ফিলিস্তীন, আলকুদ্স, আলআকছা এই পবিত্র ভূমিতে শুধু ফিলিস্তীনী মুজাহিদীনের রক্ত ঝরেনি, ঝরেনি শুধু আরব শহীদানের লহু। এ পবিত্র ভূমিতে যুগ যুগ ধরে ঝরেছে বাংলাদেশের নাম না জানা বহু তরুণের তাজা খুন।
বাংলাদেশী তরুণদের ফিলিস্তীনের পবিত্র ভূমির জিহাদে অংশগ্রহণের ইতিহাস শুরু হয়েছে, ইহুদিবাদিদের অবৈধ ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইসরাইলের জন্মেরও বহু পূর্বে। সন্ত্রাসবাদী ইহুদিবাদী মুনাহেম বেগীন (পরবর্তীকালে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী)-পরিচালিত ইরগুন-এর সঙ্গে এক সঙ্ঘর্ষে যখন একজন ‘ফিলিস্তীনী’ বন্দী হলো তখনই প্রথম প্রকাশ্যে আসে, ফিলিস্তীনের মুক্তিসংগ্রামে বালাংদেশী তরুণদের সশস্ত্র অংশগ্রহণের কথা। তবে তখনকার ফিলিস্তীনী মুক্তিযুদ্ধে কত বাংলাদেশী তরুণ অংশগ্রহণ করেছে, কতজন প্রাণ দিয়েছে এবং তাদের ভূমিকা ও অবদান কত সাহসিকতাপূর্ণ ছিলো তা ইতিহাসের পাতায় অলিখিতই রয়ে গেছে।
১৯৪৭-এর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়কালে পশ্চিমবঙ্গের মালদাহ থেকে তিনিজন বাঙ্গালী মুসলিম খোদ বাইতুল মাকদিসে, আরো সুনির্দিষ্টভাবে স্বয়ং আলআকছা মসজিদপ্রাঙ্গণে দখলদার সশস্ত্র ইহুদি সন্ত্রাসিদের বিরুদ্ধে লড়াই করে শহীদ হয়েছেন বলে জানা যায়। সম্ভবতঃ সেটাই ছিলো বাইতুল মাকদিসের পাক যমীনে এবং আলআকছার পবিত্র চত্বরে কোন বাঙ্গালী মুসলিমের খুনের পয়লা নাযরানা।
১৯৪৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরাইল রাষ্ট্রের ঘোষণা আসার পর আরব-প্রতিরোধয্দ্ধু সর্বাত্মক জিহাদের রূপ নেয়। এরপর থেকেই মূলত পর্দার আড়ালে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় পাকিস্তানের উভয় অংশ হতে তরুণদের জিহাদী কাফেলা নিয়মিত ফিলিস্তীনে রওয়ানা হতে থাকে। আর ঐ সুবাদে বাংলাদেশের যুবকদের শৌর্য-সাহস ও বীরত্ব সম্পর্কে আরবদের মধ্যে নতুন শ্রদ্ধাপূর্ণ ধারণা তৈরী হয়। এর আগে সারা পৃথিবীর মত আরবদেরও ধারণা ছিলো, বাঙ্গালীরা সাহসী জাতি নয়, ভীরু জাতি। তারা যোদ্ধা নয়, কৃষিজীবী।
আরবদের কাছে বাঙ্গালিদের সাহস ও বীরত্বের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে ১৯৬৭-এর জুনে মাত্র ছয়দিন স্থায়ী আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সঙ্কটপূর্ণ সময়।
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে প্রথমে পাদপ্রদীপে আসে তদানীন্তন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাইফুল আজমের নাম। আকাশযুদ্ধে অসামান্য কুশলতা প্রদর্শন করে তিনি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করেন। পাকবিমানবাহিনী- প্রধান ভূমি থেকে স্বচক্ষে সে আকাশযুদ্ধ অবলোকন করে মুগ্ধ হন। সাইফুল আজমকে সিতারায়ে জুরআত খেতাব দেয়া হয়।
১৯৬৭ সালে জর্দান বিমানবাহিনীতে প্রশিক্ষক হিসাবে নিয়োজিত থাকার সময় তিনি জর্দানের হয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে আকাশযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সুযোগ লাভ করেন। তিনি একা তিনটি ইসরাইলী বিমান ভূপাতিত করেন। তার চেয়ে বড় কথা, আকাশযুদ্ধে তার অসামান্য কুশলতার কারণে ইসরাইলি বিমানবাহিনী ‘রেড এলার্ট’ বা চূড়ান্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে বাধ্য হয়। অন্তত আকাশযুদ্ধে ইসরাইল আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ পায়নি। জর্দান ও ইরাক সরকার তাকে যৌথভাবে বীরত্বসূচক খেতাব প্রদান করে। তিনি পৃথিবীর একমাত্র বিমানযোদ্ধা যাকে তিনটি দেশ বীরত্বসূচক খেতাবে ভূষিত করেছে।
বিমানযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত বিমানযোদ্ধাদের যে র্যাংকিং যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী করেছে তাতে এই উপমহাদেশ থেকে একমাত্র সাইফুল আজমের নাম এসেছে তালিকার পনের নম্বরে।
বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের পরো ফিলিস্তীনমুক্তি সংগ্রামে আমাদের সাহসী তরুণদের বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ অব্যাহত ছিলো।
ফিলিস্তনমুক্তিসংস্থার প্রধান জনাব ইয়াসির আরাফাত যখন সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য দ্বিতীয় দফা বাংলাদেশে আসেন, তখনো ফিলিস্তীন ও আলকুদ্সের পবিত্র ভূমিতে দশহাজার বাংলাদেশী তরুণ নিয়োজিত ছিলেন ইহুদি সন্ত্রসবাদের বিরুদ্ধে প্রতক্ষ্য জিহাদে। ইয়াসির আরাফাত এজন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছিলেন। *