ইউরোপজুড়ে কয়েক বছর ধরে প্রধানত মধ্যপ্রাচ্য থেকে ছুটে আসা অভিবাসীদের ঢল নেমেছে। ইউরোপীয় নেতৃবর্গ এখন বলতে গেলে অভিবাসী ও শরণার্থীসঙ্কটে দিশেহরা। ইউরোপীয় দেশগুলোর জনগণের মধ্যেও শরণার্থীবিরোধী মনোভাব উগ্ররূপ ধারণ করেছে। পর্যবেক্ষকদের মতে জার্মানীতে মার্কেল সরকার অভিবাসীবিষয়ে উদার নীতি গ্রহণ করেছে বলেই তার জনপ্রিয়তা তলানিতে এসে পৌঁছেছে। ওদিকে ইতালীর সাম্প্রতিক নির্বাচনে তথাকথিত ফাইভ স্টার আন্দোলন ও চরম ডানপন্থী লীগ পার্টির গঠিত জোট অভিবাসী -বিষয়ে কঠোর নীতি অনুসরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েই নির্বাচনে জয়লাভ করে এখন সরকার পরিচালনা করছে।
জোটসরকার নির্বাচনের সময় দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এখন ইতালির সীমান্তে শরণার্থীঢল বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর। ইতালি এখন অভিবাসীবোঝাই কোন জাহায বন্দরে ভিড়তেই দিচ্ছে না। এমনকি জাহাযে বিদ্যমান সাতজন গর্ভবতী নারীকেও মানবিক দিক বিবেচনা করে কোন ছাড় দেয়া হয়নি। পুরো জাহায আবার ঠেলে দেয়া হয়েছে সাগরের দিকে, সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার মধ্যে। এই পদক্ষেপে যদিও নির্মমতা রয়েছে এবং রয়েছে চরম অমানিবকতা, যা অবশ্যই কঠোর নিন্দাযোগ্য, কিন্তু আপনাকে বুঝতে হবে যে, এটাই হচ্ছে ইতালির জনমতের বাস্তবতা।
অভিবাসন ও শরণার্থীবিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মত হলো, এভাবে যত কঠোর পদক্ষেপই গ্রহণ করা হোক না কেন, অভিবাসীঢল ও শরণার্থীপ্রবাহ রোধ করা যাবে না। কারণ যারা এখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিভিন্ন রুট ধরে ইউরোপের পথে ধাবিত, তারা শাব্দিক অর্থেই বুঝে শুনেই এ ‘মরণখেলায়’ নেমেছে। সাগরেই বহু মানুষের মৃত্যু ঘটছে; তারপরো তারা পিছিয়ে যেতে রাজী নয়। কারণ মৃত্যু থেকে বাঁচার জন্য তারা আজ মৃত্যুর ঝুঁকি গ্রহণ করছে।
সবাই আজ দেখতে পাচ্ছে, অভিবাসীসঙ্কট সমাধানে এ পর্যন্ত যত উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সবই চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আসলে ব্যর্থতাই ছিলো এর স্বাভাবিক পরিণতি। কারণ ইউরোপের নেতৃবর্গ জেনে শুনেই সমস্যার মূল কারণটি এড়িয়ে চলেছেন এবং নিজ নিজ দেশের জনগণকেও এ বিষয়ে অন্ধকারে রেখেছেন। বলাবাহুল্য, এড়িয়ে চলার এ ভ্রান্ত নীতি অব্যাহত থাকলে সমস্যার কোন সমাধান হবে না। অভিবাসী ঢল ও শরণার্থীস্রােত প্রবল থেকে প্রবল -তর হতেই থাকবে। ইউরোপের জাতিবর্গ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হতেই থাকবে, যতই তারা শরণার্থী-বিষয়ে অসহিষ্ণু হোক না কেন। সবচে’ বেদনাদায়ক বিষয় হলো, সাগরের উত্তাল ঢেউ অসংখ্য মানুষের জীবন কেড়ে নিতে থাকবে, এমনকি যারা ইউরোপের ভূমিতে উঠে আসতে সক্ষম হবে তাদেরও জীবন হতে থাকবে দুর্বিষহ এবং চরম সহিংসতার শিকার।
আমাদের সামনে লাল হরফে জ্বল জ্বল করছে যে প্রশ্নটি তা হলো, মধ্যপ্রাচ্যের একসময়ের সমৃদ্ধ দেশগুলো থেকে কেন মানুষ দলে দলে ছুটে যাচ্ছে ইউরোপের দিকে? কেন তারা ধাবিত হচ্ছে সাগরের বুকে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে এক অনিশ্চিত জীবনের সন্ধানে?
এককথায় এ প্রশ্নের উত্তর হলো যুদ্ধ, যুদ্ধ এবং ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধ। আর চরম তিক্ত সত্য হলো, এই যুদ্ধবিগ্রহের পিছনে ইউরোপ-আমেরিকাই দায়ী এবং একথা বোঝার জন্য বড় কোন বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই যে, পশ্চিমাবিশ্বের অস্ত্রব্যবসাকে চাঙ্গা করার জন্যই মধ্যপ্রাচ্যকে আজ বেছে নেয়া হয়েছে যুদ্ধের ক্ষেত্র হিসাবে। ইরাক ও আফগানিস্তানের কথা থাক। লিবিয়ায় গাদ্দাফী ছিলেন। মেনে নিলাম, তিনি একনায়ক ছিলেন, তার দেশে গণতন্ত্র ছিলো না। কিন্তু সমস্যা কী ছিলো? দেশের মানুষ সুখী হয়ত ছিলো না, তবে সচ্ছল ছিলো, অন্তত সাগর পাড়ি দিয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপে আশ্রয় তালাশ করার মত অবস্থায় ছিলো না। সেখানে কেন এত ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ বাঁধানো হলো? গণতন্ত্রের জন্য? কে তাদের উপর দায় চাপিয়েছিলো অন্য দেশের মাটিতে গণতন্ত্র রপ্তানী করার?
সিরিয়া ছিলো মধ্যপ্রাচ্যের সবচে’ সমৃদ্ধ দেশগুলোর একটি। সিরিয়ার জনগণ ছিলো একান্ত নিরীহ ও রাজনীতিবিমুখ। সেখানে ২০১৭ সালে গণআন্দোলন শুরু হয় মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় তাবেদার গোষ্ঠীর চক্রান্তে। একসময় রাশিয়াসহ বিভিন্ন পক্ষ তাতে জড়িয়ে পড়ে নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষার তাগিদে। একসময়ের সুসমৃদ্ধ সিরিয়া আজ শাব্দিক অর্থেই মৃত্যুপুরী এবং এক ধ্বংসস্তূপ। সিরিয়ার লক্ষ লক্ষ মানুষ আজ নিজেদের ঘরবাড়ী ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। এর দায় পশ্চিমা বিশ্বকে অবশ্যই নিতে হবে। অভিবাসীঢল তারা যদি সত্যি সত্যি বন্ধ করতে চায় তাহলে অস্ত্রব্যবসার মুনাফালোভ তাদের ত্যাগ করতেই হবে এবং যে কোন মূল্যে অবিলম্বে যুদ্ধের আগুন নেভাতেই হবে।