আমার আকুতি ছিলো, কিন্তু ...!!
হৃদয়ের গভীরে, অনেক গভীরে, যেখানে কখনো কারো প্রবেশ ঘটে না এমনকি নিজেরও একটু উঁকি দিয়ে দেখার সুযোগ হয় না, হৃদয়ের সেই গভীর তলদেশে একটি ইচ্ছা, একটি আকুতি বহুদিন থেকে লালন করে এসেছি, জীবনপ্রদীপ নিভে যাওয়ার আগে আমার মায়ের কথা আমি লিখবো, হাতের এই ছোট্ট কলমটি দিয়ে। সবকথা নয়, কিছু কথা। সবকথা লেখা এবং লিখতে পারা খুব কম সন্তানের পক্ষেই সম্ভব পূর্ণ হক আদায় করে। তাই শুধু কিছু কথা; এমন কিছু কথা যেখানে আমার মায়ের মুখের নির্ঝর হাসি যেমন আছে, তেমনি আছে তার চোখের গড়িয়ে পড়া অশ্রু। সেই হাসিতে, সেই অশ্রুতে হয়ত মিশে আছে আমারও কিছু হাসি, কিছু অশ্রু। আসলে মায়ের সঙ্গে আমার জীবনটা হাসিতে অশ্রুতে এমনই জড়িয়ে আছে, আলাদা করা সম্ভবই নয়।
কেন লিখতে চাই মায়ের কথা? মায়ের কথা বলতে চাওয়া, এটা বোধহয় স্বভাবেরই আকুতি। তাই যুগে যুগে দেশে দেশে অনেকেই লিখেছেন মায়ের কথা। আমিও লিখতে চাই, হয়ত তাতে বুকের ফোঁটা ফোঁটা দুধের সঙ্গে কলমের ফোঁটা ফোঁটা কালি একত্র হয়ে আমার জন্য বয়ে আনবে আকাশের কিছু প্রাপ্তি! কিছু করুণা!!
আমার মা! করুণাময়ের করুণায় এখনো তিনি বেঁচে আছেন আমাদের জন্য ‘মমতার শীতল ছায়া হয়ে’!! আল্লাহ্ তাঁকে শান্তির সঙ্গে, সুখের সঙ্গে ‘হায়াতে তাইয়েবা’ দান করুন, আমীন।
একটি কবিতার কথা এখন বড় বেশী মনে পড়ছে। কবিকে দেখিনি, শুধু শুনেছি তার এ কবিতা। কবির মায়ের জন্য নিবেদিত এ কবিতা কি হতে পারে না পৃথিবীর সব মায়ের জন্য!! কত সুন্দর বলেছেন অচিন দেশের কবি!-
‘জীবন-বৃক্ষের শাখায় এ ফুল যেন সজীব থাকে/বসন্ত আসে-যায়! এ ফুল যেন ঝরে না যায়!!’
আমি যদি কবি হতাম, একটি কবিতা লিখতাম আমার মায়ের চরণতলে উৎসর্গ করার জন্য, যার সমাপ্তি হতো এই মিনতি নিবেদন করে, ‘আমি হবো তোমার জীবন-প্রদীপের আলো!’
