শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

শাবান ১৪৩৯ হিঃ (৩/৪) | তোমাদের পাতা

জী ব নে র পা থে য় -২

আমার স্মৃতি; কিছু সুখের, কিছু দুঃখের!

লিখেছেনঃ শায়খুল ইসলাম আল্লামা মুফতি তক্বী উছমানী (দা.)

 

(২)

আমার আম্মাজান (মুহতারামা নাফীসা খাতুন ছাহেবা), আল্লাহ তা‘আলা চিরকাল তাঁর উপর করুণা ও রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ করুন। সবদিক থেকে তিনি ছিলেন একজন আদর্শ মা ও গুণবতী গৃহিণী। বংশপরিচয়ে তিনি দেওবন্দের একটি মশহূর আনছারী পরিবারের মেয়ে। দাম্পত্য জীবনের শুরু থেকে শেষপর্যন্ত সর্বপ্রকার অনুকূল ও প্রতিকূল অবস্থায় যেভাবে তিনি স্বামীর ‘সঙ্গসৌজন্য’ রক্ষা করেছেন এবং স্বামীর জন্য যেমন শীতল সান্ত¦না হয়ে ছিলেন তা এক আলাদা দাস্তান। তাঁর মৃত্যুর পর এবিষয়ে আমি বিশদ আলোচনা করেছি, যা আমার সঙ্কলনগ্রন্থ ‘নুকূশে রাফতেগাঁ’-এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

তাঁর যুহ্দ ও ইবাদত ছিলো প্রবাদতুল্য। তাঁর যিকির, তিলাওয়াত ও নাওয়াফিলের আমল ছিলো নিয়মিত, যা হুঁশ থাকা পর্যন্ত কখনো বাদ পড়েনি।

আমাদের জন্য তিনি ছিলেন সর্বসত্তায় একজন মমতাময়ী মা।

আমাদের আরাম-আহ্লাদ ও সুখ-শান্তির জন্য তাঁর দিন-রাতের প্রায় সবটুকু সময় ছিলো নিবেদিত। এজন্য নিজের আরাম-বিশ্রাম ও শান্তি-স্বস্তি সবসময় তিনি শুধু কোরবানিই করে গিয়েছেন।

এমনিতে তো তাঁর মাতৃমমতার আঁচল সব সন্তানেরই জন্য ছিলো সমান প্রসারিত; তবে সবার ছোট হওয়ার সুবাদে তাঁর আদর-সোহাগ ও মায়া-মমতা সম্ভবত আমিই সবচে’ বেশী পেয়েছি। এর একটা ফল এই ছিলো যে, যথেষ্ট বড় হওয়া পর্যন্ত তাঁর হাতেই খাবার খেয়েছি। তিনি মুখে লোকমা তুলে না দিলে আমার খাওয়াই হতো না। এছাড়া কোন আত্মীয়ের বাড়ী বেড়াতে গেলে আমাকে না নিয়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব ছিলো না।

ঐ যুগে দেওবন্দের মত কছবায় ‘যন্ত্রচালিত’ বাহনের কোন কল্পনাই ছিলো না। কখনো দেওবন্দের বাইরে যাদের যাওয়া হয়নি, সম্ভবত তারা মোটরকার দেখেওনি। সবশুদ্ধ ছিলো টাঙ্গা নামের ঘোড়ার গাড়ী, যাতে বসে কছবার সীমানায় যাতায়াত করা যেতো। তাও সেটা ছিলো শুধু পুরুষের বাহন। কোন মুসলিম নারীর জন্য তো বোরকা পরেও টাঙ্গায় করে কোথাও যাওয়া দোষের মনে করা হতো। খুব বেশী দূরের পথ হলে এবং টাঙ্গা ছাড়া সফর করা মুশকিল হলে টাঙ্গাকে পর্দাঘেরাও করে তার মধ্যে বোরকানশীন খাতুন বসতেন। অল্প দূরত্বের ক্ষেত্রে ছিলো পাল্কীর ব্যবহার, দেওবন্দে যার পরিচিত নাম ছিলো ‘ডোলী’। দু’জন বেহারা কাঁধে করে পাল্কী বহন করতো। কোন নারীর জন্য পাল্কী ভাড়া করা হলে বেহারা প্রথমে পাল্কী বাড়ীর অন্দরে রেখে বাইরে চলে যেতো। সওয়ার ভিতরে বসার পর বেহারা এসে পাল্কী তুলে নিতো। কখনো কখনো ছোট বাচ্চার শওক হতো মা-খালা-বোন কারো না কারো সঙ্গে পাল্কীতে চড়ার আনন্দ ভোগ করার। তখন ছোট বাচ্চাকেও সঙ্গে নেয়া হতো।

আম্মাজান যখন নানীর বাড়ী যেতেন, আমাকেও সঙ্গে নিতেন। পর্দঘেরা পাল্কীর ভিতর থেকে বাইরের কিছুই অবশ্য দেখা যেতো না, তবে সেজন্য কিছুটা কষ্ট থাকলেও পাল্কীর দুলুনির আনন্দই যথেষ্ট ছিলো।

***

মা-বাবার আমরা নয় সন্তান ছিলাম। সবার বড় ছিলেন আমাদের বোন মুহতারামা নাঈমা ছাহেবা মারহূমা, যাকে আমরা আপাজান বলতাম। আমার জন্মের আগেই তাঁর শাদী হয়ে গিয়েছিলো। এমনকি দুই মেয়ে ও এক ছেলেও আমার আগেই জন্মগ্রহণ করেছিলো।

তিনি ছিলেন তো খুবই খোশমেযাজ ও হাসিখুশি মানুষ। আমার সব ভাইবোন তাঁর সঙ্গে খুব অন্তরঙ্গ ও বে-তকল্লুফ ছিলেন। কিন্তু ছোট কালেই তাঁর প্রতি আমার এমনই এক ভীতি-আচ্ছন্নতা সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিলো, যা আম্মাজানের ক্ষেত্রেও ছিলো না। এর (মনস্তাত্ত্বিক) কারণ সম্ভবত ছিলো নির্দোষ শৈশবের সামান্য একটি ঘটনা। তাঁর স্বামীগৃহ ছিলো আমাদের ঘর থেকে কিছু দূরে টিলা নামের মহল্লায়। সেটি ছোট্ট একটি টিলাই ছিলো, তবে আমাদের কাছে সেটা পাহাড়ের চেয়ে কম মনে হতো না। আপাজান ঐ টিলার বাড়ীতে তাঁর স্বামী হাকীম সৈয়দ শরীফ হোসায়ন ছাহেব মারহূমের সঙ্গে বাস করতেন। এই ভগ্নিপতি সাহেবের স্বভাব ও রুচিনাযুকতা ছিলো অতি উচ্চস্তরের। মনে হতো, অযোধ্যার কোন নবাব পথ ভুলে এসে পড়েছেন! ফলে তার ঘরে পরিচ্ছন্নতা ও পরিপাটিতার প্রতি যতœ ছিলো সীমার বাইরে। তাঁর বিছানায় কারো ছোঁয়া লাগবে, আর তাতে সামান্য ভাঁজ পড়বে, এটা ছিলো তাঁর বরদাশতের বাইরে।

আমি বড় কারো সঙ্গে সেখানে যেতাম, আর সমবয়সী ভাগিনা-ভাগিনীর সঙ্গে খেলায় মগ্ন হতাম। একবার খেলতে খেলতে আধোয়া পায়েই তাঁর বিছানায় উঠে গেলাম। আপাজান (সম্ভবত স্বামীর অসন্তুষ্টির ভয়ে) আমার দিকে কুঞ্চিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘ব্যস, পদধূলি দেয়ার চেষ্টা করো না।’

‘পদধূলি’ (কদমর‌্যঞ্জা) শব্দটি তখনই প্রথম শুনেছিলাম। কিন্তু ঐ শব্দের মধ্যে লুকায়িত তির্যকতা, এবং তার চেয়ে বেশী ঐ কুঞ্চিত দৃষ্টি এক স্থায়ী ভীতির রূপ ধরে আর মনমস্তিষ্ক আচ্ছন্ন করে ফেললো। কয়েক বছর পরই ঐ অবস্থার কিছুটা উপশম হয়েছে এবং বে-তকল্লুফি সৃষ্টি হয়েছে। ঐ সময় তো আমার এটাও জানা ছিলো না যে, এরকম ক্রোধের দৃষ্টিকে কুঞ্চিত দৃষ্টি বলে। পরে যখন আপাজান ভাইবোনদের ঘটনা শুনিয়েছিলেন তখন তাঁর মুখে ‘কুঞ্চিত দৃষ্টি’ শব্দটি প্রথমবার শুনেছিলাম।

আমাদের সবার বড় এই আপা মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সেই ইনতিকাল করেছিলেন। আমি তখন তের বছরের। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউসের বে-ইনতিহা নায-নেয়ামত দান করুন। কঠিন অসচ্ছলতা এবং পারিবারিক রুক্ষতার মধ্যেও তিনি যে আত্মমর্যাদা ও আভিজাত্যের সঙ্গে জীবন অতিক্রম করেছেন তার নযির পাওয়া মুশকিল। এখানে তাঁর জীবনের একটি ঘটনা কলমের মুখ থেকে বের হওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে।

এই মাত্র বলেছি, বিবাহের পর বেশীর ভাগ সময় তিনি কঠিন আর্থিক অসচ্ছলতা ও রূঢ় পারিপার্শ্বিকতার কারণে বিপর্যস্ত ছিলেন। এরকম অবস্থায় একবার তিনি আব্বাজানের খেদমতে আরয করলেন, ‘আমার জন্য দু‘আ করুন, আল্লাহ যেন হজ্বের সৌভাগ্য দান করেন।

আব্বাজান জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার কি হজ্বের খুব শাওক?’ তিনি ‘হাঁ’ বলে উত্তর দিলেন। আব্বাজান বললেন, নাহ্, তোমার শাওক নেই।’

আপাজান হয়রান হয়ে বললেন, ‘সত্য বলছি, হজ্বের আমার বড়ই আকাক্সক্ষা।’

আব্বাজান জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এত বড় কাজের জন্য তুমি কিছু রাহাখরচ জমা করছো?’ তিনি বললেন, না।

আব্বাজান বললেন, এর অর্থ হলো তোমার এ আকাক্সক্ষা নিছক মুখের জমাখরচ। সত্যি যদি তামান্না হতো তাহলে কিছু না কিছু তুমি সঞ্চয় করতে। আপাজান ওজর পেশ করে বললেন, সংসার থেকে কিছু বাঁচলে তো সঞ্চয় করবো!

আব্বাজান বললেন, তুমি কি এক দু’আনাও এ কাজের জন্য বাঁচাতে পারো না?!

তিনি বললেন, এতটুকু তো বাঁচাতে পারি। কিন্তু এর দ্বারা হজ্বের খরচ কীভাবে পুরা হবে?

আব্বাজান বললেন, বান্দা যখন কোন নেক কাজের জন্য তার সাধ্যমত চেষ্টা শুরু করে তখন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে সাহায্য হয়। তারপর যদি সেই নেক আমল পূর্ণ নাও হয়, ইনশাআল্লাহ তার আজর ও ছাওয়াব তো অবশ্যই পাওয়া যায়। কিন্তু চেষ্টাহীন, উদ্যোগহীন আকাক্সক্ষায় কোন কাজ হয় না।

কথাটা তখন ‘এলো, গেলো’ হয়ে গেলো। হয়ত কারোই আর মনে ছিলো না। এর বহু দিন পর ১৯৫৬ সালে যখন আপাজানের ইনতিকাল হলো এবং ওয়ারিছগণ তাঁর ‘তারাকা’র খোঁজ-হিসাব নিলো তখন দেখা গেলো, তাতে কাপড়ের ছোট্ট একটি থলিয়া রয়েছে, যার গায়ে লেখা, ‘হজ্বের রাহাখরচ’।

খুলে দেখা গেলো, সম্ভবত পঁয়ষট্টি টাকা!

আব্বাজান যখন ঐ থালিয়া দেখলেন, বে-ইখতিয়ার তাঁর চোখে পানি এসে গেলো। তখন তিনি সবাইকে ঐ ঘটনা আগাগোড়া শোনালেন।

পরে আব্বাজান ঐ অসামান্য মেহনতের ‘সামান্য’ সঞ্চয়ের সঙ্গে প্রয়োজনীয় অর্থ যোগ করে তাঁর হজ্বে বদল আদায়ের ব্যবস্থা করেছিলেন।

একবার হজ্বের সময় আরাফার ময়দানে কয়েক মুহূর্তের জন্য আব্বাজানের উপর আচ্ছন্নতা অবতীর্ণ হলো। তখন তিনি ঐ আচ্ছন্নতার অবস্থায় দেখতে পেলেন, আপাজান আরাফায় জাবালে রহমতে আরোহণ করছেন।

এভাবে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর এই বান্দীকে হজ্বের নেয়ামত দান করেছেন। আপন প্রসারিত রহমতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে আচ্ছাদিত করুন, আমীন।

তাঁর থেকে ছোট যে বোন তিনি হলেন, মুহতারামা আতীকা খাতুন, যিনি এখনো জীবদ্দশায় আছেন। মাশাআল্লাহ তিনি খুব ইবাদতগুজার এবং পরিচ্ছন্ন ও সুশৃঙ্খল জীবনের অধিকারিণী। তিনি হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ.-এর নিকট বাই‘আতের খোশকিসমতিও হাছিল করেছেন। আজ (২৩শে ফেব্রুয়ারী ২০১৭ খৃ./২৫ শে জুমাদাল ঊলা ১৪৩৭ হি.) তারিখে আমার জানার সীমানায় দুনিয়াতে তিনি ছাড়া আর কোন ব্যক্তি জীবিত নেই যার সৌভাগ্য হয়েছে সরাসরি হযরত হাকীমুল উম্মত রহ-এর নিকট বাই‘আত হওয়ার।

হযরত আব্বাজান রহ.-এর নিয়ম ছিলো, রামাযানুল মুবারাক তিনি সপরিবারে থানাভোনে হযরত থানবী রহ.-এর ছোহবতে যাপন করতেন। এ উপলক্ষে বহুবার স্বয়ং হযরত থানবী রহ. এর বাসস্থানের উপরের অংশে থাকা হয়েছে।

এই উপরের অংশটি এরকম ছিলো যে, হযরতের বসবাসের কামরার সামনে অঙ্গন ছিলো। ঐ অঙ্গনের শেষ মাথায় ছিলো উপরের অংশে ওঠার সিঁড়ি।

উপর-নীচ উভয় অংশের জন্য যেহেতু বাইতুলখালা ছিলো অভিন্ন সেহেতু হযরত রহ. একটি ব্যবস্থা করেছিলেন এভাবে যে, অঙ্গনের একটি নির্ধারিত স্থানে হ্যারিকেন রাখা হতো। সেটা ঐ স্থানে থাকার অর্থ হলো, নীচের বাইতুলখালা এখন পর্দাসহ উপরের জন্য ফারেগ রয়েছে। পক্ষান্তরে হ্যারিকেন সেখানে না থাকার অর্থ হতো বাইতুলখালা এখন ব্যস্ত।

আমার এ বোনের যবানিতেই শুনেছি, উপরের অংশে থাকা অবস্থায় আব্বাজান পরম আদব ও সতর্কতার সঙ্গে থাকতেন। আমরা যারা ছোট ছিলাম, আমাদের তাকিদ করতে থাকতেন, সামান্য শোর-আওয়াযও যেন না হয়। কোনভাবেই আমরা যেন হযরতের কষ্টের কারণ না হয়ে যাই।

আমি তখন ছোট্ট মেয়ে ছিলাম; পর্দার বয়সে ছিলাম না। একদিন আব্বাজান আমাকে বললেন, হযরতকে গিয়ে বলো, ‘আপনি আমাকে বাই‘আত করে নিন।’

শুরুতে আমি ভাবলাম, এটা হচ্ছে ছোট্ট মেয়ের সঙ্গে আব্বাজানের নির্দোষ কৌতুক! কিন্তু আব্বাজান যখন দ্বিতীয়-বার বললেন তখন জিজ্ঞাসা করলাম, ছোটরাও বাই‘আত হয় নাকি?!

আব্বাজান বললেন, জ্বি হাঁ, ছোটদেরও বাই‘আত হতে পারে।

তখন আমি পীরানী ছাহেবার কাছে গিয়ে বললাম, ‘আমি হযরতের কাছে বাই‘আত হতে চাই।’ তিনি হযরতকে জানালেন, এ বাচ্চী বাই‘আত হতে চায়।

হযরত আমাকে তলব করে বললেন, বাই‘আতকে আবার ‘পুতুলখেলা’ তো মনে করবে না?!

আমি নাবাচক উত্তর দিলাম। তখন হযরত একটি কাপড়ের একপ্রান্ত আমার হাতে দিলেন, আর দ্বিতীয় প্রান্ত নিজের পবিত্র হাতে রাখলেন এবং আমাকে বাই‘আত করে নিলেন।

০০০

আমার এই বোনের শাদিও আমার জন্মের আগেই হয়ে গিয়েছিলো, বরং তাঁর এক মেয়ে পয়দা হয়েছিলো আমার আগে, আর এক মেয়ে পয়দা হয়েছিলো প্রায় আমার সঙ্গে। তিনি তাঁর স্বামীসন্তানসহ আমাদের বাসস্থানের পশ্চিম দিকে সামনেই আলাদা ঘরে থাকতেন।

মুহতারামা না‘ঈমা খাতুন ছাহেবার দুই মেয়ে, এক ছেলে এবং মুহতারামা আতীকা ছাহেবার এক মেয়ে, বলতে গেলে তো আমি তাদের মামা ছিলাম, তবে আমার এই ভাগিনা-ভাগিনী বয়সে আমার বড় ছিলেন। তদ্রƒপ ফুফু আমাতুল হান্নান ছাহেবার মকতবে (যার আলোচনা সামনে আসবে ইনশাআল্লাহ) এ চারজনই ছিলেন আমার আগে। আমাদের মধ্যে বয়সের পার্থক্য যেহেতু বেশী ছিলো না সেহেতু এরা আমার ভাগ্নে ছিলো কম, বন্ধু ও খেলার সাথী ছিলো বেশী। আর আমার বন্ধুত্ব তাদের পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিলো। তাদের মধ্যেও ভাগ্নে ছিলো একজনই, পরবর্তী কালে যিনি মাওলানা হাকীম মুশাররাফ হোসায়ন ছাহেব (রহ.) বলে পরিচিত হয়েছেন। সুতরাং যা কিছু বন্ধত্ব, তার সঙ্গেই ছিলো। সব খেলায় তিনি ছিলেন চৌকশ, আর আমি ছিলাম নিছক তার খেলার ‘যোগানদার’।

যাই হোক, এই আপাদু’জনের সঙ্গে বয়সের এত বড় ব্যবধান

ছিলো যে, আমি তাদের সন্তানদের চেয়েও ছোট ছিলাম। এ কারণে তাদের সঙ্গে ভাই-বোনের সম্পর্ক ছিলো না, বরং ছিলো মুরুব্বী ও অভিভাবকতুল্য সমীহের সম্পর্ক।

***

তৃতীয় ছিলেন আমাদের সবার বড় ভাই জনাব মুহম্মদ যাকী কাইফী ছাহেব রহমাতুল্লাহি আলাইহি। আমরা তাঁকে ভাইজান বলে ডাকতাম।

তিনি দারুল উলূম দেওবন্দে মধ্যস্তরের শিক্ষা অর্জন করেছিলেন। কিন্তু পরে এমন কিছু পরিস্থিতির উদ্ভব হলো যে, তাঁর পক্ষে ‘লেখাপড়া’ অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়নি। তিনি আব্বাজানের প্রতিষ্ঠিত কুতুবখানা দারুল ইশা‘আত-এর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তবে তাঁর নিজস্ব অধ্যয়ন ও বিদ্যার্জন অব্যাহত ছিলো। বিশেষ করে ইতিহাস, সীরাত, তাছাওউফ এবং শীর্ষ ওলামায়ে দেওবন্দের জীবন, কর্ম, তাঁদের চিন্তাধারা ও রচানা-সম্ভার সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান-পরিধি এতই বিস্তৃত ছিলো যে, ভালো ভালো আলিমও তাঁর সমকক্ষতা দাবী করতে পারতেন না। আরো বড় বিষয় এই যে, তিনি হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ.-এর দস্ত মুবারকে বাইআত ছিলেন এবং সমস্ত বুযর্গানে দ্বীনের সুদৃষ্টি-ধন্য ছিলেন। হযরত মুফতী মুহম্মদ হাসান ছাহেব, হযরত মাওলানা মুহম্মদ ইদরীস কান্ধলবী, হযরত মাওলানা দাউদ গাযনবী, হযরত মাওলানা রাসূল খান ছাহেব রহ.-সবাই তাঁকে মুহব্বত করতেন। তাঁদের কেউ যখনই আনারকলী অঞ্চলে তাঁর কুতুবখানার কাছ দিয়ে যেতেন, অবশ্যই তাঁর কুতুবখানায় কিছু সময় অবস্থান করতেন, আর তিনি তাঁদের ফায়য ও ফায়যান দ্বারা ধন্য হতেন।

ভাইজান রহ-এর তিলাওয়াতে কোরআনের বিশেষ যাওক ও রুচিমনস্কতা ছিলো। রামাযানুল মুবারকে তো দশ থেকে পনের পারা পর্যন্ত তিলাওয়াত করতেন। উচ্চস্তরের কবি ছিলেন। তাঁর কাব্যসঙ্কলন ‘কাইফিয়্যাত’ অত্যন্ত পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছিলো, যার ভূমিকা আমার কলমেই লেখা হয়েছিলো।

তাঁর বিবাহ হয়েছিলো ১৯৪৬ সালে হযরত শায়খুল হিন্দ রহ.-এর শাগিরদ এবং দেওবন্দের ঈদগাহের খান্দানী খতীব হযরত মাওলানা মুহম্মদ মুবীন রহ-এর সুপুত্রীর সঙ্গে। আমার বয়স তখন মাত্র তিন। তাঁর বিবাহের ঘটনা আমার মনে আছে। এটাও মনে পড়ে যে, তাঁর বিবাহ উপলক্ষে আব্বাজান রহ. আমাদের বাড়ীর উত্তর-অংশে তাঁর জন্য দু’টি নতুন কামরা বানিয়েছিলেন। ঐ সময় তিনি আব্বাজান রাহ.-এর কুতুবখানার রীতিমত ব্যবস্থাপক ছিলেন।

বয়সে তিনিও আমার চেয়ে কম সে কম চৌদ্দবছর বড় ছিলেন। এ কারণে প্রায় বড় দুই বোনের মতই তাঁর প্রতিও আমার অন্তরে বেশ বড়সড় ‘ভীতি-সমীহ’ বিরাজ করতো।

সুন্দর হাতের লেখা তখন একটি উচ্চস্তরের শিল্পগুণ বলে ছিলো। এটাকে বলা হতো ‘খোশনবিসি’, আর এর শিল্পীকে বলা হতো খোশনবীস। তো ভাইজানের খোশনাবিসির বড় শওক ছিলো। আর এ শওক পুরা করার জন্য কখনো কখনো তিনি বড় কাগজে বা বোর্ডে খুব সুন্দর লিখনশৈলীতে কোন কবিতা, বা নীতিবাক্যা লিখতেন।

একবারের ঘটনা মনে পড়লে এখনো মন কেমন করে ওঠে! তিনি খোশনবিসির মশগলায় মগ্ন ছিলেন। হঠাৎ কোন প্রয়োজনে তাঁকে উঠতে হলো। তিনি উঠে চলে গেলেন। আমি সেখানে গিয়ে তাঁর খোশনবিসির অনুকরণচেষ্টায় মশগূল হলাম। হলাম তো হলাম, দোয়াতের কালি সবটুকু গড়িয়ে ছড়িয়ে পড়লো! ভাইজানের ভীতি তো মনে ছিলোই, যদিও সেটা ছিলো একতরফা। অর্থাৎ ভয় পাওয়ার মত কিছু তিনি আমার সঙ্গে কখনো করেননি। মারধর তো নয়ই। কিন্তু আজকের ‘শারারাত’ তো এমন ছিলো যে, ধরেই নিলাম, তাঁর প্রতি আমার তাত্ত্বিক ভয় আজ বাস্তব হবেই হবে। তবে ধারণা ছিলো না, সেটার প্রকাশ কতটা প্রচ- হতে পারে! কিন্তু ধারণা অর্জনের প্রয়োজন ছিলো, যাতে মানসিকভাবে নিজেকে সে জন্য প্রস্তুত রাখতে পারি। তাই কালি দোয়াত সেখানেই ফেলে ভাইবোনদের খোঁজে বের হলাম। যাকে পাই তাকেই জিজ্ঞাসা করি, ভাইজানের হাতের ওজন কেমন? থাপ্পড় কতটা জোরদার?!

আমার সদ্য ঘটিয়ে আসা ‘কীর্তি’ সম্পর্কে তো তাদের জানা ছিলো না, তাই সবাই হয়রান পেরেশান যে, এই নতুন গবেষণার প্রয়োজন হলো কেন?!

ঘটনা শুনে তো তারা হেসেই অস্থির! এমনকি ভাইজানও ঘটনা ও তার জের সম্পর্কে অবহিত হয়ে বেশ আহ্লাদিতই হলেন এবং আমার গবেষণাকে অভিজ্ঞতার পর্যায়ে না এনে তত্ত্বের পর্যায়েই রেখে দিলেন।

পরে তো আমার এই পরবর্তী কীর্তি সবার জন্য আনন্দের ভালো একটা খোরাকই হয়ে গেলো এবং আমার ‘মেধাতালিকায়’ নতুন সংযোজনরূপে মজলিসে মজলিসে কীর্তিত হতে থাকলো।

এরপর ভাইজান আমাকে এমনই অন্তরঙ্গতা ও বে-তকল্লুফি দান করেছিলেন যে, তা রীতিমত বন্ধুত্বের পর্যায়ে পড়ে!

এমনও হয়েছে যে, তাঁর সঙ্গে হাস্যরসের কোন কথা বলে শেষে লজ্জা ও চিন্তায় পড়ে যেতাম যে, সীমালঙ্ঘন হয়ে গেলো  না তো!

বন্ধুত্ব পর্যায়ের এ বে-তকল্লুফির কারণেই যখনই তাঁর যতটা সঙ্গলাভ হতো, আমাদের কাছে সেটা বড় নেয়ামতই মনে হতো।

দারুল উলূমে আমাদের কর্মব্যস্ততা সম্পর্কে তিনি গভীর দৃষ্টি রাখতেন এবং মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে আমাদের বাধিত করতেন।

যখন থেকে আমি লিখতে শুরু করেছি. তিনি আমার প্রতিটি লেখা যতœ ও গুরুত্বের সঙ্গে পড়তেন এবং নিরপেক্ষ পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতেন।

‘হযরত মু‘আবিয়া আওর তারীখি হাকায়েক, কিতাবটি আমি তারই ফরমায়েশে লিখেছিলাম, যার আলোচনা ইনশাআল্লাহ সামনে আসবে।

তাঁর মৃত্যুতে আলবালাগে আমি কিছুটা বিশদ আলোচনা করেছি. যা নূকূশে রাফতে গাঁ-এ সন্নিবেশিত হয়েছে।

 (ইনশাআল্লাহ চলবে)