কা শ্মী রে র ই তি হা স
অতীত বর্তমান ভবিষ্যত
১
জম্মু-কাশ্মীরের সাংবিধানিক মর্যাদা রহিত করার পর শাব্দিক অর্থেই কাশ্মীরের সমগ্র উপত্যকা এখন অগ্নিগর্ভ রূপ ধারণ করেছে। একদিকে কাশ্মীরের প্রতি মুসলিম উম্মাহর, বিশেষ করে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানের ভালোবাসা অপরিসীম, অন্যদিকে কাশ্মীর সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহর, বিশেষ করে বাংলাদেশের মুসলমানদের অজ্ঞতাও দুঃখজনক। আমরা যেমন জানি না, কাশ্মীরের ইতিহাস, তেমনি জানি না, কাশ্মীরসমস্যার রূপ ও প্রকৃতি কী? কীভাবে এ সমস্যার শুরু এবং এর সমাধানের পথ ও পন্থা কী? তো মূলত কাশ্মীর সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা দূর করা এবং জানার পরিধি বিস্তৃত করার উদ্দেশ্য নিয়েই ‘কাশ্মীরের ইতিহাস, অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত’ নামে কিছু লেখার প্রেরণা অনুভব করেছি। আল্লাহ্ কবুল করুন। কাশ্মীরের মযলূম মুসলমানদের প্রতি একাত্মতা ও সংহতির অনুভূতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে এ লেখা যদি কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখতে পারে তাহলে কৃতজ্ঞ বোধ করবো।
মোঘল বাদশাহ যহীরুদ্দীন মুহম্মদ বাবর, যার নামে তৈরী হয়েছে বাবরী মসজিদ, যা আজ হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসনের শিকার হয়ে ‘অস্তিত্বহীন’; বাবর কাশ্মীরে এসে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে এমনই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, জীবনের শেষ পর্যন্ত কাশ্মীরকে ভুলতে পারেননি। আর তাঁর পুত্র জাহাঙ্গীর তো বলে উঠেছিলেন, যমীনে যদি জান্নাত থাকে তাহলে তা এই! তাহলে তা এই! মূলত তখন থেকেই ভূস্বর্গ বা পৃথিবীর জান্নাত বলে কাশ্মীরের পরিচয়। তবে আমার সবসময় মনে হয়েছে, এতে কিছু ভাবাবেগের মেশাল রয়েছে। কাশ্মীর সুন্দর অবশ্যই এবং সে সৌন্দর্য অপার, তাতেও সন্দেহ নেই। তাই বলে জান্নাতের সঙ্গে তুলনা! আমার ধারণা, এটা বেশ অতিশয়তাদোষে দুষ্ট, অথবা, জান্নাত মানবের কল্পনারও ঊর্ধ্বের বলে এত সহজে এ উপমা ব্যবহার করা হয়েছে।
আমি নিজে যেহেতু কাশ্মীর দেখিনি, তাই আমার মনের অনুভূতি কখনো প্রকাশ করিনি। এর মধ্যে আমার পরিচিত একজন কাশ্মীর ভ্রমণ করে এসেছেন। তিনি অত্যন্ত বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তি। তার মন্তব্য ও মতামতের প্রতি আমার আস্থা রয়েছে। কাশ্মীর সম্পর্কে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি ঠিক উপরের কথাগুলোই শব্দের বেশকমসহ বললেন। তার ভাষায় ‘জান্নাতের সঙ্গে কাশ্মীরের তুলনা, রূপসী নারীকে জান্নাতের হুরের সঙ্গে তুলনা করার মতই।
***
শৈশব থেকেই কাশ্মীরকে আমি ভালোবাসি, আর আমার ভালোবাসা কাশ্মীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য নয়। কাশ্মীরের প্রতি আমার ভালোবাসা শুধু এ জন্য যে, কাশ্মীর একটি মুসলিম ভূখ-, যেখানে বাস করে বিপুল সংখ্যক মুসলিম, দীর্ঘকাল থেকে যারা যুলুম নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার, এমনকি যারা আযাদি ও ইযযতের যিন্দেগি থেকেও বঞ্চিত। তাই বলা যায়, আমার ভালোবাসা কাশ্মীরের চেয়ে বেশী কাশ্মীরের মুসলিম ভাইদের প্রতি।
***
কাশ্মীরের প্রতি আমার ভালোবাসা ছিলো, কিন্তু কাশ্মীর ও কাশ্মীরী মুসলিম জনগোষ্ঠী সম্পর্কে আমার তেমন ‘জানকারি’ ছিলো না। একসময় বিষয়টা আমাকে বেশ পীড়া দিতে লাগলো। তখন থেকে কাশ্মীরকে জানার চেষ্টা শুরু করি। জানার বড় মাধ্যম হলো কাশ্মীর সম্পর্কে যা কিছু লেখা হয়েছে, গভীর মনোযোগ ও নিবিষ্টতার সঙ্গে তা পড়া।
তো আমার সাধ্যের ভিতরে যতটুকু ছিলো কাশ্মীর সম্পর্কে আমি পড়েছি এবং জেনেছি। সেই জানার মধ্য দিয়ে আমি ‘সত্য’ পর্যন্ত পৌঁছার চেষ্টা করেছি। বর্তমান লেখার মাধ্যমে কাশ্মীরের সেই সত্যটুকুই তুলে ধরার চেষ্টা করছি, যাতে আমার মত যারা কাশ্মীরকে জানেন না, অথচ কাশ্মীরকে ভালোবাসেন এবং কাশ্মীরের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যত সম্পর্কে জানতে চান এবং কাশ্মীরের প্রকৃত ‘সত্য’কে উপলব্ধি করতে চান তারা যেন এ লেখা পড়ে সেই সত্যের অন্তত কিছুটা নিকটবর্তী হতে পারেন।
***
কাশ্মীরের ইতিহাস দিয়ে আলোচনা শুরু করলে আমাদের যেতে হবে অন্তত পাঁচ হাজার বছর বা তারো আগে, আর সেই শুরুটা হবে সম্পূর্ণ আলো-আঁধারির মধ্যে, বরং প্রায় অন্ধকারের মধ্যে। তার চেয়ে ভালো হয়, যদি আমরা আলোচনা শুরু করি, ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রসঙ্গ দিয়ে। তাহলে আমাদের আলোচনা হতে পারে পূর্ণ আলোর মধ্যে। এরপর যদি কাশ্মীরের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা হয় তাহলে আলো-আঁধারি কিছুটা সয়ে আসতে পারে।
