দুপুরে গরম রোদে পথ চলতে চলতে আমি যখন ক্লান্ত শ্রান্ত তখন একটু বিশ্রাম নেয়ার জন্য পথের পাশে বড় গাছটার নীচে গিয়ে বসলাম। শীতল ছায়ায় দেহমন আমার জুড়িয়ে গেলো। আহ, কী শান্তি! ইচ্ছে হচ্ছিলো সেখানেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। আমার কি একটু তন্দ্রা এসেছিলো?! জানি না, তবে মনে হলো তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় শুনতে পেলাম, যে গাছটির ছায়ায় আমি বসে আছি সেই গাছটি আমাকে লক্ষ্য করে বলছে, আমার ছায়া কি তোমাকে শান্তি দিয়েছে হে পথিক? আরেকটু জিরিয়ে নাও, আর আমার কিছু কথা শুনে যাও। একসময় আমি ছিলাম ক্ষুদ্র একটি বীজ। আল্লাহর কুদরত দেখো, কত বিরাট বৃক্ষ আমি, লুকিয়ে ছিলাম ক্ষুদ্র একটি বীজের ভিতরে!
কীভাবে আমি একটি ক্ষুদ্র বীজ থেকে আত্মপ্রকাশ করে এত বিরাট বৃক্ষে পরিণত হলাম?
তোমাদের মধ্যে কিছু মানুষ আছে যাদের মন খুব ভালো। তারা ভাবে, কীভাবে মানুষের উপকার করা যায়! তেমনি একজন ভালো মানুষ একদিন সেই ক্ষুদ্র বীজটিকে পথের এখানে মাটির নীচে পুঁতে রেখেছিলেন। তোমাদের তো আল্লাহ মাটি দিয়ে তৈরী করেছেন; মাটির মধ্যে রয়েছে এমনই এক সজীবতা যে, বীজ যখন মাটির স্পর্শে আসে, তাতেও প্রাণের সঞ্চার হয়। আমার বীজটির ক্ষেত্রেও তাই হলো। কয়েকদিন পর বীজটি অঙ্কুর হয়ে মাটি ফুঁড়ে বের হলো। খুব দুর্বল একটি অঙ্কুর। যিনি আমাকে মাটিতে বপন করেছিলেন, অঙ্কুর দেখে তিনি খুশী হলেন এবং আমার যত্ন নেয়া শুরু করলেন।
ধীরে ধীরে কিছু বড় হয়ে আমি হলাম একটি চারাগাছ। সেই ভালো মানুষটি আমার চারপাশে শক্ত করে বেড়া দিলেন, আমাকে গরু-ছাগলের মুখ থেকে রক্ষা করার জন্য। সকাল-বিকাল তিনি আমার গোড়ায় পানি দিতেন। তাতে আমার শিকড়গুলো মাটি থেকে রস সংগ্রহ করতে পারতো। ফলে আমার শরীর দ্রুত বেড়ে উঠতে লাগলো। দুষ্ট ছেলেরা, এমনকি বড় মানুষেরাও আমার পাতা ছিঁড়ে ফেলতো, ডাল ভেঙ্গে ফেলতো। তাতে আমার খুব কষ্ট হতো। ঐ দরদী মানুষটি আমার কষ্ট বুঝতে পারতেন। আমার কষ্ট দেখে তারও মনে খুব কষ্ট হতো। তিনি আমার গায়ে কোমলভাবে হাত বুলিয়ে যেন আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করতেন। তখন আমি সব কষ্ট ভুলে যেতাম, আর ভাবতাম, সব মানুষ কেন হয় না এই মানুষটির মত! পথিক, আমার মনে হয়, তুমিও সেই মানুষটির মত ভালো মানুষ। তোমার সঙ্গে কথা বলতে পেরে তাই আমি খুব শান্তি পাচ্ছি।
একসময় আমি ছায়াদার গাছ হলাম। তারপর হলাম ফলবতী বৃক্ষ। আমার তো তাতে আনন্দিত হওয়ারই কথা ছিলো, কিন্তু আমার কোন আনন্দ হয়নি। কারণ যিনি আমাকে এখানে এই মাটির নীচে বপন করেছিলেন, আমার ফল ধরা দেখতে তিনি আসেননি, আসতে পারেননি। তিনি তখন মৃত্যুশয্যায়। তোমাদের মধ্যে যারা ভালো মানুষ, খুব তাড়াতাড়ি তারা মরে যায়।
দ্বিতীয়বার যখন আমার সারা দেহজুড়ে ফল এলো এবং ফলভারে আমি ভারাক্রান্ত হলাম। কত জন, কত পথিক আমার ফল খেলো, স্বাদের প্রশংসা করলো, তিনি আর এলেন না, আমার ফল তার আর খাওয়া হলো না। এই পথ দিয়েই একদিন লোকেরা তার জানাযা নিয়ে গেলো। তার জানাযার উপর আমার ছায়া পড়লো। আমি চিৎকার করে বললাম, তোমরা একটু থামো। আমার বন্ধুর জানাযা একটু নামাও। শেষবারের মত আমি তাকে একটু ছায়া দেই। কেউ শুনলো না। মানুষেরা তো গাছের কথা শুনতে পায় না। মানুষ যদি গাছের আর্তনাদ শুনতে পেতো তাহলে কী গাছের গোড়ায় কুড়াল চালাতে পারতো! তারপরো দেখো, কতভাবে আমরা মানুষের সেবা করি। ফল দিয়ে, ফুল দিয়ে, ছায়া দিয়ে, বাতাসের বিশুদ্ধতা দিয়ে। বেঁচে থেকেও আমরা মানুষের সেবা করি, আবার মরে গিয়েও শুকনো পাতা ও শুকনো ডালের জ্বালানি যুগিয়ে মানুষের উপকার করি। আমি এবং পৃথিবীর প্রতিটি বৃক্ষ-লতা আমাদের নিজেদের ভাষায়, নিজেদের নিয়মে আল্লাহর প্রশংস ও উপাসনা করি। অথচ মানুষ আল্লাহর এত নেয়ামত ভোগ করেও আল্লাহকে ভুলে থাকে।
হে পথিক, তোমার তো যাওয়ার সময় হলো, আমার একটি মিনতি রক্ষা করবে! ঐ যে দূরে কবরস্তান, ওখানে শুয়ে আছেন আমাকে বপনকারী এবং আমার পরিচর্যাকারী সেই ভালো মানুষটি। তার কবরে আমার হয়ে তুমি সালাম বলো, আর বলো, এখনো আমি ভুলিনি তাকে। এখনো মানুষকে আমি ফল দেই, ছায়া দেই।