লিখেছেনে : মুহম্মদ বিন মিছবাহ
রোহিঙ্গাদের মানবিক বিপর্যয় যেমন ক্রমে ভয়াবহ থেকে ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে, তেমনি বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গাসঙ্কট জটিল থেকে জটিল রূপ ধারণ করছে। অথচ বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের যে কোন সমস্যার চেয়ে রোহিঙ্গাসঙ্কটের সমাধান অনেক সহজ; শুধু নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পঞ্চসদস্য যদি একটু সদিচ্ছা পোষণ করে। মিয়ানমার সরকার ও বিশ্ববিবেকের কাছে রোহিঙ্গাদের দাবী বলুন, আবেদন বা ফরিয়াদ যাই বলুন, খুব সামান্য। তারা রাষ্ট্রীয় খুনী, ধর্ষক ও হত্যাকারীদের বিচার বা শাস্তি চায় না। শুধু চায়, পূর্ণ নাগরিক মর্যাদায় জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার নিরাপত্তা। আরাকান রাজ্য ও বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন শেষে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী মন্ত্রী হেনশ নিজেও তা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের অবস্থা খুবই করুণ। আমরা যা দেখেছি তা এককথায় ভয়াবহ। তারপরো রোহিঙ্গারা নিরাপত্তা ও অধিকারের নিশ্চয়তা পেলে জন্মভূমিতে ফিরে যেতে চায়। রোহিঙ্গাদের বর্তমান প্রজন্মই শুধু নয়, বহু প্রজন্মই জন্মসূত্রে আরাকানের নাগরিক, সময়ের দিক থেকে যা কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত। তার চেয়ে বড় কথা, এক সময় রাষ্ট্রীয়ভাবেই তাদের নাগরিক অধিকার স্বীকৃত ছিলো, যা তাদের কাছ থেকে অন্যায় ভাবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে কেড়ে নেয়া হয়েছে। তো নিরাপত্তা পরিষদ, জাতিসঙ্ঘের ভাষায় ‘বিশ্বের সবচেয়ে নিষ্পেষিত জনগোষ্ঠীর’ এই সামান্য দাবী তো পুরা করতেই পারে। কেন হচ্ছে না এটা? যাদের অন্তরে ক্ষোভ রয়েছে তারা বলছে, রোহিঙ্গাদের আসল অপরাধ, ওরা মুসলিম। আমরা তা বলতে চাই না। আমরা বরং আশা করতে চাই, বৃহৎশক্তিবর্গ এবং তাদের হাতে জিম্মি জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ একটি নির্যাতিত সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর মানবিক অধিকার রক্ষার জন্য দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। তিব্র নিন্দা, জোরালো প্রতিবাদ ও আন্তরিক সমবেদনা ইতিমধ্যে যথেষ্ট শোনা হয়ে গেছে। বলা যায়, বিরক্তি ধরে গেছে। এখন আমরা ‘কাজ’ দেখতে চাই, ‘কাগজ’ আর দেখতে চাই না।অন্তত, ফিলিপাইনের প্রতিরক্ষা-মন্ত্রী দেলফিন লোরেনজানা যে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন সেটাকেই আমলে নিতে পারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। আসিয়ানের ৩১তম সম্মেলনের প্রাক্কালে তিনি বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাসঙ্কটের জরুরি ভিত্তিতে সমাধান না হলে বিক্ষুব্ধ রোহিঙ্গা যুবকরা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী-চক্রের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। আর সেটা বিশ্বের জন্য, বিশেষত আসিয়ানের জন্য মারাত্মক সঙ্কটের সৃষ্টি করতে পারে।’ অর্থাৎ নিজেদের স্বার্থেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ বিষয়ে আন্তরিক হতে হবে।পরিশেষে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আমাদের জোরালো আবেদন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আরো জোরদার করতে হবে, যাতে বিশ্বনেতৃবর্গ সমস্যার গুরুত্ব ও গুরুতরতা অনুধাবন করতে পারে। মিয়ানমারের প্রতি আমাদের কূটনৈতিক ভাষা আরো শাণিত হওয়া দরকার বলে অভিজ্ঞমহল মনে করে। সরকারের সদিচ্ছায় আস্থাশীল হয়ে আমরা এদিকেও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। কারণ কূটনৈতিক নমনীয়তাকে দুর্বলতা মনে করার একটা রেওয়াজ তো রয়েছেই। ‘বাপুরাম সাপুড়ে’-এর যুগ যে এটা নয় তা আমাদের বুঝতে হবে।