শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

আরাকান সংখ্যা (৩/১) | তোমাদের পাতা

আমাকে / তোমাকে

 

আমাকে
এখন যেন আমাকে চিনতে পাই না আমি! কে আজকের আমি?! কোথায় অতীতের আমি?! কোথায় ভবিষ্যতের আমি?! আজকের আমি এমন অসুন্দর, এমন কুৎসিত কীভাবে হলাম?! সারা দেহে দগদগে ঘা, পচন ধরেছে, দুগর্ন্ধে সবাই অতিষ্ঠ! আমিও!! কীভাবে এমন হলো?! কেন এমন হলো?! উপায় কী এ জঘন্যতা থেকে মুক্তির?! কীভাবে ফিরে যেতে পারি আমি অতীতের সুন্দর আমার কাছে?! কিংবা কীভাবে পেতে পারি আমি ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় আমাকে?! খাঁচার ভিতরে ছোট্ট পাখিটি! কত হাসিখুশি ছিলো। কত কিচিরমিচির ছিলো। নিজেও আলোকিত ছিলো, খাঁচাটিকেও আলোকিত করে রেখেছিলো। সেই পাখিটি আজ কেমন বিষণœ, নীরব, নিশ্চুপ!! কেন এমন হলো। কোথায় গেলো আমার বাইরের আলো! আমার ভিতরের নূর!! মনে পড়ছে, আমার চারপাশে কত আলো ছিলো, এখন কেন এত অন্ধকার? আমার চোখের তারায় ভবিষ্যত্যের কত সুন্দর স্বপ্ন ছিলো, এখন চোখে যেন আলো নেই, না স্বপ্নর, না আশা ও প্রত্যাশার। কেন এমন হলো?! মিথ্যার কোন স্থান ছিলো না আমার জীবনে। মিথ্যাকে আমি ঘৃণা করেছি সারা জীবন, যেমন ঘৃণা করে মানুষ কুষ্ঠরোগীকে! যেমন ঘৃণা করে মানুষ পচাগলা মৃতদেহকে, নর্দমায় গড়িয়ে যাওয়া জল-আবর্জনাকে!! কোথায় হারিয়ে গেলো বুকের ভিতর থেকে আমার মিথ্যার প্রতি ঘৃণা!! অতীতের আমাকে যারা চিনতো, অবাক হয়ে দেখে তারা, কত অবলীলায় আমি বলে যাই মিথ্যার পর মিথ্যা!! সত্য ছিলো আমার জীবনের সাধনা! সত্যের জন্য বাঁচবো, সত্যের জন্য লড়বো, সত্যের জন্য মরবো, সত্যকে চিরকাল সমুন্নত রাখবো, এই ছিলো আমার প্রতিজ্ঞা। সত্যের প্রতি বিশ্বস্ততা, সত্যের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য, এই ছিলো আমার পরিচয়বৈশিষ্ট্য। একটি সত্যকে রক্ষা করার জন্য, একটি সত্যকে লালন করার জন্য, একটি সত্যকে জীবনের মঞ্চে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মনে হতো, হাসিমুখে জীবন দিতে পারি আমি! কোথায় গেলো সত্যের সঙ্গে আমার সেই অটুট বন্ধন! সত্যের প্রতি সেই বিশ্বস্ততা, সেই আনুগত্য ! আমাকে যারা চিনতো, অবাক হয়ে দেখে তারা, কত অবলীলায় সত্যকে আমি হত্যা করি। চিরকালের সত্যের পূজারী আমি, আজ সত্যের খুনী! এই যে আমার হাতে ছোপ ছোপ রক্ত! এই মাত্র খুন করেছি আমি একটি সত্যকে, চারপাশের সবার সামনে! তাতে একটুও কাঁপেনি আমার বুক!! কেন এমন হলো! কেন এমন হয়!! এ অবস্থা কি শুধু আমার একার! আমার চারপাশে মানুষের এই যে এত ভিড়! তারা কি এখনো ভালো অতীতের মত! তারাও কি হয়ে পড়েছে বর্তমানের আমার মত!! আমি, আমরা, আবার কি ফিরে যেতে পারি না সেই পবিত্র সুন্দর অতীতের কোলে?! আবার কি ফিরে তাকাতে পারি না ভবিষ্যতের সেই স্বপ্নগুলোর দিকে? আমি নিজেই একদিন যে স্বপ্নগুলোর গোড়ায় পানি দিয়েছি, যত্নের সঙ্গে লালন করেছি!! হয়ত পারি, হয়ত পারবো!! কোথায় সেই পথ! ভিতরের সেই বিষণ্ণ পাখীটি হঠাৎ যেন একটু চোখ মেলে তাকালো!! একটু যেন আশার ঝিলিক দেখা দিলো তার চোখের তারায়!! কত যেন মিনতির সুরে বললো, তোমার অতীতের সব আলো, সব সৌন্দর্য আবার ফিরে আসতে পারে, তুমি যদি যেতে পারো তাদের কাছে যেখানে তোমার প্রতীক্ষায় আছেন তোমার করুণাময়, তোমার দয়াময়!! নির্বোধের মতই জানতে চাইলাম, কোথায় তিনি, আমার প্রতীক্ষায়! ভিতরের পাখীটি এবার যেন আরো সজীব হলো একটুখানি আশার স্পর্শ পেয়ে। মমতার সঙ্গে বললো, যেখানে ক্ষুধা, অনাহার, যেখানে পিপাসা, হাহাকার, যেখানে রোগব্যাধি, আর বেঁচে থাকার আকুতি সেখানেই তিনি, যেখানে মজলূমানের ফরিয়াদ, ভয়ার্ত মানুষের আর্তনাদ সেখানেই তিনি, যেভাবে পারো সেখানে যাও তুমি। সেখানে পাবে তুমি তোমার করুণাময়ের করুণার আলীঙ্গন! সেখানেই মুক্তি তোমার বর্তমানের অন্ধকার থেকে! সেখানেই ফিরে পাবে তুমি তোমার অতীতকে, তোমার ভবিষ্যতকে এবং তোমার জীবনের হারিয়ে যাওয়া সত্যকে।

তোমাকে

তোমাকে দেখিনি। তবু তোমাকে দেখেছি!! তুমি দূর আফগানিস্তানে, দূর ফিলিস্তিনে! কাশ্মীরে! ইরাকে, সিরিয়ায়; তুমি দজলা- ফুরাত, কাবেরি ও ঝিলাম নদীতে। তুমি আরাকানে, টেকনাফে, শাহপরীর দ্বীপে এবং নাফনদীর পানিতে। আমি একজন বিধ্বস্ত মানুষ, যেমন বিধ্বস্ত তোমাদের শহরগুলো ইরাকে, সিরিয়ায়, ফিলিস্তিনে; যেমন বিধ্বস্ত তোমাদের বস্তিগুলো কাশ্মীরে, কাশগরে, মুসলিমবিশ্বের এখানে ওখানে!! আমার সারা জীবনের সব স্বপ্ন এখন জ্বলে পুড়ে সারখার, যেমন সারখার তোমাদের জনপদগুলো ওখানে আরাকানে। এজন্যই তোমাকে আমি এমন করে ভালোবেসেছি, ভালোবাসতে পেরেছি। বিধ্বস্ত আগামী প্রজন্মের জন্য বিধ্বস্ত বুকের ভালোবাসা। আমি তোমাকে দেখিনি, তবু তোমাকে ভালোবাসি। তোমার সঙ্গে আমার জীবন কোথায় যেন একাকার!! তোমার জন্য কাঁদি আমি এখানে এই বাংলাদেশে, অনেক মানুষের ভিড়ে এক বিরান জনপদে। আমি শুনেছি তোমার কষ্টের কথা, তোমার দুর্ভোগের কাহিনী। যেখানে আগুন জ্বলে, কালো ধোঁয়ারা কুণ্ডুলি পাকায়, যেখানে কামানের গর্জন, বারুদের গন্ধ সেখানেই তুমি! যেখানে নৌকা ডোবে, ভূমধ্য সাগরে, কিংবা নাফনদীর সামান্য পানিতে সেখানেই তুমি। যেখানে পশুদের উল্লাস, হায়েনার অট্টহাসি, যেখানে রক্তের ফিনকি সেখানেই তুমি! যেখানে ক্ষুধা, অনাহার, ছাদহীন আকাশ, স্বপহীন ভবিষ্যত সেখানেই তুমি। চোখ মেলে তাকাই এখানে ওখানে, চারপাশে, দেখতে পাই না তোমাকে। তুমি যেন হারিয়ে যাও মেঘ ও কুয়াসার আড়ালে, কালো ধোঁয়ার অন্ধকারে! যখন চোখদু’টো বন্ধ করি, দেখতে পাই তোমাকে! এই যে বসে আছো আমার পাশে, কিচ্ছু না বলে, আমাকে স্পর্শ না করে! তাকিয়ে আছো আমার মুখের দিকে নিষ্পাপ চোখের আশাভরা দৃষ্টি নিয়ে। তোমাকে আমি দেখেছি, তোমাকে আমি চিনেছি। তুমি আইলান কুর্দি! ইরাকের আয়মান ছাওরী!! তুমি ঝিলামনদীর তীরে আখতার গাওহারী!! তুমি আরাকানের মা-হারা, বাপহারা রওশন নূরী!! তোমার জন্য আমার বুকে অনেক কান্না, অনেক অশ্রু। কিন্তু কারো কান্নায়, চোখের পানিতে কী হবে তোমার! তোমার তো প্রয়োজন একটুকরো রুটি, হৃদয়হীন রোদের পৃথিবীতে একটুকরো ছায়া। তোমার তো প্রয়োজন একটুখানি স্বেপ্নর, অসীম আঁধারের মাঝে একটুখানি আলোর! আমি আসবো তোমার কাছে, যেভাবেই পারি, একটুকরো রুটি নিয়ে, একটু আলোর আশ্বাস নিয়ে!! আমরা তোমাকে রক্ষা করতে পারিনি সাপের বিষ-ছোবল থেকে, নেকড়ের হিংশ্র থাবা থেকে! আমরা তোমাকে পারিনি বাঁচাতে আধুনিক সভ্যতার কূটনীতির নৃশংসতা থেকে!! তাই তোমরা আজ তোমাদের জনপদ হারিয়েছো! ঘরের নিরাপদ আশ্রয়, বাবার স্নেহের ছায়া, মায়ের মমতার আঁচল সবই হারিয়েছো! ছোট্ট প্রাণটুকু এখনো আছে তোমাদের বুকে! সেই প্রাণের আলোককণাটি অন্তত বাঁচিয়ে রাখতে চাই। আমার বিধ্বস্ত স্বপ্নগুলোর জন্য তোমার ছোট্ট প্রাণের উষ্ণতাটুকরু যে প্রয়োজন!!