শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা
মাসিক আল-কলম-পুষ্প
শাবান ১৪৩১হিঃ (১৭) | হযরত আলী নাদাবীর পাতা
‘মাযা খাসিরাল আলামু বিনহিতাতিল মুসলিমীন’-এর ধারাবাহিক অনুবাদ
মুসলিম উম্মাহর অধঃপতনে বিশ্বের কী ক্ষতি হল ?
হযরত মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদবী (রহ) রচিত ‘মাযা খাসিরাল আলামু বিনহিতাতিল মুসলিমীন’-এর ধারাবাহিক অনুবাদ
-১৬-
ইউরোপীয় রেনেসাঁর অনুসারীরা দীর্ঘ কাল ধরে জড়বাদী দর্শন ও বস'বাদী জীবন এবং খৃস্টধর্মের বোধ, বিশ্বাস ও সংস্কৃতির মধ্যে সঙ্গতি সাধন করে চলার যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছিলো। কারণ ধর্মের বন্ধন থেকে তখনো তারা মুক্ত হতে পারেনি। খৃস্টজগতে তখনো ধর্মীয় প্রভাব বিদ্যমান ছিলো। তাছাড়া নৈতিক ও ধর্মীয় স্বার্থেরও দাবী ছিলো নামেমাত্র হলেও এমন একটি ধর্মীয় ব্যবস'া বহাল রাখা, যা সমপ্রদায়ের সকলকে একসূত্রে বেঁধে রাখবে এবং দেশ ও জাতিকে নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় থেকে রক্ষা করবে। কিন' শেষ পর্যন- তাদের লজ্জাই পেতে হলো। কারণ বস'বাদী সভ্যতার গতি এত প্রবল ছিলো যে, ধর্ম ও ধর্মীয় রীতি-নীতিগুলো তার সাথে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারলো না। ফলে জড়বাদ ও আধ্যাত্মিকতার মাঝে সহাবস'ান নিশ্চিত করা তখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিলো এবং সেজন্য কষ্টকর কৃত্রিমতার আশ্রয় নিতে হচ্ছিলো, যাতে মেধা, শক্তি ও সময়ের শুধু অপচয় ঘটছিলো, যার কোন প্রয়োজন ও সার্থকতা তারা দেখতে পাচ্ছিলো না। তাই শেষ পর্যন- তারা লোকলজ্জা ও কপটতার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এলো এবং প্রকাশ্যে ধর্মহীনতা ও বস'বাদকে জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যরূপে গ্রহণ করে নিলো।
এই সময়সন্ধিক্ষণে সমগ্র ইউরোপে বিপুল সংখ্যায় কবি, লেখক, সাহিত্যিক, শিক্ষক সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর আবির্ভাব ঘটলো, যারা সম- তালে জড়বাদের শিঙ্গায় ফুঁক দিতে শুরু করলেন এবং কলমের জাদুময়তা দ্বারা মনমসি-ষ্কে বস'বাদের বিষ ছড়াতে লাগলেন। নীতি ও নৈতিকতা এবং জীবন ও সামাজিক মূল্যবোধ সবকিছুরই তাদের কাছে ছিলো বস'বাদী ব্যাখ্যা। কখনো তারা প্রচার করতেন আত্মস্বার্থদর্শনের মাহাত্ম, কখনো বা অবাধ ভোগবাদের মহিমা।
