শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

জিলহজ্ব ১৪৪০ হিঃ (৩/৮) | প্রথম পাতা

কোরআনের আলো / হাদীছের আলো

  بسم الله الرحمن الرحيم

  কোরআনের আলো
আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনÑহে ঐ লোকেরা যারা ঈমান এনেছে, তোমরা (নবীকে সম্বোধন করে) ‘রা‘ইনা’ বলো না, বরং ‘উনযুরনা’ বলো। আর তোমরা শ্রবণ করো। আর কাফিরদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। যারা কুফুরি করেছে আহলে কিতাবের মধ্য হতে এবং মুশরিকরা, তারা কেউই চায় না যে, তোমাদের রবের পক্ষ হতে তোমাদের উপর কোন কল্যাণ অবতীর্ণ হয়। অথচ আল্লাহ্ বিশিষ্ট করেন আপন রহমত দ্বারা যাকে ইচ্ছা করেন। আর আল্লাহ্ বড় দয়া ও দানের অধিকারী। Ñসূরাতুল বাকারাহ ঃ ১০৪-১০৫

ফায়দা  

আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের, কথা বলার সময় শব্দপ্রয়োগে সচেতন হওয়ার আদেশ করেছেন। আমাদের মুখের ভাষা ও শব্দের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে জীবনের সর্বক্ষেত্রে। তাছাড়া মুখের ভাষা ও শব্দ দ্বারা মানুষের স্বভাব ও চরিত্রেরও প্রকাশ ঘটে।আয়াতের শানে নুযূল সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ছাহাবা কেরামকে দ্বীনের কোন কথা শিক্ষা দিতেন, আর ছাহাবা কেরামের বুঝতে কষ্ট হতো তখন তাঁরা বলতেন, راعنـا (আমাদের কিছু রিয়ায়াত করুন) অর্থাৎ আমাদের দুর্বল অবস্থা বিবেচনা করে আমাদের বোঝার মত সহজ করে বলুন।এ শব্দটি হিব্রুভাষার রা‘ঈনূ শব্দের সদৃশ ছিলো, যার অর্থ খবিছ বা ইতর। তো ইহুদিরা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে কথা বলার সময় (মুমিনদের মত) রা‘ইনা বলতো ঠিক, তবে মুখ কিছুটা বাঁকা করে, যাতে হিব্রুভাষার রা‘ঈনূ শব্দের মত শোনা যায়।হযরত সা‘আদ বিন মু‘আয রাদিয়াল্লাহু আনহু হিব্রুভাষা জানতেন, তাই ইহুদিদের মনের ইতরতা বুঝতে তাঁর অসুবিধা হয়নি। তিনি তাদের হুঁশিয়ার করে বললেন, কসম ঐ যাতের যার হাতে আমার জান, যদি তোমাদের কেউ নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শানে এ শব্দ উচ্চারণ করে, আমি তার গর্দান উড়িয়ে দেবো। ইহুদিরা বললো, বারে! তোমরা কি এমন বলো না?তখন আল্লাহ্ তা‘আলা راعنا বলতে নিষেধ করে এবং এর পরিবর্তে এর সমার্থক انظرنـا  বলার আদেশ করে আলোচ্য আয়াত নাযিল করেছেন।ইহুদিদের অহঙ্কার ছিলো যে, নবী ও রাসূল শুধু তাদের বংশেই প্রেরিত হন। তাই বনী ঈসমাইলে প্রেরিত নবীর প্রতি তারা মূলত ঈর্ষাবশতই ঈমান আনতে পারেনি। তো মুমিনদের প্রতি আয়াতের পরোক্ষ শিক্ষা এই যে, কাউকে কোন নেয়ামত দান করা হলে তার প্রতি যেন ঈর্ষা না করা হয়। কারণ, নেয়ামত মানুষ আল্লাহ্র ইচ্ছায় প্রাপ্ত হয়, সুতরাং ঈর্ষা করার অর্থ হবে আল্লাহ্র ইচ্ছাকে অসম্মান করা। হাঁ, গিবতা অবশ্যই করা যেতে পারে যে, ঐ নেয়ামত যেন আল্লাহ্ আমাকেও দান করেন।

