ক্ষুদ্র প্রাণী পিঁপড়া সম্পর্কে বিজ্ঞানজগতে গবেষণার যেন শেষ নেই। অবশ্য এর কারণও রয়েছে। প্রতিটি গবেষণা থেকেই বেরিয়ে আসছে নতুন নতুন চমকপ্রদ তথ্য, যা প্রমাণ করে যে, সৃষ্টিজগত নিজে নিজেই অস্তিত্ব লাভ করেনি। অবশ্যই এর পিছনে রয়েছেন সেই পরম সত্তা, যিনি মহাজ্ঞানী, মহাপ্রজ্ঞার অধিকারী।
এটা আমাদের জানা হয়েছে যে, মানুষের পরে পিঁপড়াই হলো সবচে’ বেশী সামাজিক প্রাণী।
পিঁপড়াদের সঙ্ঘবদ্ধ সামাজিক জীবনের সুন্দর চিত্র সর্বপ্রথম বর্ণিত হয়েছে আলকোরআনে। আল্লাহ্র নবী হযরত সোলায়মান আলাইহিস্ -সালাম তাঁর লোকলস্কর নিয়ে যাচ্ছেন। যখন তারা একটা পিঁপড়ার টিবির কাছে উপনীত হলেন, কোরআন শরীফে বলা হয়েছে ‘ওয়াদিন্-নামলি’ বা পিপিলিকা-উপত্যকা। তো ঐ উপত্যকার নেতৃস্থানীয় পিঁপড়া পরিস্থিতির গুরুতরতা অনুধাবন করে সবাইকে সাবধান করে যা বলেছিলো, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বক্তব্যটি ছিলো এরকম, ‘হে পিপিলিকাসকল, নিজ নিজ গৃহে প্রবেশ করো। এমন যেন না হয় যে, সোলায়মান ও তাঁর বাহিনী তাদের অজান্তেই তোমাদের পিষে ফেলবে।...
কোরআনের বর্ণনা থেকে জানা যায়, হযরত সোলায়মান আ. ঐ পিপিলিকার বক্তব্য বুঝেছিলেন এবং মৃদু হাস্য করে আল্লাহ্র শোকর আদায় করেছিলেন।
বলাবাহুল্য, পিঁপড়াদের উপর এ পর্যন্ত পরিচালিত গবেষণাগুলো কোরআনি বক্তব্যের সত্যতাই প্রমাণ করে।
তবে সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় পিঁপড়াদের সামাজিক জীবনের নতুন একটি দিক উন্মোচিত হয়েছে, যা দেখে বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত অবাক। আমরা অবশ্য অবাক হইনি। আমাদের শুধু মনে পড়েছে মহান খালিক ও ¯্রষ্টার এই ঘোষণা-
هـذَا خَـلْـقُ اللهِ فَـأرُونـِي مَـاذا خَـلَقَ الَّذِينَ مِـنْ دُونِـه
ফিরে আসি মূল কথায়। সম্প্রতি একদল গবেষক আফ্রিকায় বসবাস-কারী ম্যাটারেলে প্রজাতির পিঁপড়ার উপর গবেষণা চালিয়েছেন। তাতে দেখা যায়, একদিকে এরা যেমন অত্যন্ত সাহায্যপ্রবণ, অন্যদিকে অত্যন্ত যুদ্ধপ্রিয় ও আগ্রাসী। এরা নিজেদের খাদ্যসংগ্রহের জন্য উই পোকার টিবিতে হামলা চালায় এবং ডিম সংগ্রহ করে।
বিষয়টা যত সহজে বলা হলো ততটা কিন্তু সহজ কাজ নয়। এর জন্য প্রতিরোধকারী উইপোকাদের সঙ্গে আগ্রাসী পিঁপড়াদের রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়।
এ জন্য দু’শ থেকে ছয়শ সৈনিক পিঁপড়া দলবদ্ধভাবে উইটিবিতে হামলা চালায়। উইপোকাদের প্রতিরোধ যুদ্ধও অভিনব। তারা তাদের শক্তিশালী চোয়াল দ্বারা হামলাকারী পিঁপড়ার শরীরে কামড় বসিয়ে দেয়। শুধু কামড়ের কারণেই হামলাকারী পিঁপড়াদের মধ্যে প্রচুর হতাহতের ঘটনা ঘটে। অনেক পিঁপড়াকে পা হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়।
এ পর্যন্ত ঘটনার মধ্যে তেমন কিছু অভিনবত্ব নেই। আসল চমক আসছে এর পরের ঘটনায়। গবেষকগণ অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করেন যে, হামলাকারী সুস্থ পিঁপড়ারা ফেরার সময় নিহত পিঁপড়াদের ফেলে রেখে গেলেও আহত পিঁপড়াদের পারতপক্ষে ফেলে রেখে যায় না, বরং অত্যন্ত কুশলতা ও শৃঙ্খলার সঙ্গে সহযোদ্ধাদের বহন করে নিজেদের বসতিতে নিয়ে আসে। অবস্থা পর্যবেক্ষণে গবেষকদের মনে হয়েছে, আগে থেকে যেন এ বিষয়ে তারা প্রশিক্ষণ লাভ করেছে।
আরো চমকপ্রদ তথ্য এই যে, কলোনিতে বাসকারী পিঁপড়াদের গতিবিধি ও কর্মকা- দেখে পরিষ্কার বোঝা যায়, যুদ্ধপরবর্তী পরিস্থিতি সম্পর্কে তারা পূর্ণ মাত্রায় ওয়াকিবহাল। তাই আগে থেকেই সেখানে চিকিৎসাসেবার পূর্ণ ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকে এবং চিকিৎসক পিঁপড়া প্রস্তুত অবস্থায় থাকে।
উক্ত গবেষকদলের প্রধান হলেন বিজ্ঞানী এরিক ফ্রাঙ্ক। তার গবেষণায় দেখা যায়, উপযুক্ত চিকিৎসা পাওয়ার কারণে আশিভাগ পিঁপড়া সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পেরেছে, অথচ চিকিৎসা না পেলে এরা নির্ঘাত মারা যেতো।
তিনি মনে করেন, পিঁপড়াদের লালায় জীবাণু প্রতিরোধী কোন উপাদান রয়েছে, যা ক্ষতস্থানের উপশমে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
প্রশ্ন হলো, আহত পিঁপড়াদের চিকিৎসা সেবায় সুস্থ পিঁপড়াদের এই ব্যস্ততা ও সেবাপ্রবণতার মূল কারণ কী? মানুষের ক্ষেত্রে যেমন মানবিকতা, পিঁপড়াদের ক্ষেত্রে কি তেমনি ‘পিপিলিকতা’। এর উত্তর ‘হাঁ’ হলে স্বভাবতই আমাদের জন্য আনন্দদায়ক হতো, মানব ও পিপিলিকা, উভয় জাতির মধ্যে অন্য রকম একটা সংযোগের অনুভূতি কিছুটা হলেও পুলকের কারণ হতো। কিন্তু এরিক ফ্রাঙ্কের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী এর পিছনে কোন প্রকার সহমর্মিতা ক্রিয়াশীল নয়, বরং অস্তিত্বরক্ষার বড় একটা স্বার্থচিন্তা ক্রিয়াশীল।
তিনি বলেন, এ প্রজাতির পিঁপড়ার জন্মহার ও বংশবিস্তার খুব সীমিত। তাই নিজেদের গরজেই আহত পিঁপড়াদের তারা সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করে, যাতে জন্মহার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তারা ভূমিকা রাখতে পারে। আরেকটা বিষয় হলো, আহত পিঁপড়াদের ক্ষতস্থানের পচনের ফলে পুরো পিঁপড়া কলোনিতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা পুরো কলোনির ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ কারণেও আহত পিঁপড়ার চিকিৎসার প্রতি বাধ্য হয়েই মনোযোগ দিতে হয়।
এখানে সঙ্গতকারণেই এ প্রশ্ন করা যায় যে, একই কথা মানুষের ক্ষেত্রেও তো হতে পারে! করেছেন। তিনি বলেন, ম্যাটারেলে পিঁপড়া যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সব আহত পিঁপড়াকে তুলে আনে না। এক্ষেত্রে তারা যথেষ্ট বাছবিচার করে থাকে। যেমন, যাদের পাঁচটার মত পা আহত হয়েছে বা কাটা পড়েছে তাদের তুলে আনার কথা চিন্তাও করা হয় না, কারণ পরবর্তীতে তাদের সুস্থ ও কর্মক্ষম হওয়ার সম্ভাবনা কম। যেসব পিঁপড়ার একটা বা দু’টা পা আহত হয়েছে, অর্থাৎ যাদের সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশী তাদেরই শুধু বহন করে আনা হয়।
‘সুবহান’ ঐ মহান স্রষ্টার প্রতি যিনি মহাপ্রজ্ঞার অধিকারী!