হ্রস্ব-ইতে চন্দ্রবিন্দু জুটেনি কারো ভাগ্যে তেমন একটা। জোটবে কীকরে, ইঁদুরের পাল্লায় পড়েছে যে! বই-খাতা বলো, লেপ-তোষক বলো, আর চন্দ্রবিন্দু বলো, ইঁদুরে একবার দখল করলে কাউকে আর ভাগ দিতে চায়! কেটেকুটে ছাফ!
পন্ডিতেরা বলেন, ইঁদুর-এর সংস্কৃত নাকি উন্দুর, বা ইন্দুর। মূষিক শব্দটি শুনেছো? সংস্কৃত শব্দ, আমাদের দেশের সেই চন্দ্রবিন্দুওয়ালা ইঁদুর! ‘পর্বতের মূষিক প্রসব’ বলে একটা কথা আছে, যার অর্থ হলো, অনেক ঢাকঢোল ও উদ্যোগ-আয়োজনের অতি সামান্য ফল।
আরেকটা শব্দ অবশ্য আছে ইঁদারা, মানে বড় পাকা কুয়া। আগে এই ঢাকা শহরে পর্যন্ত অনেক ইঁদারা ছিলো, এখনে গ্রামেও নেই। থাকবে কীকরে, ভূগর্ভের পানি যে চলে গেছে অনেক নীচে। গভীর নলকূপ বসিয়েও তো পানির নাগাল পাওয়া যায় না। গোটা দেশই এখন মরুভূমি হতে বসেছে। এজন্য আর প্রতিবেশীকে দোষ দিয়ে লাভ নেই; সবই আমাদের কর্মফল।
ইঁচড় মানে কাঁচা কাঁঠাল, আর ইঁচড়ে পাকা মানে, অকালপক্ব। অল্পবয়সের ফাজিল ছেলে। ব্যস, হ্রস্ব-ইতে চন্দ্রবিন্দুর রাজত্ব এখানেই শেষ। হ্রস্ব-ইতে যাও একটা দু’টো ছিলো, দীর্ঘ-ঈতে তাও নেই। এবার চলো হ্রস্ব-উ এর আঙ্গিনায়। আছে মোটে তিন চারটে শব্দ।
চন্দ্রবিন্দুটা তো দেখতে ঠিক আকাশের কোণে উঁকি দেয়া নতুন চাঁদের মত, তাই উঁকি দিতে চন্দ্রবিন্দু লাগারই কথা। আমার ছেলেরা অবশ্য চন্দ্রবিন্দু ছাড়াই ‘উকি’ দিতে অভ্যস্ত। তাই তো ওরা উঁকি দিয়ে কিছু দেখতে পায় না। অনেকে আবার উঁকি দেয় না, উঁকি মারে,ছি!
উঁকি-ঝুঁকি মানে আড়াল থেকে দেখতে বারবার এদিকে সেদিকে তাকানো। জানালা দিয়ে, বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয়া এবং পর্দার আড়াল থেকে উঁকি-ঝুঁকি দেয়া খুবই ও অভদ্র কাজ, আমাদের নবী ছাল্লাল্লাহু এমন লোকের প্রতি অত্যন্ত ঘৃণা প্রকাশ করেছেন । জীবনের সাধনায় তুমি যদি অনেক উঁচুতে উঠতে চাও তাহলে চন্দ্রবিন্দু দিয়েই উঠতে হবে। ‘উঁচু’ থেকে চন্দ্রবিন্দু পড়ে গেলে তোমারও উঁচু থেকে অনেক নীচুতে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। সুতরাং সাবধান!
লোকটা নাকি, উঁচুদরের লেখক, অথচ ‘উঁচু’তে চন্দ্রবিন্দু দেয় না। বলে কিনা ‘আমি চন্দ্রবিন্দুবর্জন আন্দোলনের নেতা! এদের হাতেই বোধহয় ভাষার বারটা বাজবে।
উঁ- এটি হলো কারো ডাকে কোমল ভাবে সাড়া দেয়ার শব্দ।
উঁহুঁ নেই, মানে সাড়াশব্দ নেই; সামান্যতম প্রতিবাদ নেই।
উঁহুঁ- এটি অসম্মতিজ্ঞাপক ধ্বনি।
হ্রস্ব-উতে তাও তিন চারটে চন্দ্রবিন্দু আছে, দীর্ঘ-ঊতে নেই একটিও।
একারে আছে তিন চারটে, ঐকারে নেই একটিও।
কোনভাবেই যে ওর সঙ্গে ‘এটে’ উঠতে পারছিনে, বলতে পারো, কারণটা কী? কারণ হলো, ও এঁটে ওঠা-তে চন্দ্রবিন্দু দেয়, তুমি দাও না। আর বিশ্বাস করো, চন্দ্রবিন্দু ছাড়া কারো সঙ্গেই এঁটে ওঠা যায় না।
একপ্রকার মাটি আছে, যাকে বলে এঁটেল মাটি, শুকিয়ে খুব শক্ত হয়, কিন্তু ভিজলে নরম-পিচ্ছিল হয়ে যায়।
এঁটো মানে উচ্ছিষ্ট। এঁটো খাবার, এঁটো হাত, এঁটো বাসন। আগে কলাপাতায় করে খাওয়া হতো, তাই বলা হতো, এঁটো পাতা।
পরের এঁটো-কাঁটা ও লাথি-ঝাঁটা খেয়ে বেঁচে আছো, একে কি আর বেঁচে থাকা বলে।
এঁড়ে বাছুর মানে পুরুষ বাছুর। এঁড়ে গলা মানে রুক্ষ কর্কশ গলা।
ওকার এবং ঔকারে চন্দ্রবিন্দু নেই বললেই চলে।
***
কাক চেনে না, এমন মনুষ্য কি আছে এই বঙ্গদেশে! বাঙ্গালীরাই তো বলে, ‘ভাত ছিটালে কাকের অভাব হয় না’! তা তুমি কিছু ভাত ছিটিয়ে দেখো তো, কয়টা কাক আসে! সে যাক, আমি বলতে চাই, দিন-রাত কা-কা রবে ডাকে যে কাক তাতে চন্দ্রবিন্দু নেই। কিন্তু বকের মত দেখতে একটি পাখী আছে, মাছ খায়, আর কাঁক-কাঁক শব্দ করে, তাই তার নাম হলো কাঁক, তাতে চন্দ্রবিন্দু আছে।
কোল মানে কাঁখ, কাঁখ মানে কোল। ছেলেটাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি, কেউ কেউ বলে, কোলে কাঁখে করে মানুষ করেছি।
আগে গ্রামের বধুরা কাঁখে কলসি করে নদীর ঘাটে যেতো।
সংস্কৃত কঙ্কতিকা থেকে কাঁকই, মানে মোটা চিরুণী। তদ্রূপ সংস্কৃত কঙ্কন থেকে কাঁকন, মানে হাতের অলঙ্কার। আবার সংস্কৃত কঙ্কর থেকে কাঁকর, মানে ক্ষুদ্র পাথর, সুতরাং চন্দ্রবিন্দু ছাড়া শব্দগুলো অচল। কাঁকুরে চাল মানে পাথরকণা মিশ্রিত চাল। এখনকার চালব্যাপারীরা বিষয়টা ভালই বোঝেন।
আমরা বলি কাঁকড়া, পন্ডিতেরা বলেন কর্কট, এই জলজপ্রাণীটি অন্তত ছবিতে দেখেছো নিশ্চয়! চন্দ্রবিন্দু আছে। চীনারা কাঁকড়া খায়, ব্যাঙ খায়, ওয়াক থু!
কাঁকরোল তরকারীটা তো চেনো! গায়ে কাঁটা থাকলেও খেতে বেশ স্বাদ। চন্দ্রবিন্দু না থাকলে অতটা স্বাদের হতো কি না, কে জানে!
সুপরিচিত সরীসৃপ প্রাণী হলো কাঁকলাস, চন্দ্রবিন্দু না দিলেও সমস্যা নেই। (এর আরেক নাম হলো গিরগিটি।)
ছোটকালে নানি আমাকে বলতেন কাকলাস, পরে জেনেছি, খুব রোগা-পাতলা হলে তাকে বলে কাকলাস।
কাঁচের পাত্র সামান্যতেই ভেঙ্গে যায়, চন্দ্রবিন্দু না দিলে হয়ে পড়ে আরো ভঙ্গুর; তবু অনেকে বলেন, চন্দ্রবিন্দু ছাড়াও কাচ হতে পারে। কথাটা আমার ঠিক পছন্দ হয় না।
কাঁচের ঘরে বসত করে অন্যের দিকে ঢিল ছোঁড়া ঠিক নয়, যদিও আমাদের রাজনীতির নেতারা বরাবর সেটাই করে থাকেন। তাই বারবার ভেঙ্গে যায় তাদের কাঁচের ঘর। তবু যদি হুঁশ হতো!
কাঁচকলা মানে আনাজী কলা, যা রান্না করে খাওয়া হয়। তাই বলে কেউ যদি আমাকে বলে, কাঁচকলা খাও, খুশী হবো না। কারণ এটা বিদ্রূপের কথা। কাঁচকলা দেখানো মানে ঠকানো।
কাঁচা শব্দটির কত যে অর্থ! কাঁচা ফল, কাঁচা রং, কাঁচা রাস্তা, (কাঁচা ঘর), কাঁচা লোক, কাঁচা বুদ্ধি, কাঁচা বয়স। ছেলেটা অঙ্কে বেশ কাঁচা। কাঁচা হাতের কাঁচা লেখা। কাঁচা গোশত, রান্নাটা ভালো হয়নি, তরকারীটা কাঁচা রয়ে গেছে। কাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। কাঁচা টাকা হাতে পেয়ে মাথাটা তোমার বিগড়ে গেছে। কাঁচা মালের অভাবে শিল্পকারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
কাঁচা-তে চন্দ্রবিন্দুটা ভুলে গেলে বলবো, বানানে তুমি বড্ড কাঁচা; তাই বলে কাপড় কাচতে গিয়েও অতিউৎসাহে চন্দ্রবিন্দু দিয়ে বসো না। আমের ফালি কেচে মোরববা করে যে, তাতেও চন্দ্রবিন্দু নেই।
কাঁচি হচ্ছে সুপরিচিত কর্তন-যন্ত্র। তাতে চন্দ্রবিন্দু না দিয়ে আমাদের এক কবি নাকি দাদাদের সামনে একেবারে কাঁচুমাচু হয়েছিলেন। লজ্জার কথা, কাঁচুমাচুতেও অনেকে চন্দ্রবিন্দু ভুলে যায়।
সংস্কৃত কণ্টক থেকে বাংলায় হয়েছে কাঁটা। সুতরাং ‘কাঁটা হেরি ক্ষন্ত হবো না কমল তুলিতে’ এবং ‘ভুলিব না কভু চন্দ্রবিন্দু দিতে’। গাছের কাঁটা, মাছের কাঁটা, ঘড়ির কাঁটা, মেয়েদের চুলের কাঁটা, সব কাঁটাতে একই কথা। বিলেতি হওয়ার বাসনায় অনেকে কাঁটা চামচে খায়, কিন্তু চন্দ্রবিন্দু দিতে ভুলে যায়। এরা না হতে পারে বিলেতি, না খাঁটি বাঙ্গালী।
‘দাদা’রা যে আমাদের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছেন, চন্দ্রবিন্দুসহই দিয়েছেন। এমনিরতও দাদারা ‘চন্দ্রবিন্দু’ ছাড়া কোন কাজই করেন না। না ব্যবসা, না রাজনীতি, আর না কূটনীতি।
তিনি কাজ করেন কাঁটায় কাঁটায়। ঘড়িতে তখন বাজে কাঁটায় কাঁটায় বারটা।
কথাটা শুনে ভয়ে গায়ে আমার কাঁটা দিয়ে উঠেছে। (চন্দ্রবিন্দুটা যদি ছেড়ে দাও, লজ্জায় মাথা কাটা যাবে, আর তাতে চন্দ্রবিন্দু থাকবে না।)
কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা, কৌশল হিসাবে খুব ভালো, যদি তাতে চন্দ্রবিন্দু থাকে। একারণেই দাদারা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে যেমন পটু, আমরা তেমনই অপটু।
অসমাপ্ত