এ প্রশ্ন আজ জ্বলন্তরূপে মানবজাতির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে যে, মানুষ কি শেষ পর্যন্ত নিজেই নিজের ধ্বংসের আয়োজন সম্পন্ন করছে?
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ‘ভয়াবহ’ অগ্রগতি কিন্তু এমনই আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। আঠারো শতকের গোড়ার দিকে ইউরোপের যে শিল্পবিপ্লব, তখন থেকেই ধীরে ধীরে যন্ত্র মানুষের স্থান দখল করতে শুরু করেছিলো। তখন অবশ্য সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্ণধারদের কাছে বিষয়টি ছিলো স্বস্তিদায়ক। কারণ যন্ত্রের উন্নতির কারণে বেকারত্বের কিছু সমস্যা সৃষ্টি হলেও সাধারণভাবে যন্ত্র জীবনকে অধিক স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ ও আরামদায়ক করেছিলো। তারপর নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করে বেকারত্বের সন্তোষজনক সমাধানও করেছিলো। এমনকি যাকে বলা হয় কম্পিউটারবিপ্লব, তাও মানুষকে শুধু বিস্ময়-মুগ্ধতাই দান করেছে এবং মানুষের জীবনে এনে দিয়েছে অপার জৌলুস, যেমন কর্মক্ষেত্রে, তেমনি বিনোদনের জগতে। কম্পিউটারবিপ্লব সমাজচিন্তকদের চিন্তায় তেমন ভীতি বা উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করেনি। পক্ষান্তরে সাধারণ মানুষ ব্যাপক বেকারত্বের আশঙ্কায় কিছুটা চিন্তিত হলেও দেখা গেলো, কম্পিউটার কাজের নতুন নতুন দিগন্ত এবং নব নব সম্ভবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে।
কম্পিউটারের চরমোন্নতির পথ ধরে যখন শুরু হলো রোবটবিপ্লব তখন থেকেই আসলে শুরু হয়েছে ভবিষ্যত সম্পর্কে মানুষের চিন্তা ও উৎকণ্ঠা।
রোবটের জন্ম হয়েছে আসলে কৃত্রিম বুদ্ধি ও মেধাসম্পন্ন যান্ত্রিক মানবতৈরীর প্রেরণা থেকে, যার মূল উৎস হচ্ছে মানবজীবনে বস্তুসভ্যতা থেকে সৃষ্ট ক্ষোভ ও হতাশা। মানুষ এখন চায় জীবনের সর্বক্ষেত্রে মানুষের উপর নির্ভরতা কমিয়ে আনতে, এমনকি সম্ভব হলে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে। কারণ মানুষের মত রোবট দুর্নীতি করবে না, বিশ্বাসভঙ্গ করবে না, পূর্ণ বিশ্বস্ততা রক্ষা করে অর্পিত দায়িত্ব মানুষের চেয়ে বহুগুণ যোগ্যতা, দক্ষতা ও কুশলতার সঙ্গে সম্পন্ন করবে। বৃদ্ধ মাতা-পিতা সন্তানের কাছ থেকে সামান্য একটু সময় পায় না। মেয়ে ও ছেলে রোবট সন্তানের সে অভাব ন্যূনতম পর্যায়ে হলেও পূরণ করবে বলে ভাবা হচ্ছে। তাই সময় ও সঙ্গ দেয়ার জন্য এবং ‘আন্তরিক’ সেবাদানের জন্য রক্তমাংসের সন্তানের পরিবর্তে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অনুভূতিসম্পন্ন ‘যান্ত্রিক সন্তানের’ কথা ভাবতে মানুষ আজ বাধ্য হচ্ছে। মোটামুটি এই হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবটের আত্মপ্রকাশের আসল প্রেক্ষাপট।
প্রশ্ন হলো! এটা কি সম্ভব? রোবট কী কখনো হতে পারবে মানুষের বিকল্প? সেদিন পর্যন্ত মনে হয়েছিলো, হয়ত এটা সুদূর পরাহত। কারণ রোবট-চিন্তার বাস্তবায়ন অত্যন্ত ধীর গতিতে অগ্রসর হচ্ছিলো। হঠাৎ করেই যেন প্রযুক্তির অগ্রগতি মানুষের ধারণাকেও ছাড়িয়ে যেতে লাগলো। চালকবিহীন (অর্থাৎ রোবটচালিত) গাড়ী মানুষের পরিকল্পনা থেকে অন্তত দুই দশক আগেই রাস্তায় নেমে পড়েছে। অবাক বিস্ময়ে এবং আতঙ্ক ও স্তব্ধতার মধ্যে মানুষ এখন দেখছে, একটি মাত্র রোবট সবমানুষের সব ভাষা পড়তে পারে। একজন মানুষ ক’টি চেহারা মনে রাখতে পারে? রোবট অসংখ্য মানুষের চেহারা চিনতে পারে। মানুষ মানুষকে ফাঁকি দিতে পারে, রোবটকে নয়। এমনকি রোবট এখন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মত রোগ নির্ণয় করতে পারে এবং পারে (রোগীর পকেটের দিকে না তাকিয়েই) ব্যবস্থাপত্র লিখতে। এক্স-রে রিপোর্ট পড়া তো এখন কিছুই না। কোন বিষয়ে মানুষের ভুল করার হার এখন শতকরা ত্রিশভাগ হলে রোবটের ক্ষেত্রে তা ভগ্নাংশেরও ভগ্নাংশ।
মোটকথা, মেধা ও বুদ্ধিমত্তায় রোবট এখন মানুষের ‘কাছাকাছি’ পৌঁছে গিয়েছে, এমন কথা প্রায় স্বীকৃতি পেয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতে। কথাটা হয়ত সত্য; হয়ত সত্যতা অর্জনের পথে, কিংবা ...।
এখন যে প্রশ্ন নিয়ে প্রযুক্তির অঙ্গনে মাথা ঘামানো হচ্ছে তা হলো, রোবট কি মানুষের মত অনুভব অনুভূতি অর্জন করতে পারবে? সহানুভূতি, সমবেদনা, প্রীতি ও ভালোবাসা- এসকল সুকুমারবৃত্তি মানুষের মত রোবটের মধ্যেও কি সৃষ্টি হতে পারে?
এখানেও একই কথা! মানুষ এমন করে ভাবছে কেন? কারণ মানুষের সুকুমারবৃত্তির উপর মানুষ আর আস্থা রাখতে পারছে না। কেন এমন হচ্ছে? কারণ মানুষ এখন হৃদয় নিয়ে ভাবতে চায় না। নিজের ভিতরের ¯্রষ্টাপ্রদত্ত সুকুমারবৃত্তিগুলো রক্ষা করার চেষ্টা করতে চায় না। এককথায় মানুষ এখন এতই দেহসর্বস্ব যে, হৃদয় ও আত্মার জগত সম্পর্কে সে নির্লিপ্তই নয়, বে-খবরও। ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক অনিবার্য শূন্যতা। সেটা পূরণ করার জন্যই মানুষ এখন ‘অনুভূতিসম্পন্ন’ রোবটের কথা চিন্তা করতে শুরু করেছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, কী এর ভবিষ্যত এবং কী এর পরিণতি? আমরা কি এভাবে মহাপ্রজ্ঞার অধিকারী ¯্রষ্টার ইচ্ছা ও উদ্দেশ্যের পথে নিজেকে নিবেদন করছি, না ভিতরের পশুশক্তিকে অনুসরণ করছি?
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতে এখনো যারা হৃদয় ও আত্মা সম্পর্কে কিছুটা ভাবেন তারা ইতিমধ্যেই সতর্কবাণী উচ্চারণ করতে শুরু করেছেন যে, মানুষের এই লাগামহীন প্রযুক্তিচর্চা একসময় মানুষের জন্যই চরম পরিণতি ডেকে আনতে পারে। আমরা আমাদের বক্তব্যের সমাপ্তি টানতে চাই আলোকোরআনের এই সতর্কবাণী দ্বারা-
‘স্থলে ও জলে ফাসাদ ছড়িয়ে পড়েছে মানুষেরই ‘কর্মফল’ থেকে, যাতে তারা তাদের কর্মের কিছুটা সাজা ভোগ করে। এভাবে হয়ত তারা ফিরে আসবে।’