আমি এক অলস। আমার নাম ‘কলস’। কলস মানে মটকা। দেখতে আমি মটকার যথেষ্ট কাছাকাছি, তাই লোকের মুখে আমার এ নাম। আসল নামটা সম্পাদক ভাইয়া যদি দয়া করেন, লেখাটির শেষে দেখতে পাবে, আর না হয় এ নামেই ডেকো, আমি কিছু মনে করবো না।
তো শোনো, যদিও আমি অলস এবং নাম আমার কলস, তবে কথা আমার বড় সরস। কাউকে ডরাই না, কোন কথা লুকাই না। তো শোনো, আমি শুধু অলস নই, বরং ‘আওলাশুল উলূশ’। আওলাশু হচ্ছে অলস-এর ইসমে তাফযীল, আর ঊলূশ হচ্ছে অলস-এর বহুবচন। মানে অলসদের সেরা অলস; খাস বাংলায় যাকে বলে অলসের ঢেঁকি। দেখো, আরবী ভাষার কী ফযীলত, কামালত! একটি বাংলাশব্দকে কেমন বেমালুম হযম করে ফেললো!
তো আমার অলসতার কথা হচ্ছিলো। মাশা‘আল্লাহ, ভালো-মন্দ উভয় কর্মেই আমি সমান অলস। অর্থাৎ দাড়িপাল্লায় মাপা হলে উভয় পাল্লা সমান সমান; বিলকুল ‘ইনসাফ কা তারাযূ’! উদাহরণ চাও! যেমন ধরো নামায। অযান শেষ হওয়ার পরে চোখ মেলি: ইকামতের আগে অযুখানায় যাই; আর ইমাম ছাহাবের সঙ্গে মোলাকাত হয় আখেরি রাকাতের আখেরি হিছ্ছায়।মন্দ কর্মের উদাহরণ! যেমন ধরো বন্ধুদের জলসায় আড্ডা। একবন্ধু এসে বললো, চল্ যাই ওদিকে বেশ জমিয়ে আড্ডা হচ্ছে।
আমি একটা হাই তুলে বলি, তুই যা, আমি আসছি। বন্ধুটি চলে যায়, এদিকে আমার চোখ লেগে যায়। কিছুক্ষণ পর বন্ধুটি এসে বলে, কিরে উঠলি না!
আমি অপ্রস্ত্তত হয়ে বলি, এই যা! চোখটা লেগে গিয়েছিলো। আচ্ছা তুই যা, আমি চোখে মুখে পানি দিয়ে আসি।
গড়িয়ে গড়িয়ে অবশেষে আড্ডায় গিয়ে দেখি, সবকুছ খতম!
অলসতা, আর আলসেমি অনেকে ভাবে একই জিনিস। যে যাই বলুক শুনতে হবে এবং মানতে হবে আমার কথা। কারণ এ বিষয়ে আমি হলাম বিশেষজ্ঞ। প্রশ্ন উঠতে পারে অলসও কি হতে পারে বিশেষজ্ঞ? আলবৎ পারে। কারণ অলসতার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে কিছু করা লাগে না। শুধু তন্দ্রা-নিদ্রার হালতে একটু আধটু ফিকির করা লাগে।
যাই হোক আমার সুচিন্তিত মত হলো, অলসতা ও আলসেমি প্রকারে এক হলেও প্রকৃতিতে এক নয়। অলসতা হলো অলসের কচি অবস্থা। মানে কাজ করে, তবে ঢিলেমি আছে। আর আলসেমি হলো অলসের পরিপক্ক অবস্থা। মানে উঠি উঠি করেও ওঠে না; করি করি করেও করে না। লোকটাকে তখন আর অলস বলে না, বলে আলসে।
বাংলাভাষাকে একটা ধন্যবাদ দিতেই হয় অলসতার অতি সূক্ষ্ম স্তরতারতম্য রক্ষা করে ভিন্ন ভিন্ন শব্দ নির্মাণ করার জন্য। যেমন এক্ষেত্রে আরেকটি শব্দ হলো কুঁড়েমি।
কুঁড়েমি শব্দটির সঙ্গে পরিচয় আছে তো! এটা হলো অলসতার একেবারে আ‘লা দরজা। অলসতার রাজ্যে এর মরতবা-ফযীলত একেবারে অন্য রকম। কুঁড়েমি মানে, কাজ তো করেই না! করার জন্য উঠি উঠিও করে না। পড়ে থাকে তো পড়েই থাকে। এদিকে বেলা গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল ওদিকে তিনি যে কাতে ছিলেন সে কাতেই আছেন। কারণ কাত ফিরিয়ে দেয়ার জন্য কাছে পিঠে কেউ ছিলো না। এমন মানুষকে অলস তো নয়ই, আলসে বলারও জো নেই, বলতে হবে কুঁড়ে এবং চন্দ্রবিন্দুটা লাগাতে হবে খুব যত্ন করে।
ভালো কথা! তিন অলসের সেই কাহিনীটি কি জানা আছে? সেই যে রাজ্যের যত অলসদের নিয়ে রাজা অলসতার ব্যতিক্রমধর্মী এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন! তাতে যিনি প্রথম হয়েছিলেন রাজা তাকে পদক দিয়েছিলেন ‘কুঁড়ে দ্য চ্যাম্পিয়ন’ বলে। যিনি দ্বিতীয় হয়েছিলেন তার পদকটির নাম ছিলো ‘আলসে দ্য গ্রেট, আর তৃতীয় জনের পদকটি হলো অলস দ্য বেস্ট। সে যুগের রাজারাও ছিলেন যাকে বলে গুণের সমঝদার। গুণিদের কদর করার তরিকা তারা জানতেন বটে! নিছক কপালের ফেরে সে যুগে না জন্মে জন্মেছি এ যুগে এসে। এখন না অলসদের কদর আছে, না কর্মঠদের। অলসদের হয় জেল, কর্মঠরা যায় জেলখানায়।
বিষয়টি মনে হয় তেমন করে খোলাসা হলো না! কারণ এখানে চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপদ্বয়ের পারফর্মেন্স-এর আলোচনা আসেনি। আসলে পুরো ঘটনাটা আমিও ভুলে গেছি।
যাক আরেকটি উদাহরণ যদিও ততটা উন্নত নয়, তবে মনে আছে পুরোপুরি, আর বিষয়টিও তাতে খোলাসা হতে পারে। একদেশে ছিলো তিন বন্ধু। তিনজনই অলস। তিনজনেরই দাবী ছিলো, সে-ই সেরা অলস, মানে যাকে বলে কুঁড়েশ্রেষ্ঠ। কিন্তু কার দাবী সত্য, পরখ করে দেখার তেমন একটা সুযোগ হয়নি। একবার হঠাৎ করেই সুযোগ জুটে গেলো। তিনবন্ধু দাওয়াত পেলো রাজার ভোজসভায়। প্রথমজন যাই যাই করে গেলো একেবারে শেষ বেলায়। দ্বিতীয়জন বললো, আমারটা নিয়ে আসিস ভাই! তৃতীয়জন! সে বললো, আমারটা দয়া করে খেয়ে আসিস।
ঘটনা থেকে নিশ্চয় বোঝা গেছে, কে কুঁড়ে, কে আলসে, আর কে শুধু অলস!
এত কথা বলার একটা উদ্দেশ্য আছে মিয়াঁ ভাই। নিজের বিচার তো নিজে করা যায় না। অবস্থা শুনে আজ তোমাদেরই ফায়ছালা করতে হবে, আমি কোন্ ক্যাটাগরিতে আছি! আম্মা খেতে ডেকে বিরক্ত হয়ে বলেন, তুই এত অলস কেন্ রে? বাপের খাছলত পেয়েছিস বুঝি!
ফজরের সময় আববা ডেকে ডেকে পেরেশান হয়ে বলেন, ‘তোমার’ ছেলে জন্মের আলসে! আর বড় ভাই! মাদরাসায় যাওয়ার সময় প্রায় পার হয়ে যায়, তখনো আমি হাম্মামে। তিনি তাগাদা দিতে দিতে হয়রান হয়ে বলেন, এমন কুঁড়ে! তুই কার মত হলি রে!
সব তো শুনলে! এবার বিচার করে বলো; কুঁড়ে, অলস, আলসে, আসলে আমি কে?
ও! ঘটনাটাই বলা হয়নি! তো শোনো। কী যেন, কী যেন ঘটনাটা ঘটলো সেদিন! হাঁ, মনে পড়েছে। আমাদের মাদরাসায় আয়োজিত ‘অলসতা দূরীকরণের প্রশিক্ষণশিবিরের ঘটনা।
কবে যেন, কবে যেন! হাঁ, মনে পড়েছে। গত শনিবারের পরের রবিবারে।
ঘটনা হ-ল-ও! একি! আমাকে দেখি অলসতায় পেয়ে বসেছে! না, এটা তো বিলকুল আলসেমি! না, না, এ স্রেফ কুঁ..কুঁড়েমি!!
***
(সম্পাদক, ভাই আবু যোবায়র, তোমার লেখা অবলম্বনে আমার এ রম্যরচনা। প্রতিসংখ্যার রম্যরচনা নিয়ে আমাকে অনেক ভাবতে হয়। এরকম দু’চারটি রম্যরচনা যদি তোমাদের কাছ থেকে আসে তাহলে রম্যবিভাগটি এখনই আমি তোমাদের হাতে তুলে দিতে পারি। তুমি এসংখ্যার অতিথিসম্পাদক। বর্তমান সম্পাদনার আলোকে তুমি আরো লিখতে থাকো।