রজব ১৪৩৯ হিঃ (৩/৩)

তোমাদের পাতা

বদ খাছলত ও মন্দ স্বভাবের সংশোধন

লিখেছেনঃ হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ তক্বী উছমানী দা.

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 

হামদ ও ছালাতের পর।

প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই কম বা বেশী, কিছু না কিছু বদ খাছলত ও মন্দ স্বভাব রয়েছে, যাকে বলে ‘রাযায়েল’। হযরত থানবী রহ. বলেন, (আত্মসংশোধনের সাধনায় নিয়োজিত) সালিকের কর্তব্য হলো শায়খের ছোহবত ও তারবিয়াত গ্রহণ করে একে একে প্রতিটি মন্দ স্বভাবের সংশোধন করে নেয়া।

একটা মন্দ স্বভাব দমন করার পূর্ণ শক্তি যখন অর্জিত হবে এবং ঐ স্বভাবের প্রকোপ যখন দুর্বল হয়ে আসবে তখন আরেকটা মন্দ স্বভাবের এলাজ ও চিকিৎসা শুরু করবে। তবে কোন মন্দ স্বভাবের ইযালা ও পূর্ণ বিলুপ্তির অপেক্ষা করবে না। কারণ এটা সম্ভবও নয়, জরুরিও নয়; বরং শত চেষ্টার পরেও মন্দ খাছলতের কিছু না কিছু থেকেই যায়, আর থেকে যাওয়ার মধ্যেও  রয়েছে অনেক হিকমত ও কল্যাণরহস্য। (আনফাসে ঈসা ১৩৭ পৃ.)

সালিক অর্থ পথিক। (ইহসান ও তাযকিয়া তথা) তাছাউফের পারিভাষায় সালিক হলো ঐ ব্যক্তি যে নফসের ইছলাহ ও আত্মার সংশোধনের জন্য শায়খের কাছে যায় এবং নিজেকে তার হাতে সোপর্দ করে। যেহেতু সে শর থেকে খায়র এবং মন্দ থেকে কল্যাণের দিকে চলেছে সেহেতু তাকে বলা হয় সালিক বা পথিক।

 

তাছাউফ হচ্ছে আত্মসংশোধনের পথ, আর শায়খ হলেন সেই পথের ‘রাহবার’, যিনি পথ দেখিয়ে দেন যে, এ দিকে যাও, এভাবে যাও। সুতরাং সালিকের কর্তব্য হলো নফসের ইছলাহ তথা আত্মসংশোধনের সাধনার পথে শায়খের পূর্ণ ছোহবত ও তারবিয়াত গ্রহণ করা এবং তাঁর তত্ত্বাবধান ও প্রথনির্দেশনার মাধ্যমে নিজের যাবতীয় বদ খাছলত ও মন্দ স্বভাবের সংশোধ করা।

যেমন ক্রোধ ভয়ানক একটা মন্দ স্বভাব। যার মধ্যে ক্রোধ আছে সে যখন ক্রোধে আত্মহারা হয়ে পড়ে তখন সে কী করে বা করতে পারে সে অভিজ্ঞতা কমবেশী সবারই আছে। তো শায়খের কাছে সে নিজের ক্রোধের সব অবস্থা খুলে বলবে।  শায়খ তার সব অবস্থা জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও চিকিৎসা প্রদান করবেন।

ক্রোধ যেহেতু স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত সেহেতু শায়খের চিকিৎসায় ক্রোধ একেবারে নির্মূল তো হবে না, তবে নিয়ন্ত্রণে এসে যাবে এবং সবসময় তা শরী‘আতের অনুগত থাকবে। তখন সে ক্রোধ প্রকাশ করবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, আবার ক্রোধ দমন করবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। এক কথায় সে ক্রোধের অনুগত হবে না, বরং সে এবং তার ক্রোধ হবে শরী‘আতের অনুগত।

যত মন্দ খাছলত আছে, যেমন নফসের খাহেশাত ও কুপ্রবৃত্তি, অহঙ্কার ও আত্মতুষ্টি এবং কৃপণতা ও দানকুণ্ঠা, এগুলো সবই সৃষ্টিগতভাবে আল্লাহ মানুষের স্বভাবের মধ্যে রেখে দিয়েছেন, যাতে মানুষ যথাসময়ে যথাস্থানে এগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে।

