শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

মুহররম ১৪৩২ হি: (১৮) | কাশগর ও কায়রো

ইরানের সামনে সঙ্কট, না সম্ভাবনা?!

 

‘বন্ধুর চেয়ে শত্রু অনেক বেশী উপকার করে, যদিও তার ইচ্ছে থাকে ক্ষতি করার’, ইতিহাসে এর অনেক প্রমাণ রয়েছে। সাম্প্রতিকতম প্রমাণ হলো ইরানের প্রতি আমেরিকার শত্রুতা। ইরানের মোল্লা ও আয়াতুল্লাহদের নেতৃত্বে ইরানে যে বিপ্লব সঙ্ঘটিত হয়েছে, আজ থেকে ত্রিশবছরেরও আগে, সেটা ইসলামী বিপ্লব, না শিয়া বিপ্লব তা নিয়ে হয়ত বিতর্ক আছে, এমনকি ইরাক-ইরান ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের সময় বৃটিশপররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে, ইরানীরা হলো শিয়া, আর ইরাকের সাদ্দাম সুন্নী। কিন্তু একটি বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, ইরানের বিপ্লব ছিলো শতভাগ একটি জাতীয় বিপ্লব, আর এটাই ছিলো ইরানের প্রতি আমেরিকার শত্রুতার একমাত্র কারণ। শাহের আমলে ইরান ছিলো মার্কিন স্বার্থের অবাধ বিচরণক্ষেত্র। আয়াতুল্লাহ খোমেনির ইরান জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ছিলো আপোশহীন, বিশেষত তেলসম্পদের ক্ষেত্রে। 

আমেরিকার শত্রুতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বর্তমানে ইরান বিশ্ব-ইতিহাসের সবচে’ কঠিন অর্থনৈতিক অবরোধের মোকাবেলা করছে। আমেরিকার দাসপ্রতিষ্ঠান জাতিসঙ্ঘ দফায় দফায় ইরানের উপর কঠিন থেকে কঠিন অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে। সেই ধারাবাহিকতায় এখন চলছে চতুর্থ দফা চরম অবরোধ। আমেরিকা ও জাতিসঙ্ঘের উদ্দেশ্য ইরানী অর্থনীতির মেরুদন্ড এমনভাবে ভেঙ্গে দেয়া যাতে মার্কিন স্বার্থের পদতলে ইরান লুটিয়ে পড়তে বাধ্য হয়। কিন্তু আমেরিকা যা চেয়েছে তা ঘটেনি। ইরান এখনো সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে, আইফেল টাওয়ার ও ফ্রিডম স্ট্যাচু-এর চেয়েও মাথা উঁচু করে। আমেরিকার তাবেদারি করে সাদ্দাম ইরানের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিলেন। সেই যুদ্ধ শেষ হয়েছে এবং শেষ হয়ে গেছে সাদ্দাম ও ইরাক, ইরান এখনো আছে একটি শক্তিরূপে আমেরিকাসহ পৃথিবীর বড় শক্তিগুলোর মাথাব্যথার কারণ হয়ে। আমেরিকার ‘বন্ধু’ সাদ্দাম চেয়েছিলেন পারমাণবিক প্রযুক্তি অর্জন করতে। ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় বলা নেই, কওয়া নেই ইসরাইলি হামলায় ধ্বংস হয়ে গেলো ইরাকের পারমাণবিক স্থাপনা। আমেরিকা টু শব্দটিও উচ্চারণ করেনি ইসরাইলের বিরুদ্ধে। কিন্তু ইরান?! ইহুদি-মার্কিন সমস্ত হম্বিতম্বিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ইরান এখনো দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে পারমাণবিক প্রযুক্তি অর্জনের পথে। 

