আরাকানের মত আসামের ক্ষেত্রেও একই পথ ধরেছে মুসলমানদের বিষয়ে ঘুমিয়ে থাকা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। খুব কমই গুরুত্ব পাচ্ছে তাদের কাছে আসামের হতভাগ্য মসুলিম জনগোষ্ঠীর খবরাখবর। তাই জানার কোন উপায় নেই সেখানকার বর্তমান অবস্থা, কী কঠিন ও দুর্বিষহ জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়া সেখানকার হতদরিদ্র মুসলিমরা।
প্রথম কথা হলো, ৭১ সালের ২৪শে মার্চকে পার্থক্যরেখা ধরে আসামের মুসলিম নাগরিকদের বৈধ ও অবৈধ দুই শ্রেণীতে ভাগ করার বিষয়টাই আগাগোড়া অযৌক্তিক ও বিদ্বেষপ্রসূত, তার উপর বৈধতা প্রমাণের দায়িত্ব চাপানো হয়েছে নিরীহ মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর, যারা জানেই না কাগজপত্র কী, অফিস-দফতরই বা কোথায়?
ঘটনা এখানেই শেষ নয়; রাতের অন্ধকারে পুলিশ এসে হানা দিচ্ছে ঘরে ঘরে। ধরে নিয়ে যাচ্ছে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে। যদি জানতে চাওয়া হয়, কী তাদের অপরাধ? কেন তাদের সঙ্গে এরূপ আচরণ? একটাই উত্তর আসে উগ্রমূর্তি ধারণকারী পুলিশের কাছ থেকে, চুপ, একদম চুপ!
অসংখ্য ঘটনার মধ্যে খবরে আসে শুধু একটি দু’টি, তাও অনেক রাখঢাকের পর। এমনি একটি খবর হলেন কোকড়াঝাড় কারাগারের কয়েদি মর্জিনা। মাঝরাতে তাকে ঘর থেকে ধরে এনেছে পুলিশ। আসাম সরকারের বড় দয়া যে, মহিলা পুলিশ পাঠানো হয়েছিলো তাকে ধরে আনতে। পরে জানা গেলো, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি সন্দেহপূর্ণ ভোটার, পুলিশের খাতায় যাদের পরিচয় হলো ‘ডি ভোটার’।
একপর্যায়ে পুলিশের বোধদয় ঘটে যে, মর্জিনা সম্পর্কে তারা ভুল তথ্যের শিকার হয়েছে। মর্জিনা বিবি বড় ভাগ্যবতী যে, তার মামলাটি হাতে নিয়েছিলো আইনি সহায়তা দানকারী একটি মানবতাবাদী সংস্থা। ফলে দীর্ঘ নয় মাস পর তিনি জামিনে বের হয়ে আসতে পেরেছেন। তার ভাষায়, কারাগারের দিনগুলো, বিশেষ করে রাতগুলো ছিলো এককথায় বিভীষিকাপূর্ণ।
আসামের রাজধানী গৌহাটির নিকটবর্তী একটি গ্রামের বাসিন্দা আইয়ূব আলী ও তার স্ত্রী। নাগরিকত্ববিষয়ক বিশেষায়িত আদালতের পক্ষ হতে তাদের নির্দেশ দেয়া হলো নাগরিকত্বের বৈধতা প্রমাণের। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর ২০১৫ সালে তারা হেরে যান এবং তাদের পুলিশি হেফাযতে নেয়া হয়। সব হারিয়ে এখন তারা হাইকোর্টে মামলা চালানোর জন্য শেষ সম্বল ভিটেমাটিও বিক্রি করে দিয়েছেন। কিন্তু কোন নিশ্চয়তা নেই যে, হাইকোর্টের রায় তাদের পক্ষে যাবে।
পরিস্থিতি এখন এতই গুরুতর আকার ধারণ করেছে যে, কাগজ -পত্রে যারা বৈধ নাগরিক তারাও হয়রানি থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ৩০ বছর ধরে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে চাকুরিরত আজমলকেও বলা হয়, তোমার নাগরিকত্ব প্রমাণ করো।হয়ত শিক্ষিত ও সচেতন নাগরিক বলে তার পক্ষে নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু সবার পক্ষে তা সহজ হচ্ছে না। সরকারী স্কুলের শিক্ষক শাহজাহানের, সময় খরচ হয়েছে বিশ বছর।
আসামের বর্তমান জনসংখ্যা তিন কোটি বিশ লাখ। এর মধ্যে একতৃতীয়াংশই মুসলিম, যাদের বেশীর ভাগ আবার বাঙ্গালী বংশোদ্ভূত।
আসামে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর
আসামের হতভাগ্য...
৫৮-এর পর
বসতি শুরু হয় মূলত ওখানকার বিপুল পতিত ভূমি আবাদ করার প্রয়োজনে। বৃটিশ সরকারের ‘খাদ্য উৎপাদন বাড়াও’ নীতি বাস্তবায়নের জন্যই আসামে লাখ লাখ বাঙ্গালী চাষীকে নেয়া হয়।
১৯৪৭ সালের বিভক্তির পরই বিষয়টি রাজনৈতিক চরিত্র গ্রহণ করে। তখন থেকেই প্রচারণা শুরু হয় যে, আসামে বাঙ্গালীরা হলো বহিরাগত ভূমিদস্যু।
১৯৭০ সালে শ্লোগান ছিলো ‘বহিরাগতদের সরাও’। তাতে অন্তর্ভুক্ত ছিলো অন্যান্য প্রদেশের ভারতীয়রাও। পরে দৃষ্টিভঙ্গির
পরির্বতন হলো এবং শ্লোগান উঠলো, ‘বিদেশী খেদাও’। তখন নেপালী ও বাংলাদেশীরা ছিলো টার্গেট। সর্বশেষ পরিস্থিতি হলো, চরম সাম্প্রদায়িকতাবাদী বিজেপি ক্ষমতায় এসে শ্লোগান তুলেছে বাঙ্গালী মুসলমানদের তাড়াও। অর্থাৎ ‘বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী’ বাঙ্গালী হিন্দুদেরও আলাদা করে শুধু বাঙ্গালী মুসলমানদের টার্গেট করা হয়েছে।
বিজেপির আসল ভয় হলো, মুসলিম জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে তাতে একসময় তারা হিন্দুদের ছাড়িয়ে যাবে। এ অবস্থার জন্য আসলে দায়ী হচ্ছে হিন্দু দম্পতিদের সন্তানগ্রহণে অনীহা, ঠিক যেমনটি দেখা গিয়েছে আরাকানে মগসম্প্রদায় ও মুসলিম সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে। এর যৌক্তিক সমাধান তো ছিলো হিন্দুদম্পতিদের অধিক সন্তান-গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা। আর অযৌক্তিক সমাধান ছিলো মুসলিম জনগোষ্ঠীকে জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচীর অধীনে নিয়ে আসা। কিন্তু যৌক্তিক অযৌক্তিক কোন পথেই না গিয়ে বিজেপি সরকার গ্রহণ করেছে সম্পূর্ণ নির্যাতনমূলক পন্থা, যার ফলে বাস্তব আশঙ্কা দেখা দিয়েছে অন্তত পঞ্চাশ লাখ মানুষের তাদের জন্মজন্মের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার। এখনো যদি মুসলিম উম্মাহ ঘুমিয়ে থাকে তাহলে ...