প্রীতি ও সন্তোষ প্রকাশ করে অত্যন্ত উষ্ণতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের বিদায় জানালেন।

আলী গায়াতী ছাহেবের ওখান থেকে আমরা শাবাবু সাইয়েদিনা মুহম্মদ-২ এর কেন্দ্র দারুল আরকামে গেলাম। জনাব হোসায়ন ইউসুফ ছাহেবের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টায় কয়েকবারই আমরা ব্যর্থ হয়েছিলাম। এবার তাঁকে পেয়ে গেলাম। আমরা এই মেধাবী ও প্রতিভাবান মুসলিম যুবকের সঙ্গে মিলিত হলাম, যিনি ঈমান ও বিশ্বাস এবং ইখলাছ ও ঐকান্তিকতায় উচ্ছল ও উচ্ছ্বসিত ছিলেন। তথাকথিত আধুনিকতা ও প্রগতি এবং নগ্নতাবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তার কলম অত্যন্ত শাণিত, ক্ষুরধার ও অনলবর্ষী। তাঁর লেখা ও বক্তব্য নাস্তিকতা, আধুনিকতা ও নগ্নতার মর্মমূলে আঘাত করে এবং দ্বীনের পথে দৃপ্ত পদক্ষেপে মুসলিম যুবকদের এগিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি যেমন মেধাবী ও কর্মচঞ্চল যুবক তেমনি অন্তর্দহনে দগ্ধ এবং আবেগের তরঙ্গে আন্দোলিত এক কর্মীপুরুষ।

তাঁর লেখার প্রতি হিন্দুস্তানী পাঠকদের যে গভীর ভালোবাসা ও মুগ্ধতা এবং আত্মিক বন্ধন রয়েছে তা উল্লেখ করে আমি অশ্লীল সাহিত্য ও বিবেকহীন সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে তাঁর সফল সংগ্রামের জন্য তাঁকে অভিনন্দন জানালাম।

অশ্লীল ও নগ্ন সাহিত্যের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা: আলোচনার এক পর্যায়ে আমি তাঁকে বললাম, সাহিত্য ও সাংবাদিকতার অঙ্গনে এই যে অশ্লীলতা, নগ্নতা ও বস্তুবাদিতার সয়লাব, এর বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী প্রতিরোধ ও সংগ্রাম-শিবির গড়ে তোলা প্রয়োজন। এতে অন্তত ঢলের গতি কিছুটা হলেও কমে আসবে। আর কিছু না হোক, নূন্যতম কল্যাণ থেকে আশা করি, খালি হবে না।

তিনি বললেন, আমাদের পত্রিকায় অশ্লীলতা ও নগ্নতার বিরুদ্ধে নিন্দাবাদ ও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে যে সমস্ত লেখা প্রকাশিত হয়েছে তার কিছু প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিলো। যেমন উস্তায ফিকরী আবাযা নিজে তাঁর অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য অনুতাপ করে স্বয়ং আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তাঁর পত্রিকায় নৈতিকতাবিরোধী কোন কিছু আর ছাপা হবে না। এ প্রতিশ্রুতি তিনবছরের মত তিনি রক্ষা করেছেন। কিন্তু তারপর পত্রিকা আগের অবস্থায় ফিরে গিয়েছে।

আমি বললাম, তাহলে নিন্দা ও হুঁশিয়ারিও অব্যাহত রাখা দরকার। কেননা এরা বস্তুবাদ ও বৈষয়িক মুনাফায় এমনই বিশ্বাসী যে, বৈষয়িক ক্ষতির হুমকি ছাড়া অন্যকিছু তাদের সোজা পথে আনতে পারে না।

তিনি বললেন, হয়ত আপনি অবাক হবেন যে, মিশরে একমাত্র পত্রিকা যা মদের বিজ্ঞাপন প্রকাশে অস্বীকৃতি জানিয়েছে সেটা হলো মিশনারি পত্রিকা 'আল মুকাত্তাম'। এ বিষয়ে পত্রিকাকর্তৃপক্ষ অবশ্যই গর্ব করতে পারে। পত্রিকাটি আগাগোড়া বৃটিশ স্বার্থের ধারক হলেও নৈতিকতার পক্ষে তার এ অবদান তো আমাদের স্বীকার করতেই হবে। মিশরীয় পত্র-পত্রিকার জগতে আলমুকাত্তামই একমাত্র পত্রিকা যাতে লেখা ও ছবির অশ্লীলতা সবচে’কম।

তিনি আরো বললেন, ভেটিক্যানস্থ পোপের প্রতিনিধি একবার মিশরীয় পত্রপত্রিকার নৈতিকাবিরোধী নীতি ও অবস্থান সম্পর্কে আমীর মুহম্মদ আলী তাওফীকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন এবং চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন, তাতে সুড়সুড়িমূলক কীসব অশ্লীল লেখা ও নগ্ন ছবি ছাপা হয়। যুবরাজের অন্তরে পোপপ্রতিনিধির বক্তব্য রেখাপাত করলো, আর তিনি সংশ্লিষ্ট পত্র-পত্রিকার কিছু কাটিংসহ একটি প্রতিবেদন শাহীমহলে পেশ করলেন। আযহার এ বিষয়ে তাকে পূর্ণ সহযোগিতা দিয়েছিলো। আমরা শুধু ভালো কোন ফলের আশায় দিন গুণলাম, কিন্তু আঁতুড়ঘরেই বিষয়টির অপমৃত্যু ঘটলো। পরে এ বিষয়ে আর কোন খবরই পাওয়া গেলো না।

জনাব হোসায়ন ইউসুফকে আমি অনুরোধ করলাম, আপনার সহকর্মীবৃন্দ এবং শাবাবে সাইয়েদিনা মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর যুবকদের সঙ্গে অনুগ্রহপূর্বক আমাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিন, যাতে আমরা তাদের কিছু কথা বলতে পারি। তিনি সানন্দে রাজী হলেন এবং বৃহস্পতিবার আমাদেরসহ কিছু বিশিষ্টজনকে দুপুরের দস্তরখানে দাওয়াত দিলেন। আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তাঁর দাওয়াত কবুল করলাম।

মাগরিবের আগে আমরা আনছারুস্-সুন্নাহ দফতরে উপস্থিত হলাম। সেখানে আলী আদলী আলমুরশিদীসহ কতিপয় বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো। তাদের সঙ্গে মুহম্মদ আফিন্দী আব্দুল ওয়াহ্হাব-এর নতুন মিশরস্থ বাসভবনে গেলাম। আফিন্দী আনছারুস্-সুন্নাহ্র একজন সক্রিয় কর্মকর্তা। সেখানে আনছারের আরো কিছু কর্মকর্তা ও শুভানুধ্যায়ীর সঙ্গে দেখা হলো। বিভিন্ন বিষয়ে তাদের সঙ্গে কথা হলো। তারপর রাতের দস্তরখান হলো। সোমবার আবিদীনস্থ জমিয়তের দফতরে দুপুরের দস্তরখানে শরীক হওয়ার ওয়াদা করে আমরা যার যার ঠিকানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।

 

জুমা, ১০/৫/৭০ হি. ১৬/২/৫১ খৃ.

