শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

জিলহজ্ব ১৪৪০ হিঃ (৩/৮) | তোমাদের পাতা

জী ব নে র পা থে য় আমার স্মৃতি; কিছু সুখের, কিছু দুঃখের!

জী ব নে র পা থে য় আমার স্মৃতি; কিছু সুখের, কিছু দুঃখের!

 শায়খুল ইসলাম আল্লামা মুফতি তক্বী উছমানী (দা.) 

(৬)

প্রথমেই যেমন বলে এসেছি, দেওবন্দে আব্বাজান রহ. দারুল ইশা‘আত নামে একটি তিজারাতি কুতুবখানা ও বাণিজ্যিক পুস্তকালয় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সেটা তাঁকে দেওবন্দেই রেখে আসতে হয়েছিলো। ভাইজান (জনাব মুহম্মদ যাকী কায়ফী রহ.) শুরু থেকেই ঐ তিজারাতি কুতুবখানার দেখভাল করতেন। তাই তাঁকেও  হিন্দুস্তান থেকে যেতে হয়েছিলো।

কুতুবখানার মুনাফা একে তো খুবই সামান্য ছিলো; দ্বিতীয়ত এটাকে পাকিস্তানে স্থানান্তর করার কোন উপায় বা ব্যবস্থা ছিলো না।

পাকিস্তানে আসার পর আব্বাজান রহ. জানি না, কীভাবে কত কষ্ট করে কিছু ছোট ছোট উর্দূ রিসালা ও পুস্তিকা ছাপিয়েছিলেন। এটা ঐ সময়ের কথা যখন উর্দুভাষী মুহাজিরীন লুণ্ঠিত ও সর্বস্বান্ত অবস্থায় পাকিস্তানে আসছিলেন। তাদের তখন সবচে’ বড় চিন্তা ছিলো ‘রুটি-মাকান’-এর ন্যূনতম কোন ব্যবস্থা করা। এজন্য তখন উর্দু কিতাবের চাহিদা এমন ছিলো না যে, প্রকাশনার ব্যয়ও উঠে আসবে, আবার কিছু আয়েরও ব্যবস্থা হবে।

জীবন ও জীবিকার এরূপ কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও যে চিন্তা ও উৎকণ্ঠা আব্বাজান রহ.কে সবসময় আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো তা এই যে, তিনি তার ‘জীর্ণশীর্ণ’ বৃদ্ধা আম্মাজানকে দেওবন্দে রেখে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন হযরত গাঙ্গোহী রহ. এর বাই‘আত। তাঁর সমগ্র জীবন যাপিত হয়েছে যিকিরমগ্ন অবস্থায়; কখনো তাঁকে যিকরুল্লাহ থেকে খালি অবস্থায় দেখা যায়নি। এমনকি তাঁর শ^াস-প্রশ^াসের সঙ্গে ‘আল্লাহ্ আল্লাহ্’ যিকির আমরা নিজেরাও শুনতে পেতাম।

আব্বাজান রহ. দিল দিয়ে চাচ্ছিলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁকে এখানে নিয়ে আসার কোন ব্যবস্থা যেন করা যায়, আর তা হতে হবে বিমানপথে। কারণরেলের সফর তাঁর পক্ষে সহনীয়ই ছিলো না।

আমাদের দেওবন্দের যে বাসস্থান, ভাইজান সেখানে একাই রয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর বয়স তখন বাইশ চব্বিশের বেশী নয়। দারুল ইশা‘আতের সমস্ত ব্যবস্থাপনা তাঁর দায়িত্বেই ছিলো। মা-বাবা ও ভাই-বোন থেকে দূরে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গতার অবস্থায় তাঁর মনের অনুভূতি কেমন ছিলো তা কিছুটা অনুমান করা সম্ভব তাঁর ঐ সময়ের লেখা কবিতা থেকে। ঈদের সময় ভাই-বোনদের নামে তিনি একটি কার্ড পাঠিয়েছিলেন। তাতে তাঁর একটি অশ্রুসজল কবিতা ছিলো, যার কয়েকটি পংক্তি আজো আমার অন্তরে গেঁথে আছে-

চাই তো দিল যেন ব্যথায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে/কিন্তু উপচে পড়া ব্যথা কেমনে ঢেকে রাখি/ঈদের খুশিতে ঘরে তোমরা করো আলোর সাজ/ আমি না হয় হৃদয় আমার সাজাবো ‘ব্যথার জখমে/মা-বাবা দূরে, ভাই-বোন নেই কাছে/এমন নিঃসঙ্গতায় বলো, হবে কীভাবে ঈদের খুশি!’

আব্বাজান, আম্মাজান ও ভাই-বোন সবাইকে কাঁদিয়েছে ভাইজানের এ অশ্রুসজল কবিতা। এখনো যখন মনে পড়ে, মন ভারী হয়ে ওঠে।

আরেকটি চিন্তা, যা আব্বাজানকে পেরেশান করে রেখেছিলো তা হলো আমাদের শিক্ষা। আমরা চার ভাই তাঁর সঙ্গে পাকিস্তান এসেছিলাম। তিনজনের শিক্ষা অসম্পূর্ণ ছিলো, আর আমার শিক্ষা বলতে গেে শুরুই হয়নি। করাচিতে তখন একটা মাত্র মাদরাসা ছিলো, মাযহারুল উলূম নামে। খাড্ডা মহল্লায় ছিলো তার অবস্থান। আমাদের ঘর থেকে এত দূরে ছিলো যে, সেখানে গিয়ে তালিম হাছিল করা আমাদের পক্ষে উপযোগী ছিলো না।

