এককালের বার্মা, তারো আগের পাগান, আর বর্তমানের মিয়ানমার, আমাদের কাছে একসময় ব্রহ্মদেশ নামে পরিচিত ছিলো।বার্মা বা ব্রহ্মদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য হচ্ছে আরাকান। সুপ্রাচীন কাল থেকেই এ অঞ্চলের নাম আরাকান হলেও বর্তমানে রাখাইন নামে পরিচিত। এখন সরকারী দফতরে এবং নথিপত্রে আরাকান নামটির অস্তিত্ব আর খুঁজে পাওয়া যায় না, বরং সরকারীভাবে রাখাইন নামটির ব্যবহার বাধ্যতামূলক। আরাকান নাম ব্যবহার করা প্রশাসনিক অপরাধ বলে গণ্য হয়। অবশ্য স্থানীয় ভাবে, বিশেষত মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে আরাকান নামই এখনো সুপরিচিত ও সুপ্রচলিত। বার্মার (মিয়ানমারের) সাবেক সামরিক শাসক নে উইন ১৯৭৪ সালে আরাকানের নাম পরিবর্তন করে এটিকে মিয়ানমারের একটি অঙ্গরাজ্য বলে ঘোষণা করেন।আরাকানে সুদূর অতীত থেকে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বাস করে আসছে, তারমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি জনগোষ্ঠী হচ্ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। রোহিঙ্গা মানেই মুসলিম নয়। হিন্দু রোহিঙ্গাও রয়েছে যথেষ্ট সংখ্যায়। তবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সিংহভাগই ইসলাম ধর্মের অনুসারী। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ইতিহাস যদি লিখতে হয় তাহলে প্রথমেই আমাদের প্রামাণ্যভাবে জানতে হবে এ জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ও উন্মেষ কবে এবং কীভাবে?কারণ কোন জাতি, সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠীর প্রকৃত পরিচয় জানতে হলে সবার আগে সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক যে প্রশ্নটি সামনে আসে তা হলো ঐ জাতি বা জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ও উন্মেষের ইতিহাসটি উদ্ধার করে আনা। সেটি সম্ভব হলে অনেক জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সমাধান আপনাআপনি হয়ে যায়। বিভিন্ন উদ্দেশ্যে যারা ইতিহাসবিকৃতির বা ইতিহাসকে কেন্দ্র করে ধূম্রজাল সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালায় তাদের প্রতিরোধ করা এবং তাদের মিথ্যাচার সচেতন মানুষের সামনে নিয়ে আসা সহজ হয়ে যায়। রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে আলোচনায় যাওয়ার আগে প্রেক্ষাপটরূপে আরাকান রাজ্যটি সম্পর্কেও কিছু জেনে নেয়া দরকার। খৃস্টপূর্ব ২৬৬৬ থেকে ১৭৮৪ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় চারহাজার বছরের ইতিহাসে আমরা আরাকান ভূখ-ের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পারি। বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্ব সীমান্তে নাফনদীর অপর পারে আরাকানের অবস্থান। উত্তরে রয়েছে চীন ও ভারত। দক্ষিণ ও পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর।নাফনদীর মধ্যাংশ বাংলাদেশের সঙ্গে এর আন্তর্জাতিক সীমান্তরেখা হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। পার্বত্য অঞ্চলে সামান্য পরিমাণ স্থলসীমান্তও রয়েছে। নাফনদী দৈর্ঘ্যে প্রায় পঞ্চাশ মাইল, প্রস্থে এক থেকে দেড় মাইল। বিভিন্ন ছোটবড় জলপ্রবাহ ও খাল মংডু অঞ্চল দিয়ে নাফনদীতে মিলিত হয়েছে। এর পর তা বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। নাফনদীর পূর্বতীরে আরাকানের মংডু অবস্থিত। পশ্চিমতীরে হচ্ছে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার টেকনাফ অঞ্চল।এটা প্রমাণিত সত্য যে. দূর অতীত থেকে আরাকান কখনোই বার্মা বা ব্রহ্মদেশের অংশ ছিলো না। ভৌগলিক বাস্তবতার কারণে তা সম্ভবও ছিলো না। কারণ আরাকানের পূর্বদিকে রয়েছে বিশাল ও সুউচ্চ ইয়োমো পর্বতমালা, যা দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মত আরাকানকে বার্মা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। দুর্গম গিরিপথেই শুধু নির্দিষ্ট একটা সময় সীমিত পর্যায়ে বার্মার সঙ্গে আরাকানের যোগাযোগ রক্ষা করা যায়। এমনকি সৈন্যচলাচলও স্বাভাবিকভাবে করা যায় না। একারণেই দেখা যায়, দ্বিতীয় বিশ্ব-যুদ্ধের সময় জাপানিরা নৌপথে আরাকান দখল করেছিলো, স্থলপথে নয়। ঐতিহাসিকগণ এ বিষয়ে একমত যে, আরাকান ও মিয়ানমারের মাঝখানে ভৌগলিক প্রাচীররূপে ইয়োমো পর্বতমালা বিদ্যমান থাকার কারণেই সুদীর্ঘ কাল আরাকান তার রাষ্ট্রীয় স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীন অস্তিত্ব রক্ষা করতে পেরেছিলো। একই কারণে ইতিহাসের শুরু থেকে বার্মার চেয়ে চট্রগ্রাম ও কক্সবাজারই ছিলো আরাকানের কাছে অধিক পরিচিত। এবং এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের সঙ্গে আরাকানীদের যোগাযোগ, সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান ছিলো সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ। আরাকানের স্বাধীনতা স্থায়ীভাবে বিলুপ্ত হয় মূলত ১৭৮৪ খৃস্টাব্দে। ঐ সময় বর্মী রাজা বোধপায়া আরাকান দখলের উদ্দেশ্যে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন, যা সম্ভব হয়েছিলো আরাকানের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতির কারণে। বোধপায়া এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আরাকানের শেষ রাজা থামাডোকে পরাজিত করেন এবং নির্মমভাবে হত্যা করেন। এভাবে স্বাধীন আরাকান রাজ্য তার সুদীর্ঘ কালের স্বাধীনতা হারিয়ে বার্মার অন্তর্ভুক্ত হয়। তখন থেকে এখন পর্যন্ত আরাকান বার্মার শাসনাধীন একটি প্রদেশরূপে গণ্য হয়ে আসছে। ইতিহাস প্রমাণ করে, আরাকানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অধিবাস এই বার্মিজ আগ্রাসনেরও বহু শতাব্দী আগে থেকে।* প্রাচীন আরাকানের আয়তন কখনো স্থির ছিলো না। কারণ বাংলার সঙ্গে এর সীমানা বারবার পরিবর্তিত হয়েছে। বাংলার কক্সবাজার, রামু, এমনকি চট্টগ্রাম অঞ্চলটিও বিভিন্ন সময় স্বাধীন আরাকান রাজ্যের শাসনাধীনে ছিলো।মোগল আমলে সুবে বাংলার শাসক শায়েস্তাখান ১৬৬৬ খৃস্টাব্দে বৃহত্তর চট্টগ্রাম জয় করে বাংলার অন্তর্ভুক্ত করেন। তখন থেকে আরাকানের ভৌগলিক আয়তন মোটামুটি একটা স্থায়ী অবয়ব ধারণ করে। তখন থেকে বৃটিশ শাসনের অবসান পর্যন্ত আরাকানের আয়তন ছিলো ২০০০০ (বিশহাজার) বর্গমাইল। ১৯৪৮ খৃস্টাব্দে বার্মা যখন বৃটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে তখন প্রশাসনিক সুবিধার কথা বলে পার্বত্য আরাকানকে বার্মার চীন প্রদেশের সঙ্গে এবং দক্ষিণ আরাকানের কিছু অংশ নি¤œবার্মার ইরাবতী অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফলে বর্তমান আরাকানের আয়তন কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৪২০০ (চৌদ্দ হাজার দু’শ) বর্গমাইল। এই ভৌগোলিক কাটাচেরার সময় যদিও বলা হয়েছে প্রশাসনিক সুবিধা ও প্রয়োজনের কথা, কিন্তু এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য আরো গভীরে নিহিত ছিলো বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। অন্তত পরবর্তী ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বিষয়টির সত্যতা সম্পর্কে আর কোন সন্দেহই থাকে না।আরাকানের প্রধান প্রধান শহর হলো আকিয়াব, বুচিদং, মংডু, টংগু, মেনাং, মেবন, রামব্রী প্রভৃতি। এর মধ্যে আকিয়াব হচ্ছে সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ শহর। এটি আরাকানের প্রধান নদী কালদানের মোহনায় অবস্থিত। আকিয়াব উত্তর আরাকানের প্রধানসমুদ্র বন্দর। জলপথই হলো আরাকান রাজ্যে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রধান মাধ্যম। আরাকানে রেলপথ বলতে কিছু নেই।আরাকানের জমি খুব উর্বর।আবহাওয়াও কৃষিকাজের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। ধান এখানকার প্রধান শস্য। তবে ভুট্টা, আখ, আলু, বাদামও প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয়। বিভিন্ন সব্জি ও ফলফলাদিও ভালো উৎপন্ন হয়। প্রাচীন কাল থেকে চাল হচ্ছে আরাকানের প্রধান রপ্তানী পণ্য। এখান থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চাল রপ্তানী হতো, যার কারণে এতদঞ্চলের নাম ছিলো ধান্যবতী। এমনকি বাংলাদেশও বিভিন্ন সময় প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বার্মা থেকে চাল আমদানী করে থাকে। চাল ছাড়াও মাছ, মশলা, কাঠ, লবণ প্রভৃতি এখান থেকে রপ্তানী হয়। বনজ সম্পদও আরাকানে কম নয়। ভূমির প্রায় সত্তর শতাংশ পর্বত ও বন হওয়ার কারণে বাঁশ, কাঠ ও বনজ সম্পদ প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয়। উন্নত সেগুন কাঠের জন্য প্রাচীন কাল থেকেই আরাকানের বেশ খ্যাতি রয়েছে। এক হিসাবে জানা যায়, আরাকানের পাহাড়ী অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন সেগুন কাঠ বার্মার মোট উৎপাদিত কাঠের প্রায় পনের শতাংশ। এ ছাড়া পিনকেডু নামে পরিচিত লোহাকাঠ এবং বাঁশ প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয়। আরাকানের বনাঞ্চলের মধু খুবই উন্নত ও সুস্বাদু বলে সুখ্যাতি লাভ করেছে প্রাচীন কাল থেকেই।আরাকানরাজ্য মৎস সম্পদেও সমৃদ্ধ। একে তো প্রায় বাংলাদেশের মত আরাকানও নদীমাতৃক দেশ, তদুপরি রয়েছে মংডু থেকে শুরু করে তিনশ ষাটমাইল দীর্ঘ সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল। এসব অঞ্চলের বিভিন্ন মোহনা থেকে বিপুল পরিমাণ সামুদ্রিক মাছ আহরিত হয়। খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদে আরাকান রাজ্য খুবই সম্ভাবনাময়। তেল কয়লা ও সোনারূপার বিপুল মজুদ রয়েছে বলে বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক জরীপ ও অনুসন্ধানে জানা গেছে। বিশ্বে যে কয়টি স্থানে ভালো মানের ইউরেনিয়াম পাওয়া যায় তার মধ্যে আরাকানরাজ্য একটি। বস্তুত আরাকানী জনপদের জন্য এই সম্ভাব্য খনিজ সম্পদই হয়ে উঠেছে দুর্ভাগ্যের বড় কারণ। চীন ও ভারতসহ অনেক দেশেরই এখন ‘আগ্রহী দৃষ্টি’ আরাকানরাজ্যের ভূমির প্রতি। যদিও কৌশলগত সামরিক গুরুত্বও কম বড় কারণ নয়।* আরাকানে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আগমন ঘটেছে বিপুল পরিমাণে। কোন অঞ্চলে সাধারণত এমন দেখা যায় না। মূলত বিপুল পরিমাণ ভূমিসম্পদ এবং ভূমির উর্বরতা ও কৃষিসমৃদ্ধির কারণেই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশ থেকে এ অঞ্চলে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আগমন ঘটেছে। একটা বিষয় ঐতিহাসিকগণ বেশ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। সেটা হলো, ভারতবর্ষে আর্যদের আগমনে স্থানীয় দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যেরূপ সঙ্ঘাত-সঙ্ঘর্ষের কাহিনী ইতিহাসে দেখা যায় সেরূপ যুদ্ধ হানাহানির কথা আরাকানের ইতিহাসে পাওয়া যায় না। স্থানীয় ও বহিরাগতের মধ্যে সাধারণভাবে প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের কথাই জানা যায়। এর একটা কারণ যেমন স্থানীয়দের ভূমি ও সম্পদের প্রাচুর্য তেমনি আরেকটা কারণ Ñ এবং বড় কারণ Ñ হলো এখানে আগমনকারী জনগোষ্ঠী আর্যজনগোষ্ঠীর মত আগ্রাসী মনোভাবের ছিলো না। তদ্রƒপ তাদের মধ্যে রক্তকৌলীন্যের অহং ছিলো না। বস্তুত যুগে যুগে দেশ-মহাদেশে এগুলোই ছিলো বহিরাগত ও স্থানীয়দের মধ্যে সহিংস সঙ্ঘাতের মূল উপাদান।* আরাকানের সঠিক জনসংখ্যা, বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের প্রকৃত জনসংখ্যা সঠিকভাবে বলার তেমন কোন সুযোগ নেই। কেননা রহস্যজনক কারণে দীর্ঘ দিন থেকে ঐ অঞ্চলে আদমশুমারি করা হচ্ছে না। তবে বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে জনসংখ্যাবিশেষজ্ঞগণ আরাকানের একটি শ্রেণীবিন্যস্ত জনসংখ্যা নির্ধারিত করেছেন। সে হিসাবে আরাকানের মোট জনসংখ্যা পঞ্চাশ লাখ। তার মধ্যে ত্রিশ লাখ হচ্ছে মুসলমান। অর্থাৎ মুসলিম জনসংখ্যা হচ্ছে মোট জনসংখ্যার ষাট ভাগ। তবে বিশেষজ্ঞদের নির্ধারিত এই জনসংখ্যা এখন আর আছে বলে মনে হয় না। কারণ বিভিন্ন সময় কঠিন নির্যাতনের মুখে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা আরাকান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে, বা তাদের বিতাড়িত করা হয়েছে। এক হিসাবে শুধু সৌদি আরবেই বিভিন্ন সময় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা হিজরত করেছে। পাকিস্তানেও হিজরতকারী রোহিঙ্গাদের সংখ্য তিন লাখের কম নয়। অন্যান্য দেশেও দু’লাখের মত গিয়েছে। এমনকি এত যে বৈরী দেশ ভারত, সেখানেও চল্লিশ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম আশ্রয় গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি ভারত আরাকান পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আশ্রয়গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ‘পুশ’ করার ঘোষণা দিয়েছে এবং এসিড টেস্ট হিসাবে মাঝে মধ্যে চেষ্টাও করছে।সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে হিজরতকারী রোহিঙ্গাদের সংখ্যা দশলাখ ছাড়িয়ে গেছে। তাছাড়া বিভিন্ন সময় বর্মীজ নিপীড়কদের হাতে বহু সংখ্যক রোহিঙ্গা মুসলিম নিহত হয়েছে। এমনকি ১৯৪২ সালের কুখ্যাত দাঙ্গা ও গণহত্যার সময়ও এক লাখের বেশী মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছে। এভাবে সবক’টি সংখ্যা মিলিয়ে ত্রিশ লাখ মুসলিম জনসংখ্যার দাবী অযৌক্তিক মনে হয় না। তবে স্বাধীনতাপূর্ব ১৯৩১ এর আদমশুমারি অনুযায়ী আরাকানের জনসংখ্যা ছিলো ১২,৯৯,৪১২। তার মধ্যে বৌদ্ধ ৮,৭৮,২৪৪ এবং মুসলিমদের সংখ্যা ছিলো ৩,৮৮,২৫৪ সুতরাং মোটামুটি ভাবে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, বর্তমান আরাকানের জনসংখ্যা পঞ্চাশ লাখ, যার মধ্যে মুসলিমদের শতকরা হার হবে চল্লিশ। একটা বিষয় সবসময় লক্ষ্য করা যায়। আর তা এই যে, বিশ্বের যে সকল দেশে মুসলিম সংখ্যালঘু রয়েছে। সেখানে সরকার মুসলিমদের জনসংখ্যা কম করে দেখাতে চায় কৃত্রিম আদমশুমারীর বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে। এটা আমাদের প্রতিবেশী ভারতেও যেমন হয়, চীন-রাশিয়াতেও হয়। এমনকি হয় ইউরোপ আমেরিকার মত ‘মানবতাবাদী’ দেশ-গুলোতেও। বৃটিশ ভারতেও এটা ঘটেছে। সুতরাং ১৯১২ বা ১৯৩১ সালে বৃটিশদের পরিচালিত আদমশুমারি ও জরীপে আরাকানের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর যে জনসংখ্যা ও অনুপাত প্রকাশ পেয়েছে তার দ্বারা যে খুব একটা নির্ভরযোগ্য চিত্র পাওয়া যাবে না, বোধহয় বলা যায়।ইসলামপূর্ব প্রাচীন আরাকানমোটামুটি নির্ভরযোগ্য তথ্যের উপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিকগণ বলেন, প্রাচীন আরাকানে মারুবংশীয়দের রাজত্ব ছিলো খৃস্টপূর্ব ২৬৬৬ এর দিকে। আরো পরে বেনারশ অঞ্চলের এক রাজা আরাকানে তার একটি রাজ্য স্থাপন করেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি দক্ষিণ আরাকানে তার রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেন, যার নাম ছিলো রামাবতী বা রামব্রী। এই রাজা ও তার বংশধর দীর্ঘ দিন আরাকানে রাজত্ব করেন। এভাবে একাধিক রাজবংশের অধীনে দু’হাজার বছরেরও বেশী সময় পার হওয়ার পর খৃস্টের জন্মের প্রায় দেড়শ বছর পর আরাকানে বিখ্যাত চন্দ্রসূর্য বংশের রাজত্ব শুরু হয়।চন্দ্রসূর্য বংশের রাজত্বকালেখৃস্টীয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যভাগে মগধ অঞ্চলের রাজা চন্দ্রসূর্য সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম অধিকার করেন বলে জানা যায়। এভাবে আরাকান-রাজ্য বড় আকার ধারণ করে। তবে এই রাজ্যের রাজধানী ছিলো কালাদান নদীর তীরে অবস্থিত ‘ধান্যাবতী’।এই রাজা নিজে হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় ধর্মের প্রভাব গ্রহণ করেছিলেন। তাই তার রাজসভায় হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় ধর্মের অনুসারীরাই স্থান লাভ করেছিলো। কালক্রমে চট্টগ্রামে হিন্দু ধর্ম এবং আরাকানে বৌদ্ধ ধর্ম বিস্তার লাভ করে। আর ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির বিস্তার তো অনিবার্য বিষয়।খৃস্টীয় পঞ্চম শতক পর্যন্ত সুদীর্ঘ কাল চট্টগ্রাম ও আরাকান অখ- রাজ্যরূপে চন্দ্রসূর্য বংশের অধীনে শাসিত হয়।প্রায় সব ঐতিহাসিক এ বিষয়ে একমত যে, চন্দ্রসূর্য বংশের মোট ২৫ জন রাজা ধারাবাহিকভাবে ৭৮৮ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত আরাকান শাসন করেন। তার মধ্যে প্রথম এগার জনের সময় চট্টগ্রাম ছিলো আরাকান -রাজ্যের অঙ্গরাজ্য। কিন্তু পরবর্তী- কালে চট্টগ্রাম অঞ্চল আরাকান-রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মূলত সামরিক অভিযানের মাধ্যমে সমতটের খড়গ রাজবংশ এ অঞ্চলকে আরাকান থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আপন রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়।সিত্তাউং প্যাগোডায় সংরক্ষিত আনন্দচন্দ্রের স্তম্ভলিপি থেকে জানা যায়, ধান্যবতীতে চন্দ্রসূর্য বংশের শাসনকালে বৈশালা নামক স্থানে রাজধানী স্থাপন করে একটি চন্দ্রবংশীয় রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়।সংস্কৃতি ভাষায় লিখিত ঐ স্তম্ভলিপির বর্ণনা অনুযায়ী বোঝা যায়, বৈশালীতে চন্দ্রবংশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ধান্যবতীর চন্দ্রসূর্য বংশের পঞ্চম রাজা সূর্যম-লের (৩১৩Ñ৩৭৫) রাজত্বকালে। আর এ রাজবংশের রাজত্ব স্থায়ী হয় চন্দ্রসূর্যবংশের ২৩তম রাজা সূর্যক্ষিতির (৭১৪Ñ৭২৩) রাজত্বকাল পর্যন্ত এ রাজবংশের রৌপ্যমুদ্রা, তা¤্রশাসন ও শিলালিপি থেকে জানা যায়, তাদের রাজ্যশাসনব্যবস্থা সর্বদিক থেকে চন্দ্রসূর্যবংশের চেয়ে উন্নত ছিলো। শুধু একটি ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে ছিলো, আর সেটা হলো ‘প্রজাহিতৈষণা’।ধান্যবতীর চন্দ্রসূর্যবংশের রাজত্বের পর বৈশালীকে রাজধানী করে মহতইঙ্গ চন্দ্র ৭৮৮ খৃস্টাব্দে আরাকানের শাসনক্ষমতা গ্রহণ করেন। এভাবে চন্দ্রবংশের রাজত্বের সূচনা হয় ৭৮৮ খৃস্টাব্দে এবং মোট নয়জন রাজার মাধ্যমে ৯৫৭ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত বংশপরম্পরায় ১৬৯ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। নবম রাজার নাম ছিলো সূলাতা ইঙ্গচন্দ্র। তিনি তার পুত্র ঘামিংঘাতুম-এর হাতে রাজ্য অর্পণ করে যেতে পারেননি। কারণ ৯৫৭ খৃস্টাব্দে মিউ গোত্রের প্রধান অমাথু আরাকানের সিংহাসন অন্যায়ভাবে দখল করে বসেন। এই গোত্রপ্রধান ও তার ভ্রাতুষ্পুত্র পাইফিউ ৯৯৫ পর্যন্ত ৩৭ বছরের মত সিংহাসন দখলে রাখেন। এরপর সুলাতাইঙ্গচন্দ্রের পুত্র ঘামিংঘাতুম পিতার হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন।ঘামিংঘাতুম রাজ্য পুনরুদ্ধার করলেও শাসনব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা তার পক্ষে আর সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ বিশ বছরের নিরলস প্রচেষ্টায় সবকিছু তিনি যখন মোটামুটি গুছিয়ে এনেছেন তখনই শুরু হয়ে যায় ইয়োমো পর্বত অতিক্রম করে বার্মীজ জংলী উপজাতির লুণ্ঠন ও আগ্রাসন। রাজা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন আরাকানের স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য ১০১৮ সাল পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত তিনি নিহত হওয়ার মাধ্যমে সিংহাসনের রক্ত-মূল্য পরিশোধ করেন। এর ফল এই হলো যে, তার পুত্র (সুলাতাইঙ্গচন্দ্রের পৌত্র) খেত্তাথিং পিনসা নগরে নতুন রাজধানী স্থাপন করে রাজত্ব শুরু করেন। পনেরজন শাসকের মাধ্যমে এর ধারাবাহিকতা ১২৭৯ পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়। তবে মাত্র পাঁচজন শাসক স্বাধীনভাবে রাজ্যশাসন করতে পেরেছেন ১০৫৪ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত।একটি Ñবরং কয়েকটিÑ শক্তিশালী স্বাধীন রাজ্য ছিলো সে সময়ের ব্রহ্মদেশে। তার মধ্যে সবচে শক্তিশালী ছিলো পঁগারাজ্য। পঁগারাজ আনওয়ারথা ১০৫৭ খৃস্টাব্দে চট্টগ্রাম ও বৃহত্তর কুমিল্লা দখল করে পঁগারাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি তখন এতই প্রতাপশালী হয়ে ওঠেন যে, পিনসার রাজাগণ নিজেদেরকে পঁগার করদরাজারূপে মেনে নিতে বাধ্য হন। এ ধারা চলতে থাকে হাজার সাতান্ন থেকে ১২৭৯ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত। অবশ্য এর মধ্যে চড়াই ছিলো, উৎরাই ছিলো। রাজধানীও একাধিকবার পরিবর্তন করতে হয়েছে।১২৭৯ থেকে ১৪০৬ পর্যন্ত আরাকানে স্বাধীন রাজ্যশাসন ফিরে এসেছিলো। রাজা মেংদী মূলত ১২৮৩ সালে আরাকানের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পঁগারাজ তখন এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন যে, স্বাধীনচেতা মেংদীকে বশে আনার জন্য কিছুই করতে পারেননি।রাজা মেংদী ছিলেন রাজধানী লেংগিয়েতকে কেন্দ্র করে রাজ্য শাসনকারী আরাকানের করদরাজাদের নবম। তিনি ১৩৮৫ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত একশ ছয়বছরকাল অতি প্রতাপের সঙ্গে রাজ্যপরিচালনা করেন। তার সময় চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে ব্রহ্মপুত্রনদের তীর ঘেঁষে বিশাল অঞ্চল আরাকানরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।এখান থেকে শুরু হয় আরাকানের ভূমিতে ইসলামের প্রবেশকাল। পর্যায়ক্রমে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উত্থান ও পতন সবই দেখতে পায় বিচিত্র ইতিহাসের অধিকারী আরাকানের জনপদ। সে আলোচনায় যাওয়ার আগে একটা কথা বলে রাখা সঙ্গত মনে হয়। আরাকানের ভূমিতে মুসলিম জনগোষ্ঠী ইসলামকে তার স্বকীয় মহিমায় বিকাশ লাভ করার জন্য তেমন একটা অনুকূল পরিবেশ তৈরী করে দিতে পারেনি। বরং ইসলাম ছিলো ইসলামের মত, মুসলিম জনগোষ্ঠী ছিলো তাদের মত করে। পাকভারত উপমহাদেশে এবং বিশেষ করে বাংলাদেশের ভূমিতে যাদের হাতে ইসলামের প্রবেশ ও প্রকাশ এবং বিস্তার ও বিকাশ ঘটেছে তারা ছিলেন ব্যতিক্রম। তারা সর্বোচ্চ সুন্দররূপে ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই এখানে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী যে অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে এবং যে স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে ইসলাম গ্রহণ করেছে ওখানে এর কাছাকাছি অবস্থাও তৈরী হতে পারেনি। বস্তুত এটাই হচ্ছে আরাকানরাজ্যে ইসলামের প্রবেশ ও উত্থানের সবচে’ কষ্টের দিক।আরাকানে ইসলামআরাকানে ইসলামের প্রবেশ ও বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করার পূর্বে আমাদের জানা দরকার আরবের সঙ্গে এ অঞ্চলের সম্পর্কের সূচনা কবে হয়েছে এবং তার শেকড় মাটি ও মানুষের কত গভীরে প্রোথিত ছিলো। কারণআরবরাই ছিলো ইসলামের প্রথম ধারক ও বাহক। পাকভরত উপমহাদেশের ক্ষেত্রেও উপরে বর্ণিত নীতি সমানভাবে প্রযোজ্য।ইতিহাসের পাতায় এ সত্য সমুজ্জ্বল যে, আরবের হিজাযে ইসলামের আবির্ভাবের অনেক আগে থেকে, অর্থাৎ পঞ্চম শতকের বহু পূর্ব থেকেই এ অঞ্চলের সঙ্গে নৌপথে আরবদের বাণিজ্যিক ও মানবিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো। এমনকি ইসলামের আবির্ভাবভূমি হিজাযের, মক্কার কোরাইশের সঙ্গেও ছিলো একই সূত্রে একই সম্পর্ক।ইতিহাস আমাদের বলে, খৃস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর পূর্ব থেকে ইয়ামেন ও হাদরামাউতের আরবগোত্রগুলো দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক পথে ভারত, বার্মা ও চীনের ক্যান্টন বন্দর পর্যন্ত, যা আরবদের কাছে ‘খানফু’ নামে পরিচিত ছিলো, আসা যাওয়া শুরু করে দিয়েছিলো। হিজাযের ও মক্কার কোরাইশের বাণিজ্য ছিলো স্থলপথে প্রধানত রোম ও পারস্যশাসিত অঞ্চলে। কিন্তু ঐ সময়কালে রোম ও পারস্যের মধ্যে লাগাতার প্রবল যুদ্ধবিগ্রহের কারণে স্থলবাণিজ্যের পথ বিপদসঙ্কুল ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। তখন কোরাইশ আরবদের নৌবাণিজ্যের পূর্বঅভিজ্ঞতার সাহায্য নিয়ে নিজেরা একই পথে বাণিজ্যিক সফর শুরু করে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকের গোড়ার দিকে তারা দক্ষিণ ভারতের মালাবার, কালিকট এবং আরো পূর্বদিকে চট্টগ্রাম ও আকিয়াবের উপকূলীয় কেন্দ্রগুলো পর্যন্ত নিয়মিত সম্পর্ক স্থাপন করে। এমনকি ঐ সকল স্থানে তাদের বাণিজ্যিক উপনিবেশও গড়ে ওঠে।একটা বিষয় মনে রাখলে ইসলাম-পূর্ব আরবের সঙ্গে এ অঞ্চলের সম্পর্ক ইসলামের জন্য কতটা ইতিবাচক ও কল্যাণকর ছিলো তা স্পষ্ট হয়ে ওঠবে। বিষয়টি এই যে, ইসলামের সংস্পর্শে বা ছায়াতলে আসার পূর্বেও আরবদের মধ্যে এমন কিছু জাতীয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিলো যা অন্যান্য জাতির মধ্যে তখনো কমই ছিলো। এগুলোর মধ্যে রয়েছে তাদের চারিত্রিক দৃঢ়তা, সাহস ও বীরত্ব, বদান্যতা ও অতিথিসেবা, সততা, বিশ্বস্ততা, সত্যবাদিতা ও ওয়াদারক্ষা প্রভৃতি। এসকল গুণের কারণে আরবজাতির প্রতি এ অঞ্চলের মানুষের অন্তরে একটি কোমল অনুভূতি বিদ্যমান ছিলো। অন্তত থাকাটাই স্বাভাবিক ছিলো।যখন আরবের ভূমিতে ইসলামের আবির্ভাব ঘটলো, এই মুশরিক ও মূর্তিপূজক আরব বণিকদের মাধ্যমেই ইসলামের আগেই ইসলামের আলোচনা এ অঞ্চলে পৌঁছে গিয়েছিলো বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কয়েক বছর পরে স্বয়ং আরবমুসলিমগণ ইসলামের পাকীযা আখলাক ও চরিত্র নিয়ে এ অঞ্চলে পৌঁছে যায়। বাহ্যত তাদের উদ্দেশ্য বাণিজ্য হলেও মূল লক্ষ্য হতো ইসলামের দাওয়াত ও তাবলীগ। কারণ এটা ছিলো তাদের প্রতি তাদের দ্বীন ও শরীয়তের অপরিহার্য পালনীয় বিধান।সপ্তম শতক থেকে একাদশ শতক পর্যন্ত মুসলিম বণিকগণ ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে, বিশেষ করে মালাবার ও চট্টগ্রাম থেকে কাঠ, মশলা, সুগন্ধিদ্রব্য ও ঔষধি গাছগাছড়া সংগ্রহ করে চীন পর্যন্ত নিয়ে যেতো, আবার ফেরার পথে নিজেদের দেশেও নিয়ে যেতো।মূলত এই আরব মুসলিম বণিকদের জীবন ও চরিত্রে ইসলামের সৌন্দর্য অবলোকন করে এবং তাদের মুখে ইসলামের তাওহীদ ও ঈমানের বাণী শুনে ইসলামের প্রতি এ অঞ্চলের মানুষ আকৃষ্ট হতে থাকে।আরাকানের চন্দ্রবংশের প্রথম রাজা মহতইঙ্গ চন্দ্র ৭৮৮ খৃস্টাব্দে বৈশালীতে রাজধানী স্থাপনপূর্বক রাজত্ব শুরু করেন, এ কথা আগেই বলা হয়েছে। ধর্মের বিষয়ে তিনি ছিলেন বেশ উদার। ফলে মুসলিম বণিকদের পক্ষে বাণিজ্যের সঙ্গে সঙ্গে ইসলামপ্রচারের জন্যও সহজ ও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়।উদার নীতির এ রাজার আমলেই আরাকানের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে কয়েকটি জাহাজের একটি আরব বাণিজ্যবহর ডুবে যাওয়ার ঐতিহাসিক ঘটনা সঙ্ঘটিত হয়।ঐতিহাসিক এ কারণে যে, এঘটনাই মূলত উপলক্ষরূপে দেখা দেয় আরব মুসলিম বণিকদের রাজ- দরবারে প্রবেশের এবং স্থায়ীভাবে তাদের এ অঞ্চলে বসবাসের, যা ইসলামপ্রচারের ক্ষেত্রে একটি সুদূরপ্রসারী বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলো।স্থানীয় লোকেরা জাহাযের লোকদের উদ্ধার করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং যেহেতু এটি ছিলো বিদেশী বণিকদের জাহাযডুবির মত মানবিক দুর্যোগের ঘটনা, যা স্থানীয়ভাবে ছিলো আলোড়ন সৃষ্টিকারী সেহেতু রাজকর্মচারীদের মাধ্যমে তারা উদ্ধারপ্রাপ্ত লোকদের রাজদরবারে নিয়ে যায়। রাজা তাদের আখলাক ও আচার আচরণে এতই মুগ্ধ হন যে, তিনি তাদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করেন এবং তাদেরকে আরাকানে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দান করেন, বরং ‘রাজঅনুরোধ’ দ্বারা তাদের সম্মানিত করেন।মুসলিমগণ স্থানীয় নারীদের বিবাহ করে স্থায়ীভাবে আরাকানে বসবাস শুরু করেন। এভাবে অত্র অঞ্চলে মুসলমানদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। দশম শতাব্দী পর্যন্ত অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, মুসলমানদের সংখ্যা যথেষ্ট লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। তাছাড়া বাণিজ্যিক তৎপরতা ও দাওয়াতি মেহনতের কল্যাণে আরাকানের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে শুরু করে মেঘনার পূর্বতীরবর্তী বিস্তীর্ণ বন্দর-জনপদে ইসলামের প্রতি সন্তোষ-জনক কোমল অনুভূতি সৃষ্টি হয়। এমনকি রাজা ও রাজমহলও তার বাইরে ছিলো না। এসময় আরেকটি বিষয় যুক্ত হয়। অর্থাৎ শুধু এ অঞ্চলে ইসলামপ্রচারের উদ্দেশ্যে ছূফী-দরবেশদের আগমণ শুরু হয়, যা স্থানীয় লোকদের ব্যাপকভাবে ইসলামগ্রহণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। এটা সম্ভব হয়েছিলো মূলত এ কারণে যে, চট্টগ্রাম অঞ্চল দীর্ঘ কাল আরাকান রাজ্যের অধীনে ছিলো এবং উভয় অঞ্চলের লোকদের পরস্পর যাতায়াত ছিলো। ফলে চট্টগ্রামে আগমনকারী ইসলামপ্রচারকারী ছূফী-দরবেশগণও আরাকান অঞ্চলে যাওয়া শুরু করেন।রাজা নরমিখলা থেকে আধুনিক পূর্ব আরাকানরাজা নরমিখলা হলেন লেংগিয়েত রাজাদের মধ্যে দশম ও শেষ রাজা। তার রাজত্ব মাত্র দু’বছর স্থায়ী হয়েছিলো। সিংহাসনে তার অভিষেকই হয়েছিলো অন্যায় পথে। অর্থাৎ তিনি আপন চাচা থিংগাথুকে হত্যা করে সিংহাসনের উপর জবরদখল কায়েম করেন। তার এই অন্যায় রাজত্ব মাত্র দু’বছর স্থায়ী হয়। এরই মধ্যে এই যুবক ‘রাজা’ একটি কলঙ্কজনক কাজ করে বসেন। অর্থাৎ সেখানকার জনৈক সামন্তরাজার রূপসী বোনকে জোরপূর্বক বিবাহ দ্বারা ‘রাজকৃপা’ প্রকাশ করেন। সামন্তরাজ এর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য বর্মীরাজ মেঙ শো ওয়াই-এর সাহায্য প্রার্থনা করেন। প্রাচীন ইতিহাস থেকে শুরু করে আধুনিক ইতিহাস পর্যন্ত পৃথিবীর সকল অঞ্চলের রাজ্য ও রাজনীতিতে যা ঘটেছে এখানেও তাই ঘটলো। বর্মীরাজ যখন দেখলেন, রাজ্যদখল ও রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের সুবর্ণ সুযোগ, তখন তিনি কাল বিলম্ব না করে সামন্তরাজের ‘মানবিক আবেদনে’ সাড়া দিলেন এবং ১৪০৬ খৃস্টাব্দে ত্রিশহাজার সৈন্য নিয়ে পথের বিপদ-ঝুঁকি উপেক্ষা করে আরাকান আক্রমণ করেন। রাজা নরমিখলা যুদ্ধে পরাজিত হলেন, তবে পরাস্ত হলেন না। অর্থাৎ ধরা না পড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন এবং বাংলার রাজধানী গৌড়ে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। বস্তুত বিভিন্ন ঘটনাচক্রের মাধ্যমে রাজা নরমিখলা ইসলাম ও মুসলিম শক্তির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, যা পরবর্তীকালে আরাকানের জনপদে ইসলামের জনভিত্তিকে খুব প্রভাবিত করে। অধিকাংশ ঐতিহাসিক বিষয়টিকে ইতিবাচকরূপে বর্ণনা করলেও দু’একজন প্রাজ্ঞ ঐতিহাসিক এর নেতিবাচক দিকটিকেই বরং গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছেন।বাংলা আরাকানের প্রতিবেশী রাজ্য হওয়ার কারণে নরমিখলার পক্ষে রাজধানী গৌড়ে পালিয়ে যাওয়া সহজ হয়েছিলো। কিন্তু তিনি ছিলেন তার চাচার ঘাতক এবং সিংহাসনের জবরদখলকারী। তদুপরি যৌবনের উন্মাদনায় তিনি এক সামন্তরাজার আত্মমর্যাদায় আঘাত করেছেন। তিনি আশ্রয়লাভের যোগ্য যদিও বা হন, সাহায্য লাভের যোগ্য মোটেই ছিলেন না।গৌড়ের সিংহাসনে তখন ছিলেন সুলতান গিয়াছুদ্দীন আযম শাহ। তিনি ন্যায়পরায়ণ শাসক যেমন ছিলেন তেমনি ছিলেন উদার হৃদয়ের মানুষ। একই সঙ্গে ছিলেন বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতারও অধিকারী।তিনি আশ্রয়প্রার্থী রাজাকে পূর্ণ রাজমর্যাদায় আশ্রয় তো দিলেন, কিন্তু তার সাহায্যপ্রার্থনার বিষয়টি আজ-কাল করে কৌশলে এড়িয়ে যেতে লাগলেন।এর মধ্যে ১৪১০ সালে মন্ত্রী গণেশের কূটচক্রান্তে সুলতান গিয়াছুদ্দীন নিহত হন। এই প্রজাপ্রিয় সুলতানের শাহাদাত ছিলো এমনই আকস্মিক ও শোকাবহ যে, সবকিছু স্পষ্ট হওয়ার আগেই মন্ত্রী গণেশ রাজক্ষমতা ‘গ্রহণ’ করে নেন। সমস্ত পরিস্থিতি তিনি এমন চতুরতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন যে, যখন সব পরিষ্কার হলো তখন আর কিছু করার ছিলো না। ১৪১৮ সালে তার মৃত্যুর পর পুত্র মহেন্দ্রদেব সিংহাসনে বসেন। কিন্তু মন্ত্রীবর্গ তাকে সরিয়ে জালালুদ্দীন মুহাম্মদ শাহকে সিংহাসনের আসীন করেন।ইতিমধ্যে বাংলার আকাশে দেখা দিলো রাজ্যলোভের কালো ছায়া। সম্পূর্ণ বিনা কারণে এবং অন্যায়ভাবে জৌনপুরের সুলতান ইবরাহীম বাংলার রাজধানী গৌড় আক্রমণ করে বসেন। সুলতান জালালুদ্দীন শাহের তখন ছিলো বেশ নাযুক অবস্থা। বিতাড়িত ও আশ্রয়প্রাপ্ত রাজা নরমিখলা পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেন। বিভিন্ন প্রতিকূলতার মুখে জবরদখলের রাজ্য হারালেও প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন সমরকুশলী ব্যক্তি। তিনি সুলতান জালালুদ্দীন শাহের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। বৈষয়িকভাবে তো আশ্রিত রাজার করার কিছু ছিলো না, তবে তিনি তার ‘ঈশ্বরপ্রদত্ত’ সমরকুশলতা দিয়ে সুলতানকে যুদ্ধজয়ে যথেষ্ট সাহায্য করেন। এভাবে সুলতান আশ্রিত রাজার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে পড়েন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার বিভিন্ন যৌক্তিক উপায় ছিলো, কিন্তু সুলতান তাকে তার হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধার করে দেয়ার মত অযৌক্তিক প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসেন।১৪৩০ খৃস্টাব্দে তিনি সেনাপতি ওয়ালী খাঁর নেতৃত্বে ত্রিশহাজার সৈন্য দিয়ে নরমিখলাকে সাহায্য করেন। এর পিছনে কৃতজ্ঞতাবোধ ছাড়া আর কোন বিবেচনাই ক্রিয়াশীল ছিলো না। ওয়ালী খাঁ ছিলেন ‘সেয়ানা’ সেনাপতি। তিনি আরাকানের রাজার সঙ্গে গোপন আঁতাত করে নরমিখলাকে বন্দী করেন এবং আরাকানরাজের কাছ থেকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পেয়ে নিজেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সুলতান বলে ঘোষণা করেন। এই স্বঘোষিত সুলতানের প্রবর্তিত মুদ্রার সঠিক পাঠোদ্ধারের মাধ্যমে এ বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, চট্টগ্রামই ছিলো তার সুলতানি এলাকা, মূল আরাকানভূখ- নয়। (চলবে ইনশাআল্লাহ)