তথ্যকণিকা*

সূরাতুল বাকারাহ্র ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেনÑতোমরা তোমাদের ঘর-বাড়ীকে কবরস্তান বানিয়ে রেখো না। আর শয়তান ঐ ঘরকে সভয়ে এড়িয়ে চলে যেখানে সূরাতুল বাকারহ্’র তেলাওয়াত হয়। (মুসলিম, তিরমিযি)আরো বণিত আছে, ‘তোমরা সূরাতুল বাকারাহ্ তেলাওয়াত করো। কারণ ঐ সূরাহ্ গ্রহণ করা হলো বরকত, আর তা তরক করা হলো আফসোসের বিষয়। আর যাদুগরেরা তা তেলাওয়াত করতে সক্ষম নয়। (মুসলিম)* সূরাতুল বাকারহ্সহ কোরআনের মোট ছয়টি সূরা শুরু হয়েছে আলিফ-লাাম-মীম দ্বারা, যথাÑসূরাতুল বাকারাহ্, সূরাতু আলে ‘ইমরাান, সূরাতুল ‘আনকাবূত, সূরাতুর-রূম, সূরাতু লোকমাান, সূরাতুস্-সাজদাহ্।সূরাতুল-আ‘রাফ শুরু হয়েছে আলিফ-লাাম-মীম-ছোয়াাদ দ্বারা এবং সূরাতুর-রা‘দ শুরু হয়েছে আলিফ-লাাম-মীম-রাা দ্বারা। 

 
راعنـا শব্দটি কোরআনে মাত্র দু’বার ব্যবহৃত হয়েছে। দ্বিতীয়টি হলো সূরা নিসা ৪৬ তম আয়াত।* বাংলা, উর্দূ ও ফারসিভাষায় বলা হয় শানে নুযূল, আরবীতে বলা হয় সাবাবে নুযূল, যার বহু- বচন আসবাবে নুযূল। আসবাবে নুযূল-এর উপর প্রচুর কিতাব রচিত হয়েছে, তার মধ্যে আল্লামা সুয়ূতী রহ.-এর لباب النقول في اسباب النزول কিতাবটি হচ্ছে সবচে’ প্রসিদ্ধ।* কোন একটি ঘটনাকে উপলক্ষ করে আয়াত নাযিল হলেও আয়াতের আহকাম ও বার্তাটি সাধারণত ব্যাপক ও সর্বব্যাপী হয়।* কোরআনের সবচে’ দীর্ঘ সূরা হচ্ছে আলবাকারাহ্, যার অর্থ গাভী। যেহেতু ইহুদিদের বিভিন্ন নাফরমানির বিবরণপ্রসঙ্গে গাভীর আলোচনাও এসেছে, সেহেতু পুরো সূরার নাম রাখা হয়েছে আলবাকারাহ্। প্রায় প্রতিটি সূরার নামকরণের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি বিদ্যমান। অর্থাৎ ন্যূনতম প্রসঙ্গ অবলম্বন করে নামকরণ।* সূরাতুল বাকারাহ্-এর আয়াত-সংখ্যা ২৮৬, রুকুসংখ্যা চল্লিশ।

কোরআন সম্পর্কে

কৌতূহলের দিক থেকে পৃথিবীর সর্বকালের সর্বভাষার গ্রন্থগুলোর একটি তালিকা করা হয়েছে। তাতে মুসলিম উম্মাহ্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন এসেছে তালিকার শীর্ষে। বলা হয়েছে, না বুঝে কোন গ্রন্থ পাঠের ক্ষেত্রে সম্ভবত কোরআনই একমাত্র গ্রন্থ। একই ভাবে না বুঝে কণ্ঠস্থ করার ক্ষেত্রেও পৃথিবীতে কোরআনের তুলনা নেই। এক সাধারণ পরিসংখ্যানমতে শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কোরআনের হাফিযের সংখ্যা পঞ্চাশকোটির উপরে হবে। মহাপ্রলয় বা কেয়ামত পর্যন্ত এ সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা শুধু আল্লাহ্ জানেন। আলকোরআনের ঘোষণা চিরসত্য, ‘আমরাই নাযিল করেছি ‘যিকর’, আর অবশ্যই আমরাই তার হিফাযতকারী

হাদিছের আলো

হযরত আয়েশা (বিনতে আবীবাক্র) রা. হতে বর্ণিত যে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

‘তোমাদের কেউ যেন (কোন প্রসঙ্গে) خَـبُـثَـتْ نَـفْـسـي না বলে, বরং যেন বলে لَـقِـسَـتْ نَـفْـسِـي ( বোখারী, মুসলিম)

আলিমগণ বলেন, শব্দদু’টি সমার্থক, অর্থাৎ অসুস্থ হওয়া, কিন্তু ‘খুবছ’ শব্দটির উচ্চারণ তিনি অপছন্দ করেছেন, তা রুচিশীল নয় বলে।

ফায়দা

যে কোন জাতি ও সভ্যতায় ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ ভাষাকে অবলম্বন করেই ঘটে সর্বপ্রকার ভাববিনিময় এবং জ্ঞান ও উপদেশের প্রবাহ। তাছাড়া ভাষা বিশুদ্ধ হওয়া এবং শব্দচয়নে সচেতন ও রুচিশীল হওয়া আভিজাত্যের পরিচায়ক বলে যুগে যুগে গণ্য হয়েছে।

নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তো প্রেরণ করা হয়েছে এমন একটি জামা‘আত এবং এমন একটি উম্মত গড়ে তোলার জন্য যারা সমগ্র মানবজাতির নিকট দ্বীনের দাওয়াত ও সত্যের বাণী প্রচারের দায়িত্ব পালন করবে। আর এ জন্য প্রয়োজন ছিলো ভাষার বিশুদ্ধতা ও শব্দের আভিজাত্য রক্ষা করা, যাতে মানুষের হৃদয়ে তাদের বক্তব্য সুন্দরভাবে রেখাপাত করে।

বস্তুত দা‘ঈ ও মুবাল্লিগ উম্মত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যেই নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষার এবং শব্দচয়নের ক্ষেত্রে রুচিশীলতা অর্জনের তারবিয়াত করেছেন। পৃথিবীর আর কোন ধর্ম ও সভ্যতার কথা আমাদের জানা নেই এবং জানা নেই কোন আধ্যাত্মিক পুরুষের কথা যিনি নিজেও ছিলেন ভাষার বিশুদ্ধতা ও শব্দব্যবহারে রুচিশীলতার সর্বোচ্চ আদর্শ। বস্তুত এটাও বড় একটা প্রমাণ যে, ইসলাম সমগ্র মানবজাতির জন্য সার্বজনীন ধর্ম বা দ্বীন ও শারী‘আত।

এখানেই আমাদের জন্য চিন্তার বিষয় যে, যে নবী তাঁর উম্মতকে এভাবে শব্দসচেতন হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন এবং ভাষার বিশুদ্ধতার প্রতি এরূপ তারগীব ও উৎসাহ প্রদান করেছেন সেই উম্মতের মধ্যে যারা ‘বিরাছাত’-এর মর্যাদায় আসীন হবেন তাদের মুখের ও কলমের ভাষা কত বিশুদ্ধ হতে হবে? শব্দচয়নের ক্ষেত্রে তাদের কী পরিমাণ রুচিশীল হতে হবে? আল্লাহ্ যেন আমাদের মধ্যে চেতনা ও গায়রাতের জাগৃতি দান করেন, আমীন।

তথ্যকণিকা

* হাদীছ সঙ্কলনের ইতিহাসে দ্বিতীয় বরেণ্য ব্যক্তিরূপে মুসলিম উম্মাহ্ যাকে বরণ করেছে তিনি হলেন মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ।

২০৬ হিজরীর রজব মাসে তিনি নিশাপুরে জন্মগ্রহণ করেছেন।

মাত্র বার বছর বয়সেই তিনি হাদীছ গ্রহণ ও শ্রবণের উপযুক্ততা অর্জন করেছেন।

প্রথমে তিনি স্থানীয় মুহাদ্দিছীন ও মাশায়েখের নিকট হতে হাদীছ গ্রহণ ও শ্রবণ করেছেন। তারপর এ উদ্দেশ্যে হাদীছের কেন্দ্ররূপে পরিচিত, মুসলিম জাহানের দূরদারাজ এলাকা সফর করেছেন। যেমন হিজায, ইরাকের বাগদাদ, বছরা ও কুফা, শাম ও মিসর এবং রাঈ। জীবনের দীর্ঘ পনের বছর তিনি সফরেই অতিবাহিত করেছেন। তাঁর সংগ্রহে তিন লাখেরও বেশী হাদীছ ছিলো। সমকালের এবং পরবর্তী যুগের আলিমগণ হাদীছের ক্ষেত্রে তাঁর ইমামাত স্বীকার করে নিয়েছেন।  ২৬১ হিজরীর ২৫শে রজব তিনি ইন্তিকাল করেন এবং নিশাপুরেই তাঁকে দাফন করা হয়।

 

* ইমাম নববী রহ. ‘শব্দব্যবহারে রুচিশীলতা’ শিরোনামে একটি অধ্যায় রচনা করেছেন। তাতে তিনি সংশ্লিষ্ট কিছু হাদীছ একত্র করেছেন। ঐ সকল হাদীছের একটি হলো, হযরত আবূ হোরায়রা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, عِـنَـب (আঙুর)কে তোমরা كَرْم বলো না, কারণ ‘র্কাম’ তো হলো মুমিনের হৃদয়। হযরত আবু হোরায়রা রা. হতে বর্ণিত অন্য হাদীছে এসেছে যে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাস-দাসীকে عَـبْـدي বা أَمَـتِـي বলতে নিষেধ করেছেন, বরং তার স্থলে ‘ফাতায়া’ ও ‘ফাতাতী’ (আমার তরুণ বা আমার তরুণী) বলার আদেশ করেছেন। সম্ভবত এর কারণ এই যে, আল্লাহ্ তা‘আলা আপন বান্দা-বান্দীকে আব্দী ও আমাতী বলেছেন। তো সেটা আল্লাহ্র সঙ্গে খাছ থাকাই সঙ্গত। আরো বহু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।

বিশ্বনবী সম্পর্কে

আল্লাহ্ তা‘আলার অশেষ করুণা ও মেহেরবানি এই উম্মতের প্রতি যে, গায়ব থেকে তিনি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছ (বাণী ও কর্ম) সংরক্ষণের ইন্তিযাম করেছেন।

হাদীছের সঙ্কলন, সংরক্ষণ ও বিশুদ্ধতা পর্যালোচনার ক্ষেত্রে মুহাদ্দিছীনে কেরাম কয়েক শতাব্দীব্যাপী এমন বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করেছেন যার কোন তুলনা ধর্ম ও সভ্যতার ইতিহাসে নেই। এ উদ্দেশ্যে তারা এত দূরদারায এলাকা সফর করেছেন এবং তাও ঐ যুগের দুর্গম ও দুর্যোগপূর্ণ সফর, যা আজকের আধুনিক যোগাযোগ- ব্যবস্থার উপস্থিতিতেও কল্পনা করা সম্ভব নয়।