জামে আযহারের জুমা

এখনো পর্যন্ত কায়রোর বড় কোন জামে মসজিদে জুমা আদায়ের সুযোগ আমাদের হয়নি, যাতে জুমাকেন্দ্রিক স্থানীয় রীতি ও আচার-অভ্যাস সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারি। এর প্রয়োজন রয়েছে। কারণ দুঃখজনক সত্য এই যে, প্রত্যেক জনপদেরই নিজস্ব কিছু রীতি-প্রথা ও আচার-অনুষ্ঠান গড়ে উঠেছে যা অন্য জনপদ থেকে ভিন্ন। এগুলোর সঙ্গে দ্বীনের কোন সম্পর্ক নেই, তবে দ্বীনের মধ্যে এগুলোর অনুপ্রবেশ ঘটেছে স্থানীয় লোকাচার থেকে।

তো, এই জুমা আমরা জামে আযহারেই পড়ার চিন্তা করলাম। প্রস্তুতিপর্ব সম্পন্ন করে জামাতের একঘণ্টা আগে আমরা মসজিদে পৌঁছে গেলাম এবং সংক্ষিপ্ত দু’রাকাত সুন্নত আদায় করে বসে পড়লাম। ততক্ষণে লাউড স্পীকারে দরাজ গলায় সুরা কাহফের তেলাওয়াত শুরু হয়ে গিয়েছে। মিশরের জুমার সমাবেশে জোর আওয়াযে এটি তিলাওয়াতের প্রচলন বহু আগে থেকেই চলে আসছে। কারী সাহেব একদুটি আয়াত তেলাওয়াত করেন, আর শ্রোতা উচ্চকণ্ঠে কারী সাহেবের সুরেলা কণ্ঠের প্রতি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে 'দুবারা' তেলাওয়াতের জোরালো আব্দার পেশ করেন। ওয়াহওয়া, মারহাবা, বহুত খূব, এ জাতীয় কর্ণবিদারী শোর-হাঙ্গামার কারণে মনে হচ্ছিলো, আমরা বুঝি হিন্দুস্তানের কোন মেলা-অনুষ্ঠানে আটকা পড়েছি। কারী সাহেবের অবস্থা হলো এই যে, একটা আয়াত এক ভঙ্গিতে পড়েন। তারপর সেটাকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তিনচার ভঙ্গিতে কণ্ঠের আরো কিছু কারুকাজ মিশিয়ে পড়েন, তাতে আর কিছু না হোক তার শিল্পকুশলতার সুন্দর প্রদর্শনী হয়, আর শ্রোতাদের 'বাহারি বাহবা' লাভ হয়। কারী সাহেবের কণ্ঠের ওঠা-নামার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্রোতাদের মস্তক-আন্দোলনের দৃশ্য বেশ দেখবার মতই ছিলো। কিন্তু আমরা সত্যি বড় বিপাকে পড়ে গিয়েছিলাম। না পারছি নফল পড়তে, না পারছি মন দিয়ে তেলাওয়াত শুনতে। আর তেলাওয়াত দ্বারা আত্মিক শান্তি ও প্রশান্তি অর্জন তো অনেক পরের কথা। ভেবে অবাকই হতে হলো যে, আযহারের মত প্রতিষ্ঠানের আলিমগণ তাদের জামে মসজিদে এরকম 'বেহাঙ্গাম' তেলাওয়াত অনুমোদন করছেন কীভাবে, যা কোরআনের আযমাত ও বড়ত্ব এবং মসজিদের আদব ও ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে একেবারেই অসঙ্গতিপূর্ণ! ওলামায়ে আযহার কি ভুলে গিয়েছেন যে, সমগ্র মিশরে তাদের রয়েছে আলাদা ধর্মীয় ভাবমর্যাদা, যেখানকার প্রতিটি আচরণ ও উচ্চারণ শহর, গ্রাম ও পল্লীজনপদের জন্য দ্বীনী সনদ ও ফতোয়া মনে করা হতে পারে!

মোটকথা, মুসলিম জাহানের মর্যাদাপূর্ণ একটি দেশের সবচে’ বড় মসজিদের এই জুমা ও জামাত এমন ছিলো না যাতে 'ইলমসচেতন' কোন মুসলিম শান্তি ও সন্তোষ লাভ করতে পারে।

জুমার পর আমরা শায়খ আমীন আলখাত্তাবের ওখানে গেলাম। সেখান থেকে খাত্তাব ও শায়খ মুহম্মদ ওছমানের সঙ্গে বন্ধুবর আলহাজ আলী মাহমূদ শরীফের গৃহে উপস্থিত হলাম। সেখানে আলিম ও সুধীজনের মজলিস ছিলো। তাদের সঙ্গে দুপুরের দস্তরখানে শরীক হলাম। বেশ আনন্দদায়ক পরিবেশ ছিলো, যা কোন দস্তরখানে খুব কমই পাওয়া যায়। সেখানে শায়খ মুহম্মদ তোয়াহা সাকিতও ছিলেন। তিনি তার নতুন কিতাব درجات الناس عند ملوكهم দারুল উলূম নদওয়াতুল ওলামার কুতুবখানার জন্য হাদিয়া করলেন।

মাগরিবের নামায পড়া হলো আলকাহনা মসজিদে। নিকটস্থ বাজারের কারণে মসজিদটি ছিলো মুছল্লীতে পরিপূর্ণ। শুনলাম, মুছল্লীর আধিক্যের কারণে বড় ও বিশিষ্ট লোকদের জানাযা এখানেই পড়া হয়।

