নামের আছর ও বৈশিষ্ট্য এবং খায়র ও কল্যাণ নামে একটি ধারা সলফ থেকে চলে আসছে। আমাদের আদীব হুযূরের ক্ষেত্রেও এ বিষয়টি আমি সত্যরূপে পেয়েছি। তিনি মিছবাহ, বা আলোর প্রদীপ। তাঁর মুখের কথা, কলমের লেখা, কলবের জযবা, তাঁর চিন্তা-ফিকির এবং আখলাক ও চরিত্র সবকিছুতে যেন আলোর উদ্ভাস। আর আমি আশা করি, এই মিছবাহ সেই ‘মিছবাহ’ থেকে আলো গ্রহণ করছে এবং ইনশাআল্লাহ গ্রহণ করতে থাকবে। কারণ যিনি চান, আল্লাহ তাকে আপন শান মুতাবেক দান করেন। আমার আন্তরিক কামনা, আল্লাহ যেন ‘মিছবাহ’কে সুদীর্ঘ কাল আলোকোজ্জ্বল রাখেন, আমীন।
শুরু থেকে একটি বিষয় আমি দেখে আসছি; তাঁর মজলিসের আলোচনায় বহু ফায়দা থাকে। শুধু সাহিত্যের ফায়দা নয়, চিন্তা, চেতনা, আখলাক ও রূহানিয়াতেরও ফায়দা। সেগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে কাছের ও দূরের এবং আগামী প্রজন্মের তালিবানে ইলম অনেক উপকৃত হতে পারে। এ জন্য আমি আমার ছাত্রভাইদের বলে থাকি, যেন তাঁর আলোচনা সংরক্ষণ করা হয়। আমি যখন উপস্থিত থাকি তখন নিজেও চেষ্টা করি, এমনকি যখন ফোনে কথা হয়, সেটাও ধারণ করার চেষ্টা করি। আদীব হুযূর তাঁর নিজস্ব তাবিয়াতের কারণে প্রথমে এটা অপছন্দ করতেন। কিন্তু অধমের প্রতি স্ণেহের কারণে তাবিয়াতের খেলাফ হওয়া সত্ত্বেও তা গ্রহণ করেছেন। আর আলহামদু লিল্লাহ এখন তো তাঁর অন্তরে এর তাকাযাও পয়দা হয়েছে।
এ দীর্ঘ ভূমিকার কারণ, কিছু দিন পূর্বে ফোনে তিনি রবীন্দ্রনাথের একটি বাক্য সম্পর্কে কিছু কথা বলেছিলেন, সৌভাগ্যক্রমে যা আমি সংরক্ষণে আছে। তো মিছবাহী আদবের একটি ঝলক হিসাবে এখানে আমি তা পেশ করতে চাই
***
ফোন করে তিনি বললেন, এখন আমি রবীন্দ্রনাথের ‘সাহিত্যের বিচারক’ প্রবন্ধটি পড়ছিলাম। মানে সাহিত্যের বিচার কে করবে এবং কীভাবে করবে? তো প্রবন্ধের প্রথম বাক্যটিতেই আমার নযরে একটি খুঁত ধরা পড়েছে। ভাবলাম, ‘কাকে বলা যায়? সবার আগে আপনার কথা মনে পড়লো। তাই ফোন করলাম।’
আমি তো অবাক! আমাকে মনে পড়লো! অথচ কোথায় আমি, আর কোথায় সাহিত্য!
যাক, তিনি বললেন, প্রবন্ধটির শুরু এভাবে, ‘ঘরে বসিয়া আনন্দে যখন হাসি এবং দুঃখে যখন কাঁদি তখন একথা মনে উদয় হয় না যে, আরো একটু বেশী করিয়া হাসা দরকার, কিংবা কান্নাটা ওযনে কম পড়িয়াছে।’
এই হলো পুরো বাক্য। দেখুন, ‘যখন হাসি’ এবং ‘যখন কাঁদি’ উভয় অংশের মাপ ঠিক আছে, কিন্তু ‘আনন্দে’ এবং ‘দুঃখে’ মাপ ঠিক নেই। ছন্দপতন ঘটেছে। ওযনে বেশকম হয়ে গেছে।
হয়ত বলবেন, গদ্যের মধ্যে এত ওযন, মাপ ও ছন্দ কেন?
আমি বলবো, গদ্যেরও নিজস্ব ছন্দ আছে। দেখুন, ঠাকুর নিজেও এখানে একটি ছন্দ তৈরী করতে চেয়েছেন। ‘ঘরে বসিয়া’ এটি হলো কা-। এখান থেকে দু’টি ডাল দু’দিকে গেছে। একটি ডাল হলো ‘আনন্দে যখন হাসি’, দ্বিতীয় ডালটি হলো ‘দুঃখে যখন কাঁদি’
তো বাক্যটিকে তিনি ‘একটি কাণ্ড, দু’টি ডাল’ এই ছকে তৈরী করেছেন। কিন্তু ‘আনন্দে’ ও ‘দুঃখে’, এখানে এসে ছন্দটা পড়ে গেছে। হয় বলবো, ‘সুখে যখন হাসি এবং দুঃখে যখন কাঁদি, না হয় বলবো, ‘আনন্দে যখন হাসি এবং বেদনায় যখন কাঁদি’। মোটকথা, বাক্যটিকে তিনি যে ছকে ফেলেছেন তাতে আনন্দের বিপরীতে ‘দুঃখে’ বললে কানে বাজে। সুর ও ছন্দটা যেন কেটে যায়।
দেখুন, আমার এ মন্তব্য ঠিক নাও হতে পারে, কিন্তু আমি বলতে চাই, আমরা সাধারণত গড় গড় করে পড়ে যাই এবং অল্প সময়ে অনেক দূর পড়ে ফেলি। এটা ঠিক নয়। এতে সাহিত্যগত দিক থেকে ‘অনেক পড়ে অল্প ফায়দা’ হয়। আমাদের উচিত চিন্তা-ভাবনা ও বিচার- পর্যালোচনা করে পড়া। তাতে পড়ার পরিমাণ সামান্য হলেও, ফায়দা বেশী।
এখানে আদীব হুযূর তাঁর পর্যালোচনা সম্পর্কে আমার মত জানতে চাইলেন। আমি বললাম, আমার তো মনে হয় খুব যুক্তিপূর্ণ কথা। তাছাড়া এখান থেকে সাহিত্যবিষয়ক পাঠের একটি নমুনা সামনে আসছে, যা খুবই উপকারী।
তারপর তিনি বললেন, এবার দেখুন দ্বিতীয় অংশটি, ‘(ঘরে বসিয়া আনন্দে যখন হাসি এবং দুঃখে যখন কাঁদি) তখন একথা মনে উদয় হয় না যে, আরো একটু বেশী করিয়া হাসা দরকার, কিংবা কান্নাটা ওযনে কম পড়িয়াছে।’
এ অংশটি আমরা ভেবে দেখতে পারি যে, অন্য আর কী হতে পারতো? যেমন, ‘মনে উদয় হয় না’ ‘মনে হয় না’ মনে আসে না’ ‘ভাবনায় আসে না’ ‘কেউ ভাবে না’ ইত্যাদি। তারপর চিন্তা করা দরকার যে, তিনি এগুলোর মধ্য হতে ‘মনে উদয় হয় না’কে কেন বেছে নিলেন?
হয়ত ঠাকুরমহাশয়ের শব্দনির্বাচনই ঠিক, তবু একবার মূল বাক্যটা পড়ুন, তারপর ‘কেউ ভাবে না’ যোগ করে পড়ুন, ‘ঘরে বসিয়া আনন্দে যখন হাসি এবং দুঃখে যখন কাঁদি তখন কেউ ভাবে না যে, আরো একটু বেশী করিয়া হাসা দরকার, কিংবা কান্নাটা ওযনে কম পড়িয়াছে।’
মূল বাক্যে কিছুটা কি শব্দবাহুল্য নেই? তিন হরফের ‘উদয়’-এর পরে দুই হরফের ‘হয়’, তারপর দু’টি ‘অন্তস্থয়’-এর নিকট উচ্চারণ কিছুটাও কি শ্রুতিকটু নয়?
বিশিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয়ে ‘মনে উদয় হওয়া’ বলা হয়। সাধারণ ক্ষেত্রে বলা হয় ‘মনে হওয়া’ বা ‘মনে আসা’ ।
‘আরো একটু বেশী করিয়া হাসা দরকার’, আমরা হলে ‘একটু’ শব্দটি বলতাম না, কিন্তু শব্দটি এখানে পুরো বক্তব্যের মধ্যে ভিন্ন একটি দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে।
‘কিংবা কান্নাটা ওযনে কম পড়িয়াছে’ কান্নাকে দাড়িপাল্লা দ্বারা ওযন করার ধারণাটা উন্নত নয়। বিকল্প কী হতে পারে সেটা অবশ্য এখনই বলতে পারছি না। চিন্তা করে বলতে হবে। অবশ্য ‘মাপে কম পড়িয়াছে’। বলা যায়; কারণ পাল্লা-বাটখারার চেয়ে পাত্র দিয়ে মাপার ধারণাটি কান্নার ক্ষেত্রে কিছুটা ভালো। কান্নায় চোখের পানি আছে, আর তা পাত্রে ধারণ করা হয়। ‘পরিমাণে কম পড়িয়াছে’ও বলা যায়।
তো দেখুন, এই যে একটি বাক্য নিয়ে এত চিন্তা-ভাবনা, এতক্ষণে হয়ত অনেক দূর পড়া হয়ে যায়, কিন্তু সাহ্যিত্যের রুচি ও বিচারশক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে কোনটি উত্তম?
***
তো এই হলো আদীব হুযূরের আদবী মুতালা‘আ-এর উসলূব ও আন্দায। এটা আমাদের শেখা দরকার। কিন্তু এখানে আমি বিশেষভাবে যা বলতে চাই তা হলো, এই যে এত মূল্যবান একটি সাহিত্যসমালোচনা, যদি সংরক্ষণ করা না হতো তাহলে তো তা হারিয়ে যেতো। এরকম আলোচনা তো হুযূর সবসময় করেন এবং শুধু সাহিত্য নয়, জীবনের প্রয়োজনীয় সব বিষয়ে, যা কিতাবের পাতায় হয়ত এভাবে পাওয়া যাবে না, অথচ জীবনের জন্য হতে পারে তা মূল্যবান পাথেয়। তো আমার যে ছাত্রভাইয়েরা হুযূরের কাছে থাকার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন তাদের কর্তব্য হলো এগুলো সংরক্ষণ করা, যাতে ফায়দা ‘আম হতে পারে।
যাক, আদীব হুযূর একটি কথা প্রায় বলেন, ‘আমি চাই বাংলাভাষা ও সাহিত্যের উপর অন্যদের ইজারাদারি ভেঙ্গে দিয়ে আলিমসমাজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে। হয়ত এজন্য পঞ্চাশ বছরের নিরলস সাধনার প্রয়োজন, কিন্তু শুরু তো করা যায়!’
আমাদের আদীব হুযূরের এ স্বপ্ন আল্লাহ নে বাস্তবায়িত করেন, আমীন।