এদিকে আব্বাজানের জন্য সবচে’ কষ্টের বিষয় ছিলো এই যে, আমরা যে এলাকায় বসতি করেছিলাম সেটা প্রধানত ইংরেজ ও পারসিকদের এলাকা ছিলো। অল্পসল্প মুসলমানও ছিলো, তবে ঐ বেচারাদের মধ্যেও, একদু’টি ব্যতিক্রম বাদে দ্বীনের বিশেষ কোন চিন্তাফিকির ছিলো না। ফলে সেখানে দূর দূর পর্যন্ত কোন মসজিদ ছিলো না। প্রথম দিকে তো আব্বাজান জামাতের জন্য বহু দূরের মসজিদে চলে যেতেন। পরে তিনি আমাদের ঘরের সামনে একটা নামাযঘরের ব্যবস্থা করেছিলেন, কয়েকজন উৎসাহী মুছুল্লীর সহযোগিতায়। ওখানেই পাঞ্জেগানা জামাত শুরু হয়ে গেলো। পরে এর সামনের গলিতে মসজিদের জন্য জায়গারও ব্যবস্থা হয়ে গেলো এবং আলহামদু লিল্লাহ নিয়মিত মসজিদ তৈয়ার হয়ে গেলো। এখনো ঐ মসজিদ আবাদ অবস্থায় রয়েছে।

আরেকটা সমস্যা ছিলো বেশ গুরুতর। মুহাজিরীনের কাফেলা একের পর এক করাচি আসছিলো। তাদের মধ্যে কিছু তো ছিলো নিজেদের আত্মীয়-রিশতাদার। ল

এখানে আব্বাজান ছাড়া তাদেরকোন আশ্রয় বা অবলম্বন ছিলো না। একারণে তারাও প্রায় স্থায়ী মেহমান হিসাবে আমাদের ঘরেই অবস্থান করতেন। তাদেরকে রুটিরোযি ও জীবিকার কাজে লাগানোর চেষ্টা করা, আব্বাজান এটাকেও তাঁর দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত মনে করতেন। এছাড়া ব্যক্তিগত-ভাবেও তিনি সর্বস্ব খুইয়ে আসা মুহাজিরীনের সম্ভাব্য যে কোন সহায্য সহায়তার চেষ্টা করতেন।

মোটকথা, আব্বাজানের সামনে তখন ছিলো বহুমুখী সমস্যা ও পরিস্থিতি। এখন তো আমাদের জন্য এটা অনুমান করাও কঠিন যে, কেমন সব গুরুতর হালাত ও পরিস্থিতির তিনি তখন মুকাবেলা করেছেন। কিন্তু আমাদের জন্য সবসময় তিনি ছিলেন হাসিমুখের পরম ¯েœহশীল পিতা! পরিবারের ছোট বড় সবার সামনে তিনি সবসময় ছিলেন শান্ত উৎফুল্ল; যেন সমস্যা বলতে কিছু তাঁর সামনে নেই! এমনকি ঐ অবস্থায়ও আমাদের মনোরঞ্জনের জন্য তিনি সবাইকে আনন্দভ্রমণেও নিয়ে যেতেন। তখন করাচিতে সাগর দেখার জন্য সবচে’ মনোরম স্থান ছিলো ক্লিফটন; ঐসময় সাধারণ ভাবে যার নাম ছিলো হাওয়া বন্দর।

ঐ সময়ের বিচারে ক্লিফটন ছিলো শহর থেকে অনেক দূরবর্তী স্থান, যে জন্য বাসও খুব কমই যাতায়াত করতো। তাই দিনের বেশীর ভাগ সময় পুরো এলাকা ছিলো বেশ শান্ত নির্জন। আব্বাজান নির্জন সময় দেখে পরিবারের সবাইকে সেখানে নিয়ে যেতেন এখন যেখানে বড় উদ্যান হয়েছে তখন সাগরের ঢেউ সেখান পর্যন্ত আসতো। আর ঐ যে পুরোনো পোল, যা এখন উদ্যানের পুবে পশ্চিমে দেখা যায়, সাগরের ঢেউ ঐ পোলের সামনের অংশের নীচে এসে আছড়ে পড়তো। এখানটায় আমরা নিজ নিজ সাধ্যমত সাগরের ঢেউয়ে দোল খেতাম, ঝাঁপ দিতাম এবং সমুদ্র¯œানের আনন্দ উপভোগ করতাম। ওখানেই দুপুরে বড় আনন্দের পরিবেশে ঘর থেকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া খাবার খেতাম। তারপর বড় সুন্দর স্মৃতি বুকে ধারণ করে ফিরে আসতাম। একই ভাবে আব্বাজান কখনো আমাদের নিয়ে যেতেন পালতোলা নৌকার ভ্রমণে। কীমাড়া থেকে মানূড়া পর্যন্ত দীর্ঘ পথের ভ্রমণ ছিলো সেটা। দিনব্যাপী এই আনন্দ ভ্রমণ আমাদের ছোটদের জন্য ছিলো বড়ই ‘পুরকায়ফ’ ও চিত্তাকর্ষক! বড়ই ‘দিলকুশা’ ও প্রফুল্লতাদায়ক!

এই যে আনন্দভ্রমণ, সাগরতীরে বা পালতোলা নৌকায়, ঐ সময আব্বাজান যেন গল্প বলছেন, এমনভাবে বুযুর্গানে দ্বীনের বিভিন্ন শিক্ষণীয় ঘটনা শুনিয়ে এবং প্রয়োজনীয় উপদেশ দিয়ে আমাদের ফিকরি তারবিয়াতও করতেন। আমাদের চিন্তায়ন ও যিহিনসাজি থেকে কখনো তিনি গাফেল ছিলেন না।

এধরনের পারিবারিক সময়ে আব্বাজানকে দেখে কে বলবে যে, তিনি হলেন পুরো হিন্দুস্তানের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি, এই সেদিনও যিনি ছিলেন দারুল উলূম দেওবন্দের প্রধান মুফতী! কিন্তু সত্য এই যে, আল্লাহ তা‘আলা আব্বাজানকে যে ইলমী যাওক ও জ্ঞানমনস্কতা দান করেছিলেন তা কোন অবস্থাতেই তাঁর থেকে বিচ্ছিন্ন হতো না। ইলমের চর্চা ও ফিক্হের গবেষণায় সর্বাবস্থায় তিনি নিমগ্ন থাকতেন।

দারুল উলূম দেওবন্দের ছদর মুফতীর অবস্থান থেকে যদিও বেশ কিছু দিন হয়েছে, তিনি ইস্তিফা দিয়েছেন, তারপরো দুনিয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে ফিকহী সমস্যার উপর বিভিন্ন জটিল প্রশ্ন তাঁর কাছে আসতেই থাকতো, আর তিনিও পূর্ণ যত্ন ও ইহতিমাম এবং দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সেগুলোর উত্তর লিখে পাঠাতেন।

দেওবন্দ থেকে যদিও তিনি খুব বেশী সামানসামগ্রী আনতে পারেননি, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিতাব, হাতে লেখা প্রাচীন পা-ুলিপি, নিজের বিভিন্ন পা-ুলিপি, বড়দের পত্রাবলী ও তার্বা-রুকাত অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে সঙ্গে এনেছিলেন। তিনি বলতেন, কাস্টমসের তল্লাশির সময় আমার সবচে’ দুশ্চিন্তা হতো এই সমস্ত কিতাব ও কাগজপত্রের। তবে সুখের বিষয়, এসবে তাদের ‘গরয’ ছিলো না। তাদের তো নযর ছিলো শুধু সোনাদানা ও সেলাইহীন বস্ত্র যেন পার না হয়।

তো এভাবে আব্বাজান রহ. এর এই সমস্ত ‘ইলমিখাযানা’ মোটামুটি তাঁর সঙ্গেই এসে গিয়েছিলো। এমনকি শায়খুল ইসলাম হযরত আল্লামা শাব্বীর আহমদ উছমানী রহ.এর পক্ষেও সম্ভব হয়নি নিজের সঙ্গে এত কিতাব আনা। ফলে কখনো কোন মাসআলার তাহকীক ও সন্ধানের প্রয়োজন হলে তিনি আব্বাজানের কাছে আসতেন এবং তিনতলার সিঁড়ি ভেঙ্গে আমাদের ঘরে উপস্থিত হতেন। তারপর শুরু হতো তাঁর মুতালা‘আ ও নিবিষ্ট অধ্যয়ন।

তো বলছিলাম কিতাব ও কুতুব-খানার কথা। আল্লাহ তা‘আলার অপার দয়া ও অনুগ্রহে এসমস্ত সমস্যা ও পেরেশানির সমাধান ধীরে ধীরে এমন সুন্দরভাবে হতে লাগলো যে, ব্যস আল্লাহর শোকর! কতিপয় শুভাকাক্সক্ষী আব্বাজানের সঙ্গে শরীকানার ভিত্তিতে কিতাব-প্রকাশনার একটি সংস্থা করাচিতেই গড়ে তুললেন।

অন্যদিকে ভাইজান মরহূম, যিনি দেওবন্দে কুতুবখানা পরিচালনা করছিলেন, তাঁর সামনেও কোন না কোনভাবে কিছু অনুকূল অবস্থা তৈরী হলো। তিনি পুরো কুতুবখানা  সেখান থেকে গুটিয়ে পাকিস্তান চলে এলেন। এমনকি আমাদের দাদী ছাহেবাকেও সঙ্গে নিয়ে এলেন। আগেই বলা হয়েছে, রেলের সফর তাঁর জন্য সহনীয় ছিলো না, সেহেতু ভাইজান তাঁকে বিমানে করেই এনেছিলেন। সেটা ছিলো আমাদের ঘরের সবার জন্য আনন্দের ও সৌভাগ্যের অবিস্মরণীয় দিন। তাঁকে ইস্তিকবাল করে আনার জন্য আমরা সবাই বিমানবন্দরে গিয়েছিলাম। ড্রাগরোডের বিমানবন্দর,

তখন মনে করা হতো, শহর থেকে অনেক দূরে। মাঝখানে বনজঙ্গলও ছিলো। তখন

ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েয নামে একটাই মাত্র বিমানসংস্থা পাকিস্তান ও হিন্দুস্তানের মধ্যে ফ্লাইট পরিচালনা করতো। ডাকোটা বিমান যখন রানওয়ে পার হয়ে মাঠে এসে স্থির হলো তখন সবার ব্যাকুলতা ছিলো দেখবার মত। আমার জন্য তো কোন বিমানকে এত কাছে থেকে দেখার সেটাই ছিলো প্রথম সুযোগ। কত অবাক হয়েছিলাম ভেবে যে, এত বড় বিমান পাখীর মত আকাশে ওড়ে! পেটের ভিতরে মানুষ বোঝাই করে আনে!

সবার ব্যাকুল দৃষ্টি তখন নিবদ্ধ ছিলো বিমানের দারজার দিকে। কিছুক্ষণ পর ভাইজান দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন এবং হাস্যোজ্জ্বল মুখে আমাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়লেন। তারপর আবার ভিতরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আবার  যখন তিনি দরজার সামনে এলেন তখন দাদীজানকে তিনি আপন বাহুতে তুলে রেখেছেন। আব্বাজন তো আনন্দের আতিশয্যে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে উঠলেন। তাঁর তখনকার আনন্দের পরিমাণ পরিমাপ করে, কার সাধ্য! এভাবে আল্লাহর রহমতে আব্বাজানের বড় একটা পেরেশানির সমাপ্তি হলো।

যে পরিমাণ কিতাব বিমানে আনা সম্ভব ছিলো তা তো ভাইজান সঙ্গে করে এনেছিলেন। সমগ্র গ্রন্থসম্ভার তো পানি- পথেই আনা সম্ভব ছিলো। আল্লাহ তা‘আলা সেটারও সহজ উপায় করে দিয়েছিলেন।

ঘটনা এই যে, দেওবন্দে আব্বাজানের একজন খাছ শাগিরদ ছিলেন হযরত মাওলানা নূর আহমদ ছাহেব (রহ.) তাঁর জন্মস্থান ছিলো বার্মার (আরাকানের) আকিয়াব অঞ্চলে। দ্বীনের তা‘লীম হাছিলের জন্য তিনি দারুল উলূম দেওবন্দে হাযির হয়েছিলেন। তখন থেকে আব্বাজান রহ. এর সঙ্গে তাঁর খুছূছি তা‘আল্লুক ও বিশেষ সম্পর্ক ছিলো।

আব্বাজান যেহেতু পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় হয়েছিলেন, অথচ দারুল উলূম দেওবন্দে অবস্থান করে কোন রাজনৈতিক কর্মকা-ে অংশ নেয়া নিয়মের দিক থেকে সম্ভব ছিলো না; তাঁর নিজেরও সেটা পছন্দ ছিলো না। তাই তিনি আপন শায়খ হযরত হাকীমুল উম্মত থানবী রহ.-এর ইঙ্গিতে দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে ইস্তিফা দিয়েছিলেন। হযরত মাওলানা নূর আহমদ ছাহেব যেহেতু আব্বাজানের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রাখতেন সেহেতু সম্ভবত দরসের খারেজি সময়ে তিনি আব্বাজানের কাছে কিছু কিতাবও পড়তেন এবং বেশীর ভাগ সময় আব্বাজানের খেদমত ও ছোহবতেই থাকতেন। আব্বাজানের পাকিস্তান চলে আসার কারণে তিনি বড় কষ্টের মধ্যে ছিলেন এবং নিজেও পাকিস্তান চলে আসতে চাচ্ছিলেন। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে ‘অভিযাত্রাগুণ’ দান করেছিলেন বিরাট পরিমাণে। যে কোন কঠিন ও কষ্টসাধ্য কাজ ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সম্পন্ন করার স্বভাবযোগ্যতা ছিলো তাঁর। কিতাবের পুরো ‘যাখীরা’ ও সম্ভার পানির জাহাযে করে পাকিস্তন আনার দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন এবং অত্যন্ত সুচারুরূপে তা পালনও করেছিলেন। এভাবে তাঁর মাধ্যমে পুরো কুতুবখানা করাচিতে পৌঁছে গিয়েছিলো। আব্বাজান তাঁর সঙ্গে আপন ভাগিনা জনাব ফখরে আলম ছাহেবকেও পানিপথে আনিয়েছিলেন। (মরহূম) ফখরে আলম ছাহেব মা-বাবার ইন্তিকালের পর আমাদের দাদিজানের প্রতিপালনেই ছিলেন। দাদিজান পাকিস্তান চলে আসার কারণে দেওবন্দে তিনি তাঁর খালার কাছে ছিলেন। কিন্তু তাঁর বিচ্ছেদের কারণে আমাদের দাদিজান বড় বে-চায়ন ছিলেন।

আব্বাজান রহ. জরুরি মনে করে মাওলানা নূর আহমদ ছাহেব রহ. এর সঙ্গে তাকেও নিয়ে আসার ব্যবস্থা করলেন। এভাবে তিনিও পানির জাহাযে তাঁর সঙ্গে এসে গেলেন।

আমার তা‘লীমের শুরু

করাচিতে হযরত শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাব্বীর আহমদ উছমানী রহ. এর নিজের কোন বাসস্থান তো ছিলো না, তবে জামশেদ রোডের আমিল কলোনিতে মুসলিম লীগের একজন নেতা এস এম কোরায়শী মারহূমের একটা বাংলো ছিলো। কোরায়শী মারহূম আব্দার করেছিলেন, হযরত শায়খুল ইসলাম যেন ঐ বাংলোতে অবস্থান করেন। মরহূমের আব্দার রক্ষা করে তিনি সেখানে অবস্থান করছিলেন। হযরত আব্বাজান রহ. পাকিস্তান হুকূমতের দাওয়াতে করাচি এসেছিলেন। তো নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিষয়ে পরামর্শের জন্য তিনি হয়রত শায়খুল ইসলামের অবস্থানস্থলে ঘন ঘনই আসাযাওয়া করতেন। আর বেশীর ভাগ সময় আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতেন। উদ্দেশ্য ছিলো হযরত শায়খুল ইসলামের দু‘আ নেয়া। একবারের কথা মনে পড়ে, সুন্দর গিলাফে রক্ষিত কায়দা বোগদাদী নিয়ে হযরতের সামনে আমি বসা ছিলাম। খুব সম্ভব ঐ সময় আব্বাজান রহ. হযরতের হাতে বিসমিল্লাহ্ করানোর জন্য আমাকে সঙ্গে নিয়েছিলেন।

এদিকে হযরত মাওলানা ইহতিশামুল হক থানবী রহ. জ্যাকব লাইন এলাকায় একটি মসজিদ তৈরী করে নিয়েছিলেন। তখন তাতে টিনের চাল ছিলো। মসজিদের সঙ্গে তাঁর বাসস্থানও ছিলো। ঐ ছোট্ট মসজিদে তিনি ছোট্ট একটি মাদরাসাও শুরু করেছিলেন। সেখানে হেফযে কোরআন ও নাযেরা পর্যন্ত তালিম হতো।

হযরত আব্বাজান রহ. আমার বড় ভাইদের তো ওখানে দাখেল করে দিলেন। মুহতারাম ভাই জনাব মুহম্মদ ওয়ালী রাযী ছাহেব ক্বারী মুহম্মদ যাকারিয়্যা রহ. এর নিকট এবং হযরত মাওলানা রফী উছমানী ছাহেব জনাব হাফেয নাযীর আহমদ ছাহেব রহ. এর নিকট হিফয করতেন।

কম বয়সের কারণে আব্বাজান রহ. ঐ সময় আমাকে ওখানে দাখেল করেননি, বরং ঘরেই হযরত মাওলানা নূর আহমদ ছাহেব রহ. এর কাছে কায়দা বোগদাদী পড়ানো শুরু করে দিলেন।

কায়দা তখনো সমাপ্ত হয়নি, বরং যথেষ্ট পরিমাণ বাকি ছিলো। এমন সময় দেওবন্দ থেকে আসা পত্রযোগে জানা গেলো, আমার এক ভাগিনী (যে আমার চেয়ে মাত্র একবছর বড় ছিলো) আলিফলাম মীম পারা শুরু করে দিয়েছে।

আমি আগেও বলেছি, হযরত মাওলানা নূর আহমদ ছাহেব মুশকিল থেকে মুশকিল কাজও দ্রুত গতিতে করতে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি যখন জানলেন যে, আমার বয়সের ভাগিনী দেওবন্দে আলিফ লাম মীম শুরু করে দিয়েছে তখন তিনি খুব প্রত্যয়ের সঙ্গে বললেন, তুমি কায়দা যথেষ্ট পড়ে নিয়েছো। এখন তোমাকে ‘আম্মাপারা’ শুরু করিয়ে দিচ্ছি। যেমন কথা তেমন কাজ, কায়দা শেষ হওয়ার আগেই ‘আম্মাপারা’ শুরু হয়ে গেলো। এভাবেই তিনি আমাকে নাযেরা পড়াতে থাকলেন। এমনকি দ্রুত সময়ে সাত পারা পূর্ণ হয়ে গেলো। এ পর্যায়ে এসে তিনি বলে দিলেন। এখন তো তোমার ‘শব্দপরিচয়’ হয়ে গিয়েছে। তাই বাকি কোরআন শরীফ প্রতিদিন তুমি নিজে পড়ে নিতে থাকো।

এর পর তিনি আমাকে উর্দূ কায়দা ও বেহেশতি যেওর দ্রুত পার করিয়ে বেহেশতি গাওহার শুরু করিয়ে দিলেন।

আমার মনে আছে, বেহেশতি গাওহারের প্রথম বাক্যটি ছিলো-

یہ عالم شروع میں ناپید تھا

এ জগত শুরুতে অস্তিত্বহীন ছিলো

এ বাক্যে ‘নাপায়দ’ শব্দের মতলব বুঝতে আমার যথেষ্ট ঝামেলা হলো, আর আমি তা বোঝার জন্য উস্তাযকে বেশ অতিষ্ঠ করে তুললাম।

যাই হোক বেহেশতি গাওহারের সামান্য কিছু সবকই হয়েছিলো, এর মধ্যে হযরত মাওলানা ইহতিশামুল হক ছাহেব রহ. তাঁর মাদরাসায় কিতাবের তা‘লীমও শুরু করে দিলেন। ধীরে ধীরে সেখানে নিয়মিত দারস ও তাদরীস (পঠন-পাঠন) এর ধারা শুরু হয়ে গেলো। সেখানে হযরত মাওলানা বদরে আলম রহ. এর মত আকাবিরও দরস দিয়েছেন। সম্ভবত কিছু দিন আব্বাজান রহ. এরও দরস হয়েছে। হযরত মাওলানা নূর আহমদ ছাহেব রহ. সেখানে তাদরীসের খেদমতে মশগূল হয়ে গেলেন। এ জন্য আমি বেহেশতি গাওহার ও সীরাতে খাতামুল আম্বিয়া কিতাবের কিছু অংশ আম্মাজান রহ এর নিকট পড়া শুরু করে দিলাম। এখন মনে নেই, কার কাছে কতটুকু অংশ পড়েছি। তবে এটুকুই ছিলো আমার উর্দূ শিক্ষার ‘পুরা দুনিয়া’! অর্থাৎ এই কিতাব-দু’টি ছাড়া উর্দূ শেখার জন্য আর কোন কিতাব আমি পড়িনি।

অন্য দিকে কোরআন শরীফ প্রতিদিন নিজের মত করে পড়তে থাকতাম। এখনো চোখের সামনে ভাসে সেই দৃশ্য। সামনে তাকিয়ার উপর কোরআন শরীফ, আর চৌকির উপর বসা ছোট্ট বাচ্চা তাক্বী, আজকের আমি!

নিজেই পড়তাম। কাউকে শোনাবার তেমন সুযোগ হতো না। মাঝে মধ্যে আম্মাজানকে, বা ঘরের কাউকে হয়ত শোনাতাম।

তো এভাবে নিজে নিজে পড়ে একদিন ভোরে আলহামদু লিল্লাহ্ কোরআন শরীফের নাযেরা পূর্ণ হয়ে গেলো।

আমার ঐ বয়সেই দেখতাম, যখন কোন বাচ্চার নাযেরা বা হেফয সমাপ্ত হতো, তার জন্য রীতিমত উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো, তখন যার নাম ছিলো ‘আমীন অনুষ্ঠান’। এমনকি কখনো কখনো মিষ্টি বিতরণ করে আনন্দ প্রকাশ করা হতো। এদিকে আমার অবস্থা ছিলো এমন যে, যেদিন আমার এই স্বয়ংক্রিয় নাযেরা পূর্ণ হলো, কারো খবরও ছিলো না যে, ঘরে এক বাচ্চার কোরআন নাযেরা সমাপ্ত হতে চলেছে। এখনো আমার মনে আছে ঐ সময়ের কষ্টের কথা যে, কামরার মধ্যে আমি একা শেষ আয়াতগুলো পড়ে কোরআন শরীফ বন্ধ করলাম। না কেউ দেখলো, না কেউ শুনলো! না কোন উৎসব, না কোন জলসা!

মনের কষ্টটা চেপে রাখা আর সম্ভব হলো না। শেষ পর্যন্ত হযরত আব্বাজান রহ.কে খবর দিলাম যে, আজ আমার কোরআন শরীফ পূর্ণ হয়ে গিয়েছে।

খবর শুনে আব্বা অবশ্য খুব খুশী হলেন এবং খুশি প্রকাশও করলেন। পুরস্কার আনার জন্য আমার বড় দু’ভাই (মাওলানা মুহম্মদ ওয়ালী রাযী এবং হযরত মুফতী মুহম্মদ রফী উছমানী মু.) কে তখনি বাজারে পাঠালেন। মনে পড়ে তৃতীয় তলার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ব্যাকুলতার সঙ্গে আমি তাঁদের ফিরে আসার প্রতীক্ষায় ছিলাম। একসময় দেখি, দূর থেকে তাঁরা আসছেন। তাঁদের হাতে নীল রঙের একটা খেলনা গাড়ী। তারা নিজেরাও খেলনা হাতে খেলা করতে করতে আসছেন। পুরস্কারের নামে সেই খেলনা গাড়ী পেয়ে আমার খুশির কোন যেন ঠিকানা ছিলো না! সুন্দর, তবে খুব সাধারণ গাড়ী ছিলো সেটা। ঐ সময় সম্ভবত চাবি দেয়া বা বেটারিচালিত গাড়ীর চল ছিলো না। কিন্তু আমার চোখে সেটাই ছিলো সাতরাজার ধন।

এখন অনুভব করি, এ ক্ষণস্থায়ী জীবনের প্রতিটি স্তরে মানুষ যা কিছুর সঙ্গেই দিল লাগাতে থাকে, পরবর্তী পর্যায়ে সেটাই হয়ে পড়ে তার জন্য হাসির খোরাক! এমনকি একসময় ঐ মুহূর্তও এসে যায় যখন দুনিয়ার সমস্ত ধনসম্পদ, সোনাদানা ও ঘরবাড়ী তার কাছে খেলনার চেয়েও তুচ্ছ মনে হয়। কত না সুন্দর বলেছেন কবি-

জীবনের তামাশা দু’দিনের বেশী তো ছিলো না/তাও কী বলবো তোমাকে, কেটেছে কীভাবে?/ একদিন গেলো এদিকে সেদিকে মন লাগাতে/ একদিন গেলো এদিক সেদিক থেকে মন ফেরাতে!

আমারও কি আজ হাসি পায় না, সেই খেলনা গাড়ীর আনন্দের কথা ভেবে! তবু দূর শৈশবের সেই আনন্দটি ছিলো সত্য, যেমন সত্য আজ ঐ একই খেলনা সম্পর্কে তুচ্ছতার অনুভূতি এবং হাসির উদ্রেক।

তো যাই হোক এটাই হলো আমার শিক্ষাজীবন শুরুর ইতিকথা।

***

পাকিস্তানের নিসম্বল যাত্রা

নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্ম তো হলো। কিন্তু ভারতভাগের ফলে সম্পদের বাটোয়ারা যেভাবে হলো তাতে একে তো আনুপাতিক হিসাবে পাকিস্তানের ভাগে পড়লো খুবই অল্প পরিমাণ। তদুপরি বেশীর ভাগই ছিলো ভারতের দখলে। সেগুলো পাওয়ার জন্য যে দেনদরবার তাতেও ছিলো দীর্ঘসূত্রিতা। এমনকি আজো তার মীমাংসা হয়নি। এজন্য পাকিস্তানের হুকূমত অত্যন্ত সীমিত উপায় উপকরণ দিয়েই কাজ শুরু করেছিলো, করতে বাধ্য হয়েছিলো। বলা যায়, সেটা ছিলো শূন্য থেকে শুরু। তখন রাজধানী ছিলো করাচি। মন্ত্রণালয়গুলো সচীবালয়ে কাজ করতো টিনের চালের বিভিন্ন কামরায়। পেপারওয়েট পর্যন্ত ছিলো না, টুকরো পাথর দিয়ে কাগজ চাপা দেয়া হতো। আর ফাইলের কাগজ আটকে রাখার জন্য পিনক্লিপের স্থলে ব্যবহার করা হতো কাঁটা। আজকের প্রজন্মের কাছে বিশ^াসযোগ্য হবে এসব কথা?!

তো ঐ কঠিন সময়ে পাকিস্তানের সংবিধানপ্রণয়নপরিষদ একটি বোর্ড গঠন করেছিলো যার নাম ছিলো ‘ইসলামী নীতিমালা বোর্ড’। বোর্ডের কার্যালয়ও নির্ধরণ করা হয়েছিলো পরিষদের কাছাকাছি টালির ছাদওয়ালা কামরায়। বোর্ডের সভাপতিত্বের জন্য হযরত আল্লামা সৈয়দ সোলায়মান নদবী রহ.কে দাওয়াত দেয়া হলো। হযরত আব্বাজান রহ.কে একজন সদস্য নির্বাচন করা হলো।

বোর্ড গঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিলো প্রণয়নাধীন সংবিধানে ইসলামের শিক্ষা ও নীতিমালা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রস্তাব তৈরী করা।

বোর্ডের সদস্য হিসাবে হযরত আব্বাজানকে জ্যাকব লাইন এলাকায় একটি কোয়ার্টার দেয়া হয়েছিলো।

এর মধ্যে আমাদের সবার বড় বোন মুহতারামা নাঈমা খাতুন (মারহূমা) স্বামী-সন্তানসহ হিন্দুস্তান থেকে করাচি এসে পড়লেন। এখন তারা কোথায় থাকবেন সেটা ছিলো প্রশ্ন। আব্বাজন প্রায় একবছর ধরে সপরিবারে কিংসকোর্ট-এর ফ্লাটে বসবাস করছিলেন। সেটি তিনি সাময়িকভাবে বড় বোনের জন্য ছেড়ে দিয়ে নিজে চলে এলেন জ্যাকব লাইনের কোয়ার্টারে। এভাবে ঐ কোয়ার্টারটি তখন বড় একটা নেয়ামত প্রমাণিত হয়েছিলো।

এতে আরেকটি সুবিধা হয়েছিলো এই যে, জ্যাকবলাইনে অবস্থিত হযরত মাওলানা ইহতিশামুল হক ছাহেবের মাদরাসাটি আমাদের কোয়ার্টারের কাছে হয়ে গেলো। ওখানে তো আমাদের বড় দু’ভাই আগে থেকে পড়ছিলেন, এখন আমাকেও ওখানে পড়ার উপযুক্ত বিবেচনা করা হলো। আমার চারভাইকে তো প্রথমে হিফযে দেয়া হয়েছিলো, কিন্তু আমাকে হিফযে দেয়া হলো না। সম্ভবত আব্বাজান রহ. আমার শারীরিক দুর্বলতা ও জীর্ণ শীর্ণ অবস্থার দিকে তাকিয়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আমাকে তিনি সরাসরি উর্দূ-ফার্সির মিশ্র শিক্ষায় বসিয়ে দিলেন। শুরুটা হয়েছিলো ‘হামদে বারী’ নামের কিতাব দ্বারা। এটি ছিলো মাওলানা আব্দুস্-সামী বে-দিল মারহূম-এর রচিত কিতাব। তাতে বিভিন্ন শব্দের অর্থ বোঝানো হয়েছিলো দ্বিপদী কবিতার মাধ্যমে।

মাওলানা আব্দুস্-সামী যদিও বেরেলভী মাসলাকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তবু তার এ কিতাবটিকে বাচ্চাদের জন্য উপযোগী বিবেচনা করা হয়েছিলো। তাই ওলামায়ে দেওবন্দ এ কিতাবটিকে ব্যবহার করতে কোন রকম কুণ্ঠা বোধ করেননি এবং এ ক্ষেত্রে কোন প্রকার ফেরকাগত চিন্তাকে বাধা হয়ে দাঁড়াতে দেননি। সমস্ত দেওবন্দী মাদরাসায় এ কিতাব স্বচ্ছন্দে পড়ানো হতো। এমনই উদার চিন্তার অধিকারী ছিলেন এবং আছেন ওলামায়ে দেওবন্দ! (ওলামায়ে দেওবন্দ কি এরূপ ফিরতি আচরণ পেয়েছেন? তখন এবং এখন?- অনুবাদক)

তো জ্যাকব লাইনের মাদরাসায় আমি হামদে বারী কিতাবটি পড়তাম, আর পড়তাম ফার্সির ‘গ্যর্দাান’ শেখার কিতাব ‘রিসালায়ে নাদির’। এখানেও আমার শিক্ষক ছিলেন হযরত মাওলানা নূর আহমদ ছাহেব রহ.। তবে অল্প- বয়সের কারণে আমার এ পড়া ছিলো বেশ শিথিল ও বাধ্যবাধকতা -মুক্ত। ইচ্ছা হলো সবক পড়লাম, ইচ্ছা হলো ছুট্টি করে নিলাম। বরং এমনো হতো যে, এক সবক পড়লাম একজন উস্তাযের কাছে, আরেক সবক পড়লাম অন্যজনের কাছে।

হযরত মাওলানা ইহতিশামুল হক থানবী রহ.-এর ছাহেবযাদাদের মধ্যে মাওলানা ইহতিরামুল হক ছাহেব আমার চেয়ে কিছু বড় ছিলেন, পক্ষান্তরে জনাব ই‘তিছামুল হক ছিলেন আমার প্রায় সমবয়সী (হাফিযাহুমাল্লাহু তা‘আলা)।

এই ধরাবাধাহীন পড়ার পর অবসর সময়গুলোর বেশীর ভাগ কাটতো এ দু’জনের সঙ্গে। হযরত মাওলানা ইহতিশামুল হক থানবী রহ. এর ঘরে যে সব মজলিস হতো তাতেও গিয়ে বসে পড়তাম মাঝে মধ্যে।

আমার তা‘লীমের এই যে অনিয়মিতি, এর একটা কারণ এও ছিলো যে, ঐ সময় কয়েকবার আমার টাইফয়েড হয়েছিলো, যার ফলে মাসের পর মাস বিছানায় পড়ে থাকতে হতো।

আরেকটা বিষয় ছিলো; ঐ সময় আমাদের ভাইজান জনাব মুহম্মদ যাকী কায়ফী রহ. লাহোর চলে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ‘ইদারায়ে ইসলামিয়াত’ কুতুবখানা কায়েম করেছিলেন। ঐ সময় তাঁর প্রথম সন্তানের জন্ম আসন্ন ছিলো। এ উপলক্ষে আম্মাজান লাহোরের সফর করেছিলেন। তো আমি যেহেতু ছিলাম তাঁর আদরের সেহেতু আমাকে ছাড়া তিনি কোথাও যেতেন না।

আমার মুহতারাম বড় ভাই হযরত মাওলানা মুফতী মুহম্মদ রফী উছমানী ছাহেব মু. যাকে ঘরোয়া বে-তাকাল্লুফিতে ‘ভাই রফী’ বলে থাকি; এবং এই স্মৃতিকথায়ও বেতাকাল্লুফি প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে মাঝে মধ্যে এ সম্বোধনই ব্যবহার করবো, তিনি এই সফরে মাহরাম- রূপে আম্মাজানের সঙ্গে ছিলেন। প্রায় দুই মাস আম্মাজানের সঙ্গে সেখানে আমার থাকা হয়েছিলো। ভাইজানের যেহেতু তখন হিফয চলছিলো সেহেতু তিনি জামেয়া আশরাফিয়ার এক উস্তাযের কাছে হিফযের সিলসিলা জারি রেখেছিলেন। কিন্তু আমার তা‘লীম যেহেতু আগে থেকেই অনিয়মিত ছিলো সেহেতু বিকল্প কোন নিয়মিত ব্যবস্থার কথা চিন্তাই করা হয়নি। তবে আম্মাজান রহ. যখন কিছু ফুরসত পেতেন আমাকে বেহেশতি গাওহার এবং সীরাতে খাতামুল আম্বিয়া পড়াতে বসতেন। বাকি সময় পার হতো ঘোরা- ফেরার মধ্যেই।

এই ঘোরাফেরা প্রসঙ্গে একটা ঘটনা আমি কখনো ভুলতে পারি না। তখন ছিলো প্রচ- শীতকাল। ভাই রফী ছাহেব হযরত মাওলানা মুহম্মদ মতীন খতীব ছাহেবের ছাহেবযাদা মুহম্মদ মুঈন ছাহেব মরহূমের সঙ্গে অনেক সন্ধ্যায় লরেন্স গার্ডেনের গোলশানে ফাতেমা উদ্যানে ভ্রমণের জন্য যেতেন। আমি কখনো কখনো তাঁদের সঙ্গে চলে যেতাম। ঐ সময় গোলশানে ফাতেমা ছিলো অত্যন্ত সুন্দর ও মনোরম উদ্যান। ঐ উদ্যানের মধ্যভাগে একটি সুন্দর  লেক/জলাশয় ছিলো।

একবার এঁরা দু’জন কথায় মগ্ন ছিলেন, এই ফাঁকে হাঁটতে হাঁটতে আমি লেকের পারে চলে গেলাম।লেকের চারপাশে সরু প্রাচীর ছিলো। আমি প্রাচীরের উপর উঠে হাঁটার মশক শুরু করে দিলাম। কিছুক্ষণ তো হাঁটার কসরত ভালোই ছিলো, এর মধ্যে হঠাৎ পা পিছলে লেকের পানিতে গিয়ে পড়লাম। পড়েই যাকে বলে হাবুডুবু খাওয়া! ডিসেম্বরের শীত, আর বরফের মত ঠা-া পানি! তাতে আমার তখন জমে যাওয়ার উপক্রম। চোখের সামনে যেন সাক্ষাৎ মৃত্যু দেখতে পেলাম। লেক যদিও বেশী গভীর ছিলো না, কিন্তু আমার মত সাঁতার না জানা বাচ্চার ডুবে মরার জন্য যথেষ্ট ছিলো। সাঁতার জানলেই বা কী! হাত-পা তো জমে বরফ!!

ভাই রফী ছাহেব এবং ভাই মুঈন ছাহেব অনেক কষ্টের পর আধা বেহুঁশ অবস্থায় আমাকে পানি থেকে তুলে আনলেন। ভেজা কাপড়ে আমার তখন সারা শরীর কাঁপছে, দাঁতে দাঁতে ঠক ঠক শব্দ হচ্ছে। সেখানে ভেজা কাপড় বদলানোর তো কোন উপায় ছিলো না। ভাই রফী ছাহেব শীত থেকে বাঁচার জন্য গরম শেরওয়ানী পরে ছিলেন। আল্লাহ্ তা‘আলা সবসময় তাঁকে দুনিয়া আখেরাতে আপন রহমতের ছায়াতলে রাখুন। তিনি নিজের শেরওয়ানী খুলে আমাকে তাতে পেঁচিয়ে নিলেন। এরপর আল্লাহ্ জানেন কীভাবে আমাকে তিনি ঘরে আনলেন এবং অগ্নিকু-ের সামনে এনে বসালেন। আগুনের তাপ পাওয়ার পরই শুধু আমার শরীরে প্রাণ এলো।

এভাবে সেদিনই আমি ঐ মহামূল্যবান হাদীছের শিক্ষা পেয়ে গেলাম যাতে পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَـنْ رَعَـى حَوْلَ الْـحِـمَـى أَوْشَكَ أَنْ يَّـقَـعَ فِـيـهِ

যে ব্যক্তি সংরক্ষিত ভূমির ধারে গিয়ে পশু চরায়, যে কোন সময় তার (পশুপালের) ঐ সংরক্ষিত ভূমির ভিতরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু হায়, নিজের আমল আখলাকেও যদি এই শিক্ষার বাস্তবায়নের তাওফীক হতো!

***

ভাইজান ঐ সময় লাহোর জামিয়া আশরাফিয়ার পুরোনো ভবনের সংলগ্নএকটি সঙ্কীর্ণ ও আলোবাতাসহীন ফ্লাটে থাকতেন। ঐ ভবনেরই উপরের তলায় হযরত মাওলানা মুহম্মদ ইদরীস কান্ধলবী রহ. থাকতেন, আর একেবারে উপরের তলায় থাকতেন জামেয়া আশরাফিয়ার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা মুফতী মুহম্মদ হাসান রহ.। তিনি ছিলেন হযরত হাকীমুল উম্মত থানবী রহ. এর অন্যতম বিশিষ্ট খলীফা। আসলে এই জামেয়া আশরাফিয়া তিনি কায়েম করেছিলেন অমৃতসরে। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় যখন পূর্ব- পাঞ্জাবে মুসলমানদের কতলে আম শুরু হলো তখন তিনি লাহোরে চলে আসেন এবং এই ভবনে জামেয়া আশরাফিয়া নতুনভাবে শুরু করেন। পাকিস্তানের জন্মলাভের পর যে সকল মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার মধ্যে জামেয়া আশরাফিয়া হচ্ছে প্রথম হওয়ার গৌরবের অধিকারী।

আমাদের প্রতি হযরত আব্বাজান রহ. এর জোর তাকিদ ছিলো যে, যখন লাহোর যাওয়া হবে, অবশ্যই যেন আমরা হযরতের খেদমতে হাজির হই।

এ কারণেই ঐ সময় যখন আমার বয়স ছিলো সাত, ভাইজানের সঙ্গে হযরতের খেদমতে বারবার যাওয়া হয়েছে। হযরতের ¯েœহ ও দু‘আ দ্বারা কতভাবে যে তখন সিক্ত হয়েছি, এখনো মনে হলে অন্তরে প্রশান্তি অনুভব করি।

হযরতের উচ্চ মাকাম সম্পর্কে সমঝবুঝ ঐ বাচ্চা বয়সে আর কীই বা হতে পারতো, সে তো এখন এই বুড়ো বয়সেও নেই। তবে তখনকার এ অনুভূতি এখনো মনে জাগরূক আছে যে, হযরতের মজলিসে উপস্থিত হয়ে ঐ সঙ্কীর্ণ অন্ধকার ঘরেও আশ্চর্য রকমের নূর ও সুকূন হাছিল হতো। মনে হতো অপার ¯েœহের ছায়াদার শামিয়ানার নীচে যেন আমরা এসে পড়েছি।

চিরকাল আল্লাহ্ তাঁকে সুবিস্তৃত রহমত দ্বারা আচ্ছাদিত রাখুন, আমীন।

(ইনশাআল্লাহ চলবে