নামাযের পর কাছাকাছি একটি স্থানে ইখওয়ানের কিছু নির্বাচিত ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। তো মসজিদ থেকে বের হয়ে ভাই ইয়াসীন শরীফের সঙ্গে আমরা সেখানে গেলাম। মূলত সেটা ছিলো জনৈক ইখওয়ানী আইনজীবীর দফতর। সেখানে শহীদ শায়খ হাসানুল বান্নার ভাই আব্দুর-রহমান আলবান্নার সঙ্গে অনির্ধারিত ভাবে দেখা হয়ে গেলো। ইখওয়ানের আরো কিছু বন্ধু এসে গেলেন। তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ- যোগ্য ছিলেন জনাব ছালিহ আশমাবী, মুহম্মদ ফরীদ আব্দুল খালিক, সাদুদ্দীন ওয়ালীলী, ছালিহ কাদূর, মুহম্মদ আব্দুল হামীদ ও আব্দুল হাফীয যায়ফী। সবার সঙ্গে বেশ 'আয়োজনপূর্বক'  পরিচয়পর্ব সম্পন্ন হলো। তারপর আলোচনা শুরু হলো।

ইখওয়ানুল মুসলিমীনের কাছে আমার প্রত্যাশা

আজ ইখওয়ানের কতিপয় দায়িত্ব-শীল ব্যক্তির সঙ্গে অনির্ধারিত একটি মজলিসে একত্র হওয়ার সুযোগ হলো। সেখানে ইখওয়ানের আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনার পর্ব শুরু হলো। আমার আলোচনায় আমি বললাম, 'বিভিন্ন আরবদেশ সফর করে এবং সেখানকার সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত হয়ে আমি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, ইখওয়ানুল মুসলিমীনের যে আন্দোলন তা যদি নিজস্ব ধারা ও নীতি অনুযায়ী সুশৃঙ্খল ও সুসংহত কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে যায় তাহলে ইখওয়ান আরবজাহান -কে নৈতিক অবক্ষয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক অরাজকতা এবং ধ্বংসগহ্বরের দিকে ধাবমান অবস্থা থেকে বাঁচাতে পারবে ইনশাআল্লাহ্। এ কারণেই ইখওয়ানকে আমি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখি। তাছাড়া ইখওয়ানের প্রতি রয়েছে আমার অন্তরের গভীর ভালোবাসা। তবে 'প্রেমিক হৃদয় দোলে শঙ্কা ও আশঙ্কার দোলাচলে' এই প্রবাদের আলোকে আমি আমার মনের কিছু চিন্তাভাবনা ও অভিজ্ঞতা, যা ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন সম্পর্কে অধ্যয়নের মাধ্যমে অর্জন করেছি, পরিবারের একজন সদস্য এবং একজন হিতাকাক্সক্ষী ভাই হিসাবে এখানে তা তুলে ধরতে চাই।

তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়

ইখওয়ানের স্বভাবধারা অনুসরণ-কারী যে কোন দাওয়াত ও আন্দোলনের জন্য তিনটি বিষয় বিবেচনায় রাখা খুবই প্রয়োজন। এগুলো যদি যথাযোগ্য গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হয় তাহলেই আন্দোলন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পথে এবং মূল গন্তব্যের দিকে স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে। পক্ষান্তরে এক্ষেত্রে কোন অবহেলা ও শিথিলতা হলে আন্দোলন মাঝপথেই হোঁচট খেতে পারে, এমনকি মুখ থুবড়ে পড়েও যেতে পারে, যার পর -আল্লাহ্ না করুন- হয়ত আবার উঠে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে যাবে।

প্রথম বিষয়: ঈমানী মেহনতের অগ্রাধিকার

হাঁ, সবকিছুর আগে, সাংগঠনিক তৎপরতা, কর্মকুশলতা ও সুব্যবস্থাপনা, এমনকি ক্ষমতামুখী রাজনীতি, এসব কিছুর আগে জরুরি হলো, আমজনতা ও মুসলিম সমাজ এবং নারী-পুরুষ সবার হৃদয়ে ঈমানের বীজ বপন করা। আন্দোলনের নেতা, কর্মী ও কর্মকর্তা সবাই যদি এ কর্ম-পন্থার দীর্ঘতা ও দুর্গমতার বিষয়টি বরদাশত করে আন্দোলনের পথে অবিচল থাকে এবং মেহনত-মোজাহাদা ও প্রয়াস-প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে তাহলে আল্লাহ্ চাহে তো একসময় না একসময় আন্দোলন কামিয়াবি ও সফলতার বন্দরে অবশ্যই পৌঁছবে এবং চারাগাছ সবুজ বৃক্ষ হয়ে সুস্বাদু ফল দিতে শুরু করবে। পক্ষান্তরে আন্দোলনের পরিচালকগণ যদি তাড়াহুড়ার পরিচয় দেন এবং পথ ও মনযিল দ্রুত অতিক্রম করার দুর্বলতায় আক্রান্ত হন, কিংবা কাউম ও মিল্লাতকে ইছলাহ ও সংশোধন এবং তারবিয়াত ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রস্তুত না করেই যদি রাষ্ট্রক্ষমতার চূড়ায় আরোহণ করতে চান তাহলে 'বৃক্ষ’কাঙ্ক্ষ্যত ফলদানে নির্ঘাত ব্যর্থ হবে।

নববী দাওয়াত ও মেহনতের প্রাথমিক পর্যায়ের মধ্যে আমাদের জন্য বড় শিক্ষা রয়েছে। দাওয়াতের প্রথম পর্যায়ে মক্কায় তের বছর ব্যয় হয়েছে, মদীনা মুনাওয়ারায়ও কয়েক বছর পার হয়েছে। নববী যুগে হুকূমত ও রাষ্ট্রকাঠামোর মেয়াদ দাওয়াত ও তাবলীগের মেয়াদের চেয়ে অনেক কম ছিলো। এ বাস্তবতা যদি আমলে না নেয়া হয় তাহলে তা আত্মঘাতী হতে পারে। তো এ দৃষ্টিকোণ থেকে যদি বিচার করি তাহলে সম্ভবত আল্লাহ্ তাআলা ইখওয়ানের দাওয়াত ও আন্দোলনের জন্য খায়র ও কল্যাণেরই ফায়ছালা করেছেন। তাই ইখওয়ানকে আরো কিছু কাল দাওয়াতের প্রথম পর্যায়ে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। অথচ ক্ষমতার দেহলিযে তারা প্রায় পৌঁছে গিয়েছিলো। এ আসমানি ফায়ছালা হয়ত এজন্য হয়েছে যে, দাওয়াতের মেহনত আরো মযবূত বুনিয়াদের উপর স্থিত হোক; নেতা ও জনতা এবং কর্মী ও কর্মকর্তা আরো তারবিয়াত ও প্রশিক্ষণ অর্জন করে আরো বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ এবং আরো পোক্ত ও পোড়খাওয়া হয়ে উঠুক।