ক্রোধের কথাই ধরুন; মানুষের স্বভাবের মধ্যে যদি ক্রোধের অস্তিত্বই না থাকে তাহলে কীভাবে নিজের ও পরিবার পরিজনের জানমাল ও ইজ্জত আবরুর হেফাযত করবে? ক্রোধ না থাকলে তো দুশমনের হামলার মোকাবেলায় তার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়াই হবে না। যখন কারো জানমাল বা ইজ্জত আবরুতে হস্তক্ষেপ হয় তখন প্রথমে তার মধ্যে ক্রোধ জাগ্রত হয়, তারপর অন্যায় হস্তক্ষেপ প্রতিহত করার চিন্তা ও চাহিদা তার মধ্যে জাগ্রত হয় এবং সে যালিমের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যদি ক্রোধই না থাকে তাহলে তো এগুলো কিছুই হবে না।

এক নবাবের ঘটনা

আমার আব্বাজান হযরত মাওলানা মুফতী মুহম্মদ শফী ছাহেব রহ. একটি ঘটনা বলতেন, এক নবাবের বদ্ধমূল অভ্যাস ছিলো সব কাজ সময়মত করা, নির্ধারিত সময়ের আগে বা পরে ঐ কাজ না করা, তাতে দুনিয়া এধার সে ওধার হয়ে যাক, কুছ পরোয়া নেই।

তো ঘুমের জন্য তার নির্ধারিত সময় ছিলো ছয় ঘণ্টা। কখনো যদি নির্ধারিত সময়ের আগে চোখ খুলে যেতো, নির্ধারিত সময় পূর্ণ করে তবেই তিনি বিছানা থেকে নামতেন। কারণ ‘নিয়মের ঘড়ি’ হিসাবে তিনি তো তখন ঘুমিয়ে আছেন! একদিন নবাব সাহেব নির্ধারিত সময়ের আগে জেগে গেলেন এবং নিয়ম মেনে বিছানায় পড়ে থাকলেন। এরমধ্যে চোর এসে মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে গেলো। নবাব সাহেব দেখেও দেখলেন না। কারণ নিয়মের ঘড়িতে তার তো তখন ঘুমিয়ে থাকার কথা!

যখন সময় পূর্ণ হলো তিনি উঠে চিৎকার জুড়ে দিলেন। খাদেম লস্করের দল ছুটে এলো। সবশুনে তারা অবাক হয়ে জানতে চাইলো, আপনি যখন সব দেখেছেন তখন আওয়ায দেননি কেন? তিনি আরো অবাক হয়ে বললেন, আওয়ায দেবো কীভাবে, আমি তো তখন নিয়মের ঘুমে ছিলাম!

দেখুন, নিয়ম ছিলো তার নবাব, আর তিনি ছিলেন সেই নবাবের নওকর। নিয়মকে তিনি এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন যে, আত্মরক্ষার যে স্বাভাবিক ইচ্ছা ও প্রবণতা সেটাও বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো নিয়মের সামনে।

ক্রোধের উপযুক্ত ব্যবহার

এই ক্রোধ ও গায়রত আল্লাহ তা‘আলা মানুষের স্বভাবের মধ্যে এ জন্য রেখেছেন যে, প্রয়োজনের সময় একে সে কাজে লাগাবে। যেমন বিপদ থেকে, যুলুম অত্যাচার থেকে নিজেকে এবং পরিবার পরিজনকে রক্ষা করা। তবে ক্রোধ যদি সীমা অতিক্রম করে; যদি স্থান-কাল-পাত্র না বুঝে এবং শরী‘আতের আদেশ-নিষেধ মান্য না করে ক্রোধ প্রকাশ করে বা গায়রত দেখায় তাহলে সেটা হবে ক্রোধ ও গায়রতের ভুল ব্যবহার ও অন্যয় প্রয়োগ, যা সম্পূর্ণ হারাম।

মোটকথা, ক্রোধ ও গায়রত প্রকাশের কিছু জায়েয এবং কিছু নাজায়েয ক্ষেত্র রয়েছে। জায়েয ও বৈধ ক্ষেত্রে ক্রোধের প্রকাশ মন্দ নয়, বরং সেটাই করণীয়।

মা-বাবা সন্তানকে শাসন করবেন; উস্তায শাগিরদকে এবং শায়খ তার মুরীদকে তারবিয়াত করবেন যাতে প্রত্যেকেরই প্রয়োজনীয় সংশোধন হয়ে যায় এবং মন্দ খাছলাত দমিত হয়ে নিয়ন্ত্রণে এসে যায়, এটাই হলো শরী‘আতের মূল মাকছাদ ও উদ্দেশ্য। এসকল ক্ষেত্রে রাগ বা অসন্তষ্ট না হওয়াই বরং অস্বাভাবিক ও ক্ষতিকর। শুধু মনে রাখতে হবে ক্রোধ, গায়রত ও অসন্তুষ্টি যেন বৈধতার সীমা অতিক্রম না করে। সেটা অবশ্যই মন্দ ও নিন্দনীয়। যেমন কেউ আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলো। এখন সে আপানার মেহমান। আর শেষ পর্যন্ত মেহমানের সঙ্গে সৌজন্য রক্ষা করা হলো শরী‘আত ও শারাফাতের দাবী। অথচ আপনি কারণে বা অকারণে তার সঙ্গে রূঢ় আচরণ করলেন। তাকে কষ্টদায়ক কথা বললেন। তো এটা অবশ্যই নিন্দনীয় ও বর্জনীয়।

তো শায়খের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো এমন তারবিয়াত করা যাতে ক্রোধ দমন করার শক্তি অর্জিত হয়, যাতে ক্রোধের সঠিক ক্ষেত্র ও ভুল ক্ষেত্র বুঝে আসে।

তোমার মধ্যে যেহেতু রাগ ও ক্রোধ পূর্ণ মাত্রায় রয়েছে, অথচ ক্রোধ দমনের ও সংযমের শক্তি নেই এবং ক্রোধ প্রকাশের সঠিক ক্ষেত্র ও সঠিক মাত্রা জানা নেই সেহেতু তোমার অবশ্য কর্তব্য হলো শায়খের কাছে নিজের সব অবস্থা তুলে ধরা এবং এলাজ ও তারবিয়াতের জন্য নিজেকে তার হাতে সোপর্দ করা।

এমন যদি হয় যে, নিজেও বুঝতে পারো, কখন, কোন্ অবস্থায় এবং কার ক্ষেত্রে ক্রোধ সীমালঙ্ঘন করে তাহলে সেটাও শায়খের সামনে পেশ করো। তিনি ঐ অবস্থার উপযোগী চিকিৎসা, ব্যবস্থা ও তারবিয়াত দান করবেন। তোমরা কাজ হবে শুধু চিকিৎসা গ্রহণ করা, পথ্য ও বাছ মেনে চলা। ইনশাআল্লাহ একসময় তুমি আরোগ্য লাভ করবে এবং কামিয়াব হবে।

হিংসা-হাসাদেরও এলাজ ও চিকিৎসা প্রয়োজন

ক্রোধের মত হিংসা ও হাসাদও মানুষের স্বভাবের মধ্যে বিদ্যমান এক মারাত্মক ব্যাধি। যে কারো মধ্যে, যে কোন মাত্রায় এটা থাকতে পারে। যার মধ্যে এ ভয়ানক ব্যাধি আছে তার অবশ্য কর্তব্য হলো শায়খকে নিজের যথাযথ অবস্থা জানানো যে, আমার অবস্থা হলো এই কারো তারাক্কী ও উন্নতি দেখলে অন্তরে জ্বলন হয়। অমুকের ভালো হোক, সুখ-শান্তি হোক এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারি না; বরং ক্ষতি ও অবনতি দেখলে মন খুশী হয়। ...

শায়খ তোমার অবস্থা শুনে যে এলাজ ও চিকিৎসা দেবেন। তোমার শুধু কর্তব্য হবে হুবহু তা পালন করা এবং নিয়মিত নিজের অবস্থা শায়খকে জানাতে থাকা।

তদ্রƒপ কারো মধ্যে যদি নফসের খাহেশাত ও প্রবৃত্তির চাহিদা সীমা পার হয়ে যায় তাহলে অবশ্যই শায়খকে জানাবে এবং চিকিৎসা গ্রহণ করবে। কারণ এগুলো কলবের বড় খতরনাক ব্যাধি ও মরয। যথাসময়ে যাথাযথ চিকিৎসা না হলে এগুলো তাবাহি ও বরবাদি ডেকে আনে, শারীরিক রোগ-ব্যাধির ক্ষেত্রে যেমন।

একই ভাবে বড়াই, অহঙ্কার ও তাকাব্বুর খতরনাক ব্যাধি ও বিমারি। অহঙ্কার মানে কী? তাকাব্বুর মানে কী? নিজেকে বড় মনে করা, অন্যকে নিজের চেয়ে ছোট মনে করা এবং একারণে তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা। যা কিছু নেয়ামত, সেগুলোকে আল্লাহর দান মনে না করে নিজের মেধা ও যোগ্যতা দ্বারা অর্জিত মনে করা। ...

এটা এমনই সূক্ষ্ম ও চোরা রোগ যে, অনেকে নিজে তা অনুভব করতে পারে না। সুতরাং নিজে বুঝতে পারুক, বা কেউ ধরিয়ে দিক, তোমার কর্তব্য হবে সঙ্গে সঙ্গে শায়খকে তা জানানো এবং নিজের সব অবস্থা খুলে বলা এবং কী করণীয়, জেনে পূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে তা পালন করা।

শায়খের কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্য যেন শুধু হাত ধরে বাই‘আত হওয়া, আর কিছু আমল-অযিফা ও যিকিরের নিয়ম জেনে নেয়াই না হয়, যেমন অনেকেই মনে করে।

খুব ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে যে, যিকির-অযিফা ও তার বিশেষ নিয়ম এগুলো আসল উদ্দেশ্য নয়; এগুলো আসল উদ্দেরেশ্য পথে, অর্থাৎ ইছলাহে নফস ও আত্মসংশোধনের পথে পাথয়ে ও মাধ্যম মাত্র। আসল উদ্দেশ্য তো হলো সমগ্র জীবন সম্পর্কে চিন্তা করা এবং সকাল থেকে সন্ধ্যা প্রতিটি আমল তথা আচরণ ও উচ্চারণের হিসাব রাখা; নিজের ভিতরের রোগ-ব্যাধি ও বিমারি খুঁজে বের করা এবং শায়খের ছোহবত ও তারবিয়াত এবং এলাজ ও চিকিৎসার মাধ্যমে তা থেকে মুক্ত হওয়ার নিরন্তর চেষ্টা-মেহনত ও মোজাহাদা করে যাওয়া।

শায়খ যে চিকিৎসা দেবেন সেটা যেমন হুবহু মানতে হবে, তেমনি যদি চিকিৎসার বিষয়ে কোন অবহেলা অলসতা এসে যায়, সেটাও শায়খকে জানাতে হবে।

শায়খের প্রতি আনুগত্য

হযরত হাকীমুল উম্মত থানবী রহ. খুব জরুরি একটা বিষয় এভাবে বলেছেন, সালিকের অবশ্যকর্তব্য হলো দু’টি। ইত্তেলা ও ইত্তেবা। ইত্তেলা মানে হলো নিজের সব অবস্থা শায়খকে জানাতে থাকা, আর ইত্তেবা মানে হলো শায়খ যে পথে যেভাবে চলতে বলবেন সে পথে ঠিক সেভাবে চলতে থাকা। এভাবেই শুধু নফসের ইছলাহ এবং আত্মার সংশোধন হয়। অথচ এখন তো আমরা তাসাউফ ও তরীকতকে (কোরআন-সুন্নাহর পরিভাষায় যার নাম ইহসান ও তাযকিয়া) এটাকে আমরা নিছক রসম-রেওয়াজ ও প্রথা-প্রচলন বানিয়ে নিয়েছি যে, অমুক শায়খের হাতে বাই‘আত হয়েছি তো ব্যস, আর চিন্তা কী? খুব বেশী হলে শায়খের বাতানো আমল-অযিফা এবং যিকির-তাসবীহ করা, ব্যস এরপর তো ছুট্টি, আর কোন কাজ নেই।

না মেরে ভাই না! আমার আব্বাজান রহ. তো বলতেন, ভিতরের বদখাছলতের সংশোধন না করে আমল-অযিফা ও যিকির-তাসবীহ পালন করলে অনেক সময় উল্টো ক্ষতির কারণ হতে পারে।

শরীরের রোগ-ব্যাধির ক্ষেত্রে যেমন প্রয়োজনীয় চিকিৎসার মাধ্যমে আরোগ্য লাভ করার আগে শক্তিবর্ধক খাদ্য গ্রহণ ক্ষতিকর হয়, বরং তাতে রোগ বেড়ে যায়, এমনকি মৃত্যুরও কারণ হয়। তাই আগে উপযুক্ত চিকিৎসা, তারপর শক্তিবর্ধক খাবার, এটাই হলো নিয়ম।

কলব ও দিলের বিমারির ক্ষেত্রেও একই কথা। ভিতরে যদি তাকাব্বুর ও অহঙ্কারের বিমারি থাকে, আর ঐ অবস্থায় আমল, অযীফা খুব চালাতে থাকে তাহলে তাকাব্বুর আরো বেড় যায়; নিজেকে সে কামিল, বুযুর্গ ও মহাত্মা ভাবতে শুরু করে।

তাহলে কী হলো? আমল ও যিকির দ্বারা ফায়দা হওয়ার পরিবর্তে তাকাব্বুর বেড়ে গিয়ে আরো বড় ক্ষতি হলো। তাই সঠিক তারতীব হলো ভিতরের বদখাছলত ও মন্দ স্বভাব দূর করা, তারপর আমল-অযিফায় মশগুল হওয়া।

বদখাছলত স্বভাবগত হওয়ার প্রমাণ

হযরত থানবী রহ. বলেন, যে কোন বদ খাছলত আসলে মানুষের স্বভাবগত। তাই ছোট শিশুদের মধ্যে, যারা ফিতরত ও স্বভাবের খুব নিকটে আছে, তাদের মধ্যেও সেগুলো দেখা যায়। শিশুর মধ্যে রাগ ও ক্রোধ আছে, কৃপণতা ও স্বার্থপরতা আছে, হাসাদ-হিংসা আছে; সবই আছে।

মোটকথা, এগুলো হচ্ছে মানুষের স্বভাবগত গুণ বা দোষ। তবে এগুলো কখনো নিজে নিজে শেষ হয়ে যায় না, বরং বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এগুলো ভিতরে ভিতরে জোয়ান ও জোরদার হতে থাকে।

এজন্য কঠিন চিকিৎসার প্রয়োজন। আবার চিকিৎসা দ্বারা এগুলো নির্মুল হয় না, নিয়ন্ত্রণ ও সংযমের মধ্যে আসে মাত্র।

হযরত থানবী রহ. বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ‘বদখাছলত দূর করার অর্থ হলো তা দুর্বল করা। অর্থাৎ রিয়াযাত- মোজাহাদা ও সাধনার মাধ্যমে (ভিতরে এমন শক্তি অর্জন করা যাতে) বদখাছলতের মোকাবেলা করতে আগের মত কষ্ট না হয়। দুনিয়ার সব কাজের ক্ষেত্রে যে নিয়ম-রীতি দ্বীনের কাজগুলোর ক্ষেত্রেও একই উছূল, একই নিয়ম। দুনিয়াতে কঠিন থেকে কঠিন কাজ নিয়মিত মশক ও অনুশীলন দ্বারা আসান ও সহজ হয়ে যায়। দ্বীনের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। পাঁচওয়াক্ত নামায,

অভ্যাস না থাকার কারণে আদায় করা কত কঠিন! মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে আদায় করা তো আরো কঠিন! আরো কষ্টকর!! কিন্তু ধীরে ধীরে অভ্যাস করে নিলে (এবং আজর ও ছাওয়াবের কথা চিন্তা করলে) তা সহজ হয়ে যায়, মসজিদে গিয়ে জামাতে শরীক হওয়াও তেমন কষ্টকর মনে হয় না। নিয়মিত অভ্যাসের কারণেই তো এটা হয়। তবে

নিয়মিত অভ্যাসের কারণে কষ্ট কমে গেলেও কিছুটা কষ্ট তো এর পরও হয়, হতে পারে। নামাযের আজর, ছাওয়াব ও পুরস্কার তো এই কষ্টেরই প্রতিদান! অনন্ত জীবনের সুখ-শান্তি পেতে হলে কিছু কষ্ট ও মেহনত তো করতেই হবে। তবে ইনশাআল্লাহ মোজাহাদা দ্বারা কষ্ট ক্রমে কমে যাবে।

সমস্ত মন্দ খাছলত ও স্বাভাবের ক্ষেত্রেও একই কথা। যেমন ক্রোধ শুরুতে এত ভয়ানক থাকে যে, সামান্যতেই বারুদের মত জ্বলে উঠতো; ইচ্ছের বিরুদ্ধে সামান্য কিছু হলেও রেগে আগুন হয়ে যেতো; ঘরে বাইরে সবার সঙ্গে কথায় কথায় রূঢ় আচরণ হতো। তারপর রাগ পড়ে গেলে এমন শরমিন্দা হতো, এমন আফসোস করতো যে, ব্যস!

যখন নফসের ইছলাহ ও সংশোধনের জন্য তাছাউফের পথে চলতে শুরু করলো তখন (শায়খের ছোহবত ও তারবিয়াতের বরকতে) বুঝ হয়ে গেলো যে, রাগ ও ক্রোধ কত ভয়ানক দোষ, কত খতরনাক বিমারি! ভুল ক্ষেত্রে ক্রোধ প্রকাশ করা কত বড় গোনাহ ও বরবাদির কারণ!!

তারপরো রাগ উঠে যেতো এবং ক্রোধে আগুন হয়ে যেতো, তবে ধীরে ধীরে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা দমন করতে সক্ষম হতো। তাতে অনেক কষ্ট হতো। মনে হতো ভিতরটা যেন ফেটে যায়। কিন্তুু মেহনত মোজাহাদা ও সাধনা অব্যাহত ছিলো। ফলে একসময় এমন হলো যে, ক্রোধ দমন করতে আর তেমন কষ্ট হয় না, বরং আল্লাহর রহমতে তাতে একধরনের আত্মিক শান্তি ও প্রশান্তি বোধ হয়।

ক্রোধের মত হিংসা-হাসাদও ভয়ানক বিমারি। কিন্তু বিজ্ঞ শায়খের তত্ত্বাবধানে যদি রিয়াযত-মোজাহাদা করা হয় ধীরে ধীরে তা এতই নিয়ন্ত্রণে এসে যায় যে, কারো উন্নতিতে মুখে খুশী প্রকাশ করা আর কঠিন থাকে না, এমনকি এক-সময় অন্তরের অশান্তিও থাকে না এটা ভেবে যে, এ নিয়ামত তো আল্লাহ তার বান্দাকে দান করেছেন! মেহনত  মোজাহাদার মাধ্যমে এরূপ চিন্তা করাও একসময় সহজ হয়ে যায়।

নফসের খাহেশাতের এলাজ

একই ভাবে নফসের খাহিশাত ও প্রবৃত্তির চাহিদা বড় খতরনাক ও বিপজ্জনক ব্যাধি বা বিমারি, যা প্রয়োজনীয় এলাজ ও চিকিৎসার মাধ্যমে দমন করা না হলে বড় বড় বিপদ-বরবাদি ডেকে আনে।

বদ নযর ও বদচিন্তা দ্বারা ক্ষণিক ও সাময়িক আনন্দ লাভ করা, এতেই তো তার নফস অভ্যস্ত ছিলো, যেমন অসুস্থ মানুষ কুপথ্যে আগ্রহী এবং সুপথ্যে অনাগ্রহী হয়।

যখন নফসের ইছলাহ ও সংশোধনের জন্য তাছাউফের পথে অগ্রসর হলো তখন তার বোধোদয় হলো এবং পূর্ণ উপলব্ধি হলো যে,খাহেশাতের পথে চলা কত বড় গোনাহ! কত বড় খাসারা ও বরবাদির কারণ, আর তা থেকে বাঁচার চেষ্টা করা কত জরুরি!!

এরপর বদনযরের সুযোগ এসে গেলে ইচ্ছে তো হয় নযরের খেয়ানত করার এবং ক্ষণিকের লজ্জত হাছিল করার, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর ভয় জেগে ওঠে, ক্ষতি ও বরবাদির কথা মনে পড়ে, আর ভাবে যে, আমি তো আত্মসংশোধনের পথে আছি; আমাকে তো মনযিলে মাকছূদে পৌঁছতেই হবে; এই পিচ্ছিল পথে আমাকে তো সতর্কতার সঙ্গে চলতে হবে!! তো প্রথমে খুব কষ্ট হবে; মনে প্রচ- ঝড় ওঠবে; দিলের উপর খঞ্জর চলবে; ভিতরের পশুটা ক্ষতবিক্ষত হবে, তখন যদি এভাবে অবিচল থাকে যে, প্রতিজ্ঞা যখন করেছি, নফসের কাছে আর পরাস্ত হবো না ইনশাআল্লাহ!

এভাবে খাহেশাতের ছোবল থেকে  নযর ও চিন্তার হেফাযত করা, প্রথমবার যত কষ্ট হবে, দ্বিতীয়বার কষ্ট তার চেয়ে কম হবে; তৃতীয়বার কষ্টটা আরো কমে যাবে। একসময় তো অবস্থা এমন হবে যে, নফসের উপর বিজয় অর্জনের প্রশান্তি অন্তরের গভীরেও অনুভূত হবে। স্বভাব ও অভ্যাস তখন ভারসাম্যপূর্ণ হয়ে যাবে। তখনো খাহেশাত ও প্রবৃত্তি কিছু না কিছু  থেকে যাবে, তবে নিজেকে সম্বরণ করা এবং সংযম রক্ষা করা আর তেমন কষ্টকর মনে হবে না। কারণ অব্যাহত মোজাহাদার মাধ্যমে নফস ও তার চাহিদা তখন দুর্বল হয়ে যাবে।

তাই হযরত থানবী রহ. বলেন, ‘বদখাছলত দূর করার অর্থ হলো তা দুর্বল করে ফেলা, আর দুর্বল করে ফেলার অর্থ হলো তা দমন ও নিয়ন্ত্রণ করতে আগের মত কষ্ট না হওয়া। তাছাউফের পরিভাষায় এটাকে বলে ‘ইযমিহলাল’ (নফসের নির্জীবতা)।

সাধনা ও মোজাহাদা করে করে মানুষ আত্মসংযমের যত চূড়া ও চূড়ান্তেই উপনীত হোক, নফসের খাহেশাত ও প্রবৃত্তি তার মধ্যে কিছু না কিছু থেকেই যাবে; খাহেশাতের ফনা তখনো ছোবল মারতে চাইবে, তবে পার্থক্য হবে এই যে, এটা দমন করতে আর আগের মত কষ্ট হবে না; আগে যেমন বারবার পরাস্ত হতো, এখন তা হবে না। খাহেশাতকে দমন করতে এখন আগের মত মোজাহাদাও করতে হবে না।

হযরত থানবী রহ. এ বিষয়টিই এখানে বলেছেন যে, মোজাহাদা ও সাধনা দ্বারা নফসের রোগ-ব্যাধি, মরয ও বিমারি দূর হয় না, তবে দুর্বল হয়ে যায়। অর্থাৎ তবিয়ত ও স্বভাবের মধ্যে রোগ-ব্যাধির মূল উপাদন তো থেকে যায়, তবে মোজাহাদা ও সংযম সাধনা দ্বারা তা এতটা দুর্বল ও কমযোর হয়ে যায় যে, মানুষকে গোনাহের কাজে আর প্ররোচিত করা যায় না এবং মানুষও নফসের ডাকে আগের মত সাড়া দেয় না।

হিরছ ও লোভের এলাজ

তদ্রƒপ মানুষের স্বভাবের মধ্যে সম্পদের প্রতি মোহ ও আসক্তি রয়েছে, যাকে বলে হুব্বে মাল। কোরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘মানুষের জন্য শোভিত করা হয়েছে কাম্যবস্তুর প্রতি আসক্তিকে, হোক তা নারী ও পুত্রসন্তান এবং হোক তা সোনা-রূপার স্তূপ ও নিশানদার ঘোড়া ...!

 

তবে এই আসক্তি ও মোহ, এটাকে যদি সঠিক ক্ষেত্রে সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করা হয় তাহলে তা তেমন মন্দ কিছু নয়।

মর্যাদার সঙ্গে জীবন যাপনের জন্য, পরিবার-পরিজনের প্রাপ্য পূর্ণ করার জন্য এতটা সম্পদাকাক্সক্ষা অবশ্যই থাকতে হবে যাতে সে উপার্জনে পূর্ণ আগ্রহ বোধ করে এবং পরিশ্রমে উদ্বুদ্ধ হয়। কিন্তু এমন সীমাহীন লোভ ও লালসা অবশ্যই চরম নিন্দনীয় ও বিপজ্জনক যার কথা হাদীছ শরীফে এসেছে

‘মানুষ যদি এক উপত্যকা পরিমাণ স্বর্ণও পেয়ে যায় তাহলে সে দ্বিতীয় উপত্যকার লোভ করবে, দ্বিতীয়টার পরে লোভ করবে তৃতীয়টার। আসলে আদমের বেটার উদর কবরের মাটি ছাড়া অন্য কিছু পুরা করতে পারে না।

সম্পদের প্রতি, দুনিয়ার কোন জিনিসের প্রতি এধরনের লোভ, মোহ ও আসক্তি সম্পূর্ণ হারাম। কেননা তা মানুষকে ন্যায় ও সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত করে এবং হারাম-হালালের পার্থক্য ভুলিয়ে দেয়।

লোভের কয়েকটি স্তর রয়েছে। প্রথম স্তর মানুষকে এমন পথে মাল কামাই করতে এবং ধন-সম্পদ অর্জন করতে প্ররোচিত করে যা একেবারে হারাম।

লোভের দ্বিতীয় স্তর মানুষকে প্রতক্ষ হারাম পথে যেতে তো প্ররোচিত করে না, তবে নিজস্ব যুক্তি ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে হারামকে হালাল করিয়ে মানুষকে তাতে লিপ্ত করে। সাধারণভাবে দ্বীনদার মানুষই এর খপ্পড়ে পড়ে থাকে। আমার আব্বাজান রহ. বলতেন, মৌলভীর শয়তানও মৌলভীর বেশ ধারণ করে থাকে। কারণ সে জানে, কাকে কীভাবে ধোকা দিতে হয়, কাকে কোন কৌশলে ভ্রষ্ট করতে হয়। আলিম ও দ্বীনদার তো প্রকাশ্য হারামে লিপ্ত হবে না তাই নফস ও শয়তান বিভিন্ন দলীল-ব্যাখ্যা হাজির করে যে, এটা তো একারণে জায়েয! এভাবে সত্যের আবরণে মিথ্যা এবং হালালের পর্দায় হারাম তিনি কবুল করে নেন। বুঝতেও পারেন না যে, আসলে তিনি নফস ও শয়তানের ধোকায় পড়েছেন এবং তার পাতা ফাঁদে পা রেখেছেন।

লোভের তৃতীয় স্তর এই যে, ধন-সম্পদ সে হাছিল করে, তবে না প্রকাশ্য হারাম পথে, না দলীল-ব্যাখ্যার বাঁকা পথে। হালাল ও বৈধ পথে আল্লাহ তাকে যতটুকু দান করেন তাতেই সে সন্তুষ্ট থাকে। এ স্তরের লোভ বা সম্পদের প্রতি লিপ্সা নিন্দনীয় নয়। তাতে না গোনাহ আছে, না ক্ষতি আছে।

কৃপণতার ব্যাধি

লোভের মত বুখল ও কৃপণতাও এক খতরনাক মরয, বিমারি ও ব্যাধি। স্বয়ং আল্লাহ কুরআনুল কারীমে বলেছেন, মানুষের স্বভাব ও ফিতরতের মধ্যে কৃপণতার উপাদান রেখে দেয়া হয়েছে।

এ কারণেই সম্পদের প্রতি কিছু না কিছু টান ও পিছুটান সে অনুভব করে। তবে যতক্ষণ না এটা তাকে আল্লাহ তা‘আলার আদিষ্ট পথে, কল্যাণকর্মে এবং দায়-দায়িত্ব ও ফরয হক আদায়ের ক্ষেত্রে খরচ করা থেকে বিরত রাখে এবং যতক্ষণ না মাল বাঁচানোর জন্য কোন অন্যায় পথ অবলম্বন করে ততক্ষণ কৃপণতা নিন্দনীয় নয়, বরং এটাকে বলা হবে মানবীয় দুর্বলতা ও ফিতরী কমযোরি।

হাঁ, বুখল ও কৃপণতার কারণে যদি আল্লাহর আদিষ্ট পথে খরচ না করে, আল্লাহর হক ও বান্দার হক আদায় না করে তাহলে এ বুখল ও কৃপণতা অবশ্যই নিন্দনীয়, হারাম ও সর্বনাশের কারণ।

হাদীছ শরীফে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ অবশ্যই পছন্দ করেন যেন বান্দার মধ্যে তাঁর দেয়া নেয়ামতের আলামত ও চিহ্ন প্রকাশ পায়।

সুতরাং যাবতীয় নেয়ামতের সুন্দর, সঠিক ও তরীকামত প্রকাশ পাওয়া উচিত। নচেৎ সেটাও হয়ে যাবে না-শোকরি ও অকৃতজ্ঞতার অন্তর্ভুক্ত।

বুখল ও কৃপণতার আরেকটি ছুরত এই যে, শরী‘আতের আদেশগত মাজবূরির কারণে তো ওয়াজিব হক আদায়ে সে মজবূর, তবে চলনে বলনে ও দস্তরখানে যেন মজদূর, অথচ সচ্ছল দস্তরখানের ইনতিযাম রয়েছে ভরপুর! এটাও কৃপণতা ও অভদ্রতা, তবে এর দ্বারা যেহেতু কোন ওয়াজিব হক নষ্ট হয় না সেহেতু এটা অসুন্দর হলেও পাকড়াওয়ের আওতায় পড়ে না।

মোজাহাদা ও সাধনার পরও এধরনের বুখল ও কৃপণতা থেকে যেতে পারে, তবে তা তার আখেরাতের জন্য ক্ষতিকর নয়।

আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবাইকে সর্বপ্রকার বদখাছলত ও মন্দ স্বভাব থেকে হেফাযত করুন, আমীন।

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা