শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

রবিউল আউয়াল ১৪৪০হিঃ (৩/৭) | তোমাদের পাতা

দরদী মালীর কথা শোনো

১৪৩৮/৩৯ হিজরীর পঞ্চম বর্ষের তালিবানে ইলমের উদ্দেশ্যে আদীব হুযূরের বয়ান। তা. ২৪/৮/৩৯ হি.

 

আমাদের প্রত্যয়

নারীর মর্যাদা ও অধিকার

বিসমিল্লাহ

আমার প্রিয় তালিবানে ইলম! বয়সে, জ্ঞানে, বুদ্ধিতে তোমাদের এখন যে স্তর তাতে, যে নেছাবে তা‘লীম ও নেযামে তারবিয়াত তোমরা গ্রহণ করেছো এবং জীবন ও ভবিষ্যত গড়ে তোলার জন্য; পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতিকে প্রয়োজনীয় সেবা দানের উপযোগিতা অর্জনের জন্য যে শিক্ষাব্যবস্থা ও দীক্ষাপদ্ধতি নিজেদের জন্য তোমরা নির্বাচন করেছো সে সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান ও অবগতি এবং বাছীরাত ও অন্তর্জ্ঞান অর্জন করা অপরিহার্য। একসময় ছিলো, তোমার সিদ্ধান্ত তোমার হাতে ছিলো না, সেটার দায়-দায়িত্বও তোমার ছিলো না, সুতরাং এতটুকু বলাই যথেষ্ট ছিলো যে, আমি তো কিছু জানি না, আমার বাবা আমাকে ‘এখানে’ এনেছেন। এ উত্তর তোমার ঐ বয়সে গ্রহণযোগ্য ছিলো; এখন আর তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। তুমি যে সমাজে বাস করো সেখানে কখনো না কখনো তোমাকে এ প্রশ্নের সম্মুখীন হতেই হবে যে, তুমি মাদরাসায় পড়ো কেন? এ প্রশ্ন এ দেশের যে কোন কাওমী মাদরাসার যে কোন তালিবে ইলমকে করা হতে পারে। এ প্রশ্নের যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য উত্তর প্রত্যেক তালিবে ইলমের জানা থাকতে হবে এবং পূর্ণ প্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তুমি মাদারাসাতুল মাদীনায় পড়ো, মাদানী নেছাবে পড়ো, বা কাদীম নেছাবে পড়ো, এ প্রশ্নের জবাব সম্পর্কে তোমার শারহে ছদর থাকতেই হবে। আফসোস, আমাদের অনেকেরই তা নেই।

এর পর তোমার জন্য আলাদা করে যে প্রশ্ন আসবে এবং আসবেই; লুতফ কী বাত ইয়ে হ্যয় ক্য, আজনাবীর পক্ষ থেকে যেমন তেমনি আপন ঘরানার পক্ষ হতেও আসতে পারে। তো মাদরাসাতুল মাদীনাহর এবং মাদানী নেছাবের এই স্তরের তালিবানে ইলমের এ সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও শারহে ছদর থাকতে হবে।

 

আগামী প্রজন্মের প্রতিশ্রুতিশীল কোন তরুণ ও যুবক নিজের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে, নিজের শিক্ষাজীবন সম্পর্কে, নিজের ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ও রূপরেখা সম্পর্কে অজ্ঞতার মধ্যে কীভাবে থাকতে পারে! কিছুতেই পারে না। তাহলে পরিবারে এবং সামাজে তাকে অবজ্ঞা, অবহেলা ও করুণার পাত্র হয়েই থাকতে হবে।

তো আমার আকুল আবেদন, প্রত্যেক তালিবানে ইলমের প্রতি, বিশেষ করে তোমাদের প্রতি, উপরের দু’টি প্রশ্নকে সামনে রেখে সময়, সমাজ ও জীবনের মুখোমুখি হওয়ার জন্য এখন থেকেই পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করো। এসম্পর্কে উস্তাদের কাছ থেকে নির্দেশনা গ্রহণ করো, আমাদের বড়রা যা কিছু বলেছেন তা পড়ো এবং হৃদয়ঙ্গম করো; প্রয়োজনে আমার সঙ্গে আলোচনা করো; আমি আমার সাধ্যমত তোমাদের সাহায্য করতে প্রস্তুত। তবে একটা কথা, আমার যেন মনে হয়; তোমার সামগ্রিক আচরণ ও উচ্চারণ এবং শিক্ষার সঙ্গে তোমার দিন-রাত ও সকাল-সন্ধ্যার জীবন যাপন থেকে আমার যেন বিশ্বাস হয় যে, এ বিষয়ে তুমি আন্তরিক এবংতোমার জন্য ব্যয় করা আমার সময়গুলো উত্তম ও উপযুক্ত ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হচ্ছে। আফসোসের সঙ্গেই বলতে হয়, পিছনের জীবনে এ ক্ষেত্রে আমি যথেষ্ট ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি। এমন ছাত্রকেও উদারভাবে সময় দিয়েছি, পরবর্তী অবস্থা দেখেবোঝা যায়, আমার জীবনের  সময়গুলোর উপর তার কোন হক ছিলো না। জীবনের যে স্তরে মানুষের মধ্যে উদ্যম থাকে, উদ্দীপনা থাকে এবং থাকে প্রাণের তরঙ্গপ্রবাহ, তখন এ বিষয়ে আমি যথেষ্ট ভুল করেছি; আমার মুহসিন উস্তায হযরত পাহাড়পুরী হুযূর রহ. যেভাবে আমাকে সময় দিয়েছেন সেভাবেই আমি সময় দিয়েছি। কিন্তু তিনি যেমন আশ্বস্ত ছিলেন তার ব্যয় করা সময়ের বিষয়ে, আমি তেমন আশ্বস্ত হতে পারিনি। তো এখন আর এ ভুল করতে চাই না। হয়ত খুব অল্প সময়ই রয়েছে হাতে, অথচ বিপুল কাজ পড়ে আছে সামনে।

দেখো, কথা কত দীর্ঘ হয়ে গেলো, মূল কথা এখনো শুরুই করা হলো না।

তো পিছনের এক মজলিসে মাদরাসাতুল মাদীনাহ ও মাদানীনেছাবের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিছু কথা বলেছিলাম। এখন একটি অত্যন্ত জরুরি কথা বলতে চাই। মনের যে বিক্ষিপ্ত অবস্থা তাতে কথাগুলো কতটা গুছিয়ে বলতে পারবো, জানি না। তবে চেষ্টা করবো, তাওফীক দানকারী হলেন আল্লাহ।

 

***

মানবসমাজের অর্ধেক হলো নারী, একথা যুগ যুগ ধরে শুনে এসেছি। এটা তো এমন বাদহী হাকীকত ও স্বতঃসিদ্ধ সত্য যা দলিল দিয়ে প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই। মানবসত্তা পুরুষের মধ্যে যেমন রয়েছে তেমনি নারীর মধ্যে রয়েছে। পক্ষান্তরে পুরুষসত্তা ও নারীসত্তায় উভয় শ্রেণী আলাদা। তো মানবসত্তা ও পুরুষ সত্তা দু’দিক থেকেই নারীজাতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রয়েছে, যেমন রয়েছে পুরুষের সঙ্গে নারীর। এটা আমার জীবনে যেমন সত্য, তোমার জীবনেও তেমনি সত্য। এটা যুগ যুগের সত্য, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের সত্য। মানবসত্তা হিসাবে মা হিসাবে একজন নারীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক রয়েছে এবং রয়েছে বিপুল দায়দায়িত্ব। একই ভাবে, বোন হিসাবে রয়েছে এক বা একাধিক নারীর সঙ্গে সম্পর্ক এবং  সে সম্পর্কেরও রয়েছে বেশ কিছু দায়দায়িত্ব। তারপরে রয়েছে কন্যা হিসাবে সম্পর্ক এবং সে সম্পর্কেরও রয়েছে অপরিহার্য ও সুনির্দিষ্ট দায়দায়িত্ব। এই যে সম্পর্কগুলোর কথা বললাম, এগুলোর ভিত্তি হলো আমার, তোমার; আমাদের মানবসত্তা, পুরুষসত্তা এখানে একেবারে গৌণ। মা ও সন্তান, বোন ও ভাই এবং পিতা ও কন্যা, এসম্পর্কগুলোর ভিত্তি হলো উভয় তরফের মানবসত্তা, পুরুষসত্তা বা নারীসত্তা নয়।

আমি কি বিষয়টা তোমাদের গুছিয়ে বলতে পেরেছি? তোমরা কি বুঝতে পেরেছো? এরপরে একটা সম্পর্ক রয়েছে আমাদের সঙ্গে নারীসমাজের। তবে সে সম্পর্কের প্রধান ভিত্তি হলো আমাদের পুরুষসত্তা, মানবসত্তা এখানে গৌণ। তুমি যাকে মা ডাকো, তিনি তোমার মা হয়েছেন পরে, তার আগে তিনি হয়েছেন তোমার বাবার স্ত্রী। তো তোমার বাবার সঙ্গে তোমার মায়ের মধ্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধান রক্ষা করে এবং মানবজাতি ও মানবসভ্যতার অস্তিত্ব ও স্থায়িত্বের দাবী রক্ষা করে; সর্বোপরি ইসলামী উম্মাহর গৌরবপূর্ণ প্রসার ও বিস্তারের নববী আকাক্সক্ষা অনুসরণ করে, তোমার বাবা ও মায়ের মধ্যে এবং প্রতিটি সন্তানের বাবা ও মায়ের মধ্যে একটি জান্নাতি সম্পর্ক তৈরী হয়েছে; যার কল্যাণময় ও বরকতপূর্ণ ফলরূপে তুমি ‘আলামে আরওয়াহ থেকে দুনিয়াতে এসেছো এবং ধীরে ধীরে জীবনের দায়-দায়িত্বের পথে অগ্রসর হয়ে আজ এ পর্যন্ত এসেছো।

তো এই যে, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, এটা, চিন্তা করে দেখো, মানবজাতির ইতিহাসের সর্বপ্রথম সম্পর্কে। অন্যান্য সম্পর্ক অস্তিত্ব লাভ করেছে মূলত এই প্রথম সম্পর্ককে অবলম্বন করে। এ সম্পর্ক ছাড়া উভয়ের মধ্যে অন্যান্য সম্পর্ক কল্পনা করাই তো সম্ভব নয়! তাহলে কি বোঝা যায় না, স্বামী-স্ত্রী নামের সম্পর্ক মানব জীবন ও মানব সভ্যতার কত অপরিহার্য, কত গুরুত্বপূর্ণ এবং কত পবিত্র ও মুকাদ্দাস এবং আসামানী ও জান্নাতী সম্পর্ক? এটাই একমাত্র সম্পর্ক যার বন্ধনসূত্র হলো আল্লাহর তা‘আলার জালাল ও জামালপূর্ণ নাম। তাই এসম্পর্কের মধ্যে একদিকে যেমন রয়েছে জালালের আসমানী প্রকাশ, অন্যদিকে তেমনি রয়েছে জামালের জান্নাতী উদ্ভাস!

এবার চিন্তা করে দেখো, এ সম্পর্কের প্রায় একমাত্র ভিত্তি হচ্ছে বাবার পুরুষসত্তা এবং মায়ের নারীসত্তা।

এ প্রসঙ্গে আরো আগে যাওয়ার আগে, একটা মাযমূনের দিকে তোমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, এই যে বলে এলাম, ‘ইসলামী উম্মাহর গৌরবপূর্ণ প্রসার ও বিস্তারের নববী আকাক্সক্ষা অনুসরণ করে’, আসলে এটা আমি আহরণ করেছি যবানে নবুয়তের ঐ মহাবাণী হতে যাতে উম্মতের ‘পুরুষসত্তা’কে সম্বোধন করে উম্মতের ‘নারীসত্তা’ সম্পর্কে বলা হয়েছে-

تزوجوا الودود الولود فإنـي أباهي بكم الأمم

প্রসঙ্গ থেকে হয়ত দূরে হবে, তবু আবার সুযোগ হয় কি হয় না, তাই এখানেই জরুরি কথাটা বলে রাখি। এই হাদীছের আলোচনা যতবার আমি শুনেছি, বড় বড় ব্যক্তির মুখের ভাষা ও দেহভঙ্গি থেকে আমার যে অনুভূতি হয়েছে তা এই যে, জীবনের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ একটি নববী বাণীর মূল বার্তা ও পায়গাম সম্পর্কে সম্ভবত আমরা পূর্ণ সচেতন হতে পারিনি। আচ্ছা বলো দেখি, যিনি নবীজীর أباهي بكم الأمم এর অপরিহার্য একটি পক্ষ হবেন এবং সবচে’ কষ্টের, বেদনার, জীবন-মৃত্যুর কাশমাকাশপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন, কাওয়াম ও দায়িত্বশীল পক্ষ হিসাবে তার সঙ্গে স্বামীর, তোমার বাবার আচরণ কেমন হওয়া সঙ্গত এবং জরুরি? দ্বীন ও শরী‘আতকে সামনে রেখে, বিবেক ও মানবতা-বোধকে জাগ্রত করে এবং পুরুষ-সত্তাকে অন্তত কিছু সময়ের জন্য সংযমের মধ্যে এনে, তারপর এ প্রশ্নের জবাব দাও।

আরো কথা আছে, যিনি হবেন স্বামী, সন্তান এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সংসারের প্রতিটি মানুষের প্রতি ودود বলো দেখি, কেমন হওয়া উচিত মমতাময়ী নারীর প্রতি স্বামী, সন্তান ও পরিবারের এবং সমাজের সকল সদস্যের আচরণ?

তারপর আছে ولود -এর অর্থ কী, বোঝ! এটা কি হসবার বিষয়। তোমার মায়ের কথাই চিন্তা করো না, ولوديـة এর দায় ও দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কতবার মৃত্যুশঙ্কার হাতে নিজেকে তিনি অর্পণ করেছেন স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে, মমতার হাতছানিতে এবং বলতে চাই ‘নবীর আকাক্সক্ষার লাজ রক্ষা করে’?! র্

আমি, তুমি পুরুষ বলে ‘মৃত্যুশঙ্কা’ কথাটার অর্থ কিছুই বুঝতে পারবো না। এটা বুঝতে হলে-আমাকে মাফ করো, কথাটা যদি সঙ্গত না হয়- প্রতিটি পুরুষকে একবার, হাঁ, জীবনে অন্তত একবার মাতৃত্বের বেদনাভার বহন করতে হবে, যা সম্ভব নয় প্রকৃতিরই বিধানের কারণে। তবে যে পক্ষ এ বেদনাভার বহন করছে তার প্রতি একটু কোমল, একটু ¯িœগ্ধ এবং সহনশীল তো হতে পারি!

ুপ্রসঙ্গ থেকে আবারও দূরে যাচ্ছি; আমার মাননীয় ব্যক্তি, যিনি এখন মরহূম, আমার বক্তব্য শুনে, বেশ তরল কণ্ঠে বললেন, ওয়াদূদ না হয় সব নারী হলো, কিন্তু ওয়ালূদ? কত নারী আছে, একজন, খুব বেশী হলে দু’জন তিনজন সন্তান জন্ম দেয়?

অবাক হয়ে কিছুক্ষণ শুধু তাকিয়ে থাকলাম, আর ভাবলাম, আমাদের শিক্ষা-দীক্ষার দায়িত্ব কত ছাতহী চিন্তার মানুষের দুর্বল কাঁধে অর্পিত হয়েছে!

মুখে বললাম, কারণ হয়ত প্রাকৃতিক, হয়ত শারীরিক, হয়ত অন্য কোন মাজবূরী, কিন্তু যত বেশী সম্ভব সন্তানের মা হওয়া, এটা নারীসত্তার চিরায়ত আকুতি; বিশেষ করে মুসলিম নারীর; এই আকুতিকেই আমাদের সম্মান করতে হবে।

এরপর তিনি যা বললেন, তা এখানে অনুল্লেখিতই থাক। শুধু আমার উত্তরটুকু বলি, আমি বললাম, ‘বিবি হলো দাসী, আমি তো হুকুম দেবো, যা, পান বানাা ক্যার লাা’ যিনি বলেছেন, হতে পারেন তিনি বুযুর্গ। আমি তার এ বক্তব্যের সঙ্গে নেই। এটা দ্বীন ও শরী‘আতের বক্তব্য নয়, এটা নবুয়তের শিক্ষা নয়। শরী‘আতের বক্তব্য তো হলো ‘রিফকান বিল কাওয়ারীর!’ নবুয়তের শিক্ষা তো হলো, তাহাজ্জুদের সময় আস্তে করে দরজা খোলা, যাতে স্ত্রীর ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে! জায়নামাযের উপর ঘুমন্ত স্ত্রীর পা এসে গেলে কোমলভাবে সরিয়ে দিয়ে সেজদায় যাওয়া!

***

যাই হোক, চলো আমরা বক্তব্যের মূলে ফিরে যাই। শুরুতে বলেছিলাম, নারী হলো মানবসমাজের অর্ধেক, একই ভাবে পুরুষ। আর উভয়ের মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু সম্পর্ক এবং তার সুনির্ধারিত দায় ও দায়িত্ব। বাবা ও সন্তানের - ছেলে হোক বা মেয়ে - সম্পর্ক, ভাই ও বোনের সম্পর্কে, মা ও পুত্রের সম্পর্ক; প্রথম সম্পর্কের কথাই পরে বলছি, তোমাদের অবস্থা ও অবস্থানগত কারণে। কারণ এ সম্পর্কের বন্ধনে তোমরা এখনো আবদ্ধ নও। তবে জীবনের দাবী প্রত্যাখ্যান করা কারো পক্ষেই সম্ভব হয়নি, তোমাদের পক্ষেও সম্ভব হবে না। আর কিছু না হোক, প্রকৃতিই তোমাকে মজবূর করবে এ মহান সম্পর্কের অমোঘ বন্ধনে আবদ্ধ হতে এবং ...! সুতরাং এখন থেকেই তোমাদের প্রস্তুতি গ্রহণের সময়।

দেখো, উপরে যে ক’টি সম্পর্কের কথা আলোচনা করেছি, তার প্রতিটি সম্পর্কেই শরী‘আতে, কোরআন ও সুন্নায় আলোচনা রয়েছে এবং বিশদ আলোচনা। সেই যে ‘খালাকাকুম মিন্ নাফসিন ওয়াহিদাতিন ... থেকে শুরু, তারপর থেকে শুভ্র-সুন্দর, আলোকিত ও পবিত্র জীবন গড়ার জন্য আদেশ, উপদেশ ও দিকনির্দেশনার যেন আর আরশেষ নেই! একইভাবে সুন্নায় সেই যে স্মরণ করিয়ে দেয়া হলো, আল্লাহর নামকে সাক্ষি মেনে গ্রহণ করার কথা, তারপর কত প্রজ্ঞার সঙ্গে, কত কুশলতার সঙ্গে, কত দরদ ও মায়া-মমতার সঙ্গে দেয়া হলো বিভিন্ন আদেশ, উপদেশ এবং জীবনের অমূল্য সব পাথেয়! এমনকি বলা হলো, ... ওয়া আনা খায়রুকুম লি আহলী! কখনো ভাবার সুযোগ হয়েছে আমাদের এ হাদীছ সম্পর্কে! মাফ করো ভাই, আমরা তো ব্যস্ত শুধু ‘যদি আল্লাহ ছাড়া কাউকে সিজদা করার আদেশ করা হতো ...’ এ নিয়েই!! এভাবে পারবে কেউ জীবনকে এড়িয়ে যেতে! সম্পর্কের জান্নাতি স্বাদ ও আনন্দ অর্জন করতে!!

মা সম্পর্কে বলা হলো, তোমার জান্নাত তার কদমের নীচে! বোন ও কন্যা সম্পর্কে বলা হলো, তোমার মাঝে এবং জাহান্নামের মাঝে আড়াল হওয়ার কথা; আর গায়রে মাহারেম সম্পর্কে, ‘গায্যে বছরের কথা’ এবং আরো বহু অমূল্য উপদেশ; যেমন কোরআনে, তেমনি সুন্নায়। বিস্তারিত আলোচনার তো এখানে সুযোগ নেই। আশা করি, ইঙ্গিতই তোমাদের জন্য যথেষ্ট হবে।

তো বাজান, যদি জীবনের স্বাদ ও শান্তি এবং তৃপ্তি ও প্রশান্তি অর্জন করতে চাও; যদি কদমের নীচে জান্নাতের খোঁজ পেতে চাও; যদি জাহান্নাম ও তোমার মাঝে আড়াল তৈয়ার করতে চাও; যদি সমগ্র নারীসমাজের সঙ্গে সম্পর্কের পবিত্রতা রক্ষা করে দুনিয়া-আখেরাতে সফলতা অর্জন করতে  চাও, যদি প্রতিটি সম্পর্কের হাকীকত ও মর্ম এবং সত্য ও তাৎপর্য অনুধাবন করতে চাও এবং প্রতিটি সম্পর্কে ‘মা লাহূ ওয়া মা আলাইহি’ এবং সুবিধা ও দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে যদি অবগতি অর্জন করতে চাও তাহলে তোমাকে এ বিষয়ে কোরআন ও সুন্নাহর বিস্তৃত অধ্যয়ন ও গবেষণা করতেই হবে। এর কোন বিকল্প নেই।

আবার প্রসঙ্গ থেকে দূরে যাই, প্রাশ্চাত্যের যে শিক্ষাব্যবস্থা তাতে এ বিষয়ে তেমন কোন আলোচনা নেই। থাকা সম্ভবও নয়। তাদের শিক্ষার লক্ষ্য তো হলো এককথায় জীবনের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার যোগ্যতা অর্জন করা, তা যে ভাবেই হোক, মানবতাকে বিসর্জন দিতে হলে দাও, অন্য মানুষের, অন্য দেশের অধিকার ও সম্পদ অত্মসাৎ করতে হলে করো, তোমাকে শুধু শিখতে হবে, কীভাবে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে এবং জাতিতে জাতিতে টিকে থাকার এবং ছাড়িয়ে যাওয়ার শক্তি অর্জন করা যায়।

এই সব মানবিক ও ঊর্ধ্বজাগতিক সম্পর্কের জ্ঞান তারা পাবে কোথায় কোরআন ও সুন্নাহকে বাদ দিয়ে! তো পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী শিক্ষার পরিণতি যা হওয়ার কথা তাই হয়েছে এবং হচ্ছে। এ বিষয়ে যদি তোমাদের বাস্তব জ্ঞান থাকে তাহলে ‘কেন মাদরাসাশিক্ষা গ্রহণ করেছো, এর আত্মপ্রত্যয়ী জবাব অবশ্যই তুমি দিতে পারো।’ তুমি বলতে পারো, যে শিক্ষা বৃদ্ধাশ্রমের অভিশাপ দূর করতে পারে, যে শিক্ষা  মানুষের চিন্তা চেতনায় দাম্পত্যসম্পর্কর মধ্যে নিছক জৈবিকতার পরিবর্তে মানবিকতা ও পবিত্রতার বিশ্বাস ও প্রত্যয় দান করে এবং ... আমি সে শিক্ষা অর্জন করছি। আমি তো আপনাকেও অনুরোধ করবো, আপনার সন্তানকে ...!

অবশ্য উদার চিত্তে আমাদের একথাও স্বীকার করতে হবে যে, জাগতিক শিক্ষায় অনেক বেশী হলেও আমাদের দ্বীনী শিক্ষার মধ্যেও রয়েছে যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা, যা জীবনের সামগ্রিক দাবী পূর্ণ করার জন্য যথেষ্ট নয়। তো শিক্ষার দ্বৈততা দূর করে মানবজাতি ও মানবতার জন্য আল্লাহ যে বিধান দিয়েছেন সেই বিধানের উপযোগী অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা সামনে রেখেই আমরা এ শিক্ষা অর্জন করছি।

পক্ষান্তরে, মাদানী নেছাব কেন গ্রহণ করেছো, এর উত্তর হতে পারে অনেক কিছু, তবে এখনকার আলোচনার প্রেক্ষিতে তুমি বলতে পারো, ‘মানবজীবনের এই যে বিভিন্ন সম্পর্ক, যেগুলোর উপর দাঁড়িয়ে আছে মানুষের অস্তিত্ব এবং সভ্যতার ভবিষ্যত; যেগুলোর উপর নির্ভর করে জীবনের সকল সৌন্দর্য, সকল প্রশান্তি, মাদানী নেছাব আমাকে সেগুলোর হাকীকত ও মর্ম এবং পথ ও পন্থা শিক্ষা দেয়; এ শিক্ষা ছাড়া জীবন অচল, জীবন স্থবির এবং জীবন একটা অভিশাপ। এজন্য আমি মাদানী নেছাবের শিক্ষা ও দীক্ষা গ্রহণ করছি।

একথাগুলো সত্য এ জন্য যে, সবার প্রতি এবং সবকিছুর প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা রক্ষা করেও বলতে চাই, এসম্পর্কগুলো এমন করে জীবনের অঙ্গনে উপস্থাপন করা, আল্লাহর দয়ায় মাদানী নেছাবেরই বৈশিষ্ট্য।

তবে শুধু কথা ও বাগাড়ম্বরের ঘেরাটোপে আবদ্ধ না হয়ে আমাদের জীবনের অঙ্গনেও এর সত্যতা প্রমাণ করতে হবে।

***

আবারও মনে হচ্ছে, বিষয়টি এখন আমাদের কাছে এতই অপরিচিত এবং আজনবী যে, গুছিয়ে সবক’টি দিক বেষ্টন করে ভারসাম্যপূর্ণভাবে এবং কোরআন ও সুন্নাহ সমর্থন করে, এমন আন্দাযে তুলে ধরা আসলেই অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। তবু আজ বিক্ষিপ্ত চিন্তা নিয়েই আল্লাহ যতটুকু দিয়েছেন বলার চেষ্টা করেছি। দুঃখের সঙ্গেই বলতে হয়, দূর অতীতের কিছু গৌরব ছাড়া, এ বিষয়ে গর্ব করার মত কোন কথা আমাদের সঞ্চয়ে নেই। আমরা শুধু বলতে পারি, ইসলাম নারীকে কী কী অধিকার ও মর্যাদা দিয়েছে, আর বলতে পারি, আমাদের অতীতের ইতিহাসে মুসলিমসমাজে নারীর কত গৌরবপূর্ণ ভূমিকা ছিলো। তারপর হঠাৎ করেই যেন সবকিছু আঁধারে হারিয়ে গিয়েছে।

তো তোমরা যারা মাদরাসাতুল মাদীনাহ ও মাদানী নেছাবের পরিপক্বতা অর্জনকারী সচেতন ও দায়িত্বশীল তালিবে ইলম, তাদেরই আজ এগিয়ে আসতে হবে নারী-অধিকার ও নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে সত্যিকারের কল্যাণপূর্ণ বিপ্লব সৃষ্টি করার জন্য।

 

***

এখানে অবধারিতভাবেই নারী শিক্ষা ও নারী অধিকারের বিষয়টি এসে যায়।

‘তাহদীছে নেয়ামত’রূপে বলা যায়, সম্ভবত এ আলোচনা এভাবে কারো মুখের বা কলমের বক্তব্যে আসেনি, ওয়াল্লাহু আলাম। ‘ওয়া যালিকা ফাযলুল্লাহি ইয়ুতীহি মান ইয়াশাউ।’

নারী শিক্ষা সম্পর্কে কোরআন ও সুন্ন্াহ কী বলে? উভয়ের মধ্যে পার্থক্য করার কোন সুযোগ আছে? দায়িত্বগত অবস্থানের দিক থেকে তো পার্থক্য অবশ্যই থাকবে, কিন্তু শিক্ষার মূল অধিকারের ক্ষেত্রে? আমাদের ভালো ভালো মাওলানা বলেন, আমার মা, আমার বোন, আমার মেয়ে মাদরাসায় পড়েনি, স্কুল কলেজেও যায়নি। তাদের পুরো শিক্ষা ছিলো ঘরের পরিবেশে। কিন্তু তার শিক্ষা ও চিন্তা চেতনা এত উচস্তরের যে, কলেজ ভার্সিটির আধুনিকা মেয়েরা তার ধারে কাছেও আসতে পারে না।

আচ্ছা, কিন্তু প্রশ্ন হলো, আপনার নিজের শিক্ষা ঘরের মধ্যে হলো না কেন? আপনার জন্য এত বড় বড় প্রতিষ্ঠান কেন? আমাদের নারীদের জন্য সমগুরুত্বের কোন শিক্ষাব্যবস্থা নেই কেন? বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা?

‘মহিলা মাদরাসা’ নামে যা কিছু হচ্ছে তা যদি জরুরি হয়ে থাকে তাহলে এত বছর হলো না কেন? যুগ যুগ ধরে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের নারী সমাজ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকলো কেন? এর দায় তো কাউকে না কাউকে বহন করতেই হবে।

নারীশিক্ষার প্রসঙ্গ এলেই আমরা অতীতমুখী হয়ে পড়ি। অতীতের বিভিন্ন মহীয়সী নারীর উদাহরণ উল্লেখ করি, যদিও তা বিচ্ছিন্ন পর্যায়ের। তারপরো সেটা হলো অতীতের উদাহরণ। তারপরের সময়ের হিসাব কী? অন্ধ্যকার ছাড়া আর কিছু আছে? আল্লামা তাক্বী উছমানী মু.কে আমি শ্রদ্ধা করি। তিনি, শিক্ষার অঙ্গনে আমাদের নারীরা একসময় কত উচ্চস্তরে ছিলেন তার কিছু উদাহরণ পেশ করেছেন। বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করা যায়, এ ধারা বন্ধ হলো কেন? কবে থেকে বন্ধ হলো? এর দায় কার? সর্বোপরি এ ধারা আবার যেন শুরু হয় সে জন্য আসলে আমরা পাক-ভারত উপমহাদেশ ও আরব-বিশ্বের ওলামায়ে কেরাম কত যত্নবান ও দায়িত্বশীল?

তোমরা যারা মাদরাসাতুল মাদীনায় শিক্ষা ও দীক্ষা অর্জন করছো, জাতির এত দীর্ঘ যুগের এই অপুরণীয় ক্ষতি পূরণের জন্য তোমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। জানি, একদিনে কিছু হবে না, হয়ত একযুগেও হবে না, তবে শুরু তো করতে পারি! শুরু তো করতে হবে! আমার আন্তরিক আকাক্সক্ষা নারীশিক্ষার অঙ্গনে মহান বিপ্লবের উব্দোধন তোমাদের মাধ্যমেই যেন হয়। আল্লাহ কবুল করুন, আমীন।

কথাগুলো গুছিয়ে বলতে পারলাম না আমার বর্তমান দীনতার কারণে। তবে প্রাণের আকুতি এবং হৃদয়ের দহনযন্ত্রণা আশা করি তোমাদের সামনে তুলে ধরতে পেরেছি।

বড় বড় স্বপ্ন ও পরিকল্পনার বিলাসিতা ত্যাগ করো। তুমি তোমার বৃত্তের মধ্যে যতটুকু সম্ভব ততটুকু শুরু করো। তোমার ছোটবোন আছে, বড় বোন আছে, তাদের শিক্ষার পথ যতটা পারো মসৃণ করার চেষ্টা করো। এ জন্য যত ত্যাগ ও আত্মত্যাগের প্রয়োজন হাসিমুখে তা করো।  তোমাদের পৃথক পৃথক চেষ্টা মেহনত ও সাধনা দ্বারাই দেখবে একসময় সমাজের মনমানসিকতায়, চিন্তা-চেতানয় এবং নীতি ও আচরণে বিরাট পরিবর্তন এসেছে।  ইনশাআল্লাহ আমাদের সমাজে নারীশিক্ষার সোনালী ভবিষ্যত খুব দূরে নয়।

***

এরপর কথা হলো নারীদের হক বা অধিকার! দেখো, বে-দ্বীন সমাজের কথা তো বলাই বাহুল্য। আমাদের দ্বীনদার সমাজে, এমনকি ইলমী সমাজে পদে পদে নারীর হকূক ও অধিকার লুণ্ঠিত হচ্ছে; বৈষয়িক অধিকার, মানবিক অধিকার, মর্যাদার অধিকার, সর্বপ্রকার অধিকার থেকে আমাদের প্রতিটি পুরুষ-পরিচয় নির্মমভাবে প্রতিটি নারীসত্তার অধিকার নষ্ট করছি। তোমাকে তোমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এবং তোমার শিক্ষাজীবন থেকে এ প্রতিজ্ঞা নিয়ে জীবনের অঙ্গনে প্রবেশ করতে হবে যে, তোমার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিটি নারী-অধিকার তুমি সমুন্নত রাখবে। যদি তুমি তা করো তাহলেই তুমি সৃষ্টির কাছে এবং ¯রষ্টার কাছে দায়মুক্ত হতে পারবে।

তাওফীক তো একমাত্র আল্লাহর হাতে। ওয়া মা আলাই না ইল্লাল বালাগ।

আজ না হয় এ পর্যন্তই থাক। যদি সময় ও সুযোগ হয় তাহলে সামনে মাদানী নেছাবের বিষয়ে কিছু কথা বলার ইচ্ছে অবশ্যই আছে।