আল্লাহ্ আমাকে কলম দিয়েছেন, কবিতা দেননি। তাই মায়ের চরণে আজ নিবেদন করি ছোট্ট একটি গদ্য- ‘আমার জন্য, মা, তোমার মমতার আঁচল যেমন, তার চেয়ে শীতল যেন হয় তোমার জন্য করুণাময়ের করুণার আঁচল।’
আল্লামা ইকবার তাঁর আম্মাকে স্মরণ করে যে অমর কবিতাটি লিখেছেন তা কি শুধু তাঁর মায়ের জন্য! না, তাহলে তো হতেন না তিনি সব মানুষের কবি! কবির কবিতা কখনো তার নিজের গ-িতে সীমাবদ্ধ থাকে না। তাহলে সেটা আর কবিতা হয় না। কবি আসলে কবিতা লেখেন তাদেরও পক্ষ হতে যাদের হৃদয়ে ভাব আছে, তরঙ্গ আছে, কবিতা নেই এবং ছন্দ নেই। আমি বিশ^াস করি, আল্লামা ইকবালের কবিতাটি যেমন তাঁর মায়ের জন্য তেমনি আমার ময়ের জন্য এবং তেমনি দেশ ও কালের ঊর্ধ্বে পৃথিবীর সব মায়ের জন্য। এমনকি এই যে আমার সামান্য কিছু গদ্য লেখা আমার মাকে নিবেদন করে, তা কি শুধু আমার মায়ের জন্য! না, আমার এ লেখা তোমারও মায়ের জন্য; দেশ ও কালের ঊর্ধ্বে পৃথিবীর সব মায়ের জন্য। যাদের হৃদয়ে ভাব আছে, ভক্তি আছে, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আছে এবং আছে মায়ের প্রতি আত্মনিবেদন, কিন্তু হাতে কলম নেই, কলমের ঝর্ণায় শব্দের সঙ্গীত নেই, আমার এ লেখা তারাও গ্রহণ করতে পারে সাদরে এবং অর্পণ করতে পারে মায়ের চরণে।
জীবনের সমৃদ্ধি ও বিস্তৃতি বলো, কিংবা বলো জীবনের সীমাবদ্ধতা ও সঙ্কীর্ণতা, আসলে তা সম্পর্কের ক্রমশ বিস্তার ছাড়া কিছু নয়। বহুমুখী সম্পর্কের জটিলতাই হলো জীবন। এতেই জীবনের সমৃদ্ধি এবং এখানেই জীবনের সীমাবদ্ধতা। শুরু থেকে এভাবেই চলে এসেছে জীবনের প্রবাহ; এভাবেই চলবে শেষ দিন পর্যন্ত সময়ের স্রােতধারা।
জীবন-নদীর উজানে, প্রবল স্রােতের বিপরীতে সে-ই শুধু পারে এগিয়ে যেতে; সময়-সাগরের বেলাভূমে, আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মুখে সে-ই শুধু পারে নিরাপদে দাঁড়িয়ে থাকতে, সম্পর্কের নিগূঢ় রহস্য যে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে এবং পারে প্রতিটি সম্পর্কের দায় ও
দাবী সহজভাবে রক্ষা করতে।
আমার মা, হাসিমুখে মৃত্যুর ঝুঁকি গ্রহণ করে, আপন সত্তার গভীরে যেদিন আমার প্রাণের সূচনা এবং আমার জীবনের উদ্বোধন বরণ করে নিলেন, সেদিনই হলো একটি সিগ্ধ সম্পকের্র কোমল অঙ্কুরোদ্গম।
আমার মা, বহনের বেদনায় এবং প্রসবের যন্ত্রণায় ‘ক্লিষ্ট’ হয়ে যেদিন আমাকে পৃথিবীর আলোতে আনলেন সেদিনই হলো একটি পবিত্র সম্পর্কের আলোকিত প্রকাশ।
তিনি হলেন আমার মা, আমি হলাম তাঁর সন্তান!
মাকে যদি বলো চাঁদ, সন্তান হলো চাঁদের কণা; মাকে যদি বলো আকাশের তারা, সন্তান হলো তারার ঝিলিমিলি; মাকে যদি বলো বাগানের ফুল, সন্তান হলো সেই ফুলের সুবাস। এ জন্যই আমার মাকে বলি আকাশের চাঁদ ও তারা! এ জন্যই আমার মাকে বলি বাগানের ফুল, আর নিজেকে বলি সেই ফুলের সুবাস।
***
একসময় আমার মায়ের কোলজুড়ে শুধু আমি ছিলাম; আমি ছাড়া কেউ ছিলো না। আমার জীবনে একসময় শুধু আমার মা ছিলেন, মা ছাড়া কেউ ছিলো না। আজ আমার মায়ের মাতৃত্ব কত বিস্তৃত! একটি ফুলের আজ কত সুবাস! আমার মা এখন শুধু আমার মা নন; আমার মায়ের চারপাশে এখন বহুকণ্ঠে ধ্বনিত হয়, মা! মা!! মা!!...!!
‘মা’ একটি কণ্ঠে ধ্বনিত হোক, বা বহু কণ্ঠে, মাতৃত্ব বিস্তৃত হয়, হতে পারে, কিন্তু মাতৃত্ব কখনো খ-িত হয় না, হতে পারে না। আজো আমি অনুভব করি আমার স্বপ্নের অঙ্গনে; অনুভব করি যে, জীবনের ঊষালগ্নের মত, জীবনের এই সন্ধ্যালগ্নেও পরিপূর্ণরূপেই তিনি আমার মা! যেমন তিনি তাঁর প্রতিটি সন্তানের মা!!
হৃদয়ের সমস্ত উত্তাপ ও উষ্ণতা দিয়ে প্রতিটি ফুলের পাপড়িতে আমি লিখতে চাই, ‘মাতৃত্ব বিস্তৃত হয়, মাতৃত্ব খ-িত হয় না।’ প্রসবের বেদনাই মাতৃত্বকে খ-িত হওয়ার মলিনতা থেকে রক্ষা করে।
জীবনে ভোরের আলোর মত সন্ধ্যার আঁধারও আছে। ভোরের আলো এবং সন্ধ্যার আঁধার, দু’টোই তো সত্য, কোনটিকে তুমি স্বীকার করবে, কোনটিকে করবে অস্বীকার! জীবনের সকল সম্পর্কের উপর সবসময় শুধু ভোরের আলোই প্রতিফলিত হয় না, সন্ধ্যার আঁধারও ছায়া ফেলে কখনো কখনো। এটা সত্য, এমনকি মা ও সন্তানের সম্পর্কের মধ্যেও! তবে আরো বড় সত্য এই যে, মা যত দ্রুত মাতৃত্বের দ্যুতি ও প্রভার পরিম-লে ফিরে আসতে পারেন, সন্তান তত দ্রুত পারে না ফিরে আসতে মায়ের মমতার আঁচলের নীচে। তুমিও না, আমিও না, সেও না! কেউ না!!
***
সময়ের অনিবার্য পরিণতি এই যে, আমার জীবনেও একসময় শুরু হয়েছে বহুমুখী সম্পর্কের জটিলতা। শুধু সন্তান ছিলাম আমার মায়ের। ধীরে ধীরে ভাই হলাম অনেকের; স্বামী হলাম একজনের, বাবা হলাম একে একে তিনজনের এবং ...। নানা হলাম। তারপর এখন...!
সম্পর্কের যত বিস্তার হলো, দায় ও দায়িত্ব এবং দাবী ও চাহিদা যত বিভিন্নমুখী হলো, জটিলতা তত গভীর হলো! এবং আমি ...!
ভোরের আলো ও সন্ধ্যার আঁধার এ দু’য়ের দ্বন্দ্ব আমার জীবনে কখনো আসেনি তা নয়, তবে সবসময় আমি চেয়েছি এবং হৃদয় উজাড় করে চেয়েছি, মায়ের মমতার আঁচলটি যেন হাঁতছাড়া না হয়; জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মাতৃত্ব ও তার প্রসববেদনার প্রতি বিশ^স্ত থেকে মৃত্যুকে যেন আলিঙ্গন করতে পারি।
সন্তানরূপে আমার সৌভাগ্য এই যে, জীবনের অনেক চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে মায়ের মমতার আঁচলটি এখনো আমি ধরে রাখতে পেরেছি। এটা আমার কথা নয়, আমার মায়ের কথা, আমার ভাই-বোনদের কথা, আমার স্ত্রী-পুত্র-কন্যার কথা। এ জন্য আমার আল্লাহ্র কাছে আমি কৃতজ্ঞ!
অনুতাপের সঙ্গে স্বীকার করি, ভুল হয়েছে, অনেক ভুল হয়েছে। বুঝে না বুঝে মাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, এমনকি এখনো এই বার্ধক্যের মধ্যেও, যা মা ও আমি ‘প্রায়’ একসঙ্গে বরণ করেছি। কামনা করি, মায়ের ক্ষমাসুন্দর হাসিটি যেন শেষ পর্যন্ত ...! প্রতিটি সন্তান
যেন তার মায়ের জন্য শান্তি ও প্রশান্তির কারণ হয় চিরকাল।
***
জানি তো না, শ^াস ও শরীর আর কতটা সময় একসঙ্গে আছে। শেষ নিঃশসটি ত্যাগ করার আগে, হৃদয়ের আকুতি, আমার মায়ের সম্পর্কে কিছু কথা বলি। আমার মায়ের শৈশব, তার মাতৃত্বের শৈশব, আমার নিজের শৈশব যার প্রায় সবটুকু মায়ের কাছ থেকে শোনা। কিছু কিছু অবশ্য নিজের স্মৃতি থেকেও নেয়া। ইচ্ছে হয়, সেগুলো আজ কাগজের পাতায় লিখে রাখি।
জীবনের অনেক কিছুতেই মায়ের সঙ্গে আমার অনেক মিল, চিন্তায় চেতনায়, আচরণে এবং রুচি ও স্বভাবে। বাবার চেয়ে মায়ের
সঙ্গেই আমার মিল বেশী। তবে একটি সত্য এখানে স্বীকার করে রাখি, বাবার মৃত্যুর পর নতুন কিছু উপলব্ধি আমি অর্জন করেছি, যা বাবা বেঁচে থাকতে আমার ছিলো না। জীবন অনেক সত্যের উপর একটা আবরণের মত হয়ে থাকে, ঐ আবরণটা মৃত্যু বোধহয় কিছু পরিমাণে হলেও, সরিয়ে দেয়। যদি কখনো সুযোগ হয়, এ সম্পর্কে কিছু বলার ইচ্ছা আছে।
প্রকৃতির দানরূপে মায়ের সঙ্গে আমার প্রথম যে মিল তা এই যে, আমি যেমন মা-বাবার প্রথম সন্তান, আমার মাও তাঁর মা-বাবার প্রথম সন্তান!
এই যে আমি বারবার বলি ‘প্রথম সন্তান’, এটা প্রথম শুনেছি নানীর মুখে, দূর শৈশবে। তখন শুধু শুনেছি। এর মর্ম ও তাৎপর্য অনুভব করেছি অনেক পরে। একদিন কী প্রসঙ্গে নানী মাকে বললেন, ‘তুই আমার ফইল্যা সন্তান, তোরে দিয়াই আমি মা অইছি ...!
আমি অবাক হয়ে একবার তাকাই নানীর মুখের দিকে, একবার মায়ের!
কী বলতে চান তিনি, কী অর্থ সন্তানকে দিয়ে মা হওয়ার! মায়ের মাতৃত্বের মধ্যে তাহলে সন্তানের অবদান রয়েছে! আর তো কখনো শুনিনি। নিজেও তো কখনো ভাবিনি!
অনেক পরে একদিন মা আমাকে বললেন, ‘তুই আমার প্রথম সন্তান, তোর দ্বারাই আমি মা! কষ্ট দিলেও তুই দিবি, শান্তি দিলেও তুই দিবি’
এ-ই হলেন আমরা মা! যখন থেকে বুঝতে শিখেছি, এভাবে মাকে কথা বলতে দেখেছি। হালকা ও কোমল শব্দগুলো বেশ ভারি ও কঠিন! হাসতে হাসতে যা বলেন তাতে অশ্রুর আর্দ্রতা থাকে। উপরে তিনি শান্ত সরোবর, তলদেশে স্রােতের প্রবল আলোড়ন!
সেদিন অবাক হয়ে শুধু মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তখন এ কথাটির মর্ম কিছুটা হলেও অনুভব করার বয়স হয়েছে। মায়ের মুখে এ কথাটি শুনে সেদিন আশ্চর্য এক প্রশান্তি এবং অপূর্ব এক সৌভাগ্যের অনুভূতি হয়েছিলো। সঙ্গে সঙ্গে এ মর্যাদা ও সৌভাগ্যের যে দায় ও দায়িত্ব সেটারও অনুভূতি অন্তরে ‘কম্পমান’ ছিলো। কারণ ‘কষ্ট দিলেও তুই দিবি, শান্তি দিলেও তুই দিবি’।
তখন আমরা ভাইবোন কয়েকজন। সেদিন হঠাৎ মনে প্রশ্ন জেগেছিলো, আচ্ছা, আমার মায়ের আমি ছাড়া আর কোন সন্তান যদি না হতো, তার মাতৃত্বে কি কোন অপূর্ণতা থাকতো? নিজের কাছেই উত্তর পেয়েছি, না, কোন অপূর্ণতাথাকতো না। শুধু এই যে, তখন মাতৃত্বের বিস্তার হতো না, কিন্তু পূর্ণতা কোনভাবেই ক্ষুণœ হতো না। তখন থেকে নিজেকে আমি অনেক ভাগ্যবান ভাবতে শুরু করেছি যে, আমার মায়ের মাতৃত্ব আমার জন্মের মাধ্যমে ‘অঙ্কুরিত’ হয়েছে। আমি যখন বলি, ‘মা’ তখন তাতে অন্যরকম একটি ভাবের মূর্ছনা থাকে এবং থাকে অন্যরকম একটি দায় ও দায়িত্বের অনুভূতি। আমার পরে যারা, মায়ের মাতৃত্বে তাদের কোন অবদান নেই, তাদের অবদান শুধু মাতৃত্বের বিস্তারে।
তবে এটাও সত্য, প্রথম সন্তান সবসময় ‘প্রথম’ থাকে না। এমন দুর্ভাগা প্রথম সন্তানও আছে যে তার আল্লাহপ্রদত্ত এ মর্যাদা নিজেই পরবর্তী কোন সন্তানের অনুকূলে বিসর্জন দেয়। তখন ঐ সন্তান প্রথম না হয়েও ‘প্রথম’ হয়ে যায়।
***
নানীর কথা দিয়েই শুরু করি, শৈশবেই মা-বাবাকে হারিয়ে তিনি এতীম হয়েছিলেন। মামা-মামীর কাছেই মানুষ হয়েছেন। আমার জন্য তারা নানা ও নানী। মায়ের কাছে শুনেছি, নিজের চোখেও কিছু দেখেছি, দু’জনই এমন ভালো মানুষ ছিলেন যে, বলতে ইচ্ছে করে ‘ফিরেশতা’! যথেষ্ট আদর যত্নই পেয়েছেন মামা-মামীর কাছে। এমনকি যত দিন তাঁরা বেঁচে ছিলেন নানীর জন্য তারা দু’জন ‘ভাই ও ভাবী’ হয়েই বেঁচে ছিলেন। নানীর জীবনে লেখা-পড়ার সুযোগ তেমন করে হয়নি। হওয়ার কথাও ছিলো না। সে যুগে তো মেয়েদের লেখা-পড়ার চিন্তা মা-বাবার মনেও আসতো না। তখনকার সমাজমানস ছিলো এমন যে, ‘মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক কলম-কালির নয়, চুলা ও কালির!’
তারপরো নানীর ভাগ্য যে, বর্ণের সঙ্গে বর্ণ যুক্ত করে তিনি শব্দ ও বাক্য লিখতে পারতেন। আমার দাদীর ভাগ্যে সেটাও ছিলো না।
নানীর হাতের লেখা আমি দেখেছি। নানার হয়ত পড়তে কষ্ট হতো, তবু নানীর হাতের চিঠি তিনিপেয়েছেন! দাদা কখনো দাদীর হাতের চিঠি পাননি।
এখানে আমি শুধু লেখা-পড়ার কথা বলেছি, শিক্ষার কথা বলিনি এবং বলিনি দীক্ষার কথা। যাকে বলে ‘শিক্ষা ও দীক্ষা’ সেটা আমার নানীর যথেষ্ট ছিলো, আর দাদীর ছিলো অত্যন্ত উচ্চস্তরের। নানী ও দাদীর কিছু ঘটনা যদি এখানে বলি, আমার কথার সত্যতা তাতে সমুদ্ভাসিত হবে। এখন না হয় থাক, পরে অন্য কোন সুযোগে হয়ত বলা যাবে।
এ যুগে মেয়েদের লেখা-পড়া যতটা আছে, শিক্ষা ততটা নেই, আর দীক্ষার ক্ষেত্রে তাদের দৈন্য রীতিমত বেদনাদায়ক। আজ যত সামাজিক অবক্ষয়ের কান্না আমরা কাঁদি তার পিছনে বড় একটা কারণ এটাই যে, আমরা লেখাপড়া কিছু হয়ত করি, শিক্ষা তেমন অর্জন করি না, আরদীক্ষা তো মোটেই গ্রহণ করি না।
তখন মেয়েদের লেখা-পড়া ছিলো না, তবে শিক্ষা যথেষ্ট ছিলো। পক্ষান্তরে কিছু কিছু পরিবারে আভিজাত্য ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় দীক্ষা ছিলো অতি উচ্চস্তরের। যদি শিক্ষার অর্থ হয় চিন্তার সরলতা, হৃদয়ের কোমলতা, আচরণের শালীনতা ও পবিত্রতা; যদি শিক্ষার অর্থ হয় ধৈর্য ও সহন-শীলতা, স্বার্থত্যাগ ও সেবা; যদি শিক্ষার অর্থ হয়....!
এসকল অর্থে আমার নানীর শিক্ষা ছিলো যথেষ্ট উন্নত। সীমাবদ্ধতা কিছু যে ছিলো না, তা নয়। আসলে সীমাবদ্ধতা ছাড়া মানুষ পূর্ণতাই লাভ করে না। মানবসত্তার পূর্ণতাই হলো ‘ভুল ও ভালো’ এর পাশাপাশি অবস্থানের মধ্যে।
নানার যখন ইন্তিকাল, নানীর যখন বৈধ্যব্যের শুরু তখনকার পরিস্থিতির নাযুকতা বোঝার জন্য
এটা জানাই তো যথেষ্ট যে, নানীর প্রথম সন্তান, আমার মায়ের বয়স তখন বারো অতিক্রম করেছে এবং নানীর শেষ সন্তান, আমার মামা তখন সাতমাসের দুধের শিশু। ঘরে তখন দু’বেলার সঞ্চয় ছিলো না। দৃশ্যটা এমন যে, নৌকা মাঝ দরিয়ায়, ঝড় উঠেছে, পাল ছিঁড়েছে, যাত্রিরা দিক হারিয়েছে। এমন নৌকা যে ডুবেনি, বরং শেষ পর্যন্ত বন্দরে এসে ভিড়েছে, তার জন্য বড় অবলম্বন ছিলেন আমার আব্বা, যিনি মাত্রই পালছেঁড়া নৌকাটির যাত্রী হয়েছেন। তবে নানীর স্বভাবের সরলতা, কোমলতা, সহনশীলতা, সেবাপরায়ণতা... এগুলোর ভূমিকাও ছিলো গুরুত্বপূর্ণ।
(চলবে ইনশাআল্লাহ্)
আল্লামা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নাদাবী রাহ. লিখেছেন তাঁর আম্মার স্মৃতি স্মরণ করে-
আমার আম্মাজান সৈয়দা খায়রুন্-নিসা এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন ৬-৬-১৩৮৮ হি. ৩১-৮-১৯৬৮ খৃ. তিনি শুধু তাঁর পরিবার ও খান্দানের জন্য নন, বরং তাঁর প্রজন্মের সকল মুসলিম বাচ্চা-বাচ্চীর জন্য ছিলেন এক আদর্শ ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন বরকত ও কল্যাণে পরিপূর্ণ অতীত যুগের পুণ্যস্মৃতি ধারণকারিণী এক মহীয়সী নারী। আখলাক ও চরিত্রের পবিত্রতা, ঈমান ও বিশসের দৃঢ়তা, আল্লাহ্র প্রতি মুহব্বত ও ভালোবাসা, আখিরাতের প্রতি অনুরাগ এবং দুনিয়ার প্রতি নির্মোহতা, অল্পে তুষ্টি ও কানা‘আত, ধন-দৌলত ও অতিরিক্ত সাজসজ্জার প্রতি অনাগ্রহ, দু‘আ ও মুনাজাতের প্রতি প্রবল আকুতি; এগুলো ছিলো তাঁর সীরাত ও চরিত্রের বড় বড় বৈশিষ্ট্য। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাতানো যিকির ও দু‘আর আছর ও কবূলিয়াতের প্রতি তাঁর একীন ও বিশ^াস ছিলো নিষ্কম্প। তিনি মনে করতেন, এর মধ্যেই রয়েছে মুসলিমের দুনিয়া-আখেরাতের সৌভাগ্য ও সফলতা।