সত্য বলতে কী, এটা আল্লাহ্র পক্ষ হতে প্রদত্ত একটি সুবর্ণ সুযোগ। ইখওয়ানের অবশ্য-কর্তব্য হলো এ সময়-সুযোগকে গনীমত মনে করে তা থেকে পূর্ণ ফায়দা ও কল্যাণ অর্জন করা। দাওয়াতের সুসংহত বিস্তার, হৃদয়ের ভূমিতে ঈমানের বীজবপণ, জোরদার ইছলাহী  মেহনত ও তারবিয়াত এবং জাতি ও সমাজের প্রত্যেক স্তরের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলার কাজেই যেন প্রতিটি সময় ব্যয় করা হয়, বিন্দুমাত্র সময়েরও যেন অপচয় না করা হয়।

দ্বিতীয় বিষয়: ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব গঠন

যত বেশী সংখ্যায় সম্ভব এবং যে কোন মূল্যে আন্দোলনের অনুকূলে এমন রিজাল ও আদর্শ ব্যক্তি তৈয়ার করতে হবে যারা দাওয়াত ও আন্দোলনের দায়িত্ব গ্রহণ করবে এবং এর ভার বহন করবে। দাওয়াতের যাবতীয় কর্ম -কাণ্ড তারাই পরিচালনা করবে। সঠিক শিক্ষা-দীক্ষা ও তারবিয়াতের মাধ্যমে আগামী প্রজন্মকে সামনের সময়ের জন্য তারাই গড়ে তোলবে। যতদিন না নতুন মানুষ তৈরী হয়, সমস্ত শূন্যতা তারাই পূর্ণ করে রাখবে।

দাওয়াত ও সংগঠন এবং তাহরীক ও আন্দোলনের ইতিহাসে নির্মম সত্য এই যে, যদি ধারাবাহিক-ভাবে নতুন ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব তৈরীর প্রচেষ্টা ও প্রক্রিয়া অব্যাহত না থাকে তাহলে দাওয়াত ও আন্দোলন এবং সংস্থা ও সংগঠন দৃশ্যত যত মযবূত ও সংহতই হোক ঝুঁকির মধ্যেই থেকে যাবে। কারণ বর্তমানের যোগ্য, বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিগণ একের পর এক বিদায় নিতে থাকবেন। ফলে কাহর্তু-রিজাল ও 'ব্যক্তি-দুর্ভিক্ষ' প্রকট হয়ে সামনে আসবে এবং দেখতে দেখতে ঐ দাওয়াত ও আন্দোলন এবং সংস্থা ও সংগঠন ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে দেউলিয়াত্বের শিকার হবে।

হৃদয় ও আত্মার পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা

তৃতীয় বিষয়টি হলো কালব ও রূহ এবং হৃদয় ও আত্মাকে নিয়মিত খাদ্য ও পুষ্টি যোগানো। কারণ দেহের জন্য যেমন খাদ্য ও পুষ্টির প্রয়োজন, হৃদয় ও আত্মার জন্যও তা তেমনি প্রয়োজন, যদিও উভয়ের চাহিদা ও প্রয়োজন ভিন্ন। এমন আধ্যাত্মিক সাধনা ও মোজাহাদার বন্ধন তৈরী করতে হবে যা দাঈ ও দাওয়াতের কর্মীদের আবেগ ও জাযবা এবং উদ্যম-উদ্দীপনা শুধু বহালই রাখবে না, বরং তাতে উত্তরোত্তর গতি সঞ্চার করবে এবং কর্মের ময়দানে যে শক্তি ও জ্বালানী ব্যয় হবে তার সর্বোত্তম ঘাটতি পূরণের ব্যবস্থা করতে থাকবে। মানুষের দেহ ও আত্মা দুটোই হলো প্রদীপের মত। তেল শেষ হয়ে গেলে তা নিভে যায়। তো প্রদীপের যেমন সমুজ্জ্বল থাকার জন্য নতুন তেলের প্রয়োজন তেমনি মানুষেরও উদ্যম-উদ্দীপনা অব্যাহত থাকার জন্য নতুন জ্বালানীশক্তির খুব প্রয়োজন। বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন এবং দ্বীনী দাওয়াতের গতিপ্রকৃতি ও উত্থান-পতন আমি দেখেছি। ঐ দাওয়াত ও আন্দোলনের নেতা-কর্মী প্রথম দিকে দাওয়াত ও আন্দোলনের জন্য জান দিতেও প্রস্তুত ছিলেন। হাসিমুখে তারা জেলযুলুম ভোগ করেছেন এবং বিভিন্ন প্রকার বিপদ-দুর্যোগ ও প্রতিকূলতার মোকাবেলা করেছেন। কিন্তু অল্প কিছুদিন পরেই দেখা গেলো, তাদের মধ্যে ধীরশিথিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। তাদের ‘অন্তরোষ্ণতা’ ক্রমে শীতল হয়ে আসছে। একসময় তারা ত্যাগ ও কোরবানির পথ থেকে পিছিয়ে আসছে, বরং যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলো সেখানেই ফিরে এসেছে। কেউ কেউ তো যাত্রাশুরুর স্থান থেকেও পিছনে চলে গিয়েছে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, নিজের চোখেই দেখেছি, জীবনের কোলাহলে তারা এমনই হারিয়ে গিয়েছে যে, সাধারণ মানুষ তো বটেই, বাজারী লোকদের চেয়েও তারা নীচে নেমে গিয়েছে।

এর কারণ কী? শুধু এই যে, কালব ও রূহ এবং হৃদয় ও আত্মাকে নিয়মিত খাদ্য ও পুষ্টি এবং শক্তি ও জ্বালানী সরবরাহ করা হয়নি। আবেগ ও জাযবা এবং উদ্যম ও উদ্দীপনার যে প্রাণপ্রদীপ শুরুতে সমুজ্জ্বল ছিলো, তেল ফুরিয়ে আসার কারণে ধীরে ধীরে তার আলো নিভে এসেছে, এমনকি একসময় একেবারেই নিভে গিয়েছে।

