শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

রবিউল আউয়াল ১৪৪০হিঃ (৩/৭) | তোমাদের পাতা

আ রা কা নে র ই তি হা স

জেনারেল নে উইন ও বার্মা-আরাকান

বস্তুত জেনারেল নে উইনের সামরিক শাসন আরাকানের মুসলমানদের জন্য তো বটেই, খোদ বার্মার জন্যও ছিলো এক বিরাট অভিশাপ। প্রথমেই তিনি যে ‘পুণ্যকর্ম’টি করেন, তা হলো, সমস্ত রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ইঁৎসধ ঝড়পরধষরংঃ চৎড়মৎধসস চধৎঃু গঠন করা। বোঝার জন্য উদাহরণ যদি টানতে চাই তাহলে সেটা বাংলাদেশের বাকশালের চেয়ে রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির নাম উল্লেখ করা অধিক সমীচীন হবে। কারণ বাকশাল আর যাই করেছে, সব দল নিষিদ্ধ করেছে, বিরোধীদলের কণ্ঠ স্তব্ধ করেছে, হাজার হাজার বিরোধী কর্মীকে গুম-হত্যা করেছে ... কিন্তু জাতিগত নিধনের উদ্দেশ্যে কোন গণহত্যা চালায়নি, যা সোভিয়েট রাশিয়ায় মুসলিম জনগোষ্ঠী-গুলোর ক্ষেত্রে ঘটেছে, বিশেষত তাতারী জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে।

আরাকানের মুসলিম জনগোষ্ঠী তথা রোহিঙ্গারা স্বাভাবিক কারণেই বিএসপিপিতে যোগদান করেনি, অন্যদিকে মগজনগোষ্ঠীও স্বাভাবিক কারণেই দলে দলে তাতে যোগ দান করে। কারণ নে উইনের শাসন সম্পর্কে উভয় জনগোষ্ঠীর আলাদা আলাদা অভিজ্ঞতা ছিলো।

জেনারেল নে উইন বার্মার রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ  ধ্বংস করে সামরিক শাসন জারি করেছিলেন ঠিকই, তবে তার নিজস্ব কোন দর্শন ছিলো না। শুধু এতটুকু বলা যায়, তিনি আমেরিকার পরিবর্তে চীন ও রাশিয়ার পক্ষপুটে আশ্রয় নেয়ার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। তবে তিনি বৌদ্ধধর্মভিত্তিক বর্মী জাতীয়তাবাদ ও মার্কসবাদের মিশ্রণে অদ্ভূত এক দর্শনের জন্মদান করেন। যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তিনি গ্রহণ করেন তার নাম দেন ইঁৎসবংব ডধু ঃড় ঝড়পরধষরংস তার আমলে সমগ্র দেশের অর্থব্যবস্থা কী বিপর্যস্ত দশায় উপনীত হয়েছিলো তা বোঝার জন্য এ তথ্যটুকুই যথেষ্ট যে, ১৯৬০ সালে বার্মার মাথাপিছু আয় ছিলো ৬৭০ ডলার, পক্ষান্তরে নে উইনের আমলের শুরুর দিকেই তা নেমে আসে মাত্র ২০০ ডলারে। আন্তর্জাতিক প্রতিটি জরিপে বলা হচ্ছিলো, বার্মা আগে যদি দুর্বল অর্থনীতির দেশ হয়ে থাকে তাহলে বর্তমানে তা ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশ।

সমগ্র বার্মার ক্ষেত্রে যেমনই হোক, নে উইনের সামরিক সরকার আরাকানের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবেই ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। সেখানে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আঘাত মগসম্প্রদায়কে তেমন স্পর্শ করেনি। পুরো আঘাতটা গিয়েছিলো মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর দিয়ে। এর ব্যাখ্যা এই যে, জেনারেল নে উইন ৬৩ সালের  ফেব্রুয়ারীতে ব্যাংক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করেন। এতে রোহিঙ্গা ব্যবসায়ীরা চরম বিপদে পড়ে যায়, পক্ষান্তরে মগদের তিনি খোল্লমখোল্লা ছুট দিয়ে দেন মুসলিম জনপদে অবাধ লুণ্ঠন চালানোর। অর্থাৎ রোহিঙ্গা-জনগোষ্ঠী দোধারী তলোয়ারের নীচে পড়ে যায়। একদিকে সরকারের জাতীয়করণ, অন্যদিকে মগসম্প্রদায়ের ব্যাপক লুণ্ঠন।

সবচে’ বড় আঘাতটি এসেছিলো ১৯৬৪ সালে (১৭ই মে) পঞ্চাশ ও একশটাকা মূল্যমানের মুদ্রা অচল ঘোষণার মাধ্যমে। এতে মগসম্প্রদায়ের বলতে গেলে তেমন কোন ক্ষতিই হয়নি, পক্ষান্তরে রোহিঙ্গাদের অর্থনৈতিক মেরুদ- একেবারে ভেঙ্গে যায়। কারণ বিএসপিপি-এর সদস্যপদ এবং উচ্চপদস্থ মগকর্মকর্তাদের আনুকূল্যের সুবাদে মগসম্প্রদায় তাদের জমাকৃত অচল মুদ্রার বিপরীতে নতুন মুদ্রা পেয়ে যায়, কিন্তু রোহিঙ্গারা তাদের জমাকৃত অর্থ কানাকড়িও ফেরত পায়নি।

আরেকটা বিষয় ছিলো; রাষ্ট্রীয়-করণকৃত ব্যবসাবাণিজ্য ও রেশনব্যবস্থার সার্বিক দায়িত্ব ছিলো মগকর্মকর্তাদের হাতে। ফলে রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায় চরম বৈষম্যের শিকার হয়ে পড়ে। তদুপরি রোহিঙ্গাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের উপর উচ্চহারে কর আরোপ করা হয়, যার নযির বিশ্বের আর কোন দেশে আছে বলে আমাদের জানা নেই।

আশ্চর্যের বিষয় এটা নয় যে, বার্মার সুশীল সমাজ, বা মানবতাবাদী শক্তি সামরিক জান্তার বিভিন্ন নিবর্তনমূলক নীতি ও পদক্ষেপের নিন্দা-প্রতিবাদ জানালেও রোহিঙ্গাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের উপর এই যে নিবর্তনমূলক ভারি অঙ্কের নযিরবিহীন কর আরোপ করা হলো, এ সম্পর্কে কেউ কোন উচ্চবাচ্য করেনি। এটা আমাদের মতে আশ্চর্যের বিষয় নয়। কারণ রোহিঙ্গ মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিষয়ে সামরিকতন্ত্র ও গণতন্ত্র আসলেই ছিলো রসুনের কোয়া, গোড়ায় যারা এক।

আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বিশ্বের বড় বড় যত মানবাধিকার সংস্থা ও গণতান্ত্রিক শক্তি তারাও লজ্জাজনকভাবে নীরবতা অবলম্বন করেছে।

বৈষম্যের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটিয়ে নে উইন সরকার যে আইনটা করে তা এই যে, সরকারী অনুমতি ছাড়া মুসলিমরা এমনকি এক থানা থেকে অন্য থানায় যেতে পারবে না। ফলে রোহিঙ্গাদের প্রতিটি গ্রাম হয়ে হয়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত আলাদা জনপদ। অথচ স্বাভাবিক কারণেই গ্রামে গ্রামে যুগ যুগ ধরেই ছিলো আত্মীয়তার সম্পর্ক। এমন পাশবিক আইনের পরে যে কোন জনগোষ্ঠী মৃত্যুভয় উপেক্ষা করেই বিদ্রোহ করবে, এটাই ছিলো স্বাভাবিক। রোহিঙ্গাদের খাটানো হতো বিভিন্ন কঠিন শ্রমের কাজে। কাজ করতে অস্বীকার করলে বা মজুরি দাবী করলে নেমে আসতো ভয়াবহ দৈহিক নির্যাতন।

সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা সংস্থার জন্য নিয়মিত খাদ্য ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করা, এটাও ছিলো মুসলিম ব্যবসায়ীদের জন্য বাধ্যতামূলক।

রোহিঙ্গাদের উপর সবচে’ বড় আঘাতটা আসে ১৯৬৭ সালে, যখন রাজধানী রেঙ্গুনে চরম খাদ্যঘাটতি দেখা দেয়। সরকার আরাকান থেকে বাধ্যতামূলক চাল আমদানী করে রাজধানীর খাদ্যঘাটতি পুরণের ব্যবস্থা নেয়। তখন সেনাবাহিনী মুসলিম ব্যবসায়ীদের মজুদকৃত খাদ্যশস্য জোরপূর্বক কেড়ে নেয়।

অর্থনৈতিক আঘাতের সমান্তরালে চালানো হয় চরম রাজনৈতিক দমননিপীড়ন। রোহিঙ্গাদের সমস্ত রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দল, সংস্থা ও সংগঠন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। একদিকে ইঁৎসধ ইৎড়ধফপধংঃরহম ঝবৎারবপ (বিবিএস) থেকে রোহিঙ্গা ভাষায় প্রচারিত অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়, যা উ নূ সরকার বিদ্রোহী মুসলিম জনমতকে শান্ত করার জন্য চালু করেছিলো। এটা মুসলিম স্বার্থের অনুকূল কোন বিষয় ছিলো না। কারণ উক্ত অনুষ্ঠানটি প্রচার করা হতো আগাগোড়া সরকারী প্রচারণার উদ্দেশ্যে। এই সম্প্রচার বন্ধ করার মাধ্যমে আসলে এই সুস্পষ্ট বার্তা দেয়া হয় যে, সামরিক সরকার রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য কোন রকম জাতিগত অধিকার স্বীকার করতে প্রস্তুত নয়। প্রতিবাদ জ্ঞাপন ও জনমত গঠনের তখন একমাত্র মাধ্যম ছিলো সংবাদপত্র। ১৯৬৬ সালে রোহিঙ্গাদের মুখপত্ররূপে পরিচিত সমস্ত পত্রপত্রিকা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

এরপর শুরু করা হয় শাসন ও প্রশাসন থেকে মুসলিমউচ্ছেদ- অভিযান।

স্বাধীন বার্মার প্রথম প্রধানমন্ত্রী উ নূ এর মন্ত্রিসভায় একাধিক আরাকানী মুসলিম মন্ত্রী ছিলেন, যার মধ্যে আকিয়াবের সুলতান মাহমূদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। তারপরে যার নাম আসে তিনি হলেন উ রশীদ। কিন্তু জেনারেল নে উইন ক্ষমতা দখল করার পর আর কোন মুসলিম মন্ত্রী গ্রহণ করেননি। পক্ষান্তরে পুলিশ প্রশাসনসহ সকল সরকারী দফতর থেকে উচ্চ পদস্থ মুসলিম কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অপসারণ করা হয় এবং প্রশাসনকে শতভাগ বৌদ্ধী-করণের লক্ষ্যে শূন্যপদগুলোতে মগসম্প্রদায়ের লোকদের নিয়োগ দান করা হয়। কোন মুসলিম কর্মকর্তার চাকুরী রক্ষা করার একমাত্র উপায় ছিলো মুসলিম পরিচয় ত্যাগ করে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের প্রকাশ্য ঘোষণা দেয়া।

অর্থনীতি ও রাজনীতির পর রোহিঙ্গামুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় জীবনেও নেমে আসে চরম নির্যাতন নিপীড়ন। মসজিদে যাওয়ার অপরাধে সেনাবাহিনীর লোকেরা এবং তাদের সহযোগী-রূপে স্থানীয় মগেরা যুবক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সবাইকে প্রকাশ্যে বেত্রাঘাতের মত শাস্তিও প্রদান করে। শেষে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে মানুষ মসজিদে যাওয়াই ছেড়ে দেয়। অতি সাহসী বা ধর্মপ্রাণ দু’চারজন্য অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে শুধু মসজিদে হাযির হতো। এসময় বহু মসজিদ মাদরাসা ভেঙ্গে দেয়া হয়। উচ্চ শিক্ষা তো দূরের কথা, সাধারণ শিক্ষার দুয়ার পর্যন্ত মুসলমানদের জন্য বন্ধ ছিলো, যার প্রমাণ এই যে, সমগ্র আরাকান অঞ্চলে মাত্র সতেরটি হাই স্কুল এবং একটি  কলেজ ছিলো। সেখানেও মুসলিম ছাত্রদের প্রবেশ ছিলো সুনিয়ন্ত্রিত। একমাত্র মাদরাসার গতানুগতিক ধর্মীয় শিক্ষাই ছিলো মুসলিম শিশু-কিশোর-যুবকদের অবলম্বন। কিন্তু এসময় একের পর এক মাদরাসা বন্ধ করে দেয়া হয়। আলিম ওলামাদের প্রকাশ্যে নাজেহাল ও নির্যাতন করা হয়। সমস্ত ওয়াকফ সম্পত্তি বাজেয়াফত করা হয়। এক হিসাবে জানা যায়, জেনারেল নে উইনের শাসনামলে ছয়শর বেশী মসজিদ এবং পঞ্চাশটির মত বড় মাদরাসা অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ভষ্মীভূত করা হয়। এমনকি ঘরে ঘরে তল্লাশী চালিয়ে কোরআন ও ধর্মীয় কিতাব জব্দ করা হয়। প্রকাশ্য সড়কে স্তূপ করে পবিত্র কোরআন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু প্রতিবাদ করার কোন উপায় ছিলো না। এসময় বহু কবরস্থান সরকারী দখলে নিয়ে শূকরের চারণক্ষেত্র বানানো হয়। ফলে লাশ কবরস্থ করার ক্ষেত্রে চরম সঙ্কট দেখা দেয়। সরকারী নথিপত্রেই দেখা যায়, ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইনের ক্ষমতা দখলের পর থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত আরাকানসহ সমগ্র বার্মা থেকে কোন মুসলিমকে হজ্জে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি।

আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যাপক গণ হত্যা ও জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান তো সেই স্বাধীনতাপূর্ব ৩৮ সাল থেকেই চলে আসছিলো। তবে তা ধারাবাহিক ও নীরবচ্ছিন্ন ছিলো না এবং তাতে সরকারের প্রকাশ্য সমর্থন ছিলো না, বরং মাঝে মধ্যে সরকার বিভিন্ন রক্ষামূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করতো, যার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত ছিলো, ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারীর শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রী উ নূর পক্ষ হতে আহুত ফেডারেল কন্ফারেন্স। বলাবাহুল্য, এ সম্মেলনকে কেন্দ্র করেই সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল নে উইন রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন।

পরিসংখ্যানে দেখা যায় ৪২ সালের ভয়াবহ রোহিঙ্গাগণ-হ্যতার পর ব্যাপক আকারের গণহত্যা আর সঙ্ঘটিত হয়নি। মাঝে মধ্যে সীমিত পর্যায়ে স্থানীয় প্রতিহিংসাবাদী মগদের দ্বারা দাঙ্গা পরিচালিত হয়েছে। তাতে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু রীতিমত সরকারী পরিকল্পনা ও সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ভয়াবহ জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান নিয়মিত ভাবে শুরু হয় জেনারেল নেই উইন যখন তত্তাবধায়ক সরকারের প্রধানরূপে প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার দুই বছর স্থায়ী দায়িত্বপালনকালে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর নেমে আসে ব্যাপক গণহত্যা ও উচ্ছেদ অভিযান। এসময় সেনাবাহিনী যে কাজটি অত্যন্ত কুশলতার সঙ্গে সম্পন্ন করে তা হলো, কঠোর সংবাদগোপনীয়তা রক্ষা করা এবং পূর্বপাকিস্তান-সংলগ্ন সীমান্ত সিল করে দেয়া, যাতে শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টির কারণে আন্তর্জাতিক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে না হয়। এর মধ্যেও চরম নির্যাতনের শিকার প্রায় বিশহাজার রোহিঙ্গা মুসলিম জানহাতে নাফনদী পার হয়ে কক্সবাজারে আশ্রয় গ্রহণ করে।

পাকিস্তান সরকার তখন কঠোর প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে এবং উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য জোরালো আহ্বান জানায়। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য সামরিক জান্তা সকল উদ্বাস্তুকে দেশে ফিরিয়ে নেয়, আর বলে, এ দাঙ্গা ও হত্যাযজ্ঞে সরকারের কোন হাত ছিলো না, বরং এটা ছিলে আকিয়াবের এক উগ্রতাবাদী মগগোষ্ঠীর দুষ্কৃতির ফল।

আসল নির্যাতন ও জাতিগত উচ্ছেদ শুরু হয় জেনারেল নে উইন ক্ষমতা দখল করার পর থেকে।

এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী নে উইনের সামরিক শাসনকালে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় ভয়াবহ আকারের দশটি গণহত্যা ও জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হয়। তাতে হাজার হাজার নিরস্ত্র অসহায় রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। প্রতিটি উচ্ছেদ অভিযানে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা তাদের শত শত বছরের ভিটে মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে প্রাণহাতে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে।

১৯৭৪ সালে বার্মা স্যোসালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টি (বিএসপিপি) এর নতুন সংবিধান প্রনয়ণের উদ্দেশ্যে  প্রথম গণসভা নামে একটি সম্মেলন আহ্বান করা হয়। তাতে সামরিক জান্তা আরাকানকে শুধু বৌদ্ধশাসিত প্রদেশ বলে ঘোষণা করে মগ সম্প্রদায়কে ব্যাপক গণহত্যা ও রোহিঙ্গা-উচ্ছেদের, বলতে গেলে া অবাধ ছাড়পত্র দিয়ে দেয়। ফলে প্রতিহিংসাপাগল সশস্ত্র মগ সম্প্রদায় সমগ্র আরাকানজুড়ে উন্মত্ত উল্লাসে মুসলিম-নিধনে মেতে ওঠে; বিশেষ করে মুসলিম -প্রধান অঞ্চলগুলোতে, যেমন আকিয়াব, বুচিদং, মংডু প্রভৃতি। কারণ সামরিক জান্তার পরিকল্পনা ছিলো এসব অঞ্চলের জনসংখ্যা-গত নতুন বিন্যাস। অর্থাৎ বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার উচ্ছেদ ও  বিতাড়নের মাধ্যমে নতুন নতুন মগ উপনিবেশ স্থাপন করা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম বসতিকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করা। এ কৌশলটি তারা পেয়েছে ইহুদি-বাদী রাষ্ট্র ইসরাইলের কাছ থেকে, যারা নিষ্ঠুরতম উপায়ে ফিলিস্তীনের ভূমি-সন্তান আরব-মুসলিমদের উচ্ছেদ করে একের পর এক ভূমি দখল করেছে, আর সেখানে গড়ে তুলেছে বিভিন্ন দেশ থেকে তুলে আনা ইহুদিদের বসতি। এসবই ঘটেছে বৃটেন আমেরিকাসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখের সমনে এবং জাতিসঙ্ঘের, বলতে গেলে নীরব সমর্থনের মাধ্যমে। তারপর থেকে দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তীনীরা দেশছাড়া, রাষ্ট্রছাড়া। এখানে সেখানে ‘শরণার্থী’! সে বড় মর্মন্তুদ ইতিহাস।

তো ইহুদিবাদী ইসরাইলের সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের গোপন পরামর্শে ও সহযোগিতায় একই কাজ করেছে এবং এখনো করে চলেছে বার্মার সামরিক সরকার এবং তাদের প্রত্যক্ষ মদদে মগসম্প্রদায়, যাদের সঙ্গে শতাব্দীর পর শতাব্দী নিরীহ, শান্তিপ্রিয় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী প্রীতি ও সম্প্রীতির সঙ্গে বাস করে এসেছে।

লক্ষ্য করার বিষয় হলো, ফিলিস্তীনের ভাগ্যাহত আরব-মুসলিমদের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে সেই একই ঘটনা আমাদের প্রতিবেশী আরাকানের মুসলিম-ভূমিতে ঘটছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখের উপর এবং নীরাপত্তাপরিষদের সরব সমর্থনের মাধ্যমে; বিশেষ করে চীন ও রাশিয়ার ভেটোশক্তির প্রত্যক্ষ ছত্রচ্ছায়ায়। ফিলিস্তীনের আর্তনাদ শোনবার যেমন কেউ ছিলো না, এখনো নেই; তেমনি আরাকানের নির্যাতিত অসহায় রোহিঙ্গাজন-গোষ্ঠীর ফরিয়াদ শোনবারও বেয়াল্লিশের ভয়াবহ গণহত্যার সময় যেমন কেউ ছিলো না, আজো কেউ নেই।

প্রশ্ন হলো, যুগ যুগের বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়ে এই বনী আদমগুলো যাবে কোথায়? এর জবাব তখনকার সামরিক জান্তার কাছে যা ছিলো, এখন গণতন্ত্রের ‘মানসকন্য’, শান্তির জন্য নোবেল পদকে ভূষিতা অন শাং সূ চি-এর কাছেও তাই- ‘ওরা তো বহিরাগত বাঙ্গালী! ওরা তো বার্মার আদি জনগোষ্ঠী নয়; ওরা যেখান থেকে এসেছে সেখানেই ফিরে যেতে হবে। আবার যদি কোন ‘জাফর কাওয়াল’-এর জন্ম হয়, তখন মিয়ানমারের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও হয়ত বলবে, ‘জঙ্গী, সন্ত্রাসী, ওদের নিমূল কর।’ এটাই সম্ভবত প্রতিটি মুসলিম জনপদের ‘জাতিসঙ্ঘনির্ধারিত ভাগ্য’। এক বেচারা এরদোগানের দুর্বল গলার আওয়াযে আর কী হবে! আসল কথা হলো, আল্লাহ ছাড়া কেউ এ উম্মাহর রক্ষাকারী নেই।

যারা ইতিহাস লেখে তাদের নাকি আবেগমুক্ত হতে হয়। এদিকে আমি বারবার আবেগের তোড়ে ভেসে যাই। হয়ত আমি ইতিহাস লেখার উপযুক্ত নই; কিংবা যখন মানুষ নিজেরই দুর্ভাগ্যের ইতিহাস লেখে তখন এমনই হয়।

পৃথিবীর কোন জনগোষ্ঠী, যত নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় হোক, নিপীড়ন ও নির্যাতন যখন সীমা ছাড়িয়ে যায়, যখন নারীর সম্ভ্রম ও শিশুর জীবন পর্যন্ত বিপর্যস্ত হয়ে যায়, যখন পূর্বপুরুষের বাস্তুভিটা থেকেও উচ্ছেদ হতে হয়, আর সারা বিশ্ব শুধু চেয়ে চেয়ে তামাশা দেখে তখন যুবকদের রক্ত টগবগ করে ওঠবে, তাদের বুকের ভিতরের ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ লাভা উদ্গীরণ করবে এটাই স্বাভাবিক। একদিন আগে বা পরে, এটা ঘটবেই। পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকূল হলে এটা খুব দ্রুত ঘটে এবং পুরো ভূখ-ে, এমনকি তার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে পরিবেশ পরিস্থিতি প্রতিকূল হলে এটা দেরিতে ঘটে এবং হয়ত অস্ত্রের জোরে, শক্তির দাপটে এবং হায়েনার হিং¯্র থাবায় তা দুর্বল হয়ে যায়, তবে ধিকি ধিকি করে হলেও তা জ্বলতে থাকে এবং যে কোন সময় দাবানলের মত জ্বলে ওঠে। সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সারখার করে তবে তা শান্ত হয়, ক্ষান্ত হয়।

এটাই প্রকৃতির চিরন্তন বিধান; এটাই ইতিহাসের চিরকালের সত্য। এভাবেই একসময় বেজে উঠেছিলো জাফর কাওয়ালের কণ্ঠে অগ্নিবীণা; এভাবেই জ্বলে উঠেছিলো মুহাম্মাদ আব্বাসের বুকে প্রতিবাদ ও প্রতিশোধের দাবানল।

জেনারেল নে উইনের আমলেও প্রবল প্রতিকূলতার মুখে ক্ষুদ্র ও সীমিত আকারে সশস্ত্র প্রতিরোধে একটা দু’টো প্রচেষ্টা আমরা দেখতে পাই, যদিও বিভিন্ন বাস্তব কারণে তা খুব বেশী দূর অগ্রসর হতে পারেনি এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের ক্ষেত্রে তেমন কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি। তবু কিছু দুর্বল অসহায় যুবকের ক্ষুদ্র কিছু প্রচেষ্টা আজ ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। এগুলোই হয়ত পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অফুরন্ত প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

মুহম্মদ ইউনুসের মূল্যবান গ্রন্থ অ ঐরংঃড়ৎু ঙভ ধৎধশধহ এর বিবরণ থেকে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় যুবক সামরিক জান্তা ও মগসম্প্রদায়ের আগ্রাসন থেকে মুক্তির আকুতি নিয়ে ১৯৭০ সালে অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। প্রতিষ্ঠানটির তারা নাম রাখেন, জড়যরহমধ ওহফবঢ়বহফবহপব ঋৎড়হঃ সংক্ষেপে (জরঋ)

এ সংগঠন অল্প সময়ের মধ্যেই আরাকানের শহর ও গ্রামাঞ্চলে যুবসমাজকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। সফলতা ও ব্যর্থতা এবং পরিণাম-পরিণতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ বেপরোয়া হয়েই তারা এ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে।

এ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ তাদের সংগ্রাম ও আন্দোলনের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যান এবং বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, শুধু পড়ে পড়ে মার খেলে একদিন এ ভূখ- থেকে আমাদের অস্তিত্বই শেষ হয়ে যাবে। যতটুকু শক্তি আছে তাই নিয়ে আমাদের রুখেদাঁড়াতে হবে এবং নতুন শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। অন্তত এভাবে মরার চেয়ে প্রতিরোধ করে মরা অনেক ভালো।

নেতৃবৃন্দ তাদের পূর্বসূরী জাফর কাওয়াল ও মুহম্মদ আব্বাসের মুজাহিদ আন্দোলনের বিচ্ছিন্ন সদস্যদেরও একত্র করার চেষ্টা চালিয়ে যান এবং সফলও হন। এ সংগঠনের প্রাণপুরুষ ছিলেন বুদ্ধিজীবী মুহম্মাদ সুলতান। তার মধ্যে প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার যেমন অভাব ছিলো না তেমনি উদ্যম, উদ্দীপনা ও প্রাণচাঞ্চল্যেরও ঘাটতি ছিলো না। কিন্তু .. একদিকে ছিলো হত্যা-ধর্ষণ- লণ্ঠন ও ব্যাপক অগ্নি-সংযোগ, অন্যদিকে ছিলো অব্যাহত নির্যাতনে বিপর্যস্ত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে শৃঙ্খলার অভাব এবং বলা যায়, সাহসিকতারও কিছুটা ঘাটতি। তাই যুবশক্তিকে কিছুটা ঐক্যবদ্ধ ও প্রতিরোধের

মন্ত্রে উজ্জীবিত করতে সক্ষম হলেও নির্যাতিত জনগোষ্ঠীকে ছত্রচ্ছায়াদানে তিনি উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি। কারণ তাদের ভয় ছিলো, এতে নির্যাতনের মাত্রা আরো বেড়ে যাবে। সবচে’ বড় কথা, তাদের হাতে বলতে গেলে কোন অস্ত্রই ছিলো না। এধরনে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রথমে যেটা প্রয়োজন সেটা হলো অস্ত্রের কালোবাজারীদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান। অর্থের জন্য তিনি সউদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের সরকারগুলোর সঙ্গে যেমন যোগাযোগ করেন তেমনি প্রবাসী রোহিঙ্গাদের মধ্যেও ব্যাপক তৎপরতা পরিচালনা করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, কোন প্রচেষ্টাই তেমন কাজে আসেনি।

তো প্রবল শক্তির সশস্ত্র আগ্রাসনের মুকাবেলায় দুর্বল নিরস্ত্র প্রতিরোধের পরিণাম যা হওয়ার তাই হয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত মুহাম্মদ সুলতানকে আরাকান-ভূমি ত্যাগ করে পূর্ব-পাকিস্তানের ভূমিতে আশ্রয় নিতে হয়েছিলো। এভাবে তার দুর্বল প্রচেষ্টার মর্মান্তিক অবসান ঘটেছে সত্য, তবে যুবকহৃদয়ে স্বাধীনতার যে আকাক্সক্ষা ও জিহাদের যে উদ্দীপনা তিনি জাগিয়ে তুলেছিলেন তার মৃত্যু ঘটেনি। (চলবে ইনশাআল্লাহ)