ইরান ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধ চায়নি, যুদ্ধ করার অবস্থানে ছিলোও না কোন দিক থেকেই। কিন্তু মার্কিন প্রভুর ইঙ্গিতে ইরাক ইরানের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিলো। তাতে ইরানের লাভ হয়েছে এই যে, জাতীয় ঐক্য ও সংহতি আরো শক্তিশালী হয়েছে। নইলে হয়ত বিপ্লবের বুনিয়াদ নড়বড়ে হয়ে যেতো অনেক আগেই। 

আমেরিকা ও জাতিসঙ্ঘের বর্তমান অবরোধ সম্পর্কেও একই কথা। অর্থনৈতিক অবরোধ ইরানকে ভুগিয়েছে অনেক, এখনো ভোগাচ্ছে। কিন্তু তা একই সঙ্গে ইরানীদের জাতীয় চেতনাকে করেছে আরো জাগ্রত, আরো সংহত। ফলে ইরান এখন বিস্ময়করভাবে জীবনের সর্বক্ষেত্রে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। ইরানের অর্থনীতি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী। দেশের ভিতরে তার বহুমুখী উন্নয়নকর্মযজ্ঞ এখন সবার চোখে পড়ার মত। অবরোধের কারণেই ইরান এখন মাঝারি আকারের যাত্রিবাহী বিমান তৈরীর উদ্যোগ নিয়েছে। ইরানে ভেতরেই এধরনের ছয়হাজার বিমানের চাহিদা রয়েছে। তদুপরি সে বাইরের বাজারও পাওয়ার আশা করছে। ইতিমধ্যেই ইরানের তৈরী সাইফা নামের কার আভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বাইরে রফতানি শুরু করেছে। সিরিয়া, জর্দানসহ বেশ ক’টি দেশে সাইফা কার ভালো বাজারও পেয়ে গেছে। অর্থাৎ ইরান এখন বৃহৎ শক্তিবর্গের ব্যবসায়েও ভাগ বসাতে শুরু করেছে। 

ন্যানো প্রযুক্তিতে ইরানের অবস্থান এখন মুসলিমবিশ্বে প্রথম এবং সমগ্র বিশ্বে  চতুর্দশ। সিমেন্ট শিল্পে স্বনির্ভরতা অর্জনের পর এই প্রথমবারের মত ইরান ইরাকে সিমেন্ট রপ্তানি শুরু করেছে। অবরোধের কারণে গ্যাসলিন আমদানির কথা ছিলো, কিন্তু ইরান এখন তা রপ্তানি করছে। পক্ষান্তরে অপেট্রোলি- য়ামজাত পণ্যের রপ্তানি গত ছয়মাসে ১২৩ শতাংশ বেড়েছে। আইএমএফ স্বীকার করে নিয়েছে যে, মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্যএশিয়ায় ইরান হচ্ছে তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যশক্তি।

অবরোধকালে ইরানের অভাবনীয় উন্নতির আরেকটি ক্ষেত্র হলো সমরশিল্প। স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রে ইরান এখন স্বাবলম্বী, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের উন্নয়নেও সে এগিয়ে চলেছে। সাবমেরিন এখন ইরানের নিজস্ব সম্পদ। ড্রোনবিমানপ্রযুক্তিও ইরানের করায়ত্ত। ইতিমধ্যে ইরান মহাশূন্যের উপগ্রহ স্থাপনে সফলতা অর্জন করেছে।

মোটকথা মার্কিন ও জাতিসঙ্ঘ অবরোধ ইরানের জন্য সঙ্কট সৃষ্টির পরিবর্তে ঘুরে দাঁড়ানোর এক অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। ইরানিরা ব্যক্তিপর্যায়ে ও জাতীয়পর্যায়ে দৃষ্টান্তমূলক কৃচ্ছ অবলম্বন করছে। সউদী বাদশাহ বর্তমানে আমেরিকায় আছেন চিকিৎসা উপলক্ষে, ইরানি প্রেসিডেন্ট মরে যাবেন, কিন্তু এমন যিল্লতি কল্পনাও করতে পারবেন না। তাই আমরা মনে করি, সময় এসেছে ইরান থেকে মুসলিমবিশ্বের শিক্ষাগ্রহণের।