‘জনগণের সরকার’ যখন আড়িয়াল বিল থেকে পিছু হটার পরো পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বপ্নে বিভোর তখন দেশবাসীকে আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই মাত্র কয়েক হাজার কোটি টাকার গঙ্গাবাঁধ প্রকল্পের ভুলে যাওয়া স্বপ্নের কথা।
পঞ্চাশের দশকে শুরু হয়েছিলো গঙ্গা-কপোতাক্ষপ্রকল্প, যার মূল উদ্দেশ্য ছিলো শুকনো মওসুমে বর্ধিত ধান-উৎপাদন। এর সুফলরূপে সংশ্লিষ্ট বিশাল অঞ্চলে যখন তিনগুণ ফলন শুরু হলো, কৃষকের মুখে হাসি ফুটলো আর দেশ খাদ্যে স্বনির্ভর হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হলো তখনই নেমে এলো ফারাক্কার অভিশাপ। খাদ্য-উৎপাদনে নেমে এলো ভয়াবহ ধ্বস। কারণ পুরো অববাহিকায় শুকনো মওসুম ছাড়া পানি থাকে না। ফলে ভূগর্ভের পানি এত নীচে নেমে গেলো যে, ইরিচাষও মার খেলো।
সমগ্র অববাহিকাকে ফারক্কার অভিশাপ থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যেই পরবর্তীকালে গ্রহণ করা হয়েছিলো গঙ্গাবাঁধ নির্মাণের প্রকল্প। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের ফলে প্রকল্পটি আর আলোর মুখ দেখতে পায়নি। অথচ এ বাঁধ নির্মাণ করা সম্ভব হলে আজ পরিস্থিতি হতো সম্পূর্ণ বিপরীত। ভারতের পানি-কুটনীতি মুখ থুবড়ে পড়তো এবং রক্ষা পেতো আমাদের পরিবেশ, কৃষি ও মৎস-সম্পদ। তার উপর ছিলো বিশাল জলাধার সৃষ্টি ও বিদ্যুকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা। এটা সম্ভব হলে আজকের ভয়াবহ বিদ্যুৎ সমস্যা হয়ত আমাদের দেখতে হতো না।
গঙ্গাবাঁধ যথাসময়ে নির্মিত না হওয়ায় আমাদের বাঁচা-মরা এখন সম্পূর্ণরূপে ভারতের দয়ার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল মরুপ্রবণতার মুখে পড়েছে এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে আমাদের বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ সুন্দর- বনের অস্তিত্বও হয়ে পড়েছে হুমকির সম্মুখীন। বলাবাহুল্য যে, এ ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় যদি অব্যাহত থাকে তাহলে পুরো অববাহিকা অঞ্চলটি, সেদিন খুব বেশী দূরে নয়, যখন তা মনুষ্যবাসের আর উপযোগী থাকবে না, বরং ঊষর মরুভূমিতে পরিণত হবে।
আমরা বিশ্বাস করতে চাই, ‘জনগণের সরকার’ দেশ ও জনগণের উন্নতির মহৎ উদ্দেশ্য থেকেই পঞ্চাশহাজার কোটি টাকার বিশাল ব্যয়সাপেক্ষ একটি নতুন আন্তর্জান্তিক বিমানবন্দর এবং বঙ্গবন্ধু সিটি নামে একটি আধুনিক উপশহর গড়ে তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এটা অবশ্য ভিন্ন কথা যে, দেশের সাধারণ মানুষ ও বিশেষজ্ঞগণ শুরু থেকেই জোর দিয়ে বলে আসছেন, বর্তমানে তো নয়ই, এমনি অদূর ভবিষ্যতেও নতুন বিমানবন্দরের কোন প্রয়োজনীয়তা নেই, বরং এ উচ্চাভিলাষী প্রকল্প জাতির জন্য হবে অসহনীয় এক বোঝা এবং স্বয়ং সরকারের জন্য হবে আত্মঘাতী।
আমরা অবশ্য এত দূর যেতে চাই না। আমরা মনে করি, সরকার লাভ-লোকসান হিসাব করেই মাঠে নেমেছে এবং সরকার তার সিদ্ধান্তের সফলতা সম্পর্কেও নিশ্চয় শতভাগ আশ্বস্ত। আমরা শুধু বলতে চাই; দেশ ও জাতিকে ফারক্কার অভিশাপ থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে সরকার যেন তার এই বিশাল প্রকল্প থেকে সামান্য কয়েক হাজার কোটি টাকা বাঁচিয়ে গঙ্গাবাঁধ নির্মাণ-প্রকল্পের হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নটিকে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। তাহলে জাতি সরকারের প্রতি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ হবে।