আমাতুল্লাহ তাসনীম সাফফানা
এই গভীর রাতে আকাশে চাঁদ জেগে আছে, আর পৃথিবীতে জেগে আছি আমি। তারারা হয়ত ঘুমিয়ে আছে জোসনার চাদর মুড়ি দিয়ে; তাই তাদের দেখা যায় না। আমার পৃথিবীতেও আমি ছাড়া সবাই ঘুমিয়ে আছে। আমার স্বামী, আমার সন্তান, ছেলে মেয়ে।
আমি জেগে আছি একটি লেখার জন্য। কিন্তু লেখা আসছে না। আকাশ থেকে এত জোসনা ঝরছে, আমার কলম থেকে কালি ঝরছে না। বাগানে বাগানে কত ফুল ফুটছে, আমার কলমে শব্দ-কলিরা ফুল হয়ে ফুটছে না।
সবাই যখন জেগে থাকে, তখন সময় হয় না বলে লিখতে পারি না। কিন্তু ঘুমন্ত রাতের নিঝুম অন্তরঙ্গতার মুহূর্তেও যদি লিখতে না পারি! আববুর কথা, লেখার জন্য কলম শুধু কালি চায় না, কালির সঙ্গে অশ্রুর মিশ্রণ চায়। আমি তো কেঁদেছি; কলমের কালিতে অশ্রুর জল মিশিয়েছি, তবু কেন লেখা আসছে না! আমার চোখের নোনা অশ্রুতে হয়ত সেই উষ্ণতা, সেই পবিত্রতা নেই, কলমের কালিতে তাই লেখার প্রবাহ নেই। আচছা, এখন না হয় থাক; জলভরা মেঘ থেকে যখন বৃষ্টি ঝরবে, মনের আনন্দে তখন না হয় ভিজবো। মেঘের জন্য, বৃষ্টির জন্য ব্যাকুল প্রতীক্ষারও তো আনন্দ আছে! কলমটা তুলে রেখে টেবিল থেকে উঠে এলাম।
***
স্বামীর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মমতায় মনটা সিক্ত হলো। ঘুমুক। সারাটা দিনের কঠিন দৌড়ঝাঁপের পর মানুষটি একটু যদি শান্তির ঘুম ঘুমোতে পারে, আমার ভালো লাগে। লেখার জন্য আলো জ্বালতে ভয় করে, ঘুমের যদি ব্যাঘাত ঘটে। আমার পেয়ারা নবী তো রাতের তাহাজ্জুদে স্ত্রীর ঘুমের প্রতি সতর্ক থাকতেন! একটু শান্তিতে ঘুমাক কয়েকটা ঘণ্টা। আবার তো সামনে আছে কঠিন সংগ্রাম, নির্মম কর্মযজ্ঞ। সেখানে কারো প্রতি কারো দয়া নেই। সবার লক্ষ্য শুধু নিজে এগিয়ে যাওয়া। অন্য কেউ যদি পথ থেকে ছিটকে পড়ে তাতে কারো কিছু আসে যায় না। ফিরে তাকাবারও ফুরসত থাকে না। অথচ ইসলামের সোনালী যুগে! মানুষ কত সুন্দর করে ভাবতো, ‘আমার ঘরে বাতি যদি নাও জ্বলে, প্রতিবেশীর ঘরে যেন আলো থাকে। আমার ঘরে খাবার যদি নাও থাকে, প্রতিবেশীর ঘরে যেন তৃপ্তি থাকে। আমার দোকান যদি খালিও থাকে, প্রতিবেশীর দোকান যেন থাকে ভরপুর ।’
তখন সবার ঘরে শান্তি ছিলো, সবার মুখে হাসি ছিলো, অন্তরে তৃপ্তি ছিলো। কিন্তু এখন! সবাই সবার শান্তি কেড়ে নিতে চায়, তাই কারো ঘরেই শান্তি নেই। সবাই সবার মুখের হাসি, অন্তরের তৃপ্তি ছিনিয়ে নিতে চায়, তাই কারো মুখেই হাসির উদ্ভাস ও তৃপ্তির প্রশান্তি নেই, আছে শুধু অশান্তির কালো ছায়া এবং অতৃপ্তির যন্ত্রণা। কেন এমন হয়! কেন লোভ-লালসার এত কদর্যতা! স্বার্থের সঙ্ঘাতের এমন বীভৎসতা! কেন এই হিংস্রতা ও বর্বরতা! কেন এই পাশবিকতা ও নিষ্ঠুরতা! মানুষ কি হতে পারে না মানুষের মত! কেন হয় না!
ঘুমন্ত মানুষটিকে দেখতে বড় মায়া লাগছে। মুখমন্ডলে পবিত্রতার, নিষ্পাপতার আশ্চর্য সুন্দর একটি ছাপ আছে। ঘুমুক, কিছু সময় একটু শান্তিতে ঘুমিয়ে থাক। প্রার্থনা করি, আগামী ভোরে আবার যখন শুরু হবে জীবনের দৌড়ঝাঁপে, তখন কেউ যেন ওকে আঘাত না করে, কষ্ট না দেয়। ওর দ্বারাও যেন কারো ক্ষতি না হয়; কোন পরিবারের, কোন মাসুম বাচ্চার মুখের আহার ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। সবাই যেন সবার কল্যাণকামী হয়।
একটি অসহায় মেয়ে অন্তরের প্রার্থনা ছাড়া, হৃদয়ের কোমল কিছু মিনতি ছাড়া আর কী নিবেদন করতে পারে!
***
ছোট্ট সন্তানের ঘুমন্ত মুখ মায়েদের কাছে সবচে’ আদরের, সবচে’ আনন্দের। কিসের সঙ্গে হতে পারে শিশুর ঘুমন্ত মুখটির তুলনা! চাঁদ যদি মা হতো, চাঁদের যদি ছোট্ট কোন সন্তান হতো, আর সেই চাঁদশিশু যদি ঘুমিয়ে থাকতো, তাহলে কি এর চেয়ে সুন্দর মনে হতো কোন মায়ের চোখে!
‘চাঁদের মা হওয়া, আর তার কোলে ছোট্ট চাঁদ-শিশুর ঘুমিয়ে থাকা, এমন কল্পনা তো আর কখনো আসেনি মনে! ঘুমন্ত শিশুর মুখটি দেখে কত অদ্ভুত কল্পনা আসে মায়ের মনে! অন্য মায়েরা কী ভাবে, জানতে বড় ইচ্ছে করে। এটাও তো হতে পারে লেখার একটি বিষয়! ভারতের, বিলেতের, আরবের, চীনদেশের, কৃষ্ণ মহাদেশের মায়েদের অনুভূতি নিয়ে যদি একটি লেখা হতো! সবদেশের মায়েদের মুখ থেকে যদি শোনা যেতো, তার প্রাণের শিশুটি যখন ঘুমিয়ে থাকে, তার কেমন লাগে! হৃদয়ের গভীরে তখন কী অনুভূতি জাগে! পৃথিবীর সবচে’ সুখিনী মা এবং সবচে’ দুঃখিনী মা, দু’জনেরই কেমন লাগে! আল্লাহর উদ্দেশ্যে, ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে এবং ভগবানের উদ্দেশ্যে মাতৃহৃদয়ে তখন কী আকুতি ও মিনতি, কী আকাঙ্ক্ষা ও প্রার্থনা উদ্বেলিত হয়! আমার জানতে বড় ইচ্ছে করে; এসব নিয়ে আমার লিখতে বড় ইচ্ছে করে। পৃথিবীর যেখানে যত দুঃখিনী মা আছে, তাদের শিশু সন্তানদের জন্য যদি কিছু করা যেতো! অন্তত আমার দেশে! আমার চারপাশে! অন্তত একজন দুঃখিনী মায়ের অন্তরে যদি শান্তি দেয়া যেতো, তার শিশুটির জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যত নির্মাণ করে! আমি কি পারবো এমন কিছু করতে কোনদিন? আমাদের সমাজে আমাদের মত অসহায় মেয়েরা, আরো অসহায় মায়েরা কী করতে পারে? আসলেই কি আমরা এত অসহায়? অন্তত যেখানে আছি সেখান থেকে কি একটু এগুতে পারি না? কিছুটা শিক্ষা একটু উন্নত চিন্তা, সামান্য সুন্দর আচরণ, অন্তত এতটুকু কি আমরা অর্জন করতে পারি না? কেন পারি না? এত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চিন্তায় কেন দিন-রাত নিজেদের আমরা জড়িয়ে রাখি? আমার ক্ষুদ্রতা থেকে আমার সন্তানও যে শুধু ক্ষুদ্রতাই শিখতে পায়! আমি কেন শুধু আমার সন্তানের মা হয়ে থাকি? কেন আমি হতে পরি না সব শিশুর, সব সন্তানের মা? আমার সন্তান যদি আমার এমন কল্যাণময়ী মাতৃরূপ দেখতে পায় তাহলে কত ভালো হয়! তাহলে আমার কাছ থেকে কত সুন্দর শিক্ষা পায় সে, পাঠশালার প্রাণহীণ বর্ণসর্বস্ব শিক্ষার আগে! কেন বলা হয়, ‘মাতৃক্রোড় শিশুর সর্বোত্তম পাঠশালা! আমাদের সমাজে মায়েদের কোল কি হতে পারছে সন্তানের জন্য সর্বোত্তম পাঠশালা! মায়েরা কি হতে পারছে সন্তানের জন্য আদর্শ শিক্ষীকা! সেই শিক্ষা কোথায় মায়েদের! আমাদের! আমার!
***
ঘুমন্ত শিশুর ‘জোসনাধোয়া’ মুখমন্ডল দেখে দেখে মায়ের অন্তরে কত চিন্তা, কত ভাবনা আসে! কত স্বপ্ন, কত কল্পনা জাগে! কত শঙ্কা, কত আশঙ্কা দোলা দিয়ে যায়! হয়ত ঘুমন্ত শিশুর মুখ দেখেই কোন মায়ের শঙ্কিত হৃদয় থেকে প্রার্থনা এসেছিলো, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’!
আমিও তো মা! মাতৃহৃদয়ের অনুভূতি আমি বুঝি। কিন্তু এই ছোট্ট ঘুমন্ত শিশুটির জন্য দুধ-ভাতই কি হতে পারে আমার প্রথম ও শেষ আকাঙ্ক্ষা! না, আমি বরং প্রার্থনা করি, আমার সন্তান এবং পৃথিবীর সব সন্তান যেন হয়, ফুলের সুবাসের মত! চাঁদের জোসনার মত! আকাশের উদারতার মত! সাগরের গভীরতার মত! এবং .. এবং যেমন মানুষের স্বপ্ন দেখেছেন পৃথিবীর আদর্শ মানুষেরা, সেই মানুষের মত!
ছেলেটি ঘুমিয়ে আছে, মেয়েটিও ঘুমিয়ে আছে। যখন জেগে থাকে, ছেলেটি কত কথা বলে, নির্দোষ দুষ্টুমিতে ঘরটা মুখরিত করে রাখে। মা বলে ডাকে, কোলে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
মেয়েটি তাকিয়ে থাকে। চোখে তার, আগে শুধু চাহনি ছিলো। সেই চাহনিতে পরিচয় ছিলো না, বিস্ময় ও কৌতুহল ছিলো না। এখন তার অবাক চাহনি হৃদয়কে স্পর্শ করে। এখন মাকে সে বুঝতে পারে। বাবাকে, ভাইকে চিন্তে পারে। চোখের চাহনি থেকে বোঝা যায়, অনেক কিছু সে জানতে চায়; অনেক কিছু বলতে চায়। সেই চাহনির ভাষাকে একজন মা- হোক প্রাসাদের, বা কুড়েঘরের- নিজের মত করে বুঝে নেয়। তাতে মায়ের মন আনন্দে উদ্বেলিত হয়; তার মুখ খুশিতে হয় উদ্ভাসিত! এভাবে কয়েক ফোঁটা দুধের দান অনেক বড় প্রতিদান হয়ে তার কাছে ফিরে আসে মায়ের কাছে। মায়ের দেহ-মনের সব বেদনা ও জন্ত্রণা, সব অশান্তি-অবসাদ মুছে দিয়ে যায় শিশুর ছোট্ট একটুকরো হাসি। শিশুর শৈশবের শুধু এই কোমল অংশটুকুই মায়ের জীবনে শান্তি ও সান্ত্বনা। এর আগে ও পরে শুধু বেদনা আর যন্ত্রণা। জন্মের আগে গর্ভবেদনা, জন্মের সময় প্রসববেদনা, আর মৃত্যু পর্যন্ত থাকে কত রকম যন্ত্রণা, কে তার হিসাব বলতে পারে এক আল্লাহ ছাড়া!
ঘুমন্ত শিশুর জোসনাধোয়া মুখ দেখে মনে কত ভাবনা আসে! কেমন হবে আমার সন্তান! আমার নাযরানা! আমার আফনান! হে আল্লাহ প্রসববেদনাই যেন হয় ওদের পক্ষ হতে মাকে দেয়া শেষ বেদনা। পৃথিবীর সব সন্তানের জন্য আমার এই কামনা। ভাষা, বর্ণ, এমনকি ধর্ম ভিন্ন হলেও পৃথিবীর প্রতিটি সন্তানকে যেন স্পর্শ করে আমার এই শুভকামনা।
***
ছেলেটি ঘুমিয়ে আছে। মেয়েটিও ঘুমিয়ে আছে। ঘুমন্ত দুই মুখম-লে বয়সের ব্যবধান নেই। বড়-ছোট দু’টোই যেন গোলাবের কলি! ঘুমন্ত মুখদু’টোর দিকে তাকিয়ে কেন জানি আমার ইচ্ছে হলো, ওরা দু’টিতে চিরকাল এমন করেই ঘুমিয়ে থাক; সতৃষ্ণ নয়নে, অতৃপ্ত হৃদয়ে আমি শুধু দেখতে থাকি ওদের!
না থাক, ওরা ওদের সময়ে জেগে উঠুক। বড় হতে থাকুক। জীবনের সব সৌন্দর্য এবং যৌবনের সবটুকু পবিত্রতা ওদের আলোকিত ও উদ্ভাসিত করুক। আমি তিলে তিলে ক্ষয় হবো ওদের জন্য। আমার ক্ষয় দিয়ে ওরা জীবনকে জয় করুক। শুধু এইটুকু মিনতি; আমার কাছে, আমার জন্য ওরা যেন আজকের এই রাত্রের শিশুটিই হয়ে থাকে।
***
আকাশে চাঁদ জেগে ছিলো। চাঁদ কেন জেগে থাকে, স্রষ্টার কাছে তার কী চাওয়ার থাকে জানি না। এই গভীর রাতে আমার পৃথিবীতে আমি জেগে ছিলাম একটি লেখার জন্য। না, আমি জেগে ছিলাম আমার আববুর হৃদয়ের প্রশান্তির জন্য। কলমে লেখা আসেনি। হৃদয়ের ভাব-উদ্যান থেকে শব্দের কলিরা ফুল হয়ে ফুটেনি। আসলে সৃষ্টির প্রসববেদনা তখনো তীব্র হয়নি।
আকাশে চাঁদের মুখ দেখে, ঘরে স্বামী-সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হৃদয়ের আকাশে কখন যে এমন মেঘ জমলো! জলভরা মেঘ থেকে এমন বৃষ্টি ঝরলো! আমি মনভরে ভিজলাম একটি লেখার বৃষ্টিজলে!
চাঁদের মুখ, স্বামী-সন্তানের মুখ, এই চারটি মুখের কাছে আজকের গভীর রাতের নিঝুম সময়ের এই লেখাটির জন্য আমি কৃতজ্ঞ! আমি কৃতজ্ঞ আমার কলমের কাছে এবং রাববুল কলমের কাছে।