শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

মুহররম ১৪৩২ হি: (১৮) | তোমাদের জন্য

একটি সফরনামা

 

পরীক্ষার পর দীর্ঘ বিরতিতে বাড়ী এসেছি। মনটা খুশিতে ফুরফুর করছে, আর দিনগুলো ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে উড়ে যাচ্ছে। ‘তাউই’ সাহেব এবারও দাওয়াত দিয়েছেন বেড়াতে যাওয়ার জন্য। কখনো সুযোগ হয় না, এবার সুযোগটা নাগালের মধ্যে আছে। তো দাওয়াত কবুলের সুন্নতটা এবার আদায় করা যায়।

দিন-তারিখ ঠিক করা ছিলো এবং তা আজ। বড় ভাইয়া, আমি, আমার ছোট ভাই, আর আমাদের ছোট্ট ভাগিনী। ছোট্ট মানে এত ছোট যে, সে ভাষার নিয়মে কথা বলে না, ভাষা তার নিয়মে কথা বলে, ফলে শ্রোতাকে নিজের বুদ্ধিতে বুঝে নিতে হয়। 

চারজনের ছোট্ট কাফেলা, খুব মজার সফর হবে বলে মনে হলো। আমার মনে অবশ্য একটা বাড়তি আনন্দ আছে, যাকে বলে ‘রথ দেখা ও কলা বেচা’র আনন্দ। অর্থাৎ আরামের সফরও হবে, আবার বাংলা ভাষা মানুক বা না মানুক, তাকে জোর করে  ‘টুটাফাটা’ একটা সফরনামা ‘হাদিয়া’ দেয়া যাবে। আসলে বাংলাভাষা অত নির্দয় না। সে তো খুশিমনেই গ্রহণ করবে। সমস্যা হলো পুষ্পের সম্পাদক। তিনি প্রথমে বাতিল করতে চাইবেন বানানের ফ্যাঁকড়া তুলে (বানানভুল মোটে বারটা, তাই ছেড়ে দেয়া হলো -সম্পাদক), তারপর শব্দচয়ন, বাক্যগঠন, ভাষার গাঁথুনি, আরো কত কী! যাকগে, পাঠক যদি এ সফরনামা থেকে বঞ্চিত হয় সেটা পাঠকের ‘কমকিসমতি’, আমার তাতে কী! 

ভাইয়া বললেন, এত মিনিটে গোসল করে অত মিনিটে প্রস্ত্তত হও। তা-ই করলাম নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ১৩ মিনিট বেশী খরচ করে। বাঙ্গালীর জন্য এটা তেমন কিছু না। ভাইয়াও বললেন, আমিও আগে থেকে কিছু ‘হাতখরচ’ রেখে দিয়েছিলাম। আম্মু ইস্ত্রীকরা কাপড় এগিয়ে দিলেন। হঠাৎ ইমাম গাজ্জালী (রহ)-এর একটি লেখা, ‘আল্লাহ যদি জিজ্ঞাসা করেন, বান্দা, মানুষের জন্য তো সারা জীবন সজ্জিত হলে, আমার জন্য কত দিন ‘সাফসুতরা’ হয়েছো!

সত্যি তো! কী জবাব আছে আমাদের?! হে আল্লাহ, আমাদের সকল সাজসজ্জা তোমার জন্য গ্রহণ করে নাও। আমাদের নিয়ত বিশুদ্ধ করে দাও।

আম্মু দু‘আ দিলেন, উপদেশ দিলেন এবং পথে খুব সাবধানে চলতে বললেন। মায়ের অনুভূতি সন্তান বুঝতে পারে না। যে কারণেই সন্তান ঘরের বাইরে যাক, মায়ের প্রতিমুহূর্ত কাটে উৎকণ্ঠায়। এর কোন প্রতিকার নেই। এখন অবশ্য একটা প্রতিকার বের হয়েছে, যার নাম মোবাইল, তবে ...।

দুপুর বারটার একঘণ্টা আগে ঘর থেকে বের হলাম। আতরমোড় থেকে ভ্যানযোগে বানারপাড় পৌঁছলাম। চালকের মনে হয় খুব কষ্ট হয়েছে ভ্যান চালাতে। সংসার চালাতে হলে বেচারাকে ভ্যান চালাতে হবে, চালিয়েই যেতে হবে। যখন শরীরে আর কুলাবে না, তখন কী হবে! মনে হয় ভ্যানচালকের চোখের ঘোলা দৃষ্টিতেও রয়েছে অদূর ভবিষ্যতের সেই অনিশ্চয়তার ছাপ। মনের ভিতরে একটু সামান্য সহমর্মিতা পোষণ করা ছাড়া আসলে আর কী করতে পারি আমি?! ভবিষ্যতে কি পারবো কিছু করতে?!

এখান থেকে মোমেনশাহী যেতে হবে হয় বাসে, না হয় সিএনজিতে। অল্প দূরত্বের জন্য আমার মতে সিএনজি হলো আরামদায়ক বাহন। সিএনজি এ পথে নতুন নেমেছে। ভালোই চলে। আমার হুজুর বলেন, বাহন পাওয়ার জন্য পরীক্ষিত আমল হলো সুরায়ে কুরায়েশ পড়া। পড়লাম এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ফল পেলাম। কালিবাড়ি পর্যন্ত গিয়ে গাড়ির ইঞ্জিন ঠিকই ছিলো, কিন্তু চালকের মাথা গেলো বিগড়ে। সে আর সামনে যাবে না। কী আর করা! হয়ত ‘কালিবাড়ি’ নামটাই অনিষ্টের মূল। যাক, বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। একটা বাস এলো, আমাদের নেবে কি নেবে না, ভেবে কলেমা পড়ছি। বাসটা থামলো এবং আমাদের তুলে নিলো। তিনটি আসন পাওয়া গেলো। এতক্ষণে মনে পড়লো। আসলে আমরা শয়তানের ফাঁদে ধরা পড়েছিলাম। সিএনজিতে ওঠার সময় দু‘আ পড়া হয়নি। এবার আর ভুল হলো না। বেশ শব্দ করেই দু‘আ পড়লাম। দু‘চারজন যাত্রী ফিরে  তাকালো। তাদের চোখের চাহনির তরজমাটা অবশ্য বুঝতে পারিনি। যাকগে, তরজমা বোঝার অত কী দরকার!

বাইরে বাতাস ছিলো। জানালা দিয়ে বাতাস আসছিলো। বেশ আরাম লাগছিলো। আল্লাহর দান বাতাস সবার জন্য। যারা তাঁর কথা শোনে তাদের জন্য, যারা শোনে না তাদেরও জন্য। সুবহানাল্লাহ!

জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। মনে হলো সমগ্র বাংলাদেশের ছবি আমার সামনে। অবশ্য পার্বত্য চট্রগ্রামের ছবি এর চেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির। ফসলের মাঠ আছে, খাল আছে, বিল আছে এবং বেশ দূরে দূরে আছে গ্রামের ছায়া। কখনো খুব কাছে। গ্রামের ছেলে-মেয়েদের এবং কুলবধুদের দেখা যায়। ছেলে-মেয়েরা খেলা করছে। কুলবধুরা বাড়ীর উঠানে কাজ করছে। বাস তো ছুটে চলেছে দ্রুত গতিতে। তাই চোখের পলকে সব দৃশ্য অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।

আমাদের ছো্ট্ট ভাগিনীটি এর আগে গাড়ীতে চড়েনি। তাই তার কৌতূহলের শেষ নেই। এটা কী? ওটা কী? কী? কেন? কে? কবে? হাজারটা প্রশ্নে ভাইয়াকে সে বেশ কাহিল করে এনেছে। তবু ভাইয়া ধৈর্যের প্রতিমূর্তি হয়ে তার কৌতূহল মিটিয়ে চলেছেন।  শেখার মত বিষয় বটে। একটা ট্রাক যেতে দেখে ওর প্রশ্ন, ‘ওটা কী?’ ‘ওটা ট্রাক। আমরা যেটায় বসেছি, এটা হলো বাস, আর ওটা হলো ট্রাক।’ ‘ট্রাকের মধ্যে কী?’ ‘ট্রাকের মধ্যে বালু।’ বালু দিয়ে দা ধার দিতে দেখেছে, তাই এবার পরবর্তী প্রশ্ন, ‘বালু দিয়ে দা ধারাবে?’ ভাইয়া আর কী বলবেন, বললেন, হুঁ। কিন্তু সামান্য ‘হুঁ’তে ওর চলবে কেন! ‘বলো না, বালু দিয়ে কী করবে?’ ‘দা ধারাবে।’ হাঁ, এবার হয়েছে। বাববা, ভাইয়ার ধৈর্য বলে কথা!

