শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

রজব ১৪৩৯ হিঃ (৩/৩) | পুষ্পকলি

বানানের জলসা / বাতাসের তালব্য-শ

 

আশ্চর্যের বিষয় তো কত কিছুই ঘটে এবং ঘটতে পারে। তবে বানানের জলসায় সব চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, সভাপতি হুযূর ঠিক সময়ে হাজির হওয়া! আর একেবারে সবার আগে হাজির হওয়া, সে তো এলাহি কাণ্ড!! আর আজকে যা ঘটলো তা তো আরো তাজ্জব কি বাত! সভাপতি হুযূরের আব্বা হুযূর খোদ তশরীফ লায়া হ্যাঁয়!!! সুতরাং ছেলে-মেয়ে সবার চক্ষু চড়কগাছ!

***

এম্মা, মাছুম বাচ্চারা যা  বোঝবে না তা কেন বললাম! এখন তো মানেটা বোঝাতে হয় জলের মত সহজ করে! কী মুশকিল বলো তো!

আচ্ছা, যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে; এখন চড়ক- গাছের মানেটা সহজ করে বোঝানোর চেষ্টা করি!

তুমি যদি জিজ্ঞাসা করো, ‘চক্ষু চড়কগাছ’ কেন বলে, ‘বড়াক বাঁশ’ কেন বলে না! প্রথম কথা হলো, অত প্যাচের কথা আমি বাপু জানি না। আমি শুধু চেষ্টা করতে পারি, চড়কগাছের মানেটা বুঝিয়ে দিতে। সেটাই বরং শান্ত হয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনে নাও।

***

তার আগে শোনো; হিন্দুধর্মের সবকিছু কেমন যেন আলাদা! নাচগান হলো তাদের উপাসনার অংশ। অর্থাৎ নাচগান ছাড়া নাকি ধর্মটা ঠিকমত পালন করা হয় না। তাদের মধ্যে আবার আছে উঁচু জাত, নীচু জাত!  সে বড় অমানবিক একটা বিষয়।

তো ব্রাহ্মণ হলো সবচে’ উঁচু জাত।

নাও, ঝামেলার মধ্যে আবার ঝামেলা! শিখতে হবে ব্রাহ্মণ-এর বানান! চেনার উপায় আছে, হ আর ম জট পাকিয়েছে! হ-ম মিলে কী বিদঘুটে চেহারা, দেখো না একবার!

যাই হোক ব্রাহ্মণ জাতটা নাকি, ওরা বলে, ভাগবানের বহুত পেয়ারা, মানে সবচে’ প্রিয়। তাই অন্য জাতের সবহিন্দুর কর্তব্য হলো মনপ্রাণ দিয়ে ব্রাহ্মণের সেবা করা। ব্রাহ্মণ কারো উপর নাখোশ হলেন, তো বেচারা সোজা নরকে!

এই ব্রাহ্মণদের মধ্যে অনেকে আবার সন্ন্যাসী হন।

ছুফিয়া সন্ন্যাসী মানে কী বড় হুযূর?

সভাপতির বাবা ঃ বড় হুযূরকে প্রশ্ন! বড়ই বে‘আদবি!! নিজের ইচ্ছায় যা বলবো, তাই শুধু শুনে যাবে, কোন প্রশ্ন ছাড়া।

যাক, তুমি হলে মেয়ে মানুষ। মায়ের জাত!! তোমাকে না হয় একটু ছাড় দিলাম!

সন্ন্যাসী মানে যিনি সংসার ত্যাগ করে শুধু ধর্মকর্ম করে জীবন পার করেন।

বানানটার চেহারা তো আমি ফরসা করতে যাচ্ছিলাম, এর মধ্যে তুমি ছুফিয়া, প্রশ্নটা ‘করে বসলে’!

এম্মা! তুমি তো প্রশ্নটা করে বসোনি এবং বসেও করোনি। তুমি তো প্রশ্নটা দাঁড়িয়ে করেছো, অথবা করে দাঁড়িয়েছো!

আগে দেখলে কিন্তু বলতাম না, তুমি প্রশ্ন করে বসেছো। আসল কথা কি জানো, প্রশ্নটা তুমি দাঁড়িয়ে করেছো না বসে, সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো যখন উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে, বা অসময়ে প্রশ্ন করে, তখন বলা হয়, ‘সে প্রশ্ন করে বসেছে’।

বুঝলে মা ছুফিয়া! যাক এবার বসো এবং বানানের চেহারাটা দেখো। দুটো দন্ত্য ন, একটার ঘাড়ে চড়ে বসেছে আরেকটা। এই যে  দেখো, ‘ন্ন’ তা বসুক না, বেশী ওজন তো আর নয়! নীচের ন-টার খুব একটা কষ্ট হবে বলে তো মনে হয় না। তা না হয় হলো! কিন্তুু দু’টো ন উপরে নীচে জোড়া দেয়ার পর আবার য-ফলার কী দরকারটা ছিলো?! শুধু শুধু বানানটাকে কঠিন করা, আর আমার মাসুম বাচ্চাদের কষ্ট দেয়া!

***

যাক, শোনো। সেই আদিকাল থেকে ব্রাহ্মণরা হলো বড়ই খানেওয়ালা। ওদের আবার দাওয়াত দিতে নেই। দাওয়াত নাকি মুসলমানি শব্দ। তাই ওতে ব্রাহ্মণের জাত যায়। ব্রাহ্মণদের করতে হয় নিমন্ত্রণ। মূর্ধন্য ণটা দুই চোখ মেলে দেখে রাখো। যাক, ব্রাহ্মণকে নিমন্ত্রণ করে উদরপূর্তি করে খাওয়ালে নাকি বেজায় পূণ্য।

আচ্ছা, উদরপূর্তি কথাটা বুঝতে সমস্যা হচ্ছে! আমি আরো সহজ শব্দ বলছি। উদরপূর্তি করে খাওয়ানো মানে পেটভরে খাওয়ানো। যাক, বলছিলাম, সন্ন্যাসীদের অনেক তপস্যা করতে হয়। নাহ, বারবার ভুল হচ্ছে!

কঠিন শব্দ এসে যাচ্ছে। আসল কথা হলো, আমি তো তোমাদের জলসায় বড়

একটা আসি না! তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে যে সহজ

শব্দ দরকার, মনেই থাকে না।

শফীক ঃ হুযূর, আপনার শব্দগুলো কঠিন, আবার কথাগুলোও কঠিন!

সভাপতির বাবা ঃ  হোক কঠিন, কথাগুলো দরকারী কি না বলো? সবাই একসঙ্গে ঃ জ্বি, জ্বি, খুব দরকারী।  

সভাপরিত বাবা ঃ যাক, শোনো, তপস্যা মানে হলো কোন কিছু অর্জনের জন্য কঠিন পরিশ্রম করা এবং দীর্ঘ দীর্ঘ ধ্যান করা। বানানটা দেখো নাও। য-ফলা তো আছেই। আসল মনে রাখার বিষয় হলো স-টা হচ্ছে দন্ত্য।

***

আচ্ছা সংক্ষেপ করি এবং আসল কথায় ফিরে আসি। চড়কগাছকে ধরে ঘোরপাক খাওয়া, অথবা চড়কগাছে ওঠার চেষ্টা করা, এগুলো হচ্ছে সন্ন্যাসীদের বিশেষ তপস্যা। এটা করতে খুব কষ্ট হয়।

এখন কথা হলো, কেউ যদি খুব অবাক হয় বা ভয় পায় তখন বলে, ‘ভয়ে বা বিস্ময়ে চক্ষু তার চড়ক গাছ!

যদি জিজ্ঞাসা করো অবাক হওয়া বা ভয় পাওয়ার সঙ্গে চক্ষুর চড়কগাছ হওয়ার কী সম্পর্ক?

আমি বলবো, অতি ন্যায্য প্রশ্ন! এবং তাতে দু’টো য-ফলা! কিন্তু কথা হলো, এর উত্তর আমার জানা নেই। তবে কিনা আন্দায করে কিছু একটা বলতে পারি।

চড়কগাছে ওঠা খুব কঠিন কিনা, তাই এটা বলা হয়। অর্থাৎ এত অবাক হয়েছে, বা এত ভয় পেয়েছে যে, চোখদু’টো তার ‘জন্মস্থান’ ত্যাগ করে চড়কগাছে ঘোরপাক খেতে রাজি হয়ে গেছে! তাতে যদি অবাক হওয়া থেকে, বা ভয় পাওয়া থেকে মুক্তি পাওয়া যায়!

যাও আন্দাযে ঢিল ছুঁড়লাম। লেগে গেলে তো ভালো, না যদি লাগে তাতেও আপত্তি কী! হাদীছ কোরআন তো নয় যে, ভুল হলে সর্বনাশ!

***

আচ্ছা, চড়কগাছ বুঝতে যদি কষ্ট হয় বাদ দাও। ভয় বা বিস্ময়, এ অর্থটা বোঝানোর জন্য এর চেয়ে ভালো আরেকটা কথা আছে; ‘ভয়ে বা বিস্ময়ে তার চক্ষু ছানাবড়া।’

দেখো তো, কত মিষ্টি শব্দ! আমার তো এমনিতেই জিভে পানি এসে যায়! আসল কথা হলো, ভয় পেলে বা অবাক হলে চোখদু’টো অনেক বড় আর গোল গোল হয়ে যায়। পলকটা পর্যন্ত ফেলতে পারে না। তো যে বেটা প্রথমে এই দৃশ্যটা দেখেছে তার মনে হয়েছে, চোখদু’টো দেখতে যেন ছানাবড়া হয়েছে! ব্যস, সেই থেকে শুরু হয়েছে তো হয়েছে! সবাই বলে, ভয়ে তার চক্ষু ছানাবড়া! যাই বলো, চড়কগাছওয়ালার চেয়ে এই মানুষটার বুদ্ধি বেশী ছিলো! সোজা মিষ্টি নিয়ে হাজির! তাও আবার ছানাবড়া!! আমার অবশ্য চমচমটা বেশী পছন্দ। আমি হলে বলতাম কী, ভয়ে বিস্ময়ে তার চক্ষু একেবারে চমচম!

***

তো কী যেন বলছিলাম! দেখো তো, কথায় কথায় আসল কথা থেকে কত দূর চলে এসেছি! এখন তো বুড়ো মানুষ, পথ চিনে চিনে আগের জায়গাটায় ঠিক ঠিক ফিরে যাওয়া কি সোজা কাজ! তা তোমরা কেউ আমাকে একটু সাহায্য করো না! কোথায় যেন ছিলো আমাদের কথাটা! ওখানে আমাকে একটু পৌঁছে দাও না!

ছুফিয়া ঃ বড় হুযূর! আপনি বলছিলেন, সভাপতি হুযূর ঠিক সময়েরও আগে এসে পড়েছেন দেখে আমদের চক্ষু চড়ক গাছ! সভাপতির বাবা : ধন্যবাদ ছুফিয়া। তুমি তো খুব সহজেই পথ চিনে আমাকের ঠিক আগের জায়গাটায় নিয়ে এসেছো! তোমাকে আবার ধন্যবাদ।

ছুফিয়া (একটু সুযোগ বুঝে, একটু সাহস পেয়ে) ঃ বড় হুযূর! আমি তো আপনাকে সাহায্য করেছি, তাহলে একটা প্রশ্ন করি!

সভাপতির বাবা ঃ বেটি! তোম এক নেহী, দু’ ছুয়াল করো।

ছুফিয়া (খুশিতে গদগদ হয়ে) ঃ ধন্যবাদ বড় হুযুর, অনেক ধন্যবাদ! তা আমার প্রথম প্রশ্নটা হলো, আমাদের সভাপতি হুযুুর এত্তো বানান শিখলেন কোত্থেকে!!

বাবা ঃ আমি কী জানি, আমার কী দোষ! যে দোষ করেছে তাকেই জিজ্ঞাসা করো।

ছুফিয়া ঃ বড় হুযূর, আমার প্রথম প্রশ্ন, আপনার পোলার এত্তো গোস্সা কেন?

বাবাঃ না, এত গোস্সা ভালো না। তবে তোমাদের দোষ ধরাটা একেবারেই ভালো না। হুযুরের দোষ থাকতেই পারে, তবে ধরতে নেই।

ছুফিয়া ঃ আচ্ছা বড় হুযূর! দোষটা না হয় ছেড়েই দিলাম। এখন আমার প্রথম প্রশ্ন হলো, সভাপতি হুযূরের নাকি আক্কেল দাঁত ওঠেনি। আপনার কি আক্কেল দাঁত উঠেছে বড় হুযূর!

সভাপতির বাবা ঃ উঠেছে মানে! উঠে সেই কবে পড়েও গেছে! দেখছো না, এখন বুড়ো মানুষটার আক্কেল কত কম!

ছুফিয়া ঃ জ্বি বড় হুযূর, দেখতে পাচ্ছি! আচ্ছা, এখন আমার প্রথম প্রশ্ন হলো ...

শফিক ঃ বড় হুযূর! ছুফিয়া তো খালি প্রথম প্রশ্ন করছে, দ্বিতীয় প্রশ্ন করছেই না।

সভাপতির বাবা ঃ তাই তো! তাই তো! আক্কেল দাঁত নেই বলে আমাকে বেক্কল ভেবেছো!  নাও। আর প্রথম প্রশ্ন নয়। এবার সোজা দ্বিতীয় প্রশ্নটা।

ছুফিয়া ঃ জ্বি বড় হুযূর! আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, আপনার তো কষ্ট হচ্ছে! আপনি যাবেন কখন বড় হুযূর?!

সভাপতির বাবা (মুখটা ভার করে) আচ্ছা, তাহলে আমি না হয় যাই! কী বলো, যাবো!! সত্যি বলছো, চলে যাবো!!

ছুফিয়া ঃ জ্বি! জ্বি!! আপনার দয়া আব্বা হুযূর!

বাবা ঃ আমি কিন্তু সত্যি চলে যাচ্ছি!!

ছুফিয়া ঃ জ্বি, শুভ কাজে বিলম্ব কেন?

সভাপতির বাবা ( ছেলের দিকে করুণ দুষ্টিতে তাকিয়ে) বাবা, তুমি কিছু বলো না! আমি থাকলে ওদের কত লাভ, ছুফিয়াকে একটু বোঝাও না!

সভাপতি ঃ কী হয়েছে, আমি তো কিছু বুঝতে পারিনি আব্বু! বড় মিষ্টি একটা ঘুম পেয়েছিলো তো! একবার শুধু চোখটা একটু ফাঁক হয়েছিলো, যখন ছানাবড়া আর চমচমের কথা হচ্ছিলো! *

 

 

 

কঠিন শব্দের বানান

মুশকিল   তালব্যশ যদি না দাও, দন্ত্যস যদি দাও তাহলে তুমি বড় মুশকিলে পড়ে যাবে। আর যদি মূর্ধন্য ষ দাও তাহলে তো মুশকিলের শেষ নেই!

কা-   মূর্ধন্য ণ আর ড মিলে হয়েছে এই চেহারা (ণ+ড= -) মানে হলো কাজ, ঘটনা, বিষয়। আমরা বলি, এমন অবাক কা- ঘটেছে যে, বিশ্বাস করাই কঠিন। কা--এর আরেকটা মানে হলো মাটির উপর থেকে ডালপালা পর্যন্ত গাছে অংশ। শিকড়, কা- ও ডালপালা, এই তিনে মিলে হলো গাছ।

ব্রাহ্মণ   হিন্দুদের মোট চারটে জাত বা শ্রেণীর মধ্যে, সবার উপরে হলো ব্রাহ্মণ, হ আর ম মিলে হয়েছে এমন বিদঘুটে চেহারা। এই চেহারাটা তুমি দেখতে পাবে আরো একদু’টি শব্দে।

সন্ন্যাসী    যারা সংসার ত্যাগ করে শুধু ধর্ম নিয়ে মগ্ন থাকে তাদের সন্ন্যাসী বলে। তাদের এই কাজটাকে বলে সন্ন্যাস। ‘সন্ন্যাস গ্রহণ করে লোকটা সন্ন্যাসী হয়েছে।’

সমস্যা  এটা তো পরিচিত শব্দ। বানানে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। দু’টো দন্ত্যস, একটি য-ফলা (্য)

তপস্যা  মানে সাধনা করা,  কোন কিছু অর্জনের জন্য খুব নিমগ্ন হয়ে  চেষ্টা মেহনত করা।

ন্যায্য   দু’টি য-ফলা। প্রথমটির উচ্চারণ এ-কারের মত। সঙ্গে আছে আকার। দ্বিতীয় য-ফলাটি হলো তাশদীদের মত।