ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে, ৬ই ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পবিত্র নগরী জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানীরূপে স্বীকৃতি প্রদান করে সম্পূর্ণ একতরফা ও হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ হঠকারী সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। তাতে ১৫ সদস্যের মধ্যে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া ১৪টি সদস্যদেশই প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট দান করে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে প্রস্তাবটির কার্যকরতা বাতিল করে দেয়। এতে যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক পরাজয় এড়াতে পারলেও নৈতিক পরাজয় এড়াতে পারেনি।
এরপর প্রস্তাবটিকে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ২০ শে ডিসেম্বর রোয বৃহস্পতিবার সাধারণ ভোট অনুষ্ঠিত হয়।
আগেই ধারণা করা হয়েছিলো, নিন্দা- প্রস্তাবটি সদস্যরাষ্ট্রগুলোর বিপুল ভোটে পাস হবে। হয়েছেও তাই। পক্ষে ভোট পড়েছে ১২৮টি, বিপক্ষে মাত্র নয়টি।
শুধু এটুকু পরিস্থিতিই যথেষ্ট ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য লজ্জা হিসাবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এ প্রসঙ্গে সর্বপ্রকার কূটনৈতিক ভব্যতা বর্জন করে যে কাজটি করেছে তা রীতিমত কলঙ্কজনক এবং চরম বোকামিপূর্ণ।
অধিবেশনে ভোট শুরুর আগে সদস্যরাষ্ট্র- গুলোর উপর হুমকি ও চাপ সৃষ্টির অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তাছাড়া নীতি ও নৈতিকতাকেও এভাবে পদদলিত করা হয়েছে।
জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের দূত নিকি হ্যালি সাধারণ পরিষদের সদস্যদেশগুলোর কাছে প্রেরিত ই-মেইল বার্তায় প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়ার বিষয়ে সতর্ক করে দেন। তিনি বলেন, মার্কিন সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যানের লক্ষ্যে সাধারণ পরিষদে তোলা খসড়া প্রস্তাবের উপর ভোটাভুটির দিকে তিনি ও প্রেসিডেন্ট নযর রাখবেন। তিনি আরো জানান, প্রেসিডেন্ট বিষয়টিকে ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছেন।
দেখা গেলো, এই হুমকিকে কেউ আমালেই নেয়নি, বরং অধিকাংশ সদস্যদেশ স্বাধীন-ভাবে ভোট দিয়েছে। বরং পক্ষে যারা ভোট দিয়েছে তারাই বিতর্কের মুখে পড়ে যাচ্ছে ঐ মার্কিন হুমকির ফলে। প্রশ্ন উঠছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে স্বাধীনভাবে ভোট দিয়েছে, না হুমুকির ভয়ে ভীত হয়ে?
বিশ্লেষকগণ বিভিন্নভাবে চিন্তাভাবনা করে দেখার চেষ্টা করছেন, নিকি হ্যালির প্রচ্ছন্ন হুমুকিসম্বলিত ই-মেইলটির আসল উদ্দেশ্য কী? তারা বলছেন, আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে, ট্রাম্পপ্রশাসনে হ্যালি নিজের অবস্থান তৈরী করতে চান। সুতরাং চিঠিটি সম্পূর্ণরূপে আন্তর্জাতিক রাজনীতিনির্ভর।
বিশ্লেষকদের মতে হ্যালির এই হম্বিতম্বিপূর্ণ চিঠির আন্তর্জাতিক কোন প্রভাব থাকলেও জাতিসঙ্ঘে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমর্যাদাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং বিশ্বমঞ্চে ট্রাম্পের ভূমিকাকে খাটো করে ফেলেছে।
নিউইয়র্কে ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের জাতিসঙ্ঘবিশেষজ্ঞ রিচার্ড গোয়ান বলেন, জেরুসালেম ইস্যুতে জাতিসঙ্ঘের ভোটাভুটিকে ট্রাম্পের পক্ষে না বিপক্ষে এভাবে ব্যক্তিগত বিষয় করে তোলাটা সত্যি একটা বোকামি।
ট্রাম্প নিজেও এ বিষয়ে মুখ খুলে নিজেকে যথেষ্ট নীচে নামিয়ে এনেছেন, তিনি বলেছেন, ‘আমরা ঐ ভোটাভুটি পর্যবেক্ষণ করছি। আমাদের বিরুদ্ধে তাদের ভোট দিতে দিন। আমাদের মহান জনগণ, যারা এই দেশকে ভালোবাসে তারা জানে, তাদের দেশের কাছ থেকে সুবিধা নেয়া হচ্ছে, কিন্তু আর আমাদের কাছ থেকে সুবিধা নেয়া যাবে ন।’
এই হুমকির মধ্য দিয়ে ট্রাম্পও বৈদেশিক অর্থসাহায্যকে ভোটক্রয়ের ঘুষ হিসাবে প্রমাণ করে ছেডেছেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদা ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছে।
ব্রুকলিন ইনসটিটিউশনের গবেষণা ফেলো এলজিন্দি বলেন, ট্রাম্পের এ ঘোষণা আসলে নিজের দেশের জনগণের সঙ্গে একধরনের খেলা। বিভিন্ন কারণে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা দেশের ভিতরে এখন সর্বনিম্ম পর্যায়ে রয়েছে, এ ঘোষাণা দ্বারা তিনি আসলে জনপ্রিয়তা মেরামত করতে চাচ্ছেন।
কিন্তু এধরনের হুমকি-ধমকি তাদের কূটনৈতিক ‘বাচপনা’রই প্রমাণ।
এদিকে সাধারণ পরিষদে স্লোভাকিয়ার প্রেসিডেন্ট মিরোস্লাভ লাজকাক বলেছেন, জেরুসালেম ইস্যুতে নিজেদের মতামত প্রকাশ করা সদস্যরাষ্ট্রগুলোর দায়িত্ব। একই সঙ্গে এটা তাদের অধিকার। সুতরাং এ ভোটাভুটি হবেই। আর ভোটাভুটির ক্ষেত্রে রহস্যের কিছুই নেই।
আমেরিকা সত্যি সত্যি একটা ‘সুপার ডিফল্ট’ (ব্যাপক পরাজয়) বরণ করেছে নিজেরই কূটনৈতিক বোকামির কারণে। *