জীবনের এসব বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায় যে, সাময়িক জোশ-জাযবা ও আবেগ-উদ্দীপনার কোন মূল্য বা নির্ভরযোগ্যতা নেই। হঠাৎ করে বড় কোন ত্যাগ ও আত্মত্যাগ এবং কোরবানি হয়ত করা যায়, কিন্তু কোন গতিশীল জীবনের জন্য, বা দীর্ঘ মেয়াদি কোন দাওয়াত ও আন্দোলনের জন্য তা ভরসা ও আশ্বস্তির বিষয় হতে পারে না। কামাল তো হবে তখন যখন তা স্থায়ী হবে এবং স্থায়িত্ব লাভ করবে। আর সেটা তখনই সম্ভব হবে যখন কলব ও রূহ এবং হৃদয় ও আত্মাকে সাধনা ও মোজাহাদা দ্বারা সজীব রাখা হবে; যখন যিকির দ্বারা, ঈমানের হালাওয়াত ও মিষ্টতা দ্বারা দিলের জাহানকে আবাদ রাখা হবে।

আলোচনার ধারা অনুসরণ করে একপর্যায়ে আমি বললাম, শায়খ হাসানুল বান্নার জীবনী অধ্যয়ন করলে পরিষ্কার বোঝা যায়,  তাঁর ভিতরে আল্লাহ্প্রদত্ত কিছু যোগ্যতা ছিলো। তিনি এমন এক মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন যাকে আল্লাহ্ তাআলা একটি জামাতের তারবিয়াত ও সংশোধন এবং দাওয়াতের নেতৃত্ব ও পরিচালনার জন্য তৈরী করেছিলেন। যদ্দুর অনুভব করি, তিনি তারবিয়াত ও আত্মিক সংশোধনের যাবতীয় দিক বিবেচনার মধ্যে রাখতেন। তারপরো যে সমস্ত নির্ভরযোগ্য মানুষ তাঁর সান্নিধ্যে ছিলেন তাদের কাছ থেকে তাঁর চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমি ইচ্ছুক।

হাসানুল বান্নার ব্যক্তিত্ব ও আল্লাহ্-প্রদত্ত যোগ্যতা

আমার আগ্রহ প্রকাশের কারণে ইখওয়ানের প্রবীণ নেতা মুহম্মদ ফরীদ আব্দুল খালিক শায়খ হাসানুল বান্নার দাওয়াত ও মেহনতের বিভিন্ন দিক আলোচনা করলেন; রূহানি তারবিয়াতের মাধ্যমে রিজাল তৈরীর প্রতি তাঁর একনিষ্ঠার বিষয় তুলে ধরলেন। সর্বোপরি ইখওয়ানীদের জীবনে তাঁর গভীর প্রভাব এবং তাদের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্কের অবস্থাও বয়ান করলেন। তিনি বললেন, যখন আন্দোলনের বিস্তার ঘটেছে তখনো তিনি ইখওয়ানীদের নাম ধরে জানতেন। শত ব্যস্ততার মধ্যেও দীর্ঘ সময় নিয়ে বিশেষ মনোযোগের সঙ্গে তিনি তাদের ব্যক্তিগত অবস্থা ও পারিবারিক সমস্যার কথা শুনতেন এবং  প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সমাধান দিতেন। এমনকি যখন কাজের গতি ও পরিধি অনেক বেড়ে গিয়েছিলো এবং রাজনীতি ও ব্যবস্থাপনায় অনেক বেশী জড়িয়ে পড়েছিলেন তখনো তিনি একটি দৈনিক পত্রিকার তত্ত্বাবধান করতেন। এমনো হয়েছে যে, কাজের চাপের কারণে রাতের পর রাত বিনিদ্র অতিবাহিত করেছেন। কাজের প্রয়োজনে সচীব, মন্ত্রী ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করেছেন। দীর্ঘ দীর্ঘ সংবাদসম্মেলন করেছেন। সবই করেছেন লাগাতার এবং ক্লান্তিহীনভাবে।

মুহম্মদ ফরিদ আব্দুল খালেক আরো বললেন, শায়খ হাসানুল বান্না অনেক সময় আক্ষেপ করে বলতেন, হায়, কেউ যদি আমার এসমস্ত কাজ ও দায়-দায়িত্ব সামাল দিতো, আর আমি ইখওয়ানের তারবিয়াতি দায়িত্ব পালনের জন্য একাগ্র হতে পারতাম!

মুহম্মদ ফরীদ জামাতের তালীম ও তারবিয়াতের পুরো রূপরেখা অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও হৃদয়গ্রাহী ভাষায় উপস্থাপন করলেন এবং আমি যা কিছু বলেছি তার সঙ্গে একমত পোষণ করলেন। তাঁর সঙ্গীগণও তাঁর বক্তব্য সমর্থন করলেন। তিনি বললেন, ইখওয়ানের বর্তমান নেতৃত্বও আপনার উপস্থাপিত বিষয়তিনটির প্রতি পূর্ণ গুরুত্ব আরোপ করে। এ সম্পর্কে তারা মোটেই উদাসীন নয়। আমার কাছে তিনি প্রস্তাব রাখলেন, যেন পুরো বক্তব্যটি আমি স্মারক ও নির্দেশিকা আকারে তৈরী করে দিই। ইখওয়ানের পক্ষ হতে সেটির ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করা হবে। আমি তাদের প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করে লেখার ওয়াদা করলাম। ইখওয়ানের বন্ধুরা বললেন, এধরনের নিয়মিত দেখাসাক্ষাতের প্রয়োজন রয়েছে। আমিও এ বিষয়ে আমার আগ্রহ ও সম্মতির কথা তাদের জানালাম।

ফরিদ আব্দুল খালেক বুধবার দুপুরের দস্তরখানে দাওয়াত দিলেন। আমরাও তা বে-তাকাল্লুফ কবুল করে নিলাম। মজলিস খতম হলো। প্রত্যেকে অপরের প্রতি ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বের অনুভূতি পোষণ করে ইতমিনান ও সন্তুষ্টির সঙ্গে বিদায় নিলো। আমরাও অন্তরে অত্যন্ত সুখকর স্মৃতি ধারণ করে নিজেদের অবস্থানক্ষেত্রে ফিরে এলাম।

 

১১/৫/৭০ হি. ১৭/২/৫১ খৃ. শনিবার

আজ مطبعة السنـة المحمديـة ছাপাখানায় গেলাম এবং ছাপার জন্য المد والجزر فـي تاريخ الإسلام এর পাণ্ডুলিপি হস্তান্তর করলাম। সেখান থেকে আনছারুস্-সুন্নাহ্র দফতরে গেলাম। কারণ সেখানে কতিপয় বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য পূবর্-নির্ধারিত সময় ছিলো। তাদের সঙ্গে দেখা হলো এবং প্রয়োজনীয় আলোচনা হলো। তারপর আমরা একসঙ্গে মুহম্মদ আফিন্দী আব্দুল ওয়াহ্হাব আলবান্নার নয়া মিশরস্থ বাসভবনে গেলাম। সেখানে শায়খ আব্দুল্লাহ্ বিন আলী ইয়াবিস নাজদীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো, যিনি الرد القويم على ملحد القصيم  (কাছীমের নাস্তিকতার সঠিক জবাব) কিতাবের লেখক। শায়খ আব্দুল্লাহ্র নামের সঙ্গে আগেই পরিচিত ছিলাম। আজ প্রথম দেখা হলো। আলোচ্য কিতাবটি যথেষ্ট পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে, যদিও আমার এখনো দেখার সুযোগ হয়নি। শায়খের সঙ্গে সামান্য যা কথা হলো তাতে সুখকর অনুভূতিই হলো। দুপুরের দস্তরখানে ব্যবস্থা সেখানেই হলো, যা আড়ম্বরমুক্ত ছিলো। আমরা মাগরিবের আগে সেখান থেকে বের হয়ে দারুল কিতাবিল আরাবী গেলাম। ওখান থেকে بَـيْـنَ العَالَـمِ وَجَزيرَةِ العَـرَبএর কিছু নোসখা সংগ্রহ করার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু জানা গেলো, এখনো প্রচ্ছদ ছেপে আসেনি।

 

১২/৫/৭০ হি. ১৮/২/৫১ খৃ. রোববার

যোহর পর্যন্ত হিজাযের বন্ধুদের নামে পত্র লেখা ও উত্তর দেয়ার কাজেই ব্যস্ত ছিলাম। যোহরের পর আনছারুস্-সুন্নাহ্ দফতরে গেলাম। ওখান থেকে শায়খ আব্দুল্লাহ্ বিন আলী ইয়াবিসের গৃহে গেলাম। সেখানেই দুপুরের দস্তরখানে শরীক হলাম। শায়খ আব্দুল্লাহ্ তার কিতাব 'র্আরাদ্দুল কাবীম'র নোসখা হাদিয়া দিলেন। সেখানেই বসে বসে চোখ বুলিয়ে নিলাম। সৈয়দ কুতুবের কিতাব সম্পর্কে যে মন্তব্য লিখেছেন তাও দেখলাম, পছন্দ হলো। কিতাবের বক্তব্য, উপস্থাপন হৃদয়গ্রাহী। লেখা যথেষ্ট ভারসাম্যপূর্ণ। তাতে লেখকের ইলমের গভীরতা, ঈমানের শক্তি এবং চিন্তার ভারসাম্য প্রকাশ পায়।

আমি কাছীম ছাহেবের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। উপস্থিত কেউ কেউ দ্বিমত পোষণ করলেন, তবে গৃহস্বামী আমার চিন্তার সঙ্গে একমত হলেন। আমার আসলে ইচ্ছা ছিলো তার সঙ্গে দেখা করে তার মত ও বিশ্বাস সম্পর্কে সরাসরি তার কাছ থেকে অবগত হওয়া। হয়ত এর মাধ্যমে তার চিন্তাগত বিভ্রান্তির রূপ ও স্বরূপ অনুধাবন করা সম্ভব হবে। কিন্তু সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার জন্য উপযুক্ত কোন মাধ্যম পাওয়া গেলো না; তাই ইচ্ছেটাও আর পূর্ণ হলো না।

শায়খ আব্দুল্লাহ্র বাসগৃহ থেকে আবার আমরা আনছারুস্-সুন্নাহ্ দফতরে গেলাম। সেখানে শায়খ মুহম্মদ হামিদ ফাকীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো, যিনি শায়খ মহাম্মদ বিন ইবরাহীম আলে শায়খের 'বিমারপুরসি'র উদ্দেশ্যে বের হচ্ছিলেন। শায়খ সম্প্রতি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে জীযাস্থ তার বাসগৃহে ফিরে গিয়েছেন। আমি ও মাওলানা ওবায়দুল্লাহ্ বালইয়াবীও শায়খ ফাকীর সঙ্গে বের হলাম। সফল অস্ত্রোপচারের পর শায়খ মুহম্মদ বিন ইবরাহীম প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছেন। আমরা 'বিমারপুরসি'র জন্য এসেছি, শুনে শায়খ খুশী হলেন এবং সুন্দরভাবে তা প্রকাশও করলেন। তিনি এতটাই প্রফুল্ল ছিলেন যে, বিভিন্ন বিষয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা শুরু করলেন। পবিত্র হিজাযের দ্বীনী ও আখলাকি অবস্থা সম্পর্কেও কথা হলো। আমার পুস্তিকাসমগ্র আগেই তিনি পড়েছেন। আমার চিন্তাভাবনার প্রতি মুগ্ধতা ও একাত্মতা প্রকাশ করলেন। একটি জিনিস বড় ভালো লাগে, যে কোন বিষয়ে তাঁর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির প্রকাশটি বড় সুন্দর, স্নিগ্ধ ও কোমল।

আল্লামা মুহম্মদ খিযির হোসায়নের সঙ্গে সাক্ষাৎ

ফেরার পথে আমি ও মাওলানা ওবায়দুল্লাহ্ জমিয়াতুল হিদায়াহ্-এর দফতরের কাছে নেমে পড়লাম। জমিয়ার প্রধান তত্ত্বাবধায়ক তোয়াহা সাকিত ছাহেব আমাদের বলেছিলেন সন্ধ্যা ছয়টায় আসার জন্য। আমরা জমিয়ার সভাপতি এবং কুল্লিয়া উছূলিদ্দীন-এর সাবেক অধ্যাপক শায়খ খিযির হোসায়নের সঙ্গে দেখা করলাম। বিভিন্ন গবেষণাপত্রে অনেক দিন থেকেই তাঁর মূল্যবান প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছাপা হচ্ছে। সেগুলোর সঙ্গে আমাদের পাঠ-পরিচয় ছিলো। ধর্ম ও সাহিত্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞরূপেই তাঁকে আমরা চিনতাম। অসুস্থতার কারণে তিনি যথাসময়ের কিছু পরে এসেছেন বলে দুঃখপ্রকাশ করলেন।

আমার এক প্রশ্নের জবাবে তিনি নিজের সম্পর্কে বললেন, মিশরে আমার ত্রিশ বছর হতে চলেছে। আমি আসলে আলজিরিয়ার বাসিন্দা। জন্ম তিউনিসিয়ায়। মিশরে আসার আগে প্রায় দশবছর সিরিয়া ও অন্যান্য অঞ্চলে ছিলাম। কিছু সময় জার্মানিতেও থাকা হয়েছে। আমার লেখাপড়া যায়তুনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ...

যায়তুনা ও আযহার সম্পর্কে তুলনামূলক প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, বিশালতা, প্রাচীনতা ও উৎকর্ষে আযহার প্রথম, যায়তুনা দ্বিতীয়। বর্তমানে যায়তুনার ছাত্র সংখ্যা দশহাজার, যেখানে তিউনিসিয়ার মোট জনসংখ্যা পয়ত্রিশ লাখের বেশী নয়।

কথাপ্রসঙ্গে তিনি বললেন, কাদিয়ানী মতবাদের উপরও কিছু কাজ তিনি করেছেন। কাদিয়নিয়াত ও কতিপয় কাদিয়ানী ব্যক্তি সম্পর্কে তিনি আমাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করলেন। আমার আলোচনায় নতুন কিছু তথ্য পেয়েছেন, মনে হলো। তিনি তাঁর কিছু রচনা আমাকে হাদিয়া করলেন। সেগুলোর মধ্যে একটি ছিলো তিনখণ্ডের 'রাসাইলুল ইছলাহ'। এটি মূলত ধর্মীয়, সামাজিক ও নৈতিক বিষয়ের প্রবন্ধসঙ্কলন। আরেকটি হলো আদাবুল হারবি ফিল ইসলাম (ইসলামের যুদ্ধনীতি)। তৃতীয়টি হলো তার কাব্যসঙ্কলন খাওয়াতিরুল হায়াত (জীবন-ভাবনা)। চতুর্থটি হলো তাওয়াইফুল কাদিয়ানিয়্যাহ (কাদিয়ানি ফেরকা)। তাঁর রচনাবলী দেখে এবং তাঁর সঙ্গে কথা বলে হিন্দুস্তানের বিভিন্ন বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ আলিমের স্মৃতি অন্তরে জাগ্রত হলো।

সুন্দর কিছু সময় যাপনের পর আমরা নিজেদের ঠিকানায় ফিরে এলাম।

১৩/৫/৭০ হি. ১৯/২/৫১ খৃ. সোমবার

আরবপ্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে

যোহর পর্যন্ত চিঠিপত্রের উত্তর লেখার কাজে ব্যস্ত ছিলাম। এরপর জাদুঘর পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে বের হলাম। আরব প্রত্নতত্ত্বের প্রধান পরিদর্শক হাসান আব্দুল ওয়াহ্হাব জাদুঘরের দোরগোড়ায় আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন। আপন বদান্যতার কারণে তিনি পুরো জাদুঘর আমাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন। কোন্টি কোন্ অঞ্চলের খনন থেকে উদ্ধার করা হয়েছে এবং প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর গুরুত্ব কী, এ বিষয়ে তিনি বিশদ বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাতে আমাদের বুঝ অল্পসল্প হলেও, এটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিলো না যে, নিজের বিষয়ে তার জানাশোনা কতটা বিস্তৃত এবং কতটা গভীর! বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও তার বিবরণের সুবাদে আসলে আমরা মিশরের আরবযুগের ইতিহাস অধ্যয়ন করে চলেছিলাম। বিভিন্ন পাত্র, কাষ্ঠখণ্ড এবং অস্ত্রশস্ত্র যেমন আমরা দেখতে পেলাম, তেমনি এমনকিছু দুর্লভ বস্তুও দেখা গেলো যা ফুসতাতের খননকার্য থেকে বের হয়েছে। সঙ্গত কারণেই আমাদের ধারণা হলো, মিশর জয়কারী ছাহাবা কেরামের আমলের দ্রব্যসামগ্রী হবে। আমাদের ধারণা সমর্থন করে হাসান আব্দুল ওয়াহ্হাব বললেন, এগুলো ফাতেমী যুগের বা তারো আগের। স্থাপত্যকারুকাজ ও নকশার বিভিন্ন নমুনা, বিভিন্ন রঙের মর্মর পাথর, বিভিন্ন আকার ও প্রকারের মৃৎপাত্র, তৈজসপাত্র, পিতলের গায়ে দৃষ্টিনন্দন কাজ, প্রসাধনের নজরকাড়া বিভিন্ন পাত্র ও সমাগ্রী, কফিন ও শবাধার, সুন্দর কারুকাজ সম্পন্ন কাঠের দরজা, স্থানান্তরযোগ্য মেহরাব ও মিম্বর, কার্পেট ও জায়নামাযের দুর্লভ সংগ্রহ এবং অন্য আরো বহু কিছু আমদের অল্প সময়ের দেখার মধ্যে এলো। এর মধ্যে কাঠের কারুকাজের বিভিন্ন নমুনার কথা আলাদা করে বলতেই হয়। সত্যি বড় অদ্ভুত ও বিস্ময়কর! তবে সবচে’ আনূখা ও বিরল যে নমুনা দেখলাম সেটি হলো 'শামাদান' বা মোমের বাতি রাখার অপূর্ব কারুকাজ করা পাত্র। সত্যি বলতে কী, পৃথিবীতে এর তুলনা খুঁজে পাওয়া মুশকিলই হবে।

কাঠের মধ্যে বিভিন্ন কারুকাজের বড় আনূখা ও দুর্লভ নমুনা দেখে আমরা নিশ্চিত হলাম যে, সূত্রধরি শিল্পে তখনকার মিশর অনেক অগ্রসর ছিলো। এককথায় পুরো জাদুঘরটি, আমাদের মনে হয়েছে, অত্যন্ত সমৃদ্ধ। কোন সন্দেহ নেই যে, দুর্লভ সামগ্রীর সংগ্রহপ্রাচুর্যের দিক থেকে মিশরের এই প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর পৃথিবীর বহু জাদুঘরকে ছাড়িয়ে যাবে।

উস্তায আহমদ হাসান যাইয়াতের সঙ্গে সাক্ষাৎ

প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর থেকে বের হয়ে আমরা ঐতিহ্যবাহী গবেষণাধর্মী সাহিত্যপত্রিক 'আর রিসালা'র দফতরে গেলাম। পত্রিকার স্বনামধন্য সম্পাদক, تاريخ الأدب العربـي  এর লেখক আহমদ হাসান যাইয়াতের সঙ্গে দেখা হলো। কয়েকবছর ধরে আমি দারুল উলূম নাদওয়াতুল উলামায় আরবী সাহিত্যের ইতিহাসের অধ্যাপনায় নিযুক্ত ছিলাম। এ কিতাবটি সেখানে ষষ্টবর্ষের পাঠ্যভুক্ত ছিলো এবং আমি নিয়মিত পাঠদান করেছি।  সে সুবাদে কিছু সময় আমি কিতাবটির নিবিড় সংস্পর্শে ছিলাম। লেখকের ভাষাজ্ঞান, রচনাকুশলতা ও সাহিত্যরুচি আমার যথেষ্ট মুগ্ধতার বিষয় ছিলো। লেখকের এ বৈশিষ্ট্যের কারণেই কিতাবটি আরবী ভাষার ইতিহাস ও সাহিত্য উভয়কেই 'পরিবেষ্টন' করেছে, বরং সম্ভবত কিতাবের সাহিত্যগুণ তার ইতিহাসগুণকে ছাড়িয়ে গিয়েছে।

আমি তাঁর সঙ্গে আমার এই জ্ঞানসম্পর্ক ও সাহিত্য-বন্ধনের কথা উল্লেখ করলাম। তাঁর খুশী হওয়াটাই ছিলো স্বাভাবিক। মানুষ যখন তার লাগানো গাছটি সবুজ-সজীব হতে দেখে। তারপর দেখে, গাছের ছায়া এমন বিস্তার লাভ করেছে যে, ভূগোলের সীমারেখা পার হয়ে অন্য দেশেও তার শীতলতা পৌঁছে গিয়েছে, তাতে অবশ্যই সে আত্মিক প্রশান্তি লাভ করে। এটা স্বভাব ও ফিতরতেরই দাবী। তিনি বেশ খোলামনে এবং প্রফুল্লতা নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বললেন। হিন্দুস্তানের দ্বীনী হালাত, ওখানকার মাদরাসাশিক্ষা এবং আরবী ভাষার ভবিষ্যতসম্ভাবনা, এগুলো ছিলো প্রশ্নের বিষয়। তিনি একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছেন, আর আমি যথাসম্ভব গুছিয়ে উত্তর দিয়ে যাচ্ছি। একটু পর পর তিনি বিস্ময় ও মুগ্ধতা প্রকাশ করছিলেন যে, একজন হিন্দুস্তানী, যে নিজ দেশেই আরবী পড়েছে, কীভাবে এমন সাবলীলতা ও স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে আরবীতে কথা বলে যাচ্ছে! আমরা চারজন ছিলাম। তিনি তারীখুল আদাবিল আরাবী, এর একাদশ সংস্করণের তখন আমরা আন্তরিক কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তা গ্রহণ করলাম। এ দেশে এ পর্যন্ত আমরা যত জ্ঞানী-গুণী, লেখক-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে দেখা করেছি তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে বদান্যতা, প্রাণবন্ততা ও সৌজন্যবোধে তাঁর স্থান অতি উঁচুতে। বৈদগ্ধ্য অর্জন করা সহজ, দগ্ধতা অর্জন করা কঠিন।

আমি তাঁকে আমার প্রবন্ধ اسمعي يا مصر  (শোনো হে মিশর) রিসালায় প্রকাশের জন্য হস্তান্তর করলাম, যা মাত্রই কাল-পরশু সমাপ্ত করেছি। তিনি লেখা পড়ছিলেন আর বিস্ময়ের সঙ্গে বলছিলেন, এ আপনারই হস্তাক্ষর? আমারও অবাক হওয়ার বিষয় ছিলো যে, মিশরীয় বুদ্ধিজীবী-সমাজ হিন্দুস্তানী আলিমদের এতটা উপযুক্তও মনে করেন না যে, সুন্দর হস্তাক্ষরে তারা আরবী লিখতে পারে!

যাই হোক, লেখাটি তিনি রিসালায় প্রকাশের সানন্দ প্রতিশ্রুতি দিলেন এবং পরবর্তী সংখ্যায় তা ছাপা হলো। আল্লাহ্র শোকর, মিশরে এবং মিশরের বাইরে, লেখা ও বিষয়বস্তু সাদরে বরণ করা হয়েছে।

এর মধ্যে জনাব সাতি বেগ আলহাছরী এবং আদিল যা‘তীর (যিনি গোস্তাফ লীবানের বই-এর অনুবাদক) আহমদ হাসান যাইয়াতের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তাদের সঙ্গে হালকাভাবে পরিচয়পর্ব শেষ করে আমরা ফিরে এলাম।

এসে দেখি, আযহারী আলিম শায়খ যাইনুল আবিদীন ফারারা আমাদের অপেক্ষায় রয়েছেন। তাঁর দাওয়াতি কার্যক্রমের একটি নিজস্ব পদ্ধতি ও প্রকৃতি রয়েছে। তার চিন্তা ও চিন্তাধারা তাঁকে এতটাই আচ্ছন্ন করে রাখে যে, প্রতিটি বিষয় ও ঘটনাকে তিনি আপন চিন্তার দর্পণে পর্যালোচনা করেন। তাঁর চিন্তার সারমর্ম হলো, পাপের কারণেই শাস্তি হয় এবং কর্মই ভোগান্তির কারণ। সংসারে মানুষ যত কষ্ট ও দুর্ভোগের সম্মুখীন হয়, নিজের পাপের কারণেই হয়। এমনকি পায়ে সামান্য যে কাঁটা বিঁধে, হোঁচট খায় সেটারও কারণ তার কৃতকর্ম।

তিনি আরো বলেন, যিনার কারণে মানুষ কতলের উপযুক্ত হয়ে যায়। তাছাড়া অভাব-দারিদ্র্য এবং বিভিন্ন দুষ্ট ব্যাধিরও কারণ এটা। বাচ্চারা যে বিভিন্ন কষ্টে পড়ে, তা বাবা-মায়ের পাপকর্মের কারণেই হয়। তিনি একটি জামাত তৈরী করেছেন এবং তিনি নিজেই তার প্রধান। তারা ‘শাওকা বিযাম্বিন’ (কাঁটা ও পাপ) নামে পরিচিতি লাভ করেছে। কোন সন্দেহ নেই এই আন্দোলন ও চিন্তাদর্শন এমন দেশ ও জনপদের জন্য উপযোগী ও কল্যাণকর হবে, যেখানে পাপের সীমাহীন বিস্তার ঘটেছে, আর মানুষ পাপাচারে বেপরোয়া হয়ে গিয়েছে।

(চলবে ইনশাআল্লাহ্)

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা