পেয়ারে বেরাদারান! এখনই শুরু হইবে রসের বয়ান। তবে কিনা কলমদানিতে রস এখনও ততটা ভর্তি হয় নাই। সুতরাং আইস, এই অবসরে তোমাদের বাংলাভাষার শব্দজ্ঞান একটুখানি ঝালাই করিয়া দেখি। বল তো ‘ন্যাড়া’ কাহাকে বলে? না, না, বানানের ফ্যাসাদে পড়িও না; তুমি ন্যাড়া লেখ, বা নেড়া, পণ্ডিৎ মহাশয়ের তাহাতে আপত্তি নাই; তুমি শুধু বল, ন্যাড়া কাহাকে বলে? সেই সঙ্গে যদি পার তো বল, উহা কত প্রকার ও কী কী? এই দেখ, আবার শুরু হইল ফ্যাসাদের বানান-ফ্যাসাদ! অবশ্য এখানেও ফ্যাসাদে ও ফেসাদে তেমন ঝামেলা নাই। যদিও বা কিছুটা থাকে, ঝামেলায় কিন্তু মোটেও কোন ঝামেলা নাই। সতুরাং তুমি ফ্যাসাদের পরিবর্তে নির্ঝঞ্ঝাটে ঝামেলা শব্দটি ব্যবহার করিতে পার। ঝঞ্ঝাটে অবশ্য বড় ধরনের ঝঞ্ঝাট আছে, একটু সাবধান থাকা ভাল। আসলে বাংলাভাষার চেহারাখানা যদিও দেখিতে অতিশয় শান্তশিষ্ট স্বর-ব্যঞ্জনবিশিষ্ট, তবে বানানের ফ্যাসাদ বল, ঝামেলা বল, আর ঝঞ্ঝাট বল, পরিমাণে তাহা প্রচুর।অনেক দূরে আসিয়া পড়িয়াছি, না! কোথায় যেন ছিলাম, ন্যাড়া! তো চল, ন্যাড়ার কাছে ফিরিয়া যাই।অবশ্য জিজ্ঞাসা করিতে পার যে, আমার ‘ন্যাড়া-প্রীতি’র কারণটা কী? বঙ্গভাষার শব্দকোষে কাঁঠালের মত কতই ত শব্দের কোষ আছে! ত্রাস ও সন্ত্রাস হইতে শুরু করিয়া তার ও কাঁটাতার, ডোর ও করিডোর, মন ও ‘মনমোহন’, শান্তি ও শান্তিচুক্তি এবং ললাটের তিলক ও কলঙ্কতিলক, এমন কত কিছুই তো হইতে পারে পরীক্ষার বিষয়!
পারে, আলবত পারে; তবে কিনা ন্যাড়া শব্দটির আলাদা মাহাত্ম্য আছে, যাহাকে বলে ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিক মাহাত্ম। আর ইহাই ন্যাড়ার প্রতি আমি অধমের প্রীতির কারণ।
আচ্ছা, এই সকল তত্ত্ব আলোচনার তত্ত্ব পরেও লওয়া যাইবে, এখন চট করিয়া বল দেখি, ন্যাড়া কাহাকে বলে এবং উহা কত প্রকার ও কী কী?
কী? চুপ কেন? পার না, এই তো! জানিতাম, পারিবে না। লেখা-পড়া তো কর না! শুধু‘মোবাইল কর’! লিখিতে বসিলে অঙ্কন কর হংস ডিম্ব, আর পড়িতে বসিলে পাঠ কর অশ্বডিম্ব; সুতরাং ফলাফল ‘ডিডিম্ব’! আর হতাশা হইল ভবিষ্যতের কুটুম্ব!
তবে না, হতাশ হইও না এবং দুশ্চিন্তা করিও না, আমি গোলাম হোসেন বাঁচিয়া থাকিতে কোন চিন্তা নাই, দুশ্চিন্তা তো মোটেও নাই। সবকিছু আমি হাতে কলমে শিখাইয়া দিব।
যদি হাতে কলমে শিখিতে না চাহ, তবে মিয়াঁ ভাই, রক্ষা নাই! কী করিব জান! পড়া-লেখা দু’টিকে ছাতু করিয়া বুড়িগঙ্গার জলে গুলিয়া গিলাইয়া দিব! জান তো ঐ জল বর্ণে গন্ধে এখন কত সুস্বাদু! শুধু শুনিয়া রাখ, ট্যানারিগুলা উহারই তীরে অবস্থিত এবং ঐ জলে মৎস বাস করে না। করে না মানে, করিতে পারে না। আমার কথা বিশ্বাস করিও। আমি বুড়িগঙ্গা-তীরের বাসিন্দা। এখন কেহ ঐ জলে গোসল করে না। করে না মানে, করিতে পারে না। ধোবারা অবশ্য কাপড় ধোয় এবং আশ্চর্য! পরিষ্কারও হয়! আফটার অল গঙ্গা তো! তাও ছুঁড়ি নহে, বুড়ি!
কিন্তু কথা হইল, এত কষ্ট করিয়া ছাতু গিলিবার আবশ্যক কী! হাতে কলমে শিক্ষা করাই তো আসান! তো আইস, বইস এবং সহজ পদ্ধতিতে শিখিয়া লও ন্যাড়া কাহাকে বলে এবং উহা কত প্রকার ও কী কী?
এই যে নিরীহ বালক, কী নাম তোমার? সজীব! তা তুমি কোন্ প্রকারের জীব! গো-চনা পান কর, না গোমাংস আহার কর! থাক, ‘গো-আলোচনা’ এখন থাক। দিনকাল ভাল না। তাছাড়া এখন তো পিতৃপরিচয় লাগে না, মাতৃপরিচয়ই কাফি। সুতরাং ধর্মপরিচয়ের আর আবশ্যক কী? তো বাবা সজীব, তুমি এত নির্জীব কেন? আর মাথা চুলকাইতেছ কেন? উকুন হইয়াছে? লম্বা চুলের জঙ্গলে উকুন হইতেই পারে! মাথা কামাও না কেন? আচ্ছা, চিন্তা করিও না, একটা সুব্যবস্থা করিতেছি।
ঐ যে নরসুন্দর, এদিকে আইস, সজীব বাবার মস্তকটিকে চাঁছিয়া সুন্দর সজীব করিয়া দাও। না, ইন্ডিয়ান ব্লেড ব্যবহার করিও না। তাহাতে চুলের গোড়া কাটে না, চামড়াসহ উঠিয়া আসে এবং কখনো রক্ত ঝরে, কখনো ঝরে খুন । বাংলাদেশী তলোয়ারমার্কা ব্লেডই ব্যাবহার কর। তাতে চুলও সাফ হয়, চামড়াও যথাস্থানে বহাল থাকে।
বাহ, দেখ তো, কী সুন্দর হইয়াছে দেখিতে তোমার মাথাটি এবং মস্তকটি! যেন পাকা বেল!ইহা অবশ্য একটি জটিল প্রশ্ন, মুন্ডিত মস্তকের সহিত বেলের কী সম্পর্ক? আছে, অতিশয় একটি ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিক কারণ আছে। তবে সে আলোচনা এখন থাক। এখন শুধু বাবা সজীবের মস্তকটি অবলোকন কর এবং দেখিয়া শুনিয়া বুঝিয়া লও যে, ইহা হইল ন্যাড়া। বাবা সজীব ও তাহার মস্তক, উভয়েই ন্যাড়া।
আলহামদু লিল্লাহ! কত জটিল বিষয় কত সহজে সমাধান হইয়া গেল! হাতে কলমে ন্যাড়ার পরিচয় জানা হইয়া গেল? বাকি রহিল দ্বিতীয় বিষয়; ন্যাড়া কত প্রকার ও কী কী? ইহা হাতে কলমে বুঝিতে হইলে সকলের ন্যাড়ামাথা হওয়া এবং বেলতলায় যাওয়া আবশ্যক! তা অবশ্য কঠিন ছিল না। নরসুন্দর তো কাছেই আছে, আর বেলগাছটাও দূরে নহে। তবে কি না দুর্ঘটনার আশঙ্কা আছে। হঠাৎ পাকা বেল পড়িতে পারে, খটাশ করিয়া আওয়ায হইতে পারে এবং .. ন্যাড়া মাথাটি ‘ফণ্টন’ করিতে পারে।
ঘটনা এখানেই শেষ, কস্মিনকালেও তাহা ভাবিও না। যাহার মাথা ফাটিল সে যাইবে হাসপাতালে। অতঃপর বাঁচা-মরা নির্ভর করে মালাকুল মউতের কর্মব্যস্ততার উপর। অর্থাৎ তাহার যদি অন্যত্র ‘ডিউটি’ থাকে, তবে তো ভাল। নচেৎ অবসর বুঝিয়া চট করিয়া তিনি আসিয়া পড়িতে পারেন যে, চল ‘বেরাদর’! তুমি তো চলিয়া গেলে এবং আশা করি স্বর্গে, এদিকে শুরু হইবে পুলিশি তদন্ত; তদন্ত মানে রিমান্ড, আর রিমান্ড মানে, আগে শাস্তি পরে বিচার! তো দেখ, যিনি মাথা ন্যাড়া করিবার এবং বেলতলায় গমন করিবার বুদ্ধিটি দান করিবেন তাহার কী করুণ দশা হইতে পারে! সুতরাং হাতে কলমের শিক্ষা থাক, বরং তাত্ত্বিক আলোচনার মাধ্যমেই যথাসম্ভব সহজ করিয়া বুঝিয়া লও। সেজন্য ভূমিকাস্বরূপ আমাদিগকে জানিতে হইবে, ন্যাড়া মাথা ও বেলতলা, এ দুইটিতে ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিক সম্পর্কটি কী? বঙ্গদেশের প্রাচীন ইতিহাস ঘাঁটিয়া যাহা জানা গিয়াছে তাহা এই- আদিকাল হইতে বঙ্গদেশে মানুষ ও বেলগাছ, এক সঙ্গে বাস করিয়া আসিতেছে।ভ্রাহ্মণেরা দিনে কয়েকটি নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতেন এবং প্রচুর আহার করিতেন। ফলে পেটে অসুখ লাগিয়াই থাকিত। একদিন এক বৈদ্য আবিষ্কার করিলেন, পাকা বেলের শরবত ও কাঁচা বেলের শুঁটকি পেটের গোলমালে অতিশয় উপকারী। শুনিয়া ভ্রাহ্মণেরা ভারি আশ্বস্ত হইলেন।
একদিন এক ব্রাহ্মণ বেলতলায় গেলেন। উদ্দেশ্য, পড়িয়া থাকা পাকা বেল এবং ঝুলিয়া থাকা কাঁচা বেল সংগ্রহ করিবেন। ব্রাহ্মণগণ মস্তক মুন্ডন করেন। মাথায় চুল থাকে না, শুধু টিকি থাকে; আর জানা কথা, মুন্ডিত মস্তক বেলতলায় গমন করিবার পক্ষে বিশেষ উপযোগী নহে। ব্রাহ্মণ তাহা জানিতেন না। তিনি নিশ্চিন্ত মনে বেলতলায় গেলেন এবং..।পেয়ারে বেরাদারান, এবং-এর পরেরটুকু তুমি নিজেই বুঝিয়া লও। দেখিতেছ নিশ্চয়, আমার সময় ফুরাইয়া আসিয়াছে! আচ্ছা, হায়াতের বাত্তিতে যদি তেল অবশিষ্ট থাকে তবে আগামীবার!
(ইনশাআল্লাহ)