মেয়েটির কত কষ্ট হয়েছিলো মৃত্যুর সময় পানির পিপাসায়! কয়েক ফোঁটা মাত্র পানি চেয়েছিলো মেয়েটি, যারা গুলি করেছিলো তাদের কাছে এবং ‘মহান’ ভারতের কাছে। দেয়নি! আমাদের লুণ্ঠিত পানি থেকেও দিতে পারতো কয়েক কাতরা! তাও দেয়নি। ‘পানি! পানি!’ চিৎকার করছিলো অসহায় মেয়েটি! শেষে আর চিৎকার-শক্তি ছিলো না। রক্তাক্ত দেহটা ছটফট করে নিস্তেজ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলো।
ওপারে বিবেক থাকে না; তাই বিবেকের দংশন হলো না। এপারে সাহস থাকে না, তাই কোন প্রতিবাদ হলো না। কাঁটাতারের উপর লাশটা ঝুলে ছিলো, ঝুলেই থাকলো। পরে টানাহেঁচড়া করে লাশটা নিয়ে গেলো; গায়ের অলঙ্কারগুলো ‘রেখে দিলো’। এটা ওরা পারে ভালো। লাশটা যখন ফেরত দিলো, সেদিকে তখন আর চাওয়া যায় না! তবু সান্ত্বনা, আমাদের ফেলানি লাশ হয়েও ফিরে এসেছে আমাদের কাছে! কাফনে আবরু ঢেকে মাটির নীচে রাখা গেছে তাকে! কিন্তু ...
এখনো আমি যেন দেখতে পাই, কাঁটাতারে ঝুলছে মেয়েটির লাশ? কী ছিলো তার অপরাধ? সে কি শত্রু ছিলো তাদের? এতটুকু মেয়ে শত্রু হতে পারে এত বড় দেশের? কেমন পশু হলে, কত হিংস্র হলে একটি অসহায় মেয়েকে গুলি করে খুন করতে পারে, যে মেয়েটি জানে না, কাকে বলে সীমান্ত? কেন এই কাঁটাতারের বেড়া?
এখনো আমি যেন দেখতে পাই, কাঁটাতারে ঝুলছে মেয়েটির লাশ? কোথায় তাহলে মানবতা ও মানবাধিকার? তেহরানে রাজপথের মিছিলে গুলিবিদ্ধ তরুণীর মৃত্যুতে যারা অশ্রুপাত করে, কোথায় তারা? ফেলানির ঝুলন্ত লাশ কি তারা দেখেনি? কখন তারা দেখে? কখন শোনে? লাশের মূল্য কখন তাদের কাছে? কখন হয় কোন লাশ মূল্যহীন?
এখনো আমি যেন দেখতে পাই, কাঁটাতারে ঝুলছে মেয়েটির লাশ? কেন এ পাশবিকতা? কে দেবে জাবাব এ প্রশ্নের, এ আর্তনাদের? ওরা বন্ধু আমাদের? নদীর বুকে তাহলে বাঁধ কেন? কেন ভূমিদখল সীমান্তের? কেন ফসল কেটে নেয়; গরু-মানুষ ধরে নেয়? তুমি দেবে বেড়া, আমরা দেবো পথ, এর নাম বন্ধুত্ব? এরই জন্য স্বাধীনতা? কোথায় তুমি হে স্বাধীনতা?!
কোথায় তুমি, হে মা! হে মাতৃভূমি! সন্তানকে রক্ষা করতে যদি না পারো, তাহলে কেন ‘মা’ হলে? কেন লক্ষ বুকের রক্ত নিলে? তোমার আকাশ, তোমার ভূমি, তোমার লাল-সবুজের সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য তোমার সন্তান প্রাণ দিতে পারে; বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিতে পারে, কিন্তু হে মা! হে মাতৃভূমি! পাখীর মত গুলি খেয়ে তোমার ছেলে মরতে পারে না; বে-আবরু লাশ হয়ে তোমার মেয়ে কাঁটাতারে ঝুলে থাকতে পারে না।
হে বুদ্ধিজীবী! হে স্বার্থজীবী! কোথায় তোমাদের বিবেক? আর কতকাল থাকবে তা বন্ধকি মাল? ‘পানি! পানি!’ আর্তনাদ শুনতে কি পাওনি? তোমাদের বিবেক একবারও কি ঝাঁকুনি খায়নি? কেন হলো না কোন বিক্ষোভ, সামান্য প্রতিবাদ, অন্তত অক্ষম একটি আর্তনাদ? এত টেবিল-গোলটেবিল, এত ভাষণ-প্রবন্ধ, তাহলে কিসের জন্য?
হে লেখক, কবি, গায়ক ও শিল্পী! কোথায় তোমার শব্দের বারুদ, কবিতার ফুলকি, গানের শিখা অনির্বাণ! কোথায় তোমার চিত্রকর্মের রক্তলাল বর্ণ? এই একুশের, এই পদকের, এই নামফলকের তাহলে কী মূল্য? এই কবিতার আসর, গানের জলসা ও চিত্রপ্রদর্শনী তাহলে কিসের জন্য?
রক্তলাল একটি লাশের আড়ালে ঐ কাঁটাতারে আসলে কি ঝুলে আছে আমাদের মানচিত্র!? কী অপরাধ মানুষের এবং মানচিত্রের?! মানুষ ও মানচিত্র আর কতকাল এভাবে লাঞ্ছিত হবে? তারপরো চলবে ‘এপারে ওপার-নর্তকীদের’ নাচ-গান! তারপরো জ্বলবে মঙ্গলপ্রদীপ! এর নাম যদি হয় স্বাধীনতা, তাহলে....!