ভাইয়া বললেন, এই যে খাকডহর মাদরাসা!

গাড়ী খাগডহর মাদরাসার একেবারে নিকট দিয়ে গেলো, কিন্তু থামলো না, থামার কথাও নয়। বহু দিন থেকে মনের সুপ্ত একটি বাসনা, খাগডহর মাদরাসা দেখবো। এত কাছ থেকে দেখা হলো, তবু দেখা হলো না! এমনই হয়।

রাস্তার দু‘পাশে বৃক্ষের সারি। ফলে পুরো পথটা সুন্দর ছায়াঘেরা। এমন সুন্দর দৃশ্য ও পরিবেশ যে ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। গাছেরা যেমন পরিবেশ বাঁচায় তেমনি পথের সৌন্দর্য বাড়ায়। পথিককে ছায়া দেয়, শান্তি দেয়। তবু গাছের প্রতি আমাদের মমতা নেই। যখন তখন প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আমরা বৃক্ষনিধন করি। বলতে হয় আসলে আমরা নিজেরা নিজেদের পায়ে কুড়াল মারি।

গাড়ি এসে থামলো হাইস্কুল গেইটে আমাদের নামানোর জন্য। এখানেই আমরা নামবো।

এখান থেকে ‘তাউইদের’ বাড়ী খুব দূরে নয়। অল্পক্ষণেই আমরা পৌঁছে গেলাম। হঠাৎ দেখার এবং হঠাৎ পাওয়ার আনন্দ এখন আর নেই। সে আনন্দ মাটি করে দিয়েছে মোবাইল। তাই আমাদের পেয়ে সবাই আনন্দিত হলো, তবে যাকে বলে উচ্ছ্বসিত হওয়া, সেটা হলো না। না তাদের, না আমাদের।

খাওয়াদাওয়া হলো রীতিমত একটা ভোজের পরিবেশে। যত

খাই বলে, আরেকটু খাও। আরেকটু খাই তো বলে, আরো খাও। আরো খাই তো বলে, বেশী করে খাও। বেশী করে আর খেতে পারি না। একরকম ব্যাগ আছে প্রয়োজন মত ছোট বড় করে নেয়া যায়। আমাদের পেটটা যদি প্রয়োজন মত সেরকম বড় করে নেয়া যেতো তাহলে আজ বড় একটা কাজ হতো! পদে ও স্বাদে দস্তরখানটা তেমনই ছিলো।

একসময় গ্রাম দেখতে বের হলাম। গ্রামটি সত্যি খুব সুন্দর। যেমন শুনেছিলাম এবং যেমন কল্পনা করেছিলাম তার চেয়ে সুন্দর। সত্যিকার অর্থেই এটি একটি সবুজ গ্রাম। চারদিকে সবুজের সমারোহ। মনে হয় খুব পরিকল্পিতভাবে লাগানো হয়েছে সারি সারি গাছ। তাই গ্রামটি শুধু সবুজ নয় পরিপাটি সবুজ।

বাড়ীঘর সাধারণ, আমাদের গ্রামগুলোতে যেমন হয়, তবে খুব পরিচ্ছন্ন। পরিচ্ছন্নতাই এ গ্রামের বড় বৈশিষ্ট্য মনে হলো। শুধু বাড়ীর আঙ্গিনার পরিচ্ছন্নতা নয়, হৃদয়েরও আঙ্গিনার পরিচ্ছন্নতা। যেখানে গেলাম, গ্রামের মেহমান বলে বরণ করা হলো। সবার আচরণে মুগ্ধ হলাম।

সুন্দর আনন্দময় কিছু সময় কাটিয়ে আমরা সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওয়ানা হলাম। যোবায়র, জুনাইদ অশ্রুসজল চোখে আমাদের বিদায় জানালো। আজকের দিনটির স্মৃতি বহুদিন আমার মনে থাকবে।