পুরো রাজ্যটির নাম কিন্তু শুধু কাশ্মীর নয়, যদিও স্থানীয়ভাবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে বলা হয় কাশ্মীরসমস্যা। সম্ভবত কাশ্মীর উপত্যকার নৈসর্গিক সৌন্দর্যের কারণে এবং জনসংখ্যাগত কারণে কাশ্মীর নামটি প্রাধান্য লাভ করেছে।
এখানেও আরেকটি কথা, পুরো রাজ্যে রয়েছে তিনটি প্রধান অঞ্চল, যার মধ্যে সবচে’ বড় অঞ্চলটির নাম হলো লাদাখ। পুরো রাজ্যের হিসাবে জম্মুর আয়তন হবে প্রায় ত্রিশ শতাংশ; কাশ্মীরের আয়তন প্রায় বাইশ শতাংশ, পক্ষান্তরে লাদাখের আয়তন হবে প্রায় আটচল্লিশ শতাংশ। অথচ রাজ্যের নামের মধ্যে লাদাখ নেই! কারণ জনসংখ্যাগত দুর্বলতা। রাজ্যের মোট জনসংখ্যার মাত্র ২.৩ শতাংশের বাস লাদাখ অঞ্চলে। এর দ্বারা সেই সত্যটি আবার আমাদের সামনে সমুদ্ভাসিত হয়ে ওঠে যা বিভিন্ন স্বার্থগত কারণে মানুষের বিবেচনার আড়ালে চলে যায়। আর তা হলো, ভূমির গুরুত্ব আয়তন বা অন্যকিছু দ্বারা নয়, বরং ভূমিপুত্রদের দ্বারা।
লাদাখে দু’টি অঞ্চল, কারগিল ও লেহ। এ হচ্ছে সেই কারগিল যেখানে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ‘অঘোষিত’ যুদ্ধ হয়েছে মাত্র কয়েকবছর আগে ১৯৯৯ সালে। তাতে ভারতের সৈন্যক্ষয় হয়েছিলো অকল্পনীয় পরিমাণে। তবে যুদ্ধ থেকে পাকিস্তানকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিলো কৌশলগত কারণে অনন্যোপায় অবস্থায়। সেটা এখন ইতিহাসের অংশ।
কারগিলের অধিবাসী প্রায় সবাই মুসলিম। লেহ অঞ্চলে বৌদ্ধরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের ভাষা ও কৃষ্টি রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বলা যায় পাশের অঞ্চল তিব্বত ও তিব্বতীদের সঙ্গে সবদিক থেকেই তাদের যথেষ্ট মিল। পুরো লাদাখ অঞ্চল হিমালয়ের সুউচ্চ পর্বতসারির মধ্যে অবস্থিত।
মহারাজার আমল থেকে জম্মু-কাশ্মীর হচ্ছে পৃথিবীর এমন মাত্র কয়েকটি অঞ্চলের একটি যেখানে রাজধানী হচ্ছে মৌসমভিত্তিক। এখানে শীতকালীন রাজধানী হচ্ছে জম্মু। কারণ জম্মুর অবস্থান হিমালয়ের পাদদেশে, সমতল ভূমিতে। অবশ্য ক্রমে এগিয়ে গিয়ে ছোট ছোট পাহাড়ের দেখা পাওয়া যাবে। গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হচ্ছে কাশ্মীর উপত্যকার প্রধান শহর শ্রীনগর। কাশ্মীরের অবস্থান হলো মধ্য হিমালয়ে।
পুরো অঞ্চলের মৌসুমের তারতম্য বোঝার জন্য আমাদের বুঝতে হবে হিমালয়ের সজ্জা ও বিন্যাস। উচ্চতার দিক থেকে হিমালয়কে তিনটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে। সমুদ্রের দিক থেকে উত্তরে অগ্রসর হলে প্রথমে দেখা যাবে ছোট ছোট পাহাড়, তারপর দেখা যাবে মাঝারি উচ্চতার পর্বতসারি, তৃতীয় স্তরে দেখা যাবে সর্বোচ্চ পর্বতসারি,
সমুদ্র থেকে উঠে আসা নীচু মেঘগুলো ছোট ছোট পাহাড়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বৃষ্টিরূপে নেমে আসে। সেই বৃষ্টিতে স্নাত হয় সমতল ভারত, যার মধ্যে পড়ে পুরো বাংলা অঞ্চলও। এই গোটা অঞ্চলের আবহাওয়া ও জলবায়ুকে বলা হয় মৌসুমি জলবায়ু ,
অপেক্ষাকৃত উঁচু মেঘগুলো বাধাপ্রাপ্ত হয় মধ্য হিমালয়ের মাঝারি উচ্চতার পর্বতগুলোতে। তাতে বৃষ্টি হয় ভুটান, নেপাল, জম্মু প্রভৃতি অঞ্চলে। সঙ্গত কারণেই হিমালয়ের পাদদেশীয় অঞ্চলগুলোও পায় মৌসুমি জলবায়ুর কিঞ্চিৎ ছোঁয়া।
কাশ্মীরের অবস্থান মধ্যহিমালয়ে। তাই কাশ্মীর মৌসুমি জলবায়ুর আওতায় পড়ে না। তবে কাশ্মীরেও খানিকটা বৃষ্টি হয় সাধারণত মার্চ-এপ্রিলে পশ্চিমের ভূমধ্যসাগর থেকে উঠে আসা শীতল পূবালী বায়ুর কারণে। এদিক থেকে কাশ্মীরের জলবায়ুকে বলা যায় ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু তবে হিমালয়ান জলবায়ুই হচ্ছে কাশ্মীরের মূল জলবায়ু। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো অনিশ্চয়তা। অর্থাৎ এই বৃষ্টি, এই মেঘ, এই মৃদু কোমল রোদ, এই তাপদাহ। কখন কোনটা হবে, কেউ আগাম খবর দিতে পারে না।
হিমালয়ের পাদদেশের সমতল ভূমি এবং মধ্যহিমালয়ের উপত্যকাভূমি, এই ভৌগোলিক পার্থক্য ছাড়াও জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চল দু’টির মধ্যে রয়েছে ব্যাপক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পার্থক্য। জম্মু অংশে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, বর্তমান আদমশুমারি অনুযায়ী ৬৫ ভাগ, মুসলিমরা ৩১ ভাগ। পক্ষান্তরে কাশ্মীরে জনসংখ্যার প্রায় ৯৮ শতাংশই মুসলিম। এ হিসাবে পুরো রাজ্যেও মুসলমানরাই যথেষ্ট পরিমাণেই সংখ্যাগরিষ্ঠ।
রাজনৈতিক দিক থেকে ১৮৪৬ সালে এ অঞ্চলে একটি নতুন দৃশ্যপট শুরু হয়। শিখশাসিত পাঞ্জাবের অধীনে ছিলো জম্মু, কাশ্মীর, লাদাখ, পুঞ্চ, গিলগিত বালতিস্তান প্রমুখ এলাকা। শিখ শক্তি বৃটিশদের হাতে পরাজিত হয়। ঐ যুদ্ধে গোলাব শিং নামে জম্মুর এক জমিদার, যিনি শিখদরবারের ‘আস্থাভাজন’ ছিলেন, গোপনে বৃটিশবাহিনীকে সাহায্য করেন। এর বিনিময়ে গোলাব শিং বৃটিশদের কাছ থেকে ঐ পুরো অঞ্চলের ‘বন্দোবস্ত’ লাভ করেন, সংক্ষেপে যার নাম দেয়া হয় জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য। এ বিষয়ে বিশদ আলোচনার উপযুক্ত স্থান সামনে আসছে।
১৯৪৭ সালে বৃটিশশাসিত উপমহাদেশ যখন ভারত ও পাকিস্তান নামে ভাগ হয় তখন জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের অধিকার দাবী করে ভারত ও পাকিস্তান। কুটিল রাজনীতি এবং জটিল যুদ্ধের পর শেষ পর্যন্ত জম্মুর কয়েকটি জেলা, কাশ্মীরের কিছু অংশ এবং গিলগিত ও বালতিস্তানের নিয়ন্ত্রণ যায় পাকিস্তানের কাছে, যা পরিচিত হয় আযাদ জম্মু ও কাশ্মীর নামে, সংক্ষেপে আযাদ কাশ্মীর। পক্ষান্তরে ভারতের দখলে যায় জম্মু ও কাশ্মীরের বেশীর ভাগ অংশ এবং লাদাখের বিশাল অংশ, যা পরিচিতি লাভ করে জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর নামে আলাদা একটি রাজ্যরূপে।
এই সেদিন পর্যন্ত রজ্যটির জন্য ভারতীয় সংবিধানে ছিলো ৩৭০ নামে আলাদা একটি অনুচ্ছেদ। এর অধীনে ছিলো ৩৫এ নামে একটি ধারা, যার আলোকে রাজ্যটি বিশেষ কিছু সুবিধা ভোগ করে আসছিলো। সম্প্রতি ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার ঐ অনুচ্ছেদ ও ধারা বাতিল করে দিয়েছে। ফলে কাশ্মীরসমস্যায় যুক্ত হয়েছে নতুন এক জটিল মাত্রা।
ভারত সরকারের প্রকাশিত মানচিত্রে মহারাজার আমলের অবিভক্ত জম্মু ও কাশ্মীরকে ভারতের অংশ হিসাবে দেখানো হয়। অর্থাৎ জম্মু, কাশ্মীর ও লাদাখ-এর সম্পূর্ণ অঞ্চলকেই ভারত নিজের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবী করে। ফলে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণাধীন অংশকে ভারত মনে করে অধিকৃত, দখলকৃত, ইত্যাদি। একই ভাবে পাকিস্তান ভারতের নিয়ন্ত্রণাধীন অংশকে মনে করে অধিকৃত বা মাকবূযা অঞ্চল।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়। অবিভক্ত জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের উত্তর দিকের একটা বিরাট অংশ চীনের দখলেও রয়েছে, যাতে আছে গিলগিত, বালতিস্তান ও লাদাখের বিশাল এলাকা। অর্থাৎ পুরো রাজ্যের মালিকানা বিরোধের পক্ষ হচ্ছে তিনটি, পাকিস্তান, ভারত ও চীন। তবে যেহেতু চীনের অংশে জনবসতি একেবারেই কম সেহেতু বিরোধের আলোচনায় চীনের নাম খুব একটা গুরুত্বের সঙ্গে আসে না। ঘুরে ফিরে পাকিস্তান ও ভারতের নামই আসে। সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কারণে অবশ্য চীনের নামও আলোচনায় আসছে।
মহারাজার আমলের অবিভক্ত জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের মোট ভূমির পরিমাণ হলো দুই লাখ বাইশ হাজার দুইশ ছত্রিশ বর্গকিলোমিটার। পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মোট ভূমির ৩৬ ভাগ, প্রায় ৭৮ হাজার বর্গকিলো -মিটার। ভারতের দখলে রয়েছে মোট ভূমির ৪৫ ভাগ প্রায় ১০০০০০ (একলাখ) বর্গকিলোমিটার। পক্ষান্তরে চীনের দখলে প্রথমে ছিলো প্রায় ষোল ভাগ, ৩৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। পরে ১৯৬৪ সালে কৌশলগত কারণে পাকিস্তান চীনের সঙ্গে একটি সীমান্ত সমঝোতায় আসে। তাতে পাকিস্তান পাঁচহাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা চীনের কাছে হস্তান্তর করে। ফলে বর্তমানে চীনের অধিকৃত এলাকা দাঁড়ায় মোট ভূমির প্রায় ১৯ শতাংশ, পাকিস্তানের এলাকা দাঁড়ায় ৩৩ শতাংশ।
***
জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের সীমান্ত উত্তর দিকে চীন, রাশিয়া ও আফগানিস্তানের সঙ্গে যুক্ত। অন্যদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে চিত্রাল, সোয়াত এবং সীমান্ত প্রদেশের হাজারা অঞ্চল দিয়ে। তারপর রাজ্যের পশ্চিম, দক্ষিণ এবং দক্ষিণপূর্ব অংশ যুক্ত হচ্ছে পশ্চিম পাঞ্জাবের সঙ্গে। তার মানে হলো পাকিস্তানের সঙ্গেই কাশ্মীরের বেশীর ভাগ সীমান্ত, প্রায় দু’শ বর্গকিলোমিটার। পক্ষান্তরে ভারতের সঙ্গে এই রাজ্যের কোন সীমান্ত সংযোগ থাকার কথাই ছিলো না। রেডক্লিফ-এর অন্যায় সিদ্ধান্তের মাধ্যমে পূর্বপাঞ্জাবের গুরুদাশপুর জেলাকে ভারতের ভাগে ফেলা হয়, যা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিচারে পাকিস্তানের ভাগে পড়েছিলো। তো সুপরিকল্পিত অন্যায় বটোয়ারার ফলেই ভারতের সঙ্গে রাজ্যটির চিকন একটা সীমান্ত সংযোগ তৈরী হয়েছে। বস্তত এই ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই এ অঞ্চল পৃথিবীর সবচে’ সংবেদনশীল অঞ্চলরূপে বিবেচিত হয়ে আসছে। আর পাকিস্তানের জনক কায়েদে আযম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ্ বলেছেন কাশ্মীর হলো পাকিস্তানের শাহরগ।
***
যেটাকে বলা হয় কাশ্মীর উপত্যকা, এবার এর ভূপ্রাকৃতিক রূপ ও পরিবেশ সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই।
মধ্যহিমালয়ের পর্বতগুচ্ছের উপর যে বিরাট সমতল উপত্যকা, সেটাই কাশ্মীর নামে পরিচিত। আকাশ থেকে দেখলে দৃশ্যটা হয় এমন, চারপাশে উঁচু উঁচু পর্বতসারির বেষ্টনী। মাঝখানে উল্টো পাঁচ আকারের বেশ বিস্তৃত সমতলভূমি, যেখানে গড়ে উঠেছে মানুষের জনবসতি।
কাশ্মীরউপত্যকা এবং ছোট ছোট আরো কিছু উপত্যকা ছাড়া কাশ্মীরের এই পুরো অঞ্চল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উচ্চতা-সম্পন্ন (৮০০ ফুট থেকে শুরু করে ২৮২৫০ ফুট পর্যন্ত)। ওখানে প্রতিটি মৌসুম প্রচ-রূপে বিদ্যমান। জম্মু, কাঠোয়া ও মিরপুরে গ্রীষ্মকালের গরম যেমন প্রচ- তেমনি ছয়হাজার ফুটের চেয়ে অধিক উঁচ্চতার অঞ্চলে শীতকালে প্রচ- শীত পড়ে। তখন যতদূর দৃষ্টি যায়, শুভ্র তুষার ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না। পৃথিবীর সবচে’ বড় হিমবাহ কাশ্মীরে অবস্থিত যার উচ্চতা বিশ হাজার থেকে পঁচিশ হাজার ফুট পর্যন্ত। সেখানে তুষার জমাট বেঁধে থাকে। পৃথিবীর অতি উচ্চ পর্বতচূড়াগুলো কাশ্মীরে যে পরিমাণ, অন্যকোন দেশে সে পরিমাণ নয়। তন্মধ্যে কে-টু শৃঙ্গ, নাঙ্গা পর্বত, রাকাপুশি, গেশির বরুম ও মাশির বরুম অধিক প্রসিদ্ধ।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পাঁচ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই উপত্যকা প্রায় আশি মাইল দীর্ঘ এবং ত্রিশ মাইল পর্যন্ত প্রশস্ত। পৃথিবীতে এত উচ্চতায় এত বড় আয়তনে আর কোন উপত্যকা নেই। পক্ষান্তরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিচারে তো কাশ্মীরের কোন তুলনাই নেই। বলা হয়, সৌন্দর্যের রাণী কাশ্মীর নিজেই নিজের তুলনা। পুরো উপত্যকাজুড়ে শুধু সবুজ আর সবুজ, যেন সবুজের বিরাট এক গালিচা, যার মধ্যে ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে রঙ বেরঙের ফুল, সুবাসে সৌন্দর্যে যা অতুলনীয়। সর্বত্র দাঁড়িয়ে আছে সবুজশ্যামল গাছগাছালি, যেন হাজার হাজার সবুজ ঝা-। শীতল স্বচ্ছ পানির নদী ও ঝর্ণা এখানে ওখানে প্রবাহিত। তাতে এমন এক অপার্থিব দৃশ্যের অবতারণা হয় যে, মানুষ শুধু তাকিয়েই থাকে নির্বাক দৃষ্টিতে। ভুলে যায় চারপাশের অন্যসবকিছুর অস্তিত্ব। যখন সম্বিত ফিরে পায় তখন নাস্তিক ও সেকুলার মানুষের মুখ থেকে ছোট্ট করে একটা শব্দই শুধু উচ্চারিত হয়, ওয়ান্ডার ফুল! পক্ষান্তরে ধার্মিক মুসলিম শুধু উচ্চারণ করে, সুবহানাল্লাহ্! জনৈক পর্যটক লিখেছেন, ‘কুদরত ও ¯স্রষ্টা এ ভূখ-টি তৈরী করার সময় সমস্ত সৌন্দর্য যেন এখানেই উপুড় করে ঢেলে দিয়েছেন। তারপর যা কিছু সৌন্দর্য বেঁচেছে তা দিয়েছেন, অন্যান্য অঞ্চলে। হয়ত এ বর্ণনায় অতিশয়োক্তি রয়েছে, তবে কাশ্মীরউপত্যকার সৌন্দর্য অবলোকন করে মানুষ এমনই আত্মহারা হয়ে পড়ে যে, কোন অতিশয়তাই দোষের মনে হয় না!
কাশ্মীরে সৌন্দর্যের একটা বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে পাহড়-পর্বত। এগুলোর বিভিন্ন উচ্চতা, বৈচিত্র্য -পূর্ণ বিন্যাস, তারপর পর্বতের বুক চিরে আশ্চর্য মধুর সঙ্গীতের সুর তুলে নেমে আসা ঝর্ণাধারা। ¯রাতে কখনো গতিময়, কখনো মৃদুমন্দ; কখনো নিস্তরঙ্গ, কখনো হালকা ঢেউ। সে তরঙ্গসৌন্দর্য আবার দেখার দৃষ্টি বিভিন্ন। একজন, হয়ত তিনি কবি, তাই কাব্যের লীলায়িত ভঙ্গিতে লিখেছেন, ‘যেন রূপসীর ঠোঁঠের কম্পন, কিংবা নৃত্যের মৃদু কোমল অঙ্গদোলা!’
অন্যজন, হয়ত কাশ্মীরে চলমান জীবনের বাস্তবতা চিন্তা করে ছন্দহীন সাদামাটা ভাষায় লিখেছেন, ‘যেন প্রতিবাদী জনতার বজ্রমুষ্টির আন্দোলন!’
দু’টো বর্ণনাই হয়ত সত্য; একটা সুখের সময়, একটা দুঃখের সময়। তবে, কাশ্মীরের জীবনে এখন শুধু দুঃখ আর দুঃখ; ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের দুঃখ, অশিক্ষা ও বেকারত্বের দুঃখ, আর সবচে’ বড় দুঃখ হলো আগুনের ধোঁয়া ও বারুদের গন্ধ, মৃত্যুর আর্তনাদ এবং গোলামির জিঞ্জির। কাশ্মীরে একসময় কিছু সুখের উপস্থিতি ছিলো, এখন তা সুদূর অতীত।
***
পর্বতসৌন্দর্যের প্রসঙ্গ চলছিলো। এ প্রসঙ্গটা আরো কিছু দূর এগিয়ে নিতে হয়, সৌন্দর্যে পূর্ণতা আনয়নের জন্য। সমতলে দাঁড়িয়ে চারপাশের পর্বতবেষ্টনীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করুন। মনে হবে, বেষ্টনীটা খুব বুঝি কাছে। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। এটা আসলে বাস্তবের সঙ্গে দৃষ্টির মধুর রহস্যলীলা! কারণ দৈর্ঘ্যে প্রস্থে উপত্যকার বিস্তৃতি কম করে একশ কিলোমিটার।
প্রথমে অপেক্ষাকৃত নীচু পাহাড়-গুলোকে মনে হবে, একটি সবুজ প্রাচীর। কারণ সেখানে রয়েছে সারি সারি গাছের ঘন ছায়া। তারপরে রয়েছে আরো উঁচু পাহাড়, তাতেও সবুজের আবরণ। যেন দু’টি ধাপে সবুজের ঊর্ধ্বমুখী একটা ঢেউ। আরো পিছনে ঋজু হয়ে উঠে গিয়েছে নাঙ্গাপবর্ত। সবুজের চিহ্নমাত্র নেই, এজন্যই বোধ হয় এ নাম! কয়লার মত কালো পাথর। সবুজহীনতা ও কৃষ্ণতাই যেন এখানে সৌন্দর্যের নতুন রূপ। কারণ তার চূড়ায় রয়েছে শুভ্র তুষারের অপূর্ব এক আবরণ। ধীর গতিতে দূর থেকে ভেসে আসা মেঘেরা যেন আলতো করে তুষারের শুভ্রতাকে চুমু খেয়ে যেতে চায়। এই যে ধাপে ধাপে পর্বতবেষ্টনীর ছবিটি আপনার সামনে আঁকা হলো, তাতে সৌন্দর্যের শেষ আঁচড়টি কিন্তু এখনো দেয়া হয়নি! সেটা হলো ছবির ক্যানভাসরূপে বিদম্যান বিস্তৃত নীল আকাশ!
আকাশের নীলিমা এবং পবর্ত-চূড়ার শুভ্রতার যেখানে মিলন ঘটেছে, সৌন্দর্য যদি হয় কোন দেবীমূর্তি তাহলে সেটাকে বলা যায় সৌন্দর্যের দেবীর মুখমন্ডল। যে কোন পর্যটকের আরাধ্য গন্তব্য। কাশ্মীর ভ্রমণে এসেছেন, এই নীলিমা ও শুভ্রতার মিলনের রূপসৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে ছুটে আসেননি, অন্তত পর্বতের পাদদেশে, এমন মানুষ হয়ত একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা; এই তিনটি সময় সমতল থেকে দেখা পর্বতবেষ্টনী তিনরকম অনুভূতি দান করে।
ভোরের রাঙ্গা আলোতে মনে হয়, একটা রাঙা বেষ্টনী বুঝি উপত্যকাকে বেষ্টন করে আছে। আর ঝির ঝির করে সিঁদুর বর্ষিত হচ্ছে উপত্যকার সর্বাঙ্গে। দুপুরের রোদে মনে হবে কৃষ্ণদেহী ও শুভ্রকেশের কোন ঋষি বুঝি ধ্যানমগ্ন অবস্থায় পুরো এক শতাব্দী অতিক্রম করেছেন। এখন তার মুখম-লে মোক্ষলাভের পরম পুলকের উদ্ভাস!
সন্ধ্যায় দিগন্তে যখন ছড়িয়ে পড়ে বিষণ লালিমা, মনে হবে, বিরহের বেদনায় নির্বাক বধু বসে আছে লাল ওড়নার ঘোমটা টেনে। আরো মনে হবে, প্রতিটি পর্বতচূড়া যেন, তার দিকে বিষণ বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মনুষ্যসন্তানকে এই বার্তা দান করছে যে, পৃথিবী ও তার জীবন বড় ক্ষণস্থায়ী। জীবনের প্রতিটি সৌন্দর্যই অনিশ্চিত ও অস্তগামী।
***
পর্বতগুচ্ছের বেষ্টনীর যে সৌন্দয, তাকেও ছাড়িয়ে যায় মাঝখানের সবুজ উপত্যকার সৌন্দর্য। উপত্যকার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় যে কোন পর্বতচূড়া থেকে নীচের দিকে তাকিয়ে। হাঁ, পর্বতের চূড়ায় উঠতে থাকুন। একটা অসীম গভীরতা ও গম্ভীরতা ধীরে ধীরে আপনাকে আচ্ছন্ন করবে। সেই আচ্ছন্নতার মধ্যে হারিয়ে যান এবং চূড়ার দিকে তাকিয়ে উঠতে থাকুন। মনের তখনকার অনুভূতিগুলো ধরে রাখার চেষ্টা করুন। চূড়ার খুব কাছে এসে চোখ দু’টো বন্ধ করুন। কেন? কারণ চোখ যখন মেলবেন, উপত্যকার পুরো সৌন্দর্য কেন্দীভূত হয়ে পূর্ণতম রূপে আপনার সামনে উদ্ভাসিত হবে। মনে হবে, বাস্তবতা অতিক্রম করে আপনি দাঁড়িয়ে, আত্মসমাহিত কোন শিল্পীর আঁকা একটি মনোরম ছবির সামনে। সমতল উপত্যকা যদি সম্পূর্ণ সমতল হতো, সৌন্দর্য কিছুটা হলেও ক্ষুণ হতো। এখানে সমতলের বুকেও রয়েছে উঁচু-নীচু ঢেউ, সবুজের ঢেউ। একজন লিখেছেন এবং বোধহয় মন্দ লেখেননি, ‘কাশ্মীর উপত্যকার পুরো ভূমি নদী ও নারীর মত ঢেউ খেলানো।’ এখানেও সেই একই কথা, দেখার দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্নতা!
সমতল থেকে উপত্যকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা চলবে না এবং মাত্র একদিনের সময়পরিসর যথেষ্ট হবে না। আপনাকে বেড়াতে হবে পুরো উপত্যকা। একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত। প্রতিটি সবুজ গালিচায় কিছুক্ষণ বসুন! সবুজের পরশ অনুভব করুন, কেউ সাজিয়ে রাখেনি, তবু মনে হবে সুন্দর করে সাজানো ফুলের বাগানে বিভিন্ন রঙের থোকা থোকা ফুল। সবুজের আবহে ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করুন। এখানে ওখানে উপত্যকাজুড়ে রয়েছে ফলের বাগান, বহুদূর বিস্তৃত একেকটি বাগান, আঙুর, অপেল, নারঙি। জিহ্বার সাহায্যে স্বাদ গ্রহণ করার প্রয়োজন নেই। শুধু চোখের দৃষ্টি দিয়ে এর স্বাদ উপভোগ করুন। নিজেকে বিলিয়ে দিন, সবুজের মাঝে, ফুলের সমাবেশে, ফলের সমাহারে।
তারপর আছে নদী ও ঝর্ণা, পাহাড় থেকে নেমে বয়ে চলেছে উপত্যকার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, সবুজ ও সজীবতার এবং প্রাণ ও উচ্ছলতার উপহার বিতরণ করে করে। নদীর তীরে ঝর্ণার কিনারে কোন একটা পাথরের উপর বসে উপভোগ করুন প্রকৃতির অন্য একরূপ, যার প্রধান অনুষঙ্গ হলো ঢেউ শিশুদের খেলা এবং কুলকুল সঙ্গীত। মনে হবে, আপনি নিজে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের সঙ্গে একাকার। আপনি প্রকৃতির মাঝে এবং প্রকৃতি আপনার মাঝে যেন এসে মিশে গিয়েছে। তখন আপনার ইচ্ছে হবে, ‘প্রকৃতির সকল সৌন্দর্য নিজের মধ্যে ধারণ করে আমি ভালো হয়ে যাই। আমার সমগ্র সত্তা মানুষের জন্য যেন কল্যাণ বয়ে আনে। জীবনকে সুন্দর কিছু উপহার দিয়ে তারপর যেন জীবনের কাছ থেকে বিদায় গ্রহণ করতে পারি।...’
বিভিন্ন রকম অনুভব অনুভূতি অনেক্ষণ আপনাকে আচ্ছন্ন করে রাখবে, যদি আপনি একা হন। আপনার নিঃসঙ্গতা এবং প্রকৃতির নিঃসঙ্গতা যদি একে অন্যকে আলিঙ্গন করতে পারে। অন্তত আপনার মনের মানুষটি ছাড়া আর কেউ যদি কাছে না থাকে!
ইচ্ছে হতে পারে, নদীতে, ঝর্ণায় বা জলাশয়ে নৌকা ভাসিয়ে স্বচ্ছ পানির আয়নায় নিজেকে অবলোকন করার। সে সুযোগও অবারিত আপনার জন্য। তবে এখানে মনের মানুষটি যদি সঙ্গে থাকে, স্বচ্ছ জলের দর্পণে যুগল ছবি অবলোকনের পুলক অনুভূতি সত্যি বড় অপার্থিব। মনে হবে, আহা, সময়ের গতি যদি থেমে যেতো! কিংবা অন্তত জলের দর্পণে এভাবে যুগলবন্দী হয়ে জীবনের শেষ প্রান্তকে যদি স্পর্শ করা যেতো!
কিন্তু না, সময়ের গতিও থামবে না, জলের দর্পণও হবে না স্থায়ী। আপনাকে এবং মনের মানুষটিকে শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করতে হবে জীবনের দাবী ও বাস্তবতার কাছে।
কাশ্মীর উপত্যকার সবসৌন্দর্যের যেটি মিলনমোহনা, স্বপ্নের শহর, প্রেমের নগর, শ্রীনগর। পাঁচহাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যের নগর শ্রীনগর। আসুন এবার শ্রীনগরে। এখানে উপত্যকার অন্যসব সৌন্দর্যের সমাবেশ তো রয়েছেই, সঙ্গে রয়েছে ঝিলাম নদীর ¯রাতে ও তরঙ্গ, আর রয়েছে ডাল জলাশয়ের ‘নীলদর্পণ’! জীবন এখানে এত দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছে এবং পরতে পরতে এত বিচিত্র ছাপ রেখে গিয়েছে যে, এখানে আপনি উপভোগ নয়, অনুভব করতে পারেন জীবনের সকল বৈচিত্র্য এবং জীবনের প্রতিটি অবয়ব।
জীবনের পূর্বাহ্ণ, জীবনের মধ্যাহ্ন, জীবনের অপরাহ্ণ, জীবনের সন্ধ্যা, জীবনের প্রভাত এবং জীবনের সকাল-সন্ধ্যা সবকিছু আপনি অনুভব করতে পারেন আলতো একটি সৌন্দর্যের আবরণে, যদি বিভিন্ন সময়ে ঝিলাম নদীর তীরে গিয়ে দাঁড়ান এবং ডালের শান্ত জলাশয়ে জীবনের ছবি দেখার চেষ্টা করেন।
এখানে শেষ কথাটি বলে আপনাকে অন্য প্রসঙ্গে নিয়ে যাবো। শেষ কথাটি হলো, কাশ্মীরউপত্যকার এই যে, প্রাকৃতিক রূপ ও অপার নৈসর্গিক সৌন্দর্যের চিত্র আপনার সামনে তুলে ধরা হলো, এটি বর্তমানের রূপ নয়। অতীতের কোন এক সময়ের, কাশ্মীরে যখন সহৃদয় শাসক ছিলেন এবং ন্যায়ের শাসন ছিলো। কাশ্মীরে যখন ফুলের পাপড়িতে জীবনের হাসি ছিলো; পর্বতের চূড়ায় উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি ছিলো এবং নদী ও ঝর্ণায় ছিলো সুখের সুরসঙ্গীত! বর্তমানের কাশ্মীরে সৌন্দর্যের কিছু নেই; অন্তত তাদের চোখে যাদের হৃদয়ে এখনো স্পন্দন আছে, যাদের অন্তরে এখনো বিবেক জাগ্রত রয়েছে, যাদের চিন্তায় এখনো ন্যায় ও সত্যের আকুতি রয়েছে এবং যাদের চেতনায় এখনো রয়েছে মানুষ ও মানবতার প্রতি কল্যাণকামনা।
কাশ্মীরে এখন যা আছে তা হলো, আগুন ও ধোঁয়া, কামানের গর্জন ও বারুদের গন্ধ, ছিন্নভিন্ন লাশ ও ছোপ ছোপ রক্ত। কাশ্মীরে এখন যা রয়েছে তা হলো হায়েনাদের অবাধ বিচরণ, উল্লাস ও অট্টহাসি, আর রয়েছে মযলূমানের আর্তনাদ এবং লুণ্ঠিত আবরুর ফরিয়াদ!
এই বর্তমানেরই বাস্তব চিত্র আপনার সামনে এখন আমরা তুলে ধরতে চাই। অবশ্য আমাদের যাত্রা শুরু হবে, ইতিহাসের ঊষালগ্ন থেকে। তবে তার আগে সেই বার্তাটি আপনাদের শুনিয়ে যাই, যা আমি অর্জন করেছি, কাশ্মীরের তুষারশুভ্র পর্বতচূড়ার কাছ থেকে, ‘কাশ্মীরউপত্যকার এত রক্ত, এত কোরবানি বৃথা যাবে না। যালিমানের নির্যাতন, নিপীড়ন ও যুলুম-বর্বরতা শেষ পরিণতি থেকে রক্ষা পাবে না। মযলুমানের ফরিয়াদে একসময় না একসময় আরশ অবশ্যই দুলে ওঠবে। পূর্বদিগন্তে আযাদির রাঙ্গা সূর্য অবশ্যই উদিত হবে। কারণ কোন জাতির আযাদির আকুতি পৃথিবীর কোন শক্তি চিরকাল দাবিয়ে রাখতে পারে না। প্রয়োজন শুধু গন্তব্যের পথে অবিচল থাকা, আর পথের মান্যিলে মান্যিলে খুন ও পসিনার নাযরানা দিয়ে যাওয়া।
***
কখন কীভাবে অস্তিত্ব লাভ করেছে সৌন্দর্যের অপার লীলা-ভূমি কাশ্মীরউপত্যকা? কখন কীভাবে শুরু হয়েছে এখানে মানুষের জনবসতি? কখন কীভাবে বিকশিত হয়েছে এখানে সভ্যতা ও সংস্কৃতি?
যে কোন ভূখ-ন্ডের জন্য প্রতিটি প্রশ্নই মৌলিক, কিন্তু কাশ্মীরের ভূখ-ন্ডে কোন প্রশ্নের স্পষ্ট কোন উত্তর নেই।
কাশ্মীরের প্রথম দিকের ইতিহাস সম্পর্কে আস্থার সঙ্গে কিছু লেখার কোন সুযোগ নেই। ইতিহাসপূর্ব সময়কালটা যদি এড়িয়েও যাই, এমন কোন নথিপত্র, দলীল দস্তাবেজ, বা সামান্য কোন লেখাও নযরে আসে না, যার উপর ভিত্তি করে কাশ্মীরের ইতিহাসে ঊষালগ্নের স্পষ্ট বা অস্পষ্ট কোন চিত্র আঁকা যায়।
কারো মনে হতে পারে তিক্ত, তবে সত্য এটাই যে, পুরা হিন্দু জাতির ‘মনপছন্দ’ বিষয় হলো কুসংস্কার ও কল্পকাহিনী। কাশ্মীরের হিন্দুসমাজও এর ব্যতিক্রম নয়। ইতিহাসের সঙ্গে হিন্দুদের কখনো কোন ‘দিলচাসপি’ ছিলো না। এ কারণেই তারা না নিজেদের শাসনকাল সম্পর্কে কিছু লিখে গিয়েছেন, না পূর্ববর্তী জাতি ও সম্প্রদায়ের অবস্থা সম্পর্কে কোন আঁচড় টেনেছেন। ‘তাহকীক’ ও গবেষণা-অনুসন্ধান তো অনেক পরের কথা। কিছু গল্প, কিছু কল্প, কিছু কাহিনী, যা মুখ থেকে মুখে এবং কান থেকে কানে চলে এসেছে সেগুলোই পরবর্তীকালে কিছুটা সাজিয়ে-গুছিয়ে ইতিহাসের চেহারা দেয়ার চেষ্টা চলেছে।
হিন্দুজাতির ইতিহাসচর্চার নমুনা দেখুন
বেদ, বিশস করা হয়, প্রাচীনতম গ্রন্থ। তাতে রয়েছে, ‘ভারতবর্ষে সূর্য ও চন্দ্রের সন্তান, তথা সূর্যবংশ ও চন্দ্রবংশ, এ দু’টি শাসকবংশ অস্তিত্ব লাভ করেছে। সূর্যবংশের প্রথম রাজা বিগত হয়েছেন, মাত্র নাকি চল্লিশ লাখ বছর হয়েছে! এরপর হিন্দু ‘ঐতিহাসিক ও গল্পকারদের’ দাবী হলো, প্রথম রাজা থেকে রাজা রামচন্দ্র পর্যন্ত ছাপ্পান্ন জন রাজা বিগত হয়েছেন। রামচন্দ্রজীর শাসনকাল নির্ধারণ করা হয়েছে কত সাল? বিভিন্ন মত রয়েছে। তবে আজ থেকে আট লাখ ও এগার লাখ ছাপ্পান্ন হাজার বছরের মধ্যেই তা ঘুরপাক খায়। কিন্তু কোন মতের পক্ষেই কোন সনদ নেই। সনদের প্রয়োজনও মনে করা হয়নি। এখানে বিশসের নামই ইতিহাস!
বিশসের ইতিহাস, এরই উপর ভর করে দাবী করা হচ্ছে রামের জন্মভূমি হলো বাবরি মসজিদের স্থানটি এবং এই দাবীর উপর ভর করেই সভ্যপৃথিবীর চোখের সামনে বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে, যার সম্পর্কে আদালত বলছে, কাজটি বৈধ হয়নি। অথচ এই বিশসের উপর ভর করেই পৃথিবীর সব বিচারক ও বিচারালয়কে হতবাক করে, ভারতের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছে, এখানে মসজিদ নয়, প্রতিষ্ঠিত হবে রামন্দির! আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রধানবিচার-পতিকে উষ্ণতম অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছেন।
যাই হোক, বলছিলাম, কাশ্মীরের ইতিহাসের প্রাথমিক যুগের কথা। যে কোন ঐতিহাসিক এ বিষয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করেছেন, যথেষ্ট জটিলতা ও প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছেন। কাশ্মীরের প্রাথমিক যুগের ইতিহাস সম্পর্কে ‘প্রমাণবান্ধব’ কিছু লিখতে পারেননি কেউ। অধিকাংশ লেখকই ‘রাজতেরঙ্গা’-এর ভিত্তির উপর পুরো ইমারত তৈয়ার করতে সচেষ্ট হয়েছেন। এটি প-ন্ডিত কুলহান আজ থেকে প্রায় আটশ বছর পূর্বে ১১৪৮ সালে রাজা জয়সিং-এর আমলে লিখেছেন বলে জানা যায়। এটি সংস্কৃত ভাষায় লেখা হয়েছিলো। অধিকাংশ ঐতিহাসিক কাশ্মীরের প্রাচীন ইতিহাস লিখতে গিয়ে এটিকেই বুনিয়াদ ও ভিত্তি সাব্বস্ত করেছেন।
তবে বাস্তব সত্য এই যে, এটি কোনভাবেই ইতিহাস নয়, বরং ঐ সব কল্পকাহিনীরই সঙ্কলন, যা মুখে মুখে যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে।
এটাকে আমরা কী বলতে পারি? হিন্দু মিথোলজি, বা রূপকথা! বিভিন্ন ভাষায় যারাই কাশ্মীরের ইতিহাস লিখেছেন, সবাই এই সব হাস্যকর মিথোলজির আশ্রয় নিয়েছেন। তাই বুদ্ধি ও বিবেকের সায় না থাকা সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমিও এখানে সেই রূপকথা লিখবো, যাতে অন্তত ইতিহাসের প্রতি হিন্দুমানসিকতা সম্পর্কে স্পষ্ট একটা ধারণা পাওয়া যায়।
তো হিন্দু রূপকথা অনুযায়ী ‘আদিযুগে উপত্যকার পুরো এলাকা জলমগ্ন ছিলো, যার নাম ছিলো স্বতিস্বর। এই ‘জলস্থলে’ পুরূতীজী নৌবিহারে বের হতেন। জলাঞ্চলের চারদিকের স্থলে যে জনবসতি ছিলো, তাতে জলদেব নামের দানবদের বড় উৎপাত ছিলো। পুরূতীজী নিজেও দানবদলের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে এ সময় ব্রহ্মাজীর পৌত্র কাশপ ভারতের সকল মন্দিরের উদ্দেশ্যে তীর্থ যাত্রায় বের হয়েছিলেন। পথে তিনি স্বতিস্বর জলাশয় এবং দানবকুলের অনাচার সম্পর্কে অবগত হলেন। তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে দানবকুলকে নির্মূল করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু জলদানবও ছিলো বড় সেয়ানা। কাশপের আগমনসংবাদ জানামাত্র জলের তলদেশে এমন ডুব দিলো যে, তার কোন হদীসই পাওয়া গেলো না। কাশপের ব্যর্থতা দেখে বিষ্ণুজীকে হস্তক্ষেপ করতে হলো। তিনি একটা পাহাড় তুলে সজোরে নিক্ষেপ করলেন, যাতে জলধারা দু’ভাগ হয়ে ভূমি বের হয়ে এলো। কিন্তু জলদানব তাতেও কাবু হলো না। পরে এক সুযোগে পুরূতীজী জলদানবকে মেরে ফেললেন। তখন জনবসতি আবাদ হতে লাগলো এবং বিস্তার লাভ করতে লাগলো। পরে সেখানে শাসন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলো। অন্যবর্ণনায়, দেবী সারিকা সাধু কাশপের ইচ্ছানুযায়ী মস্তবড় এক পক্ষীর আকারে সেখানে উপস্থিত হন এবং আপন চঞ্চুতে করে বিরাট এক স্বর্গীয় প্রস্তরখণ্ড আনয়ন করেন। এরপর তা দানবকুলের উপরে নিক্ষেপ করেন। ফলে দানবকুল বিনাশ-প্রাপ্ত হয়। আর প্রস্তরখণ্ডটি নিজেই পাহাড়ে পরিণত হয়ে যায়, যা এখন হরিপর্বত নামে পরিচিত। কাশ্মীরী ভাষায় হর মানে পক্ষী। তা থেকেই হরি শব্দের উৎপত্তি বলে মনে করা হয়। পরে ঋষি কাশপ খাল কেটে পানি অপসারণ করেন বলে কথিত আছে।
পক্ষান্তরে উপত্যকা সৃষ্টির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে গিয়ে অধ্যাপক এম শফী ভাট বলেন, ‘কাশ্মীরউপত্যকা সৃষ্টির ভূতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা হিমালয়ের সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত। ধরা হয়, ত্রিশ মিলিয়ন বছর আগে হিমালয়পর্বতমালার সৃষ্টি। হিমালয় তার গঠনপ্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করতে থাকে। শেষ বরফযুগ সমাপ্ত হয় আজ থেকে দশহাজার বছর আগে। ঐ সময় একটি পর্বতবেষ্টিত উপত্যকা বরফগলা পানির মাধ্যমে জলাশয়ে পরিণত হয়। সম্ভবত রাশিয়ান প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের মধ্যে সঙ্ঘর্ষের কারণে এটা হয়েছে। পরে আবদ্ধ পানির হাইড্রোলিক প্রেসার, ভূতাত্ত্বিক কোন বিবর্তন, অথবা বড় কোন ভূমিকম্পের ফলে ঐ আবদ্ধ উপত্যকার পশ্চিম দিকটা উন্মুক্ত হয়ে পড়ে এবং আবদ্ধ পানি সরে গিয়ে পুরো উপত্যকা বসবাস উপযোগী হয়ে ওঠে। ...
প্রশ্ন হলো, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নামে যা বলা হচ্ছে তারই বা ভিত্তি কী? শুধু কতগুলো, ‘হয়ত- সম্ভবত’ ছাড়া আর কিছু তো নয়! তার চেয়ে যুক্তিযুক্ত কি এটা নয় যে, সরলচিত্তে বলি, ‘আমরা কিছু জানি না। যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনিই জানেন প্রকৃত অবস্থা!
রাজতেরেঙ্গির লেখকও কাশপকে কাশ্মীরের জনবসতির প্রতিষ্ঠাতা স্বীকার করে লিখেছেন, খৃস্টপূর্ব ২১৮০ পর্যন্ত কাশ্মীরে নিয়মতান্ত্রিক কোন শাসক ও শাসনব্যবস্থা ছিলো না। কিন্তু জনবসতির সূচনা কীভাবে হলো, কীভাবে সমাজব্যবস্থা ও শাসন-ব্যবস্থা গড়ে উঠলো এ বিষয়ে ইতিহাস ও ঐতিহাসিক সম্পূর্ণ নীরব। বেচারা প-ত কোলহান কী করবেন! শাসকবর্গের নামের দীর্ঘ একটা তালিকা ধরিয়ে দিয়ে বলছেন, বিক্রমাজীত নামের একজন শাসক থেকে শুরু করে যুধিষ্টর পর্যন্ত একুশজন রাজা কাশ্মীর শাসন করেছেন, যাদের শাসনকাল ছিলো ১০২৪ বছর। এরপর আরো ছয়জন রাজার নাম উল্লেখ করে কোলহান বলছেন, এরা ১৯২ বছর পর্যন্ত শাসন করেছেন। এ সময়ই মূলত বিক্রমি সনের উদ্ভব।
এই সময়ের একটা ‘ঐতিহাসিক’ ঘটনা উল্লেখ করেছেন কোন কোন হিন্দু ঐতিহাসিক। তাতে হিন্দু ইতিহাসের রূপ ও স্বরূপ আরো কিছুটা উন্মোচিত হয়। ঘটনা এই যে, উপরোক্ত ছয়রাজার শেষজন হলেন রাজা জয় ইন্দ্র। তিনি ৩৭ বছর শাসনকার্য পরিচালনা করে শেষ দিকে এসে আপন মন্ত্রীর প্রতি সন্দিহান হয়ে পড়েন যে, হয়ত মন্ত্রীর মনে সিংহাসনের প্রতি লোভ জেগেছে। ব্যস, শূলে চড়িয়ে দিলেন। মন্ত্রীর লাশের একটা গতি তো করতে হয়! তো লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো, হঠাৎ দেখা গেলো লাশের ললাটে, রহস্যময় একটি লেখা, যাতে বোঝা যায়, মন্ত্রী দ্বিতীয়বার জীবন লাভ করে শাসক হবেন। জনৈক ব্রাহ্মণ সবার অগোচরে বিষয়টি জানলেন এবং মন্ত্রীর পুনর্জীবনপ্রাপ্তির প্রতীক্ষায় থাকলেন।
রাত যখন গভীর, তখন ব্রাহ্মণপ্রবর দেখতে পেলেন, কতিপয় অপ্সরা ‘আত্মপ্রকাশ’ করলো। আর মন্ত্রী অপ্সরাদের ছোঁয়ায় জীবন লাভ করলেন। এর পর শুরু হলো আমোদফুর্তির মাইফেল, যা ভোর পর্যন্ত অব্যাহত থাকলো। ভোরের আলো দেখা দিতেই অপ্সরারা মন্ত্রীকে মৃত্যু দান করতে মনস্থ করলো। তখন ব্রাহ্মণপ্রবর তলোয়ার নিয়ে ধেয়ে এলেন, আর অপ্সরার দল মন্ত্রীকে জীবিত রেখেই ভয়ে পালিয়ে গেলো। এরপর এই মন্ত্রী রাজ সন্দীমান- নাম ধারণ করে কাশ্মীরে রাজত্ব করলেন একাধারে দীর্ঘ ৪৭ বছর। তারপর তিনি সিংহাসন ত্যাগ করে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করলেন। এই হলো হিন্দুদের ‘মনপছন্দ’ ইতিহাস! (চলবে ইনশাআল্লাহ্)