শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

রবিউল আউয়াল ১৪৪০হিঃ (৩/৭) | তোমাদের পাতা

শৈশবের একটি মধুর প্রতিযোগিতা -আলী মিয়াঁ রহ.-এর লেখা অবলম্বনে

 

১- শৈশবের দিনগুলো কী যে মধুর ছিলো! মাদরাসায় সহপাঠীরা সবাই বন্ধুর মত ছিলাম, ভাই ভাই ছিলাম। সুখে দুঃখে একসঙ্গে ছিলাম। জীবনের ডাকে, জানি না আজ কে কোথায় হারিয়ে গিয়েছে! অনেককে মনে পড়ে, অনেককে মনে পড়ে না! কাউকে মনে পড়ে ঝাপসা ছবির মত। অথচ সবাই কত কাছে ছিলাম! যে যেখানে আছে, কামনা করি, যেন সুখে থাকে।

 

২- আমাদের মাদরাসার খুব সুনাম ছিলো; যেমন লেখাপড়ায়, তেমনি খেলাধূলায়, তেমনি আদব আখলাকে। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো। কখনো সাঁতার- প্রতিযোগিতা, কখনো বা দৌড়প্রতিযোগিতা। যে প্রথম হতো, সবাই মিলে তাকে অভিনন্দন জানাতাম। আমাদের মধ্যে কোন হিংসা-বিদ্বেষ ছিলো না। একদিনের কথা আজ বড় বেশী মনে পড়ে। যখনই মনে পড়ে অন্তরে বড় শান্তির অনুভূতি হয়। জানি না, কোথায় আছে এখন সেই এতীম ছেলেটি, আর তার মা!

৩- দরস শেষ হওয়ার পর শরীরচর্চার শিক্ষক আমাদের একত্র করে বললেন, আগামী পরশু দৌড়প্রতিযোগিতা হবে। যারা শরীক হতে চাও আজই নাম লেখাও। আমরা চব্বিশজন নাম লেখালাম। একটি এতীম ছেলে ছিলো; খুব ভদ্র ছিলো; সেও নাম লেখালো।

৪- আমাদের মধ্যে বিপুল সাড়া জাগলো। এমনকি মা-বাবাদের মধ্যেও খুব সাড়া জাগলো। কে প্রথম হবে, কার ছেলে জয়ী হবে, এই নিয়ে কত রকম আলোচনা!

আমরা সবাই প্রস্তুতি গ্রহণ করলাম। হঠাৎ দেখি, সেই এতীম ছেলেটি মসজিদে একা একা মুনাজাত করছে। কৌতূহল হলো। পিছনে গিয়ে দঁড়ালাম। সে বলছে, হে আল্লাহ, আমি যেন প্রথম হতে পারি। আমার মা তাহলে খুশী হবেন, আমার মাকে খুশী করো হে আল্লাহ!

৫- মাদরাসার পিছনে ছিলো বিরাট খেলার মাঠ। প্রথমে প্রতিযোগিতা হলো তিনজন তিনজন করে আটটি দলে। প্রতিটি দলের প্রথম ও দ্বিতীয়কে নিয়ে আবার প্রতিযোগিতা হলো চারজন করে চারটি দলে। প্রত্যেক দলের প্রথম ও দ্বিতীয়কে নিয়ে আবার প্রতিযোগিতা হলো দু’টি দলে। এভাবে চূড়ান্ত দল গঠিত হলো চারজনের। এতীম ছেলেটিও ছিলো চূড়ান্ত দলে।

৬- মাঠে তখন বহু মানুষ! অনেক ছেলেরই মা-বাবা এসেছেন প্রতিযোগিতা দেখতে। বাবারা বসেছেন একদিকে  খোলা জায়গায়। মায়েরা অন্যদিকে সুন্দর পর্দার মধ্যে।

আমরা চারজন পাশাপাশি দাঁড়ালাম। বশির, সাঈদ, সেই এতীম ছেলেটি, যার নাম ছিলো খালেদ, আর আমি। বশির লাইন থেকে এগিয়ে ছিলো; শিক্ষক তাকে ঠিক করে দিলেন

৭- সময় হয়ে গিয়েছে। এখনই প্রতিযোগিতা শুরু হবে। আমি সেই এতীম ছেলেটির দিকে তাকালাম। মনে হলো, তার চোখ দু’টি যেন ছলছল করছে! বারবার সে তাকাচ্ছে মায়েরা যেদিকে বসেছেন সেদিকে। হয়ত মাকে খুঁজছে।

ছেলেটিকে দেখে খুব মায়া হলো। মনে পড়লো কাল মসজিদে তার মুনাজাতের কথা।

 

৮-  ঘোষক বললেন, এক! আমরা প্রস্তুত হলাম। ঘোষক বললেন, দুই! আমরা সতর্ক হলাম। ঘোষক বললেন, তিন! দৌড় শুরু হলো। অর্ধেক মাঠ পর্যন্ত আমি ছিলাম প্রথম; এতীম ছেলেটি ছিলো আমার ঠিক পিছনে। আমার মনে পড়লো তার মুনাজাতের কথা, আর ছলছল চোখ দু’টির কথা! সারা মাঠে তখন আমার নামে তুমুল শ্লোগান! এদিকে আমি ইচ্ছে করেই একটু পিছিয়ে থাকলাম!

 

৯- কেউ জানলো না, আসলে কী ঘটেছে! এতীম ছেলেটি প্রথম হলো, আমি হলাম দ্বিতীয়। এতীম ছেলেটি, খালেদ মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিজয়ীর পুরস্কার গ্রহণ করলো। আনন্দ যেন তার চোখ মুখ থেকে উপচে পড়ছে। তার খুশি দেখে, আমারও খুব ভালে লাগলো। সবাই যখন ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে, শরীরচর্চার শিক্ষক তখন আমার কাছে এসে বললেন, মাজেদ, আমি জানি, তুমি কী করেছো!

জীবনের প্রতিযোগিতা তো সামনে। সেখানে তুমিই প্রথম হবে ইনশাল্লাহ!

শিক্ষকের কাছ থেকে ঘটনা শুনে আব্বুও খুশী হলেন। তিনিও একই দু‘আ দিলেন।

১০- আজ জীবনের সন্ধ্যাবেলা যখন মনে পড়ে সেই দৌড়প্রতিযোগিতার কথা, আশ্চর্য এক শান্তির পরশ অনুভব করি মনের ভিতরে। আমার বিশ্বাস, জীবনের যা কিছু অর্জন, যা কিছু সফলতা, সব আমি পেয়েছি সেদিনের সেই মধুর পরাজয় থেকে!