- !কাঁটার আঘাতে ফুটলো ফুল
একটি বাগান, সবুজ সজীব! কত গাছ, কত ফুল!! প্রতিটি ফুলের নিজস্ব সৌন্দর্য, নিজস্ব সুবাস! বাগানের বুড়ো মালী, তার তো কৃতজ্ঞ হওয়ার কথা, যার কাছে থেকে আসে বাগানে বসন্ত এবং ফুলে ফুলে সৌন্দর্য-সুবাস, তাঁর প্রতি! বুড়ো মালী কৃতজ্ঞ ছিলো। কিন্তু তার হৃদয়ে আনন্দ ছিলো না, ছিলো বিষাদের কুয়াসা ও বিষণ্ণতার মেঘ! সবুজের ছায়াঘেরা, ফুলে ভরা বাগানের ঐ যে গোলাবগাছটি তাতে এক বসন্তে কিছু পাপড়ি নিয়ে একটি ফুল ফুটেছিলো। বুড়ো মালীর হৃদয়ে জেগেছিলো আনন্দের ঢেউ। দ্বিতীয় বসন্তে ফুটলো আরেকটি গোলাব, অনেক পাপড়ি নিয়ে। বুড়ো মালী যেন আনন্দে আত্মহারা! তার বুকের শুকনো পাঁজরগুলো একটু যেন সজীব!! তার চোখের ঘোলা দৃষ্টিতে আবার যেন তারার ঝিলিমিলি!! হৃদয়ে তার নতুন স্বপ্ন নতুন বসন্তের, আরো সুন্দর নতুন গোলাবের!! বসন্ত এলো। অনেক ফুল ফুটলো, কিন্তু .. স্বেপ্নর সেই গোলাবটি আর ফুটলো না। বুড়ো মালীর চোখের দৃষ্টি আবার ঝাপসা হলো; বুকের শুকনো পাঁজরগুলো একটু যে সজীব হয়েছিলো, আবার যেন ...! কেন এমন হলো, বুড়ো মালীর তা জানা হলো না। শুধু ভাবলো, হয়ত আমারই কোন ভুল ছিলো! বাগানে নতুন বসন্ত আসে। নতুন নতুন ফুল ফোটে! মালীর তো খুশী হওয়ার কথা, কিন্তু কী যে মায়ার বাঁধন! গোলাবগাছটিকে সে ভুলতে পারে না। সকাল-সন্ধ্যা পানি দেয়, আর পরম মমতায় শুকনো ডালে হাত বুলিয়ে দেয়। বুড়ো মালীর মনে থাকতো না, গাছে কাঁটা আছে! হাতে কাঁটা বিঁধতো। একফোঁটা রক্ত ঝরতো। বুড়ো মালী ‘উহ’ করে হাতটা সরিয়ে নিতো। কিন্তু কী যে মায়ার বাঁধন ছিলো! কাঁটার আঘাতের কথা সে ভুলে যেতো। আবার হাত বুলাতো। আবার কাঁটা বিঁধতো, আবার রক্ত ঝরতো। আবার ‘উহ’ করে হাতটা সরিয়ে নিতো। বুড়ো মালীর শুকনো পাঁজরের বুকটার ভিতরে একদিন কী যে ঢেউ উঠলো! কাঁটার আঘাত পেয়ে হাতটা আর সরালো না। তাতে আরো কাঁটা বিঁধলো। আরো রক্ত ঝরলো। আরো ব্যথা হলো। কিন্তু বুড়ো মালী ‘উহ’ করে উঠলো না। কাতর দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে থাকলো কাঁটাগুলোর দিকে। এবার আগে যা হয়নি তাই হলো! ফোঁটা ফোঁটা রক্তের সঙ্গে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু ঝরলো!! রক্তের ফোঁটায়, অশ্রুর ফোঁটায় শুকনো গোলাববৃক্ষের মাটি ভিজলো। বুড়ো মালী অবাক বিস্ময়ে দেখে, গোলাবের শুকনো গাছ একটু একটু করে সজীব হয়! একটা দু’টো করে সবুজ পাতা আসে!! বুড়ো মালীর বুকের ভিতরটা একটু যেন কেঁপে ওঠে! শুকনো পাঁজরগুলো একটু যেন...। হয়ত আনন্দের আতিশয্যে, হয়ত উৎকণ্ঠার প্রবলতায়। তারপর এক প্রভাতে বুড়ো মালী দেখতে পায়, অনেক কাঁটার মাঝে ছোট্ট একটি গোলাবের কলি! বুড়ো মালী আনন্দের উচ্ছ্বাসে নিজের অজান্তেই বলে উঠে, ‘আলহামদু লিল্লাহ! বাগানের গাছগুলো, ডালে
ডালে ফুলগুলো বুড়ো মালীকে ভালোবাসতো! তারাও বলে উঠলো আলহামদু লিল্লাহ!
গোলাবের কলিটি ধীরে ধীরে বড় হয়। একটু একটু করে পাপড়ি মেলে। আজ আঁধার রাতের শেষে যে ভোর হবে, সেই ভোরে হয়ত প্রস্ফুটিত একটি গোলাব ...! অনেক দিন পর আজ সন্ধ্যায় বুড়ো মালী তার চোখের ঘোলা দৃষ্টি নিয়ে তাকালো আকাশের দিকে। আকাশে মেঘ নেই। পশ্চিম দিগন্তে আছে সন্ধ্যার লালিমা। অস্তগামী সূর্যের পক্ষ হতে যেন পূবর্দিগন্তের জন্য রাঙ্গা ভোরের সোনালী সূর্যের আশ্বাস! বুড়ো মালী একবার তাকায় প্রস্ফুটিত গোলাবের দিকে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে, একবার তাকায় গোলাবকে ঘিরে থাকা কাঁটাগুলোর দিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে। ***
একসময় পুষ্প ছিলো। অনেক ব্যথা ও যন্ত্রণার মধ্যেও জীবনে সান্তনা ছিলো, হৃদয়ে শান্তি এবং আত্মায় প্রশান্তি ছিলো। একদিন পুষ্প হারিয়ে গেলো। সব আলো যেন নিভে গেলো। হৃদয়ের আকাশ যেন ছেয়ে গেলো আঁধারে। তবু জীবন ছিলো এবং ছিলো জীবনের সন্ধ্যা ও প্রভাত। তখনো যে সঙ্গে কলম ছিলো, কলমের মমতা ছিলো। শব্দের ফুল গেঁথে কলম তখনো যে লেখার মালা উপহার দিতো। এক নির্জন রাতে, হৃদয় যখন গলে গলে অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়ে, আকাশ থেকে যখন ঝিরঝির করে শিশির ঝরে, আমি শুনতে পেলাম আমারই জন্য আমার কলমের প্রার্থনা আবার যেন ফিরে আসে পুষ্পের সেই আলোকিত দিন, সেই জোসনামাখা রাত! আজ এই শুভলগ্নে কলমের সেই মিনতিই যেন রাব্বুল কলমের কাছ থেকে ফিরে এলো পুষ্পের সুবাস হয়ে!! আমর হৃদয় ও আত্মার সবটুকু কৃতজ্ঞতা তোমারই জন্য হে আল্লাহ
হয়ত এরই নাম তাকদীর! পুষ্প আমাদের জীবনে ফিরে এলো,আরাকানের মুসলিম জনপদে যখন আগুন জ্বলছে এবং বয়ে চলেছে রক্তের স্রোত ! যখন সভ্য পৃথিবী দেখছে শতাব্দীর ভয়াবহ গণহত্যা ও জাতিগত উচ্ছেদের নৃশংসতা। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কারো যেন কোন দায় নেই, দায়িত্ব নেই; যেন বিবেক নামের কোন কিছুর অস্তিত্ব এ সভ্যতার মধ্যে নেই! আমাদের বিক্ষত হৃদয়ের অক্ষম আর্তনাদ তুলে ধরার জন্য পুষ্পের তৃতীয় প্রকাশের উদ্বোধনী সংখ্যাটি আরাকান- সংখ্যা নামেই প্রিয় পাঠক, আপনার হাতে তুলে দেয়া হলো। প্রতিটি শব্দ যেন মজলুমানের আর্তনাদ হয়ে; প্রতিটি বাক্য যেন বিক্ষত হৃদয়ের প্রার্থনা হয়ে আল্লাহর আরশে পৌঁছে যায়।
***
***
প্রিয় পাঠক, আজকের পুষ্পে কালো কালির হরফে আপনি যদি রক্তের লাল দেখতে পান, অবাক হবো না, হয়ত কালো কালিতে মিশেছে ‘ওখানের- এখানের’ কিছু রক্ত!! যদি আপনার মনে হয়, আজকের লেখা থেকে আসছে আগুনের পোড়া গন্ধ, অবাক হবো না। কারণ আগুন তো জ্বলছে ওখানে আরাকানের জনপদে এবং এখানে আমাদের বুকের ভিতরে! ফুলের পাপড়িতে সবসময় সুবাস থাকে না বন্ধু, কখনো থাকে রক্তের ঘ্রাণ!! আজকের পুষ্পের পাপড়িগুলো হয়ত তেমনি কিছু!! বিদায় বন্ধু! তোমাদের জন্য নতুন ফুলের তোড়া নিয়ে, পুষ্পের নতুন সাজের ডালি নিয়ে আবার যেন ফিরে আসতে পারি, বারবার যেন ফিরে আসতে পারি, আকাশের কাছে এই মিনতি নিবেদন করে বিদায় বন্ধু!!