মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে পরিচালিত নৃশংসতা, গণহত্যা ও জাতিগত নিধনযজ্ঞের ভয়াবহ খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনামে আবার উঠে এসেছে। সকল গণমাধ্যমের অভিন্ন বক্তব্য যে, এবারের নৃশংসতা অতীতের সব নযীর ছাড়িয়ে গেছে। রাখাইনের সঙ্ঘাতময় এলাকায় কোন সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মীর প্রবেশাধিকার না থাকায় সেখানকার সঠিক চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। তবে ছিটেফোঁটা যা পাওয়া যাচ্ছে তাতেই বিশ্ববিবেক ব্ধস্ত বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়েছে। * আরব নিউজ থেকে মাহা আকীল, ‘মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নৃশংসতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দিশেহারা লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশের দিকে ছুটে যাচ্ছে, আর বিশ্ব তাকিয়ে দেখছে, যেন নীরব দর্শক! ... যা ঘটছে তা আসলে পরিকল্পিত ও নৃশংস জাতিনির্মলূ অভিযান। অনেক আগেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো। নবায়ন করার অজুহাতে ধীরে ধীরে রোহিঙ্গাদের পরিচয়পত্র প্রত্যাহার করে নিচ্ছিলো। বাস্তবে এটা ছিলো বাজেয়াপ্ত, যা আর ফেরত দেয়া হয়নি। ... * গার্ডিয়ান পত্রিকা লিখেছে, ‘দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতন নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গাদের পক্ষে কথা না বলা এবং সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাই গাওয়ার কারণে অং সান সূ চী বিশ্বব্যাপী ধিক্কার ও সমালোচনার মুখে পড়েছেন। ... বিবিসির জোনাহ ফিশার লিখেছেন, রাখাইন রাজ্যে কী ঘটছে তার উত্তর নির্ভর করছে,
আপনি কাকে বিশ্বাস করবেন তার উপর। কারণ সেখানে যাওয়ার এবং স্বাধীনভাবে সব জানার সমস্ত পথ বন্ধ করে দিয়েছে মিয়ানমার সরকার। * মিজিমা নামে একটি অনলাইন সংবাদপত্রের বক্তব্য, ‘মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে আগত অবৈধ বাঙ্গালী বলে উল্লেখ করছে, অথচ তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রাখাইনে বসবাস করছে। * নিউইয়র্ক টাইমসের মন্তব্য, ‘মিয়ানমারের সরকার রাখাইনে গণমাধ্যমের প্রবেশ নিষিদ্ধ করার মানেই হলো সেখানে তারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর নির্মম নির্যাতন চালাচ্ছে এবং তারা চাচ্ছে, সেই বীভৎসতার কোন খবর বা চিত্র যেন বিশ্ববাসী জানতে না পারে এবং দেখতে না পারে। রাখাইন বলা চলে এখন বিশ্বমিডিয়ার জন্য ‘নিষিদ্ধ এলাকা’। * রাখাইনে কার্যত গণহত্যা চলছে এমন প্রতিবেদন একের পর এক প্রকাশ করছে কাতার- ভিত্তিক সংবাদ সংস্থা আলজাজিরা। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জাতিগত উচ্ছেদ ও গণহত্যার বিরুদ্ধে এশিয়াজুড়ে যে প্রচ- বিক্ষোভ ও উত্তাল প্রতিবাদ সে সব খবর গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করছে সি এন এন, বিবিসি ও আলজাজিরা। * বিবিসির সংবাদদাতা জোনাথন কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে রাখাইনের উপদ্রুত অঞ্চলে যাওয়ার এক বিরল সুযোগ পেয়েছিলেন। যদিও তারা ছিলেন সেনাবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রনে। তিনি লিখেছেন, ‘কিন্তু কখনো কখনো এমন হয় যে,
আপনি নিজেই অনেক কিছু বুঝে নিতে পারবেন যা অপর পক্ষ বুঝাতে চাচ্ছে না। ... আমাদের প্রথমে নেয়া হলো মংডুর এক স্কুেল যেখানে আশ্রয় নিয়েছে রোহিঙ্গা মুসলিমদের কথিত নির্যাতনের শিকার ঘরবাড়ি হারানো কিছু হিন্দু পরিবার। এক কমলা রঙ্গের ব্লাউজ এবং ধূসর লুঙ্গি পরা এক হিন্দু মহিলা বেশ উত্তেজিতভাবে মুসলিমদের নিষ্ঠুরতার বয়ান দিতে লাগলো। এরপর আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো একটি বৌদ্ধ মন্দিরে। সেখানে একজন ভিক্ষু বর্ণনা করলেন কীভাবে তাদের বাড়িঘর রোহিঙ্গারা জ্বালিয়ে দিয়েছে। সেখানে দেখি সকালের সেই হিন্দু মহিলা। এখন সেজেছে বৌদ্ধ! এমন কিছু ভিডিও আমাদের দেখানো হলো যা পরিষ্কার বোঝা যায় তৈরী করা। * গার্ডিয়ান পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ভয়াবহ আকার ধারণ করছে রাখাইনের মানবিক বিপর্যয়। কারণ সেখানে ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা কার্যক্রম কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে সূ চীসরকার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ত্রাণকর্মীদের রাখাইনে প্রবেশের সুযোগ দেয়ার আহ্বান জানালেও তাতে কান দিচেছ না দেশটির সরকার। ... রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর নৃশংস গণহত্যা ও জাতিনিমূর্ল অভিযানের মধ্যে সূ চীসরকার রাখাইনে মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করে তুলেছে। গার্ডিয়ান পত্রিকার আরো মন্তব্য, ‘আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে সঙ্ঘাতকবলিত অঞ্চলে যেতে না দেয়ার ফলে যে শুধু মানবিক বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে তাই নয়, বরং ওখানে প্রকতৃপক্ষে কী ঘটছে তার দেখারও কেউ রইলো না। একজন ত্রাণকর্মকর্তা বলেছেন, ‘যে রাষ্ট্র মুসলমানদের নাগরিকই মনে করে না তারা তাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কতটুকু ত্রাণ বিতরণ করবে তা তো সহজেই অনুমেয়। * ওয়াশিংটন পোস্ট/ মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত জাতিগত নিধনের ঘটনাটি কয়েক দশকের মধ্যে বিশ্বের নিষ্ঠুরতম ঘটনা বলে আখ্যায়িত করেছে প্রভাবশালী মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট। পোস্টের সম্পাদকীয়তে বলা হয়, সুদানের জাতিগত নিধনের সময় যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিলো তার তুলনায় এই অপরাধের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া অবাক করার মত দুবর্ল। নিরাপত্তাপরিষদ শুধু দায়সারা বিবৃতি দিতে পেরেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের বিবৃতিও ছিলো এর কাছাকাছি। সম্পাদকীয়তে আরো বলা হয়, অং সান সূচী এই নৃশংসতার মুখে দুঃখজনকভাবে নীরব রয়েছেন। সম্পাদকীয়তে আরো বলা হয়, জাতিসঙ্ঘে মিয়ানমারকে রক্ষা করছে চীন। এতে চীনের উপর কোন প্রভাব পড়ছে না কেন? এমনকি পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কোন পরোয়া করতে হচ্ছে না চীনকে, কেন? সম্পাদকীয় কলামের শেষ দিকে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত এই জাতিগত নিধন নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে প্রকাশ্য বিতর্কের পক্ষে অবস্থান নেয়া। * স্কাই নিউজ/ ব্রিটেনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজের সাংবাদিক আশীষ জোশি লিখেছেন, প্রাকাশ্যে দিনের বেলা পুরো একটা গ্রাম জ্বলতে দেখলাম বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে, অথচ আমি শুনেছিলাম, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী জ্বালাও পোড়াও অব্যাহত রেখেছে, তবে দিনের বেলায় নয়। কিন্তু এখন দেখি, ওরা যা করছে কোন রাখঢাক না রেখে প্রকাশ্যেই করছে। এতটা আমি ধারণা করিনি। আমি ধারণা করেছিলাম, আন্তর্জাতিক ক্ষোভ আর নিন্দা এড়াতে হয়ত তারা রাতের বেলা এসব নিপীড়নমূলক কাজ করে থাকে। মুহাম্মাদ সায়েম নামের এক প্রত্যক্ষদর্শীকে উদ্ধৃত করে আশীষ জোশি বলেন, যে গ্রামটি জ্বলছিলো সেখানে প্রায় ছয়হাজার মানুষের বাস ছিলো। সায়েমের দাবী, দুই তিন দিন আগে ওই আগুন জ্বলা শুরু হয়। মোবাইলে তোলা কয়েকটি ছবিও সায়েম আমাকে দেখান। * পাকিস্তানের জাতীয় দৈনিক জং লিখেছে, মুসলিম জনগোষ্ঠী বলেই রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধন ও গণহত্যা সম্পর্কে বিশ্ব আজ এরূপ নির্বিকার। এখনো যদি শতাব্দীর জঘন্যতম এই গণহত্যা রোধে জাতিসঙ্ঘ ও তার নিরাপত্তা পরিষদ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তাহলে বুঝতে হবে, বিশ্ব আজ পরিষ্কারভাবে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। সম্পাদকীয়তে মুসলিমবিশ্বের প্রতিও উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়েছে নির্যাতিত এই মুসলিম জনগোষ্ঠীটির পাশে দাঁড়ানোর জন্য। বলা হয়েছে, এটা মুসলিম উম্মাহর নৈতিক ও মানবিক দায়িত্বই শুধু নয়, বরং ঈমানেরও দায়িত্ব। * কাতারভিত্তিক সংবাদসংস্থা তার এক পর্যালোচনায় বলেছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মুসলিমদের বিরাট এক অংশ ভালোবেসে সূ চীকে ভোট দিয়েছিলো। তারা আশা করেছিলো, শান্তিতে নোবেলজয়ী সূ চী তাদের জন্য কিছু করবেন। কিন্তু বিজয়ের পর তিনি বেমালুম ভুলে গিয়েছেন নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর কথা। ভোটের আগে রোহিঙ্গাদের কাছে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা তো রাখেনইনি, উপরন্তু ঘাতক আর খুনী সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। আলজাজিরার সাংবাদিক সাইফ খালিদকে রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, সূ চীকে তারা আর বিশ্বাস করেন না। তিনি তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। আলজাজিরা সাংবাদিক বলেন, রোহিঙ্গা স্রোতে বাংলাদেশ যখন ভারাক্রান্ত, যখন বিষয়টি নিয়ে বিশ্বমিডিয়ায় চলছে তোলপাড় তখন সূ চী বালিতে মাথা গুঁজে তার ভাষণে বিস্ময় প্রকাশ করছেন যে, মুসলিমরা কেন পালিয়ে যাচ্ছে সেটা তার বোধগম্য নয়। * বিবিসি ও আলজাজিরা- এর খবরে প্রকাশ, জাতিসঙ্ঘের এক অনুসন্ধানী দল রোহিঙ্গা নারীদের উপর সঙ্ঘবদ্ধ যৌননির্যাতনের প্রমাণ পেয়েছে। তদন্তকারী দুই কর্মকর্তা বলেছেন, রোহিঙ্গাদের রাখাইন থেকে তাড়ানোর অস্ত্র হিসাবে সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণকে ব্যবহার করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিশনের উদ্যোগে তদন্তকারী দল তাদের তদন্তকার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের চলমান তদন্তকে ভিত্তি করে রোহিঙ্গাদের উপর সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় জাতিসঙ্ঘের ওয়েবসাইটে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখ্য জাতিসঙ্ঘ বারবার দাবী জানিয়ে আসছে তাদের তদন্তদলকে যেন রাখাইন অঞ্চলে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু মিয়ানমার সরকার এখনো পর্যন্ত অনুমতি দেয়নি। ফলে তদন্তদলকে রাখাইন সফর করা ছাড়াই ফিরে আসতে হয়েছে। * খালিজ টাইমস। খালিজ টাইমস তার এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, মিয়ানমার এখন আন্তর্জাতিক চাপ সামাল দেয়ার জন্য কাগুজে চুক্তিতে আগ্রহী হতে পারে। তাই বাংলাদেশকে এ বিষয়ে পূর্ণ কূটনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়। প্রতিটি রোহিঙ্গা যে ভয়াবহ স্মৃতি ধারণ করছে তাতে তারা ফিরে যেতে...