মেকিয়াভেলি (১৪৬৯-১৫২৭ খৃঃ) ও অন্যান্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আরো আগেই ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিভাজন এবং সামাজিক ও ব্যক্তিক চরিত্রের ভিন্নতার দর্শন প্রচার করেছিলেন। তাদের চূড়ান- সিদ্ধান- ছিলো, ধর্ম যদি মানতেই হয় তাহলে তার সীমানা হবে ব্যক্তির ব্যক্তি- জীবন। রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে তার প্রবেশাধিকার থাকবে না। তাদের মতে জীবনে রাষ্ট্রের ভূমিকা ও গুরুত্ব হবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে। পরকাল বলে যদি কিছু থাকে তাহলে খৃস্টধর্মের সম্পর্ক হলো পরকালের সঙ্গে। সুতরাং ধার্মিক লোকেরা গীর্জা ও ধর্মব্যবস'ার জন্য প্রয়োজনীয় হলেও সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষে উপযোগী ও কল্যাণকর হতে পারেন না। কেননা ধর্মীয় বিধিবন্ধন ও বাধ্যবাধকতার ঘেরাটোপে আবদ্ধ থাকতেই তারা ভালোবাসে। তাই রাষ্ট্র ও জনস্বার্থের জন্য অপরিহার্য হলেও ধর্মীয় বিধান ও নৈতিক মূল্যবোধ থেকে তারা সরে আসতে পারে না। শাসক ও রাষ্ট্রনায়ককে প্রয়োজনে শৃগালের ধূর্ততা ও শঠতা দেখাতে হয়। দেশ, রাষ্ট্র ও জনগণের সামান্য স্বার্থও যদি নিহিত থাকে তাহলে নির্দ্বিধায় তাকে মিথ্যা, কপটতা, ধোকা ও প্রতারণার আশ্রয় নিতে হবে। এ নতুন আহ্বান অত্যন- জনপ্রিয়তা লাভ করলো এবং ভৌগলিকতাবাদ ও জাতীয়তা- বাদ (যা প্রাচীন ধর্মের স'ান দখল করেছিলো) এ নতুন দর্শনকে পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা দান করলো। ইউরোপের কবি-সাহিত্যিক, লেখক-শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীসমাজ বিশেষ করে ফরাসিবিপ্লব ও তার পরবর্তী সময়ে নীতি ও নৈতিকতার সকল শাশ্বত মূল্যবোধ এবং প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস'ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলো তদুপরি তারা পাপ ও পাপাচারের সৌন্দর্য মানুষের সামনে চিত্তাকর্ষক ভাষায় তুলে ধরলো। ভোগস্বাধীনতার এই প্রবক্তাদের মূল বক্তব্য ছিলো, ব্যক্তিজীবনে মানুষ যাবতীয় নৈতিক দায়দায়িত্ব থেকে মুক্ত এবং তার পূর্ণ অধিকার রয়েছে অবাধ আনন্দ-বিনোদনের এবং জীবন ও যৌবনের পরিপূর্ণ উপভোগের। এ জীবন, এ যৌবন খুব অল্প সময়ের। সুতরাং জীবনের স্বাদ ও যৌবনের আনন্দ যত পারো ভোগ করো। ইন্দ্রিয় আনন্দ ও বস'গত লাভ ছাড়া জীবনের আর সবকিছু তারা অস্বীকার করতো। এককথায় পশুবৃত্তি ও পাশবপ্রবৃত্তির চরিতার্থতাই ছিলো ভোগবাদী ও বস'বাদী জীবনের মূল কথা।
এভাবে উনিশ ও বিশশতকের ইউরোপীয় জীবন মূলত মূর্তি- পূজক গ্রীক ও রোমকদের বস'বাদী জীবনেরই এক জীবন- প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠলো। বস'ত এটা ছিলো প্রাচীন গ্রীক ও রোমান জাহেলিয়াতের নতুন সংস্করণ যা উনিশ শতকে খুব যত্নের সাথে তৈরী করা হয়েছিলো। প্রাচ্যের খৃস্টধর্ম গ্রীক ও রোমক সংস্কৃতির যেসকল রেখা ও চিত্র মুছে ফেলেছিলো উনিশশতকের ইউরোপীয় চিত্রকররা সেগুলো যেন আরো উজ্জ্বল ও উদ্ভাসিত -রূপে পরিবেশন করলেন। প্রাচ্যসংস্কৃতির প্রভাবে ইউরোপের যে অবদমিত স্বভাব, সেটা যেন নতুন করে আরো শক্তি নিয়ে মাথাচাড়া দিলো। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। কেননা আজকের ইউরোপীয় জাতিবর্গ মূলত গ্রীক ও রোমকদেরই সুযোগ্য বংশধর। বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যতা এবং প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সভ্যতার মধ্যেও রয়েছে অতি নিকটসাদৃশ্য। ইউরোপের বর্তমান ধর্মীয় জীবনও আত্মিকতা ও আধ্যাত্মিকতা থেকে ততটাই মুক্ত যতটা ছিলো প্রাচীন গ্রীক ও রোমকদের ধর্মীয় জীবন; যেমন ডক্টর হ্যাশ গ্রীক সভ্যতার আলোচনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন।
আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংযম, নৈতিকতা ও ধার্মিকতা, ইশ্বরভীতি ও পরকালপ্রীতির অনুপসি'তি এবং বিনোদন ও ক্রীড়াসক্তির প্রাবল্যের যে চিত্র ঐতিহাসিক লেকী গ্রীকদের ধর্মবোধ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন তা একই ভাবে এবং আরো চড়া মাত্রায় আধুনিক ইউরোপের জীবনেও ছিলো। এবং তা সেই ধর্মব্যবস'ার স্বাভাবিক ফল যা ইউরোপ গ্রহণ করেছিলো, কারণ আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্ম- নিবেদন এবং তার উপাসনায় পরিপূর্ণ আত্মনিমগ্নতার সঙ্গে এ ধর্মব্যবস'া কিছুতেই খাপ খেতে পারে না। তদ্রূপ তা ছিলো বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের বিভিন্ন ধ্যান-ধারণা ও বাদ-মতবাদ প্রচারের অনিবার্য ফল, যা ইউরোপে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলো এবং এমনকি তা ধর্মের স'ান দখল করে নিয়েছিলো।
ইউরোপের বস'বাদী সমাজে আপনি দেখতে পাবেন, মানুষ বস'গত স্বাদ-আনন্দ ভোগ করার এবং জীবন ও যৌবনের মজা লুটে নেয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে যেমন পিপাসার্ত পানিতে ঝাঁপ দেয় কিংবা যেমন পতঙ্গ আগুনে ঝাঁপ দেয়, ঠিক যেমনটি সক্রেটিস তার সময়ের গ্রীক গণতান্ত্রিক আদর্শ যুবকের চিত্র অঙ্কন করেছিলেন। তদ্রূপ এখানে আপনি দেখতে পাবেন ধর্মবিশ্বাসে দ্বিধা-সংশয় এবং ধর্মীয় বিধি-বিধান ও জীবনব্যবস'ার প্রতি একই অনাস'া ও উপহাস, যা ছিলো রোমে মুক্তবুদ্ধির চর্চা শুরু হওয়ার পর।
খৃস্টবাদ নয়, ইউরোপের ধর্ম বস'বাদ
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আধুনিক ইউরোপের ধর্ম, যা তার হৃদয় ও আত্মাকে এবং আবেগ ও চিন-াসত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে সেটা খৃস্টধর্ম নয়, বরং জড়বাদ ও বস'বাদ। যিনি খুব নিকট থেকে ইউরোপকে অবলোকন করেছেন এবং বইয়ের পাতা ছেড়ে জীবনের পাতায় ইউরোপীয়দের মানস ও মানসিকতা অধ্যয়ন করেছেন, এ সত্য তিনি অবশ্যই উপলব্ধি করবেন; এমনকি বইয়ের পাতা থেকেও তা বোঝা যাবে, যদি কেউ ধর্মীয় বাহ্যিকতা দ্বারা প্রতারিত না হয়, যা রাষ্ট্রগুলো নিছক ঐতিহ্যের প্রতীকরূপে গ্রহণ করে থাকে; তদ্রূপ যদি কেউ গীর্জার ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যাপক অংশগ্রহণ দ্বারা বিভ্রান- না হয়, যা মানুষ শুধু জীবনবৈচিত্র্য ও আত্মিক বিনোদনরূপে করে থাকে। জার্মান নও মুসলিম মুহম্মদ আসাদ তার ‘সঙ্ঘাতের মুখে ইসলাম’ গ্রনে' সুস্পষ্ট ভাষায় তা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন-
‘এটা অবশ্য ঠিক যে, পাশ্চাত্যে এখনো কিছু লোক ধর্মীয় আবহে চিন-া করে এবং জীবন যাপন করে। তাদের যথাসাধ্য চেষ্টা থাকে ধর্মীয় চিন-া ও বিশ্বাসকে সভ্যতার মূল চেতনার সঙ্গে সঙ্গতি বিধান করে চলার। কিন' তারা বিরল ব্যতিক্রম। সাধারণভাবে একজন ইউরোপীয়, সে গণতান্ত্রিক হোক বা ফ্যাসিবাদী, পঁজিবাদী হোক বা সমাজতন্ত্রী, শ্রমজীবী হোক বা বুদ্ধিজীবী, জীবনে সে একটিমাত্র ধর্মের সঙ্গেই পরিচিত, আর তা হলো জড়বাদ ও বস'বাদ। জড়জাগতিক উন্নতিই হলো এ ধর্মের একমাত্র উপাসনা এবং এ চিন-া-চেতনাই হলো এর মূলমন্ত্র যে, জীবন যেন হয় আরো সহজ, ভোগের আনন্দে আরো পরিপূর্ণ এবং স্বভাব ও প্রকৃতির সকল বাধাবন্ধন থেকে মুক্ত-স্বাধীন। শিল্পকারখানা, প্রেক্ষাগৃহ, নৃত্যালয় এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র ও রাসায়নিক গবেষণাগার হলো এ ধর্মের গীর্জাঘর, আর পুরোহিত হলেন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, পূঁজিপতি, শিল্পপতি এবং চিত্রতারকা ও ক্রীড়াবিদ, যারা রেকর্ড ভাঙ্গেন এবং গড়েন। শক্তির এই বাঁধভাঙ্গা উন্মত্ততা ও ভোগ-আনন্দের এই বে-লাগাম উন্মাদনার অনিবার্য ফল এই হলো যে, সমাজ ও সভ্যতায় পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী বিভিন্ন দলের উদ্ভব হলো এবং প্রতিটি দল অস্ত্রসজ্জিত হয়ে চাহিদা ও স্বার্থগত সঙ্ঘাতের কারণে প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করার নেশায় মেতে উঠলো। পক্ষান-রে সভ্যতার অঙ্গনে মানুষের এমন এক নতুন সংস্করণ তৈরী হলো যারা বিশ্বাস করে যে, লাভ ও মুনাফাই হলো সুনীতি ও সুচরিত্র, আর বস'বাদী সফলতাই হলো জীবনের একমাত্র আদর্শ মানদণ্ড এবং ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্যরেখা।’
তিনি আরো বলেন- ‘পাশ্চাত্যসভ্যতা আল্লাহর অসি-ত্ব খোল্লামখোল্লা অস্বীকার করে না, কিন' বাস-বত এ সভ্যতার চিন-া- ব্যবস'ায় আল্লাহর কোন স'ান এবং ঈশ্বরচিন-ার কোন অর্থবহতা নেই।’
ইউরোপের সমাজসভ্যতা ও ধর্ম- ব্যবস'ার এ বিপর্যস- চিত্র এমন এক ব্যক্তি পরিবেশন করেছেন যিনি খৃস্টধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং পাশ্চাত্যের বস'বাদী জীবনের কাঁটাবন থেকে ইসলামের আধ্যাত্মবাদী জীবন-উদ্যানের ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছেন, এটা যদি তাঁর বক্তব্যের মূল্যায়নের পথে বাধা হয় তাহলে আমাদের কাছে আরো জোরালো সাক্ষ্য রয়েছে, যা আপনাকে বুঝিয়ে দেবে যে, সত্যি সত্যি এ রাষ্ট্রধর্মটি তার প্রধানতম কেন্দ্রে প্রভাব ও প্রতাপ এবং সজীবতা ও প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলো। ফলে নতুন প্রজন্ম ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক ও সম্পৃক্তির ধারণাই প্রত্যাখ্যান করে বসেছিলো। আমরা এখানে যার সাক্ষ্য তুলে ধরবো তিনি ইউরোপের বরেণ্য শিক্ষাবিদ এবং ইংরেজীভাষার শীর্ষস'ানীয় লেখক-গবেষক। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন ও মনস-ত্ত্ব বিভাগের প্রধান প্রফেসর ঈ.ঊ.গ লড়ধফ তার সুবিখ্যাত গ্রন' এঁরফব ঃড় গড়ফবৎহ ডরপশবফহবংং এ বলেন, ‘বিশোর্ধ্ব বিশজন ছাত্র-ছাত্রীর কাছে আমার প্রশ্ন ছিলো, তাদের কতজন ন্যূনতম অর্থে খৃস্টান? মাত্র তিনজনের উত্তর, হ্যাঁ। সাত-জনের মন-ব্য, বিষয়টি নিয়ে তারা কখনো ভাবেনি। বাকি দশজন পরিষ্কার ভাষায় বলেছে, খৃস্টধর্মের প্রতি তাদের বৈরী মনোভাব রয়েছে। আমি মনে করি, খৃস্টধর্ম যারা মানে, আর মানে না তাদের মধ্যে এই যে অনুপাত, এ ভূখণ্ডে তা বিচ্ছিন্ন নয় এবং অস্বাভাবিকও নয়। তবে এটা ঠিক যে, পঞ্চাশ বা বিশবছর আগে এ প্রশ্ন একই ধরনের কোন দলকে করা হলে অনুপাতগত দিক থেকে উত্তর অনেক ভিন্ন হতো। সুতরাং বলা যায়, যারা ক্যানন ব্যারির সঙ্গে একমত যে, খৃস্টধর্মের কোন নবজাগরণ বিশ্বকে উদ্ধার করতে পারে, তাদের সংখ্যা কমতেই থাকবে। বস'ত এ মতের পক্ষে আমি যুক্তির শক্তি দেখতে পাচ্ছি না। হতে পারে, এটা তার স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা। তবে বুঝতে হবে যে, স্বপ্ন চিন-া ও ভাবনার জন্ম দিতে পারে; তথ্য, সাক্ষ্য ও যুক্তি সৃষ্টি করতে পারে না। পরিসি'তি ও পূর্বলক্ষণ বরং এটাই প্রমাণ করে যে, আগামী শতাব্দীতে খৃস্টীয় গীর্জার মৃত্যু ঘটবে। এ মতের সমর্থনে একটি দৈনিক পত্রিকার একটি খবর তুলে ধরছি- ‘সাতাত্তর বছর বয়সের এক ব্যক্তি একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে, যা পবিত্র ধর্মগ্রনে'র প্রাচীন কপিগুলো কার্তুস, কৃত্রিম রেশম ও কাগুজে মুদ্রার কাঁচামালে রূপান-রিত করতে পারে। এ যন্ত্রটি কার্ডিফ ও অন্য আটটি কারখানায় স'াপন করা হয়েছে এবং তাওরাতের প্রাচীন কপি দ্বারা রীতিমত যুদ্ধের অস্ত্র তৈরী করা শুরু হয়ে গেছে। আর উদ্ভাবক ভদ্রলোক, যিনি ছিলেন ফকীর, এ সুবাদে হয়ে গেলেন আমীর।’
মাননীয় প্রফেসর তার বক্তব্যের সমাপ্তি টেনেছেন তাওরাতেরই একটি বাক্য দ্বারা, আর আমার ধারণায় ক্যানন ব্যারির মত যাজক ও ধর্মনেতাদের সম্বোধন করার জন্য এর চেয়ে সুন্দর বাক্য আর হতে পারে না। বাক্যটি হলো, ‘যার দু’টি কান আছে সে যেন শ্রবণ করে’।
একই লেখক তার দ্বিতীয় গ্রন' চযরষড়ংড়ঢ়যু ড়ভ ঙঁৎ ঞরসবং
-এ লিখেছেন-
‘কয়েক শতাব্দী ধরে ইংল্যান্ডের চিন-া-চেতনায় অর্থচাহিদা ও সম্পদ-লিপ্সা জেঁকে বসেছে। বস'ত বিগত দু’শবছর সম্পদ অর্জনের চাহিদাই ছিলো এ দেশের কর্মোদ্যমের মূল চালিকাশক্তি ও প্রধান অনুঘটক। এখনো মানুষ রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য, চলচ্চিত্র ও বেতার প্রচার থেকে, এমনকি কখনো কখনো গীর্জার ধর্মীয় মঞ্চ থেকেও অর্থোপার্জন ও সম্পদসঞ্চয়ের প্রণোদনা ও প্ররোচনা পেয়ে আসছে। সর্বসূত্রে এখনো তাদের এ শিক্ষাই দেয়া হচ্ছে যে, সুসভ্য ও সমুন্নত জাতি তারাই যাদের মধ্যে সম্পদস্পৃহা চরমোৎকর্ষ লাভ করেছে।
এই যে সম্পদপূজা ও অর্থলিপ্সা, এটা আমাদের ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় চেতনার বিরোধী। কারণ ধর্ম হচ্ছে দারিদ্র্য-অনুরাগী এবং বিত্তপ্রাচুর্যের নিন্দাকারী। ধর্ম বলে, সততা ও পুণ্যমনস্কতায় একজন দরিদ্র একজন বিত্তশালীর চেয়ে অগ্রগামী। এভাবে যদিও ধর্মপ্রজ্ঞা ও ধর্মীয় সুনীতির দৃষ্টিতে ঈশ্বর-উপাসনা ও স্বর্গপ্রবেশের জন্য দারিদ্র্যই অধিকতর উপযোগী, কিন' মানুষ ‘ধর্মকথা’ ও গীর্জীয় সুবচন অনুসরণে আগ্রহী নয়। এখনো তারা প্রতিশ্রুত স্বর্গীয় সম্পদের চেয়ে নগদ জাগতিক সম্পদেই বেশী আগ্রহী। সম্ভবত তাদের ধারণা, জীবনের শেষভাগে পাপস্বীকারের মাধ্যমেই তাদের পরকাল নিরাপদ হয়ে যাবে, যেমন স্ফীত ‘ব্যাংকব্যালেন্স’ দ্বারা জাগতিক জীবন ও ভোগ-উপভোগ নিশ্চিত হয়ে আছে। সমকালের এই সাধারণ চিন-াকে স্যামুয়েল বাটলার তার গ্রনে' এভাবে প্রকাশ করেছেন-
‘কতিপয় অর্বাচীন লেখক-চিন-াবিদ ভাবেন, একই মসি-ষ্কে যুগপৎ আমরা ঈশ্বরচিন-া ও বিত্তচিন-া করতে পারি না। আমিও স্বীকার করি, তা সহজ নয়। কিন' পৃথিবীর কোন কাজটি কবে সহজ হয়েছে?!
মোটকথা, আমাদের নীতি ও বোধ যাই হোক, বিদ্যমান বাস-বতা এটাই যে, আমরা বাটলার ও তার সমমতীদের জোরালো সমর্থক। অর্থলিপ্সা ও সম্পদাসক্তিতে আমরা আকণ্ঠ নিমজ্জিত এবং আমাদের কার্যত বিশ্বাস, সম্পদই হচ্ছে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের বড়ত্বের সঠিক মানদণ্ড। এই চিন-া-চেতনা থেকেই পৃথিবীতে দু’টি চালিকা- নীতি জন্মলাভ করেছে এবং তাদের বিরাট ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। প্রথমত হস-ক্ষেপমুক্ত অর্থনীতির মৌলধারণা, যা ঊনিশ শতকে অতি প্রবল ছিলো। এ মূলনীতির প্রবক্তারা দাবী করেন, সর্বোত্তম মুনাফাই হচ্ছে মানুষের যাবতীয় কর্মোদ্যগের ভিত্তি। তাদের মতে হৃদয়ের আনন্দাবেগ কর্মের উৎস নয়, বরং সম্পদ- ভোগের আনন্দই হচ্ছে মূল চালিকাশক্তি। দ্বিতীয় মূলনীতিটি বিশশতকে প্রায় অপ্রতিহত গতিতে ধেয়ে এসেছিলো, যা মার্কসীয় মতবাদরূপে পরিচিত। এ মূলনীতির শিরোনাম হলো অর্থবণ্টনব্যবস'া এবং এর মূলকথা হলো, মানবসমাজে অর্থনৈতিক ব্যবস'ার উদ্ভবের মূল ভিত্তি হলো জীবনে অর্থের অনিবার্য প্রয়োজন। বস'ত অর্থ-প্রয়োজন ও অর্থ- ব্যবস'াই ধর্ম, সাহিত্য, নীতি, চরিত্র, জ্ঞান ও যুক্তি এবং শাসন ও প্রশাসনব্যবস'ার জন্ম দেয়।
বলাবাহুল্য যে, এ দুই মতবাদের এ বিপুল জনপ্রিয়তা কিছুতেই সম্ভব হতো না, যদি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের দেশবাসী অতিসম্পদমুখী ও অর্থলিপ্সু না হতো। হাঁ, এটা এজন্যই সম্ভব হয়েছে যে, নারী-পুরুষ সকলেই লক্ষণীয়ভাবে বিত্ত-প্রাচুর্যকেই সৌন্দর্য ও জৌলুসের ভিত্তিরূপে গ্রহণ করেছে।’
একই গ্রনে'র অন্যত্র তিনি বলেন- ‘যে জীবনবোধ এ যুগের চিন-া-চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে তা এই যে, জীবন ও জগতের সবকিছু ‘পকেট ও পাকস'লী’র দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার্য। সুপ্রসিদ্ধ মার্কিন সাংবাদিক মিস্টার জনগুন'ার তার ওহংরফব ঊঁৎড়ঢ়ব গ্রনে' এ চরম বস'বাদী মানসিকতা বড় সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন, তিনি বলেন- ‘ইংরেজজাতি সপ্তাহের ছয়দিন পূজা করে ব্যাংক অব ইংলেন্ডের, আর সপ্তম দিন হাজিরা দেয় গীর্জায়।’
ইউরোপের বস'বাদী স্বভাব ও পরিণতি
এটা তো খুবই স্বাভাবিক যে, যারা অনন- জীবনে বিশ্বাসী নয়, তদুপরি ক্ষণস'ায়ী জীবনের ক্ষণিক ভোগ-বিলাস এবং ব্যক্তিগত ও জাতীয় উচ্চাভিলাষ ছাড়া যাদের মহৎ কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নেই এবং যাদের অন-রে আল্লাহর প্রতি ভয় ও ভালোবাসা নেই তাদের কাছে কীভাবে আশা করা যায় যে, বিপদে-দুর্যোগে ও ঝড়তুফানের মুখে তারা আল্লাহকে ডাকবে এবং আল্লাহর কাছে কাকুতি-মিনতি ও আত্মনিবেদন করবে! দেখুন, আল্লাহকে বিশ্বাস করতো বলে মুশরিকরাও বিপদে যেভাবেই হোক আল্লাহকে ডাকতো। কোরআন বলছে-
‘যখন বিশাল ঢেউ তাদের উপর আছড়ে পড়ে তখন তারা আল্লাহকে ডাকে শুধু তাঁর প্রতি নিবেদিত হয়ে, আর বলে, যদি আপনি উদ্ধার করেন আমাদের এই বিপদ থেকে, অবশ্যই আমরা শোকরগুজার হবো। (অবশ্য বিপদশেষে তারা তা ভুলে যায়।)
কিন' ইউরোপের এ জনগোষ্ঠী বস'বাদী চিন-া-চেতনায় এতই আচ্ছন্ন এবং জড়জাগতিক ‘কার্যকারণ’ দর্শনে এমনই অভ্যস-, সর্বোপরি তাদের অন-র এতই আল্লাহবিমুখ, এতই রুক্ষ-কঠিন ও অনুভূতিহীন যে, কোরআনের এ আয়াতের তারাই যেন বাস-ব চিত্র, বরং তাদেরই সম্পর্কে যেন তা নাযিল হয়েছে। আল্লাহ বলছেন-
‘আর আপনার পূর্বে বিভিন্ন জাতির কাছে আমি অহী প্রেরণ করেছি (কিন' তারা তা গ্রহণ করেনি), অনন-র তাদের আমি পাকড়াও করেছি বিপদ ও দুর্যোগ দ্বারা, যাতে তারা কাকুতি-মিনতি করে। তো কত না ভালো হতো, যদি তারা বিগলