কলিম মুন্সীর হাতে, মনে হলো মিষ্টির হাঁড়ি। দূর থেকে দেখা গেলো, বেশ হেলে দুলে আসছে। সবার মনে খুব কৌতূহল, কী আছে কলিম মুন্সির হাঁড়িতে!
বুশরা (একবার ছেলেদের দিকে, একবার মেয়েদের দিকে তাকিয়ে) ঃ কলিমমুন্সি এসেই তো শুরু করবে বানানের মাতব্বরি! চলো তার আগেই আমরা দু’টো শব্দের বানান শিখে ফেলি। দেখো তো হাঁড়িতে চন্দ্রবিন্দু আছে কি না!
নাফীসা (অভিধান মানে লোগাত দেখে) ঃ আছে গো বুশরা, আছে! এই দেখো, হ-এর মাথায় কেমন সুন্দর চন্দ্র-বিন্দু জ্বলজ্বল করছে, ছোট্ট ছোট্ট দু’টি ‘ ¦’-এর বাতি জ্বালিয়ে। জ্বলতে হলেও লাগে ছোট্ট একটি ‘ ¦’।
নাফীসা ঃ দ্বিতীয় শব্দটি হলো কৌতূহল; হ্রস্ব উ, না দীর্ঘ ঊ?
বুশরা ঃ এটা আমার আগে থেকেই জানা আছে; দীর্ঘ ঊকার। মানুষের, বিশেষ করে মেয়েদের কৌতূহল দীর্ঘ হয় তো! সহজে দমন করা যায় না। তাই প-িতেরা বুদ্ধি করে কৌতূহলে দীর্ঘ ঊকার বসিয়ে দিয়েছেন। এটা কিন্তু আমার ব্যাখ্যা না, সভাপতি হুযূরের নিজস্ব ব্যাখ্যা।
নাফীসা ঃ ব্যাখ্যা-এ বানানটা নিয়ে প্রায় আমার ঝামেলা হয়। মুখস্থ করি, আর ভুলে যাই! লাল কালিতে একটু লিখে দাও তো!
বুশরা ঃ এই যে দেখো তোমার ব্যাখ্যা; লাল কালিতে লিখে দিলাম, তাও আবার বড় বড় হরফে। আসলে ঝামেলা হয় কেন জানো নাফীসা আপু! ঐ যে দু’রকম য-ফলা এর দু’রকম উচ্চারণ!
সুমাইয়া ঃ নিজস্ব (স+ব সংযুক্ত) মানে তো একেবারে নিজের, তাতে অন্য কারো ভাগ নেই। তো কৌতূহল-এর দীর্ঘ ঊকার সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা সেটা সভা-পতি হুযূরের নিজস্ব হলো কীভাবে?!
বুশরা ঃ হুযূর নিজেই বলেছেন। এ ব্যাখ্যাটা তুমি কোন কিতাবে পাবে না। আমি নিজে চিন্তা করে, অনেক মাথা ঘামিয়ে এ ব্যখ্যাটা আবিষ্কার করেছি, রীতিমত মূর্ধন্য-ষ দিয়ে!
নাফীসা ঃ যাই বলো, হুযূরের বুদ্ধিটা...
***
কলিম মুন্সি দুই ঠোঁটের মাঝখানে লম্বা একটা হাসি ঝুলিয়ে জলসায় হাযির। ঠোঁটের লম্বা হাসিটির মতই লম্বা করে সালাম দিয়ে বলে কিনা, ‘অনেক চেষ্টা করলুম; সভাপতি হুযূরের নিদ্রাখানা কিছুতেই ‘ভগ্ন করতে’ পারলুম না! শেষটায় একাই চলে এলুম। আমিও যদি না আসি, তোমাদের বানানের কী হবে গো!
মুসলিম ঃ কলিম চাচা, তোমার ঐ এক দোষ! একেবারে মূর্ধন্য-ষ-ওয়ালা দোষ। তুমি শুধু মেয়েদের দিকে তাকিয়ে কথা বলো। ছেলেদের দিকে তাকাওই না কেন!?
কলিম মুন্সি (হাসিটা আরো লম্বা করে) হে হে, কিছু মনে করো না বাবারা, তেনারা মা-জননীর জাত তো!
মুসলিম ঃ তা তোমার হাঁড়িতে কী মুন্সি চাচা?
কলিম মুন্সি ঃ হে হে মিয়াঁ ভাই, এটা হলো ভূতের হাঁড়ি! এর মধ্যে আছে ছোট্ট একটা ভূতের বাচ্চা!
ভূত, আর ভূতের বাচ্চা! শুনেই সবার গা একদম ছম ছম! ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা ভয় পেলো বেশী! সবক’টি একেবারে জড়োসড়ো। (কানে কানে বলি, ড শূন্য ড়; আর লিখতে হয় একজোড়া বানিয়ে। তা আবার জোড়াতেও কিনা ড শূন্য ড়)।
ছেলেরা ভয়ে ভয়ে বললো, ভূতের বাচ্চা বলে ভয় পাবো নাকি, খোলো ঢাকনা, দেখি তোমার ভূতের বাচ্চা!
মেয়েরা (ভয়ে একেবারে এতটুকুন হয়ে) ঃ না না মুন্সি চাচা! সভাপতি হুযূরের দোহাই, ঢাকনাটা খুলো না। হোক না বাচ্চা, তবু তো ভূত! যদি ঘাড় মটকে দেয়!
কলিম মুন্সি (মেয়েদের ভয় পাওয়া দেখে মজা করে) ঃ কিছু হবে না গো, খুলেই আবার বন্ধ করে দেবো। বের হতে পারবে না।
বুশরা (কলিম মুন্সিকে কাবু করার উদ্দেশ্যে) ঃ তাহলে কিন্তু হুযূরের কাছে নালিশ করবো তোমার নামে।
কলিম মুন্সি (যেন সভাপতি হুযূরের নাম শুনে মোটেই ঘাবড়ে যায়নি!) ঃ কী হবে নালিশে! তাছাড়া তোমরা মেয়েরা তো জানোই না, নালিশে কোন্ শ!
বুশরা ঃ একশবার জানি! আর হোক না দন্ত্য-স তালব্য-শ কিছু একটা। নালিশ হলেই হলো। দেখে নিয়ো, সভাপতি হুযূর কেমন কান মলে দেন। হুঁ, মেয়েদের ভয় দেখানো! এটা কিন্তু হযূর মাফ করবেন না!
কলিম মুন্সি (নিজেও জানে, কথাটা কত বড় সত্য। তাই কিছুটা ছাড় দিয়ে) ঃ আচ্ছা ঢাকনা না হয় খোলবো না, তবে ভূতের বাচ্চা পেলাম কোথায়, সে গল্পটা তো শোনবে!
বশির (ও আবার বুশরার ভাই। ছেলেদের পক্ষ হতে) গল্প শোনাবে শোনাও, আমরা ছেলেরা কিন্তু ভূতের বাচ্চা দেখেই ছাড়বো!
শফিক (কানে কানে) ঃ বললে তো বাহাদুরি দেখিয়ে! সত্যি যদি ঢাকনাটা খুলে দেয়?!
বশির ঃ ভয় পাস কেন, আমি তো আছি তোর পাশে! দরকার হলে একসঙ্গে দৌড় দেবো! আর ভূতের বাচ্চা বুঝি আমাদের সঙ্গে দৌড়ে পরবে! হাজার হোক বাচ্চা তো!
শফীক ঃ না ভাই, আমার বড্ড ভয় করছে। হাজার হোক ভূতের বাচ্চা তো! যতই না লেজ তুলে দৌড় দাও, ঠিকই ধরে ফেলবে আমাদের। তখন ঘাড় মটকে দেবে, কোন সন্দেহ নেই।
কলিম মুন্সি ততক্ষণে গল্প শুরু করে দিয়েছে। শোনো মেয়েরা, শোনো ছেলেরা। সাতদিন আগের কথা! মনে আছে না, কেমন প্রচ- ঝড় হলো! টিনের চাল উড়ে গেলো, গাছপালা সব পড়ে গেলো!!
সেই ঝড়ে পড়েছিলাম আমি কলিম মুন্সি! সে কী ভয়ঙ্কর ঝড়! তাও সামনে ছিলো বিরাট বটগাছটা! রাত বিরেতে এ বটগাছের কাছ দিয়ে যেতে অতি বড় সাহসীরও গায়ে কাঁটা দিতো।
কিন্তু ঝড় বলে কথা! বটগাছের নীচে গিয়েই আশ্রয় নিলুম। ঝড়ের ভয়ে, তার চে’ বড় কথা, ভূতের ভয়ে আমি তখন থরথর করে কাঁপছি।
শফীক ঃ তোমার কাঁপুনিতে কি চন্দ্রবিন্দু ছিলো মুন্সি চাচা।
কলিম মুন্সি ঃ ঝড় তো এমন ছিলো যে, দু’চার দশটা চন্দ্রবিন্দু উড়ে যায়! কিন্তু সভাপতি হুযূরের শিক্ষা বলে কথা! অমন ঝড়টার মধ্যে পড়েও, আর তেমন বটগাছটার নীচে দাঁড়িয়েও কি না মনে ছিলো কাঁপতে হলে চন্দ্রবিন্দু লাগে!
মুসলিম ঃ এখনো তো ভূতের বাচ্চার কথা এলো না, মুন্সিচাচা!
কলিম মুন্সি ঃ আসছে রে আসছে! তো হলো কী! বটগাছটা যখন পড়ো পড়ো, ঠিক তখন ঝুপ করে পড়লো আমার ঘাড়ের উপর!
সবাই একসঙ্গে ঃ কী, পড়লো! কী পড়লো!!
কলিম মুন্সি ঃ আমিও বলি, কী পড়লো! কী পড়লো!! শেষে ভালো করে তাকিয়ে দেখি, জলজ্যান্ত একটা ভূতের বাচ্চা!
(ভূতের ভয়ে ভুলে যেয়ো না, জলজ্যান্ত-এর বানান। প্রথম কথা, একসঙ্গে লিখবে; দ্বিতীয় কথা বর্গীয় জ এবং য-ফলা, আকার।)
কলিম মুন্সি ঃ ভূতের বাচ্চাটা দেখি, ঝড়ে একেবারে জবুথবু!
আমি আর ভয় পাবো কী! ভূতের বাচ্চাটা দেখি নিজেই ভয়ে কাঁদো কাঁদো। বলে কী! মুন্সিচাচা, আমাকে চিনতে পেরেছো! ঐ যে একদিন মাঝরাতে তুমি যাচ্ছিলে বটগাছের ধার দিয়ে, আর আমি কালো বেড়াল হয়ে ভয় দেখালাম! তুমি ‘ভয় পাই না’ বলে দিলে দৌড়! চিনতে পেরেছো, আমি হলাম সেই ভূতের বাচ্চা!
কলিম মুন্সি ঃ আমি বুক ফুলিয়ে বললাম, তোকে আবার চিনবো না! তা পড়বি তো পড়, আমার ঘাড়ে কেন?!
ভূতের বাচ্চা ঃ তোমার চে’ ভালো মানুষ আর কে আছে এ গ্রামে! তাই তোমার ঘাড়েই আশ্রয় নিলুম। ভয় নেই। আমি ছোট্ট বাচ্চা তো, ঘাড় মটকাতে পারি না। ভয় দেখাতে পারি, তবে কথা দিচ্ছি তোমাকে কখনো ভয় দেখাবো না। বানান জলসার ছেলে মেয়েদেরও না। আমি সবার বন্ধু হয়ে থাকবো! আমাকে শুধু একটু আশ্রয় দাও।
কলিম মুন্সি (একটু দম নিয়ে) ঃ ভূতের বাচ্চাটার কথায় মনটা নরম হলো; তাই গলাটা নরম করে বললাম, তোমার মা-বাবা কোথায়!
ভূতের বাচ্চা (কাঁদো কাঁদো হয়ে) ঃ ঝড়ের শুরুতে বিকট আওয়াযে বজ্রপাত হলো না! তাতেই ভূতবাবা, আর ভূতনি মা জ্বলে পুড়ে শেষ!
আমার মনটা তখন একেবারে গলে গেলো। আহা রে! ভূতের বাচ্চা এতীম!
তখন আর কী করি! নিয়ে এলাম ভূতের বাচ্চাকে সঙ্গে করে। ঘরে এসে শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে দিলাম ভূতের বাচ্চাটার ভেজা শরীর। তাতে বেশ আরাম পেলো। আরাম পেয়ে ঘুমিয়েই পড়লো। কিন্তু ওম্মা! এতটুকুন বাচ্চার কী নাকের গর্জন!! যেন ঘরটাই ভেঙ্গে পড়ে!
সকালে দেখি নাস্তা হাজির! আমি তো খুশী! ভূতের বাচ্চা হাত বাড়ায়, আর যা চাই তাই এসে হাজির! বলতে পারো; একটা সপ্তাহ বড় আরামেই কেটেছে!
বুশরা ঃ তা এতদিন পর বুঝি মনে পড়লো বানানজলসার কথা! এদিকে হুযূর যে ...!
কলিম মুন্সি ঃ ভূতের বাচ্চাটা বললো, তোমাদের দেখতে ওর মনটা নাকি বড় পুড়ছে! তাই না হাঁড়িতে ভরে নিয়ে এলুম।
সবাই একসঙ্গে (এখন কারো মনে ভয় নেই) ঃ খোলো ঢাকনা। ভূতের বাচ্চা যদি বন্ধু হয় তাহলে তো ভারি মজা!
কলিম মুন্সি ঢাকনা খুললো। কিন্তু কোথায় কী! না ভূত, না ভূতের বাচ্চা!
কলিম মুন্সি লজ্জা পেয়ে বললো। ছিলো তো হাঁড়িটার ভেতরে! হয়ত বাতাস হয়ে আছে!
না না, ঐ যে আরশোলাটা! ওটাই বোধহয় ভূতের বাচ্চা! আরশোলা দেখে মেয়েরা ভূতের কথা ভুলে আরশোলার ভয়ে পড়ি মরি করে দিলো ছুট! এদিকে ছেলেরা, হুড়াহুড়ি করে আরশোলাটা ধরার চেষ্টা করলো। ভূতের বাচ্চার সঙ্গে আজ বন্ধুত্ব করেই ছাড়বে। কিন্তু আরশোলা ধরা কি অত সোজা!!