দুর্ঘটনাজনিত ব্যাপক প্রাণহানির দেশরূপে ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশের নাম উঠে এসেছে। তার মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার এখন সর্বোচ্চ। প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটছে এবং একদু’টি, তিনচারটি তাজাপ্রাণ অকালে ঝরে পড়ছে। সড়কদুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল দিন দিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। একটি জাতীয় দৈনিকের হিসাবমতে গত পাঁচমাসে সড়কদুর্ঘটনায় একহাজার নয়শ পচানব্বইটি মৃত্যু ঘটেছে। জরীপে প্রকাশ, বিশ্বে সড়কদুর্ঘটনা ও প্রাণহানিতে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম এবং এশিয়ায় সপ্তম। বুয়েটের দুর্ঘটনাগবেষণা-কেন্দ্রের প্রস্তুতকৃত পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর গড়ে ১২ হাজার মানুষ নিহত হচ্ছে এবং ৩৫ হাজার মানুষ গুরুতর আহত হচ্ছে, যার মধ্যে অঙ্গহানি ও পঙ্গত্বের সংখ্যাও কম নয়। দুঃখজনক বিষয় হলো, এ বিষয়ে দায়িত্বশীল মহল এ পর্যন্ত অমার্জনীয় উদাসীনতা ও নির্লিপ্ততা প্রদর্শন করে এসেছেন। বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট বিভাগের শীর্ষমহলের গা-ছাড়া ভাব দেখে মনে হয় যেন বলতে চান, ‘পথ থাকলে গাড়ী ও পথচারী থাকবে এবং দুর্ঘটনা ঘটবে।’সড়কদুর্ঘটনার কারণরূপে যেসব বিষয় চিহ্নিত হয়েছে তার মধ্যে প্রধান হলো, সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ীর চলাচল, চালকদের অদক্ষতা, বেপরোয়া গাড়ীচালনা- যাদের অনেকের আবার লাইসেন্স নেই। বুয়েটের পরিসংখ্যানমতে সড়ক দুর্ঘটনার নব্বই শতাংশ কারণ হচ্ছে চালকের অদক্ষতা স্বেচ্ছাচার ও বেপরোয়া মনোভাব। এক্ষেত্রে অনেকে গ্রেফতারকৃত চালকের ইচ্ছাকৃতভাবে দুই ছাত্রকে চাপা দেয়ার চাঞ্চল্যকর স্বীকারোক্তির বিষয়টি সামনে আনতে চান। উল্লেখিত কারণ-গুলো ছাড়াও অভিজ্ঞ মহলের মতে, সংশ্লিষ্ট বিভাগের পক্ষ হতে অলিখিত প্রশ্রয়ও এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট দায়ী। দুর্বল স্মৃতির বদনাম আমাদের আছে, তারপরো মনে থাকার কথা, পরিবহনবিভাগের অভিভাবক ব্যক্তিটি বলেছিলেন, গরু-ছাগল চিনতে পারলেই গাড়ী চালানোর লাইসেন্স পেতে পারে! বিশ্বাস করা যায়!!গত ২৯ জুলাই রোববার বেপরোয়া গাড়ী-চালকের গাড়ীর নীচে চাপা পড়ে প্রাণহারায় কলেজছাত্রী দিয়া এবং তার সহপাঠী করিম। সেখান থেকেই কোন পূর্বপ্রস্তুতি ও সুসংগঠিত নেতৃত্ব ছাড়া সম্পূর্ণ আকস্মিকভাবে সূত্রপাত ঘটে স্কুল-কলেজের অল্পবয়সী শিক্ষার্থীদের অভূতপূর্ব আন্দোলন। সবকিছুতেই যারা বলে, ‘মুরোদ’ নেই তারা বিচলিত হয়ে দেখতে পেলো অবিশ্বাস্য গতিতে আন্দোলন সরা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। মফস্বলের শিক্ষার্থীরাও শিক্ষাঙ্গন ছেড়ে রাস্তায় নেমে এসেছে। শিক্ষার্থীদের দাবীর মুখে‘প্রতাপশালী’ ব্যক্তিদেরও ‘কাগজপত্রহীন’ গাড়ী থেকে নেমে পায়ে হেঁটে যেতে হয়েছে। আমরা বলি না, এগুলো ঠিক হয়েছে, কিন্তু এটাকে দেয়ালের লিখনরূপেই গ্রহণ করতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, পঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রশমনের উপায় না করা হলে তার বহির্প্রকাশ কত রকম হতে পারে! সুতরাং এখনো সময় আছে সাবধান হওয়ার।বলাবাহুল্য, এ আন্দোলন কোনভাবেই সরকারের বিরুদ্ধে ছিলো না, ছিলো শুধু নিরাপদ সড়কের দাবীতে, যাতে বেপরোয়া চালকের গাড়ীর চাকার নীচে চাপা পড়ে আর কোন মায়ের বুক খালি না হয়।নিরাপদ সড়ক এবং জীবনের নিরাপত্তা প্রত্যেক নাগরিকের জন্মগত মৌলিক অধিকার। তাই প্রতিবাদ বিক্ষোভে রাজপথে নেমে আসা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন জনগণের পক্ষ হতে অভাবিতপূর্ব সমর্থন ও সহানুভূতি লাভ করে। দলমত নির্বিশেষে সকল পেশা ও শ্রেণীর মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগ সত্ত্বেও আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে।স্কুল-কলেজের কাঁচা বয়সের শিক্ষার্থীরা প্রায় দশদিন ধরে চলা রাজপথের আন্দোলন, বলা যায় বাংলাদেশের আন্দোলনের ইতিহাসেই এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে, যাতে রয়েছে দেশের অভিভাবক শ্রেণীর সবার জন্য অনেক বড় শিক্ষা। সুশীল সমাজের মতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন না হলে জানাই হতো না, কত গাড়ী সড়কে চলে ফিটনেস ও লাইসেন্স ছাড়া। জানা হতো না, উঠতে বসতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যারা উপদেশ বিতরণ করেন তাদেরই গাড়ীর বৈধ কাজগপত্র নেই এবং চালকের ছাড়পত্র বা লাইসেন্স নেই। তারা দেখিয়ে দিয়েছে, কীভাবে সড়ক নিরাপদ করতে হয়; কীভাবে বেপরোয়া চালকদের নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়। জাতিকে, জাতির অভিভাবক শ্রেণীকে আসলেই কোমলমতি শিক্ষার্থীরা লজ্জায় ফেলে দিয়েছে।আন্দোলনের শুরুতেই বিচলিত সরকারের ‘উচ্চ’ পর্যায় থেকে শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবী মেনে নেয়ার ঘোষণা ও আশ্বাস দেয়া হয়েছে। এতে আন্দোলনের যৌক্তিকতা অবশ্যই প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ শিক্ষার্থীরা আশ্বাসের প্রতি আস্থা রাখতে পারেনি। এটা জাতির ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। আমাদের আজ ভেবে দেখতে হবে এরূপ আস্থাহীনতার কারণ কী?সুশীলসমাজ দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘কোমলমতি শিক্ষার্থী-দের আন্দোলন অনমনীয় ছিলো, তবে শান্তিপূর্ণ ছিলো। কিন্তু যে নিষ্ঠুর সহিংসতার মাধ্যমে তা দমন করা হয়েছে, তাতে জনবিচ্ছিন্নতা ও দেউলিয়াত্বই শুধু প্রকাশ পেয়েছে। রাজপথের ছবিগুলো, যারা জনপ্রিয়তা দাবী করে তাদের জন্য কিছুতেই গৌরবের ছিলো না।অভিজ্ঞমহলের মতে এ আন্দোলন ছিলো সম্পূর্ণরূপে স্বতঃস্ফূর্ত এবং অন্তর্প্রেরণা থেকে উৎসারিত। এর পশ্চাতে ছিলো নির্মম মৃত্যুর শিকার সহপাঠীদের প্রতি ভালোবাসা ও সহমর্মিতার আকুতি। তাই কারো উপর ‘উস্কানি’র দায় আরোপ করা সুবিবেচনার পরিচায়ক মনে হয় না। তাছাড়া একটা শিশুও বোঝে, সবাই এখন এমন ‘মারমুখিতা’র শিকার যে, চক্রান্তকারীর ভূমিকায় মাঠে নামার অবস্থা নেই কারো।‘ছাত্ররা তো কোন আন্দোলনই করতে পারেনি। আন্দোলন করতে হলে রোদে পুড়তে হয়, বৃষ্টিতে ভিজতে হয়’ এধরনের হালকা মন্তব্য অভিভাবকের অবস্থান থেকে দুঃখজনক। ষড়যন্ত্রতত্ত্বের পিছনে না গিয়ে আমাদের এখন শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে, যাতেএরূপ দুঃখজনক পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি না ঘটে।পরিশেষে আমাদের আন্তরিক কামনা, সড়ক চলাচলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে সচেতনতা ও দায়বোধ যেন জগ্রত হয়; সড়ক -দুর্ঘটনার মত মর্মান্তিক মৃত্যুর হাত থেকে নিরীহ যাত্রী ও পথচারী যেন মুক্তি পায়। এ মৃত্যুর মিছিল এখনই যেন থেমে যায়। প্রত্যেকেরই মনে রাখা কর্তব্য, দুর্ঘটনার একটি মৃত্যু পরিবারের সবার সারা জীবনের অশ্রু, সারা জীবনের কষ্ট ও কান্না। এ অবস্থায় ‘হাসিমুখ’ যত খুবসুরত হোক ‘আবেদনপূর্ণ’ হতে পারে না।পুনশ্চ ঃ নিরাপদ সড়কের দাবীতে উঠে আসা আন্দোলনের রেশ না কাটতেই খোদ মন্ত্রীর গাড়ী ধাক্কা দিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে বাস- চালক। প্রশাসন অবশ্য কালমাত্র বিলম্ব না করে ‘সক্রিয়’ হয়েছে। বাসচালকের গ্রেফতারি ও বাসটির ডাম্পিং-এ। মন্ত্রী বলে কথা!অভিজ্ঞ মহল বলছেন, যারা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমিয়ে ফেলেছেন বলে উল্লসিত তাদের জন্য খোদ মন্ত্রীর গাড়ী ধাক্কা খাওয়ার ঘটনায় যথেষ্ট শিক্ষার খোরাক রয়েছে।আমাদের মনে রাখতে হবে, ছোট্ট একটি স্ফুলিঙ্গ থেকেও জ্বলে উঠতে পারে ভয়াবহ দাবানল।আন্দোলন থেমেছে, সড়কে মৃত্যুর মিছিল কিন্তু থামেনি। প্রতিদিন গাড়ীর নীচে চাপা পড়ছে অসহায় মানুষ! বিষয়টা অবশ্যই আমলে নেয়া দরকার।