শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

কাশ্মীরসংখ্যা | শেষের পাতা

আমার মাওলার দয়া ও দানে যেভাবে হলো কাশ্মীরসংখ্যা!

আমার মাওলার দয়া ও দানে

যেভাবে হলো কাশ্মীরসংখ্যা!

এটাই হলো আল্লাহ্ তা‘আলার গায়বী মদদ ও নোছরাত! তিনি উম্মাহকে যেমন সাহায্য করেন ইতিহাসের বড় বড় মোড় পরিবর্তনের সময়, জটিল থেকে জটিল সঙ্কটকালে; উম্মাহর মহান মহান ব্যক্তিকে যেমন সাহায্য করেন মহৎ মহৎ কাজে, তেমনি সাধারণ থেকে সাধারণ মানুষকেও তিনি সাহায্য করেন সামান্য থেকে সামান্য বিষয়ে। জীবনের অন্যসব প্রসঙ্গ এখন থাক, শুধু কলম হাতে আমার এই ছোট্ট পরিসরে, সামান্য কিছু পরিশ্রমের কথাই এখানে বলতে চাই। কতবার কতভাবে যে আমার আল্লাহ্ তাঁর অধম বান্দাকে সাহায্য করেছেন! আমার কলমের যিন্দেগির পুরো সফরের কথাও এখানে থাক; শুধু পুষ্পের টুটাফাটা মেহনতের কথাই বলি। সেই যে যাত্রা শুরু হলো অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে, আশা ও ভয়ের মাঝখান দিয়ে চড়াই-উৎরাইবহুল পথটা দিয়ে, আমার আল্লাহ্র সাহায্য ও গায়বি মদদ যদি না হতো..., ভাবতেই বুক কেঁপে ওঠে। দুই দু’টি বিরতিসহ পুষ্পের দীর্ঘ পথের যাত্রার কথাও না হয় থাক, শুধু যদি বলি আরাকান, আলকুদস ও কাশ্মীর, এ তিনটি বিশেষসংখ্যার কথা, তাহলেই তো... যিন্দেগি খতম হয়ে যাবে, রাব্বে কারীমের ইহসান ও অনুগ্রহের বয়ান শেষ হবে না। কাশ্মীরসংখ্যা শুরু করার ফায়ছালা যখন দিলের মধ্যে আল্লাহ্ দান করলেন, মনে হলো, কূলহীন সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে আছি। ভাঙ্গা কিশতি, ছেঁড়া পাল, তাই নিয়ে ‘এ তুফান ভারি দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার...’

ভয় ছিলো, তবে আশাও ছিলো, যিনি নিয়ত ও প্রতিজ্ঞা দান করেছেন, তিনিই তাওফীক দান করবেন। তাঁর সাহায্যেই সবকিছু হবে এবং ইনশাআল্লাহ্ সুন্দরভাবেই হবে...!

আমার দুর্বলতা, অক্ষমতা, অজ্ঞতা আমার চেয়ে ভালো কে জানবে! তবু সাহস হয়েছে শুধু আল্লাহ্র গায়বি সাহায্যের উপর ভরসা থেকেই। মনে পড়ে, প্রথম যেদিন লিখতে বসলাম, দেখি সবকিছু শূন্য, সবকিছু শুকনো! হৃদয়ের পাতা শূন্য, চোখের পাতা শুকনো, বুকের ঝরণা প্রবাহহীন...!  হঠাৎ  নির্জন রাতে ভিতরে একটা আর্তনাদ ধ্বনিত হলো। আমার প্রিয়তম আলি মিয়াঁর ভাষায়

ومن لي سواك يا رب؟

তুমি ছাড়া আমার কে আছে হে আল্লাহ্!

দেখি, বুকের ভিতরে একটু একটু প্রবাহ শুরু হয়েছে! হৃদয়ে পাতা সবুজ সজীব হতে শুরু করেছে! আর চোখের শুকনো পাতা! একটু যেন সিক্ত হতে শুরু করেছে! নিজের অজান্তেই ‘আঙুলগুলো বোতাম ঘরে’ সচল হয়ে উঠেছে। দৃষ্টি তখন ‘আলোকিত পর্দায়’, ধীরে ধীরে যে বাক্যটি সেখানে অবয়ব লাভ করলো, মনে হলো ‘আতশবাজি’র মাধ্যমে এক শুভ উদ্বোধন! ঠিকমত যে বলা হলো না, এটা আমার শব্দের দৈন্য, আমার ভাষার দারিদ্র্য এবং আমার কলমের অক্ষমতা, বাক্যটি ছিলো এই

হৃদয়ের ফোঁটা ফোঁটা রক্ত এবং চোখের ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু দিয়ে লেখা

‘কাশ্মীরসংখ্যা’

সেই যে হৃদয়ের ঝরণায় শুরু হলো প্রবাহ, আজো চলছে কুলকুল শব্দের সঙ্গীত হয়ে! যখনই প্রয়োজন হয়েছে, যখনই আঁচল

পেতে দাঁড়িয়েছি; মসজিদের ডান দিকে ঐ যে আমার শিউলীগাছটা, ওখান থেকে যেভাবে শিউলী ঝরে, আল্লাহ্র দয়া ও করুণার ফুল তেমনই যেন ঝরে ঝরে পড়েছে। আমি শুধু ফুলগুলো আঁচল থেকে এনে পুষ্পের পাতায় সাজিয়ে দিয়েছি!

পুষ্পের, বিশেষ করে এ সংখ্যার কোন্ কোন্ লেখার কথা বলবো! একটি লেখা মানে পুষ্পের একটি পাপড়ি, যে পাপড়ি বাগানে ফুটেনি, আকাশ থেকে ঝরেছে, বলতে ইচ্ছে করে, জান্নাতের বাগানে ফুটেছে, আর জান্নাতের বাগান থেকে কলমের মুখ থেকে লেখা হয়ে ঝরেছে।

সম্পাদকীয়-এর জন্মকথা বলি, কয়েক দিন থেকে ভাবছি, আর  ভাবছি। আমরা মানুষ, দুর্বল তো! মাঝে মধ্যে হতাশা পেয়ে বসে, নাহ, আমাকে দিয়ে বোধহয় হবে না। ...

একদিন ফজরের পর মসজিদে... হঠাৎ দোতালায় কোন তালিবে ইলমের হাত থেকে সম্ভবত টেবিল পড়ে গেলো! দ্রিম বা ধড়াম করে একটা শব্দ হলো, আর বুকের ভিতর যেন শব্দটা প্রতিধ্বনিত হলো। ‘বড় তালিবে ইলমের এ কেমন অসতর্কতা!’ ভেবে অসন্তুষ্টি হতে পারতো, কিন্তু ভিতরে শুরু হয়ে গেলো ভাবের প্রবাহ...

‘আগ্নেয়গিরির লাভা নিয়ে আবার জ্বলে উঠেছে কাশ্মীর! বারুদের আগুন, জিঘাংসার আগুন এবং প্রতিরোধের আগুন নিয়ে আবার জ্বলে উঠেছে কাশ্মীর!

তখনই এসে বসলাম ‘আলোকিত পর্দা’র সামনে। এই যে শব্দের, বাক্যের স্রোতে শুরু হলো, থামলো গিয়ে একেবারে শেষ বাক্যে

‘কাশ্মীরের মযলূম মুসলিমান আবার মুক্ত আকাশে, মুক্ত বাতাসে আযাদীর শ্বাস গ্রহণ করবে। আমাদের শুধু একবার প্রতিজ্ঞা করতে হবে, যে প্রতিজ্ঞায় থাকবে ইস্পাত ও ফাওলাদের দৃঢ়তা, আমরা আল্লাহর পথে, কোরআনের পথে, সুন্নাহ্র পথে ফিরে আসবো!’

আমার আল্লাহ্র নামের জালাল ও জামালের কসম, এখনো বিশ্বাস হয় না, এ লেখা আমার কলমের দান, আমার বিশ্বাস, এ লেখা রাব্বুল কলমের দান!

***

এই ফুলটা আপনার জন্য!

মাদানী মাক্তাবের ছোট্ট ছেলেটি, কত দূর থেকে এসেছে মায়ের মমতার আঁচলখানি ছেড়ে! হাতে একটি ফুল নিয়ে ধীরে ধীরে কিছুটা লাজুকভাবে এগিয়ে এলো। আমি লেখার চিন্তায় মশগুল। হাতের ফুলটা আমার দিকে বাড়িয়ে লাজুক একটা হাসি উপহার দিয়ে বললো, ‘হুযূর, এই ফুলটা আপনার জন্য!’ আর তা থেকে আমি পেয়ে গেলাম ‘প্রথম কথা’ লেখাটি! কল্পনায় ভেসে উঠলো কাশ্মীরের অজানা অদেখা এই রকম কোন শিশুর ছবি, যার হাতে রয়েছে কাশ্মীরের কোন বাগানের ফুল! ভিতরে একটা প্রশ্ন বিঁধলো, এমন ফুলের মত শিশুদের কীভাবে হত্যা করতে পারে মানুষ! ... ধীরে ধীরে লেখাটির অবয়ব তৈরী হতে থাকলো এবং...

একটি লেখা পেলাম বিকট শব্দের প্রতিধ্বনি থেকে, আরেকটি লেখা পেলাম এক নিষ্পাপ শিশুর হাত থেকে পাওয়া ফুলের মাধ্যমে! আমার প্রতিপালকের দয়া ও করুণার কি কোন শেষ আছে!

এভাবে যদি বলতে যাই, প্রতিটি লেখা সম্পর্কে, পুষ্পের প্রতিটি পাপড়ি সম্পর্কে বড় কলেবরের আলাদা একটা পুষ্পই হয়ে যাবে।

***

পুষ্পের ২৫তম পৃষ্ঠার বাম পাশের লেখাটির কথা বলতে ইচ্ছে করছে...! ইচ্ছে তো করবেই! চুপচাপ বসে আছি। পুরো কলামটা কি দিয়ে পূর্ণ করবো! চিন্তায় কিচ্ছু নেই, যেন ধূধূ মরুভূমি!

তোমরা কেউ হাসবে না! এখন আমি একটি কথা বলবো। চুপচাপ বসে আছি, হঠাৎ মনে হলো ‘দয়াময়’ আনারের একটা দানা যেন মুখে তুলে দিলেন! আনারের স্বাদ অনুভূত হলো, আলোকিত পর্দায় তাকিয়ে দেখি, ‘এক ফোঁটা দুধ’ কথাটা কখন যেন লেখা হয়ে গিয়েছে! শুভ্র দুধের মতই যেন ভাসছে! আমি তো অবাক!

হঠাৎ মনে হলো, আনারের আরেকটি দানা! কী মিষ্টি স্বাদ! আলোকিত পর্দায় তখন দেখি, ‘এক ফোঁটা রক্ত’ কথাটা রক্তের লাল বর্ণের মতই জ্বল জ্বল করছে! আমার বিস্ময় তখন আকাশ ছোঁয়! আকাশের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে কৃতজ্ঞতা নিবেদন করি। ওম্মা! আনারের আরেকটা দানা, রসে যেন মুখটা ভরে যায়! আমার দৃষ্টি তখনো আলোকিত পর্দায় এবং সেখানে ভাসছে, ‘এক ফোঁটা জল’!

এভাবে একে একে তিনটি আনারের দানা যেন আমার মাওলা বান্দার মুখে তুলে দিলেন! এক ফোঁটা দুধ!

এক ফোঁটা রক্ত!

এক ফোঁটা জল!

আমার হৃদয় ও আত্মার গভীরে তিনি যেন আমাকে সম্বোধন করে বলছেন, নাও বান্দা, তিনটি দানা আমি দিলাম, এবার তুমি...

হঠাৎ চিন্তায় এলো দুধের ফোঁটা সম্পর্কে ‘মা’ যদি কিছু বলেন, আর রক্তের ফোঁটা সম্পর্কে মুজাহিদ যদি কিছু বলেন, আর জলের ফোঁটা সম্পর্কে নদী ও ঝরণা যদি কিছু বলে তাহলে তো লেখাটা বেশ কিছুটা অবয়ব লাভ করতে পারে! কীভাবে যেন এক ফোঁটা দুধের মূল্য, এক ফোঁটা রক্তের মূল্য এবং এক ফোঁটা জলের মূল্য, এ ভাবনাটা মনের মধ্যে উঁকি দিলো! আসল কথা হলো, আমরা শুধু দেখতে পাই, চাঁদের আলো, সূর্যের আলো, তারার আলো, জোনাকির আলো, কিন্তু আলোর উৎস দেখতে পাই না। তো আমাদের চিন্তার জগতে এই যে আলোর চকিত বিচ্ছুরণ ও ঝলকানি, আসলে এগুলো আসে আলোর উৎস থেকে!

তো আমার মনের ভিতরে ঐ যে আলোর বিচ্ছুরণ সেটাই শব্দে রূপ গ্রহণ করলো এভাবে

এর মূল্য কত, জিজ্ঞাসা করো কোন মায়ের মমতাকে, যিনি সন্তানকে বলতে পারেন, আমার দুধের করয আদায় করো মাটি ও মানুষের জন্য জান কোরবান করে!

জিজ্ঞাসা করো সেই মুজাহিদীনকে যাদের রক্তে বাগানের গোলাব লাল হয়, স্বাধীনতার সূর্য রাঙা হয়!

জিজ্ঞাসা করো নদী ও ঝরণার জলধারাকে, যা নিবারণ করে মাটি ও মানুষের পিপাসা!

এখন চিন্তা হলো, লেখাটার তো আরো সম্প্রসারণ দরকার! কলাম তো এখনো অর্ধেকও পূর্ণ হয়নি। আচ্ছা, উপরে দুধের, রক্তের, জলের তিনটা ফোঁটা ছিলো! যদি আরো তিনটা জিনিস নিয়ে আসি এবং সেগুলো অবলম্বন করে কিছু নতুন চিন্তা তুলে ধরি!

আবার হৃদয়ের পর্দায় আলোর উৎস থেকে আলোর বিচ্ছুরণ!

একটি ফুলের পাপড়ি...

একমুঠ মাটি...

একটুকরো আকাশ...

একটুকরো মেঘ...

দুধের, রক্তের, জলের মূল্য জিজ্ঞাসা করেছি, তো এগুলোরও মূল্য জিজ্ঞাসা করি এবং দেখি কী উত্তর আসে!

মনের এ ভাবনাটাই বাক্যের রূপ ধারণ করলো এভাবে

এগুলোর মূল্য কত, জিজ্ঞাসা করো ঐ ভূখ-কে যেখানে এখন ফুল ফোটে না, শুধু আগুন জ্বলে। আকাশ যেখানে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, যেখানে এখন মেঘ নেই, বৃষ্টি নেই, আছে শুধু হতাশা ও পিপাসা!

এখনো যথেষ্ট জায়গা আছে! এবার মনে হলো, এমন তিনটা বিষয় আনা দরকার যাতে লেখাটির মূল বার্তা জোরালোভাবে এসে যায় এবং লেখাটি পূর্ণতা ও পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে।

কিন্তু, আমি বা তুমি, কিছু লিখতে কি পারি যদি হৃদয়ের পর্দায় আলোর উৎস থেকে আলোর বিচ্ছুরণ না ঘটে! সেই বিচ্ছুরণটা যেন এবার ঘটলো অন্যরকম ঔজ্জ্বল্য নিয়ে!

খুঁজে খুঁজে অন্যরকম তিনটা জিনিস বের করলাম।

মসজিদের অধিকার ...

মিনার থেকে আযানের ধ্বনি...

শিশুর জন্ম, কান্না ও হাসি...

স্বাভাবিকভাবেই এগুলোরও মূল্য জিজ্ঞাসা করতে হয়! তো কাকে জিজ্ঞাসা করা যায়?

(রাতের ঘড়ি তখন তিনটার ঘর পার হয়েছে। বিদ্যুৎ তো বেশ আগে থেকেই নেই। এখন ‘আলোকিত পর্দা’র আলোও ফুরিয়ে গেলো। কী করি! হঠাৎ মনে হলো আসমানের ইশারা, ‘প্রযুক্তির সঙ্গ ত্যাগ করে তুমি হে বান্দা ফিরে যাও সে যুগের কলম কাগজের কাছে।’

বহুদিন পর আগের যুগের কলম-কাগজের সান্নিধ্য বেশ লাগছে। অভ্যাস ছুটে যাওয়ায় একটু কষ্ট হচ্ছে, এই যা)

তো ফিরে আসি আগের কথায়। কাকে জিজ্ঞাসা করা যায় মসজিদের মূল্য? বাবরি মসজিদের যখম তো দিলের মধ্যে তাজা ছিলো, আর একটা মাত্র আযানের জন্য কাশ্মীরভূমির সন্তানেরা যে কোরবানি দিয়েছে...

মসজিদের মূল্য, আযানের মূল্য আমরা কী বোঝবো! আমরা তো এগুলো বিনামূল্যে পাওয়া মানুষ! এর মূল্য জানতে হলে আমাদের যেতে হবে ভারতের যমীনে, কাশ্মীরের ভূমিতে। ওখানকার মযলূম মুসলিমানই বলতে পারবে মসজিদের মূল্য, আযানের মূল্য। আবার সেই আলোর বিচ্ছুরণ, যা ভাষা লাভ করলো এভাবে!

এগুলোর মূল্য কত, জিজ্ঞাসা করো ঐ জনপদকে যেখানে মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয় পাশব শক্তি, যেখানে মসজিদের অধিকার ছিনতাই হয়ে যায় আদালতের আদেশে!

যেখানে আযান দিতে গিয়ে শহাদাত বরণ করেন একে একে বাইশজন মুজাহিদীন!

হাসি ও কান্নার মূল্যও আমাদের শিশুরা বলতে পারবে না, যারা মায়ের কোলে হাসে সুখের হাসি এবং কাঁদে দুঃখের কান্না! হাসি ও কান্নার মূল্য জানতে হবে কাশ্মীরের শিশুদের কাছ থেকে, যারা কাঁদলেও মায়ের বকুনি খায়, হাসলেও মা বলেন, ‘চুপ একদম চুপ!’

মনের এই ভাব ও ভাবনা ভাষার অবয়ব লাভ করলো এভাবে, একটু ভিন্ন মাত্রা ও ভিন্ন বার্তার আবহ নিয়ে

জিজ্ঞাস করো ঐ শিশুকে, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যাকে শুধু কাঁদতে হয় অঝোরে, যার মুখে হাসি ফোটে শুধু মৃত্যুর শেষ সময়!

প্রিয় পাঠক, এভাবে অদৃশ্যের মমতা থেকে পাওয়া আনারের তিনটি দানা থেকে, তারপর হৃদয়ের পর্দায় একে একে তিনটি আলোর বিচ্ছুরণ থেকে তৈরী হয়েছে এ লেখাটি, যার শুরু মায়ের বুক থেকে পাওয়া দুধের ফোঁটা দিয়ে, আর শেষ, শিশুর মুখে মৃত্যুর সময়ের হাসি দিয়ে!

অবয়বে ও কলেবরে লেখাটি ছোট, তবে তিনটি স্তবকে বিভক্ত লেখাটির প্রতিটি স্তবক পর্যায়ক্রমে উচ্চ থেকে উচ্চতর বার্তা ধারণ করছে। এমন লেখা যদি কলম অর্জন করে রাব্বুল কলমের গায়বের খাযানা থেকে, শোকরে কৃতজ্ঞতায় মাথা কেন লুটিয়ে পড়বে না সিজদায়!

***

প্রিয় পাঠক, এবার না হয় অন্য একটি প্রসঙ্গ বলি। আমার মাওলায়ে কারীমের অন্য রকম একটি গায়বি মদদের কথা বলে লেখাটির ইতি টানি!

শুরু থেকেই মনটা অস্থির ছিলো কাশ্মীরবিষয়ে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাচীন কাগজের ছবি সংগ্রহের জন্য।

কাশ্মীরের ডোগরা মহারাজারা তো তিন পুরুষ থেকে কাশ্মীরের ভূমিপুত্র মসুলমানদের উপর চরম যুলুম নির্যাতন চালিয়ে আসছিলোই, যার বিবরণ, এমনকি অমুসলিম লেখকদের কলমেও ‘অশ্রুর ভাষায়’ লেখা হয়েছে। তবে মহারাজা হরি সিং মুসলিম কাশ্মীরের, এমনকি নিজেরও শেষ সর্বনাশটা করে গিয়েছেন ১৯৪৭ সালে ভারতভুক্তির দাসখতে দস্তখত দিয়ে। বুদ্ধিমান নেহরু এবং সাধু পুরুষ গান্ধী বরাবর বলে এসেছেন, ‘কাবায়েলী দস্যুরা’ কাশ্মীরের নিরস্ত্র মুসিলম, হিন্দু ও শিখদের উপর অস্ত্রহাতে ঝাঁপিয়ে পড়ার কারণে প্রজাদের সুরক্ষার চিন্তায় অস্থির মহারাজা হরি সিং ভারতের কাছে সাহায্যের আকুল আবেদন জানিয়েছেন, আর ‘মহান’ ভারত মহারাজার ডাকে নিছক মানবিক কারণে সাড়া দিয়ে কাশ্মীরে ফৌজ পাঠিয়েছে। কোন্ পথে? ঐ যে মুসলিমপ্রধান গুরুদাশপুরের পাঠানকোটের চিকন রাস্তাটি, যা বুদ্ধি করে নেহরু-গান্ধী আগেই রেডক্লিফের সহায়তায় হাতিয়ে নিয়েছিলেন! সেই সরু পথটি দিয়ে।

এ বিষয়ে বলাবলি হচ্ছিলো যে,পণ্ডিত নেহরু ও লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন আগস্টের শুরুতেই চুক্তিপত্র টাইপ করে রেখেছিলেন। মাসের উল্লেখ ছিলো আগস্ট, দিনতারিখের জায়গাটা শুধু খালি ছিলো। এরপর নেহরু-ব্যাটেন ও ‘মহাত্মাজী বেচারা মহারাজাকে লাগাতার চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করার জন্য। হরিসিং নিজের ভবিষ্যত চিন্তা করে গড়িমসি করছিলেন। আগস্ট পার হয়ে অক্টোবর এসে গেলো। ওদিকে ডোগরা ফৌজ এবং আরএসএস জঙ্গিরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে পাকিস্তানের পতাকা উড্ডয়নকারী

পুঞ্ছের মুসলমানদের উপর। ব্যাপক গণহত্যা যখন শেষপ্রায়, তখন কাবায়েলী অঞ্চলে এ বেদনাদায়ক খবর গিয়ে পৌঁছে, আর তারা দলে দলে ছুটে আসে প্রায়খালি হাতে, পুঞ্ছের অবশিষ্ট মুসলমানদের রক্ষা করার জন্য। শাহাদাতপাগল কাবায়েলী মুজাহিদীনের ঝড়ো হামলার মুখে ডোগরা ফৌজ ও আরএসএস যখন দিশেহারা তখন মহারাজা হরিসিংও উপায় না পেয়ে নেহরু-গান্ধীর চাপের কাছে মাথা নত করেন এবং ভারতভুক্তির দাসখতে দস্তখত করেন। আগস্ট শব্দটা কেটে দিয়ে তার উপর ‘হাতে কলমে’ অক্টোবর লেখা হয়।

তাহলে ষড়যন্ত্রের চেহারাটা পরিষ্কার হয়ে গেলো যে, নেহরু-গান্ধীর চক্রান্ত ও চুক্তিপত্র কাবায়েলী হামলার আগেই তৈরী ছিলো! পাঠানকোটের ফৌজি রাস্তা তো প্রস্তুত ছিলোই! এখন কাবায়েলী হামলা না হলে, আব্দুল্লাহ্ ও আব্বাসপন্থীদের মধ্যে হানাহানির অজুহাত সহজেই তৈরী করে নেয়া যেতো! খলের তো আর ছলের অভাব হয় না!

তো কাবায়েলী হামলার মিথ্যাচার রাজনীতিবিদ নেহরু যেমন করেছেন তেমনি করেছেন সাধুপুরুষ গান্ধীজী, এমনকি তেমনি করেছেন ‘কোরআনের কারী’ শেখ আব্দুল্লাহ্! আর এখন তো এটা ইতিহাসের ‘সত্য’ রূপেই স্বীকৃতি পেয়ে যাচ্ছে, কলমের সওদাগরদের মাধ্যমে।

বিভিন্ন গ্রন্থে জানা যায়,আমেরিকা ও জাতিসঙ্ঘ ভারতসরকারের কাছে নাকি চুক্তিপত্রটি দেখতে চেয়েছিলো। তখন নেহরু আবার মিথ্যাচারের আশ্রয় নিলেন যে, মহাফেযখানা থেকে চুক্তিপত্রটি খোয়া গিয়েছে! সবাই সব বুঝলো, কেউ কিছু বললো না। কাশ্মীরের ভুখানাঙ্গা মুসলমান, আর ‘পোকায় খাওয়া’ পাকিস্তান, এদের শোরগোল নিয়ে আর কত ভাবা যায়! বিষয়টা এভাবেই চাপা পড়ে যায়।

উপরের কথাগুলো সবই জানা হয়েছে বিভিন্ন বইয়ের পাতা থেকে। তো বড় একটা আকুতি ছিলো, প-ণ্ডি তজীর খোয়া যাওয়া চুক্তিপত্রের অন্তত একটা ছবি যদি যোগাড় করা যেতো, কিছুটা হলেও সান্ত¡না পেতাম।

এর মধ্যে একরাত্রে স্বপ্নে দেখি, কে যেন বলছেন, ‘চিন্তা করো না, পেয়ে যাবে?’ স্বপ্নেই মনে হলো, চুক্তিপত্রের কথা বলা হচ্ছে! স্বপ্ন থেকে জেগেও মনে হলো স্বপ্নের মধ্যেই রয়েছি! কীভাবে পাওয়া যাবে? যিনি বলেছেন, কে তিনি?

কিন্তু পাওয়া গেলো! অকল্পনীয়-ভাবেই পাওয়া গেলো! এবং আমার ‘বাবা’র মাধ্যমেই পাওয়া গেলো!! আজ (১/৫/৪১ হি.) এশার পর আনন্দে উদ্বেলিত অবস্থায় বাবা এসে বললো, ‘আব্বু, এই দেখো হরিসিং-নেহরুর সেই ...!’

খুশিতে আমি তো আত্মহারা! একবার তাকাই ‘নেটে’, একবার তাকাই পুত্রের ললাটে!

চুক্তিপত্রের আগস্ট শব্দটি কালির আঁচড়ে কাটা, উপরে হস্তাক্ষরে লেখা ‘অক্টোবর’।

প্রিয় পাঠক, বাপ হয়েছি বলে সন্তানের যদি শোকর আদায় না করি, ঠিক হতো! উজ্জ্বল ললাটে চুম্বন এঁকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলাম। তারপর রাব্বে কারীমের প্রতি শোকরের জাযবায় এই যে দীর্ঘ লেখাটি, লিখতে শুরু করলাম। আল্লাহ্ যখন দান করেন আশা ও প্রত্যাশা এবং চাওয়া ও চাহিদার চেয়ে বেশীই দান করেন। চেয়েছি শুধু চুক্তিপত্রের ছবি। তার সঙ্গে পাওয়া গেলো, পত্রিকার সংশ্লিষ্ট কাটিং! শোকর আলহামদু লিল্লাহ্!

এ লেখাটি ছিলো আসলে সেই চুক্তিপত্র ও পেপার কাটিং সম্পর্কে একটি প্রতিবেদনের ভূমিকা।

এখানে আবার পাশে বসে থাকা বাবা বললো, ‘এমন সুন্দর লেখা, এর তো নিজস্ব মূল্য ও স্বকীয়তা রয়েছে। এটা অন্য লেখার ভূমিকা পরিচয়ে মানাবে না। এটাকে তুমি স্বতন্ত্র হিসাবে রাখো, আর প্রতিবেদনটি পুষ্পের পরিশিষ্টে নিয়ে যাও। মনে হলো, সুচিন্তিত পরামর্শ। তাই সেভাবেই করলাম।

প্রিয় পাঠক, একটা আবেগ উপচে এসে পড়ছে কলমের মুখে। আমার তো আবার বন্ধু আছেন কতিপয়! তাই কিছুটা আশঙ্কা...! বলে ফেলি! কথাটা হলো, লেখা সুন্দর হোক নাহোক, সন্তান যদি বলে, ‘সুন্দর’, ভালো লাগে না! আবার লেখক বাবার পাঠক পুত্র যদি পাশে থাকে এবং আলো দেখায় আনন্দ হয় না! আমার ভালো লেগেছে এবং আনন্দ হয়েছে! দু‘আ করি, নযর থেকে আল্লাহ্ হেফাযত করুন। পুষ্পের সকল পাঠক-পাঠিকা, আল্লাহ্ তাদের মঙ্গল করুন, কল্যাণ করুন, আমীন।

দয়াময় করুণাময় আল্লাহ্র অপরিসীম শোকর আদায় করে এখানেই লেখাটির ইতি টানছি।আর ঐ যে চুক্তিপত্রের ছবি, যার জন্য আজকের এই ‘তুলকালাম’ সেটা ইচ্ছে করলে, প্রিয় পাঠক, দেখতে পারেন এ সংখ্যার পরিশিষ্টে। আল্লাহ্ সবাইকে ভালো রাখুন, সুখে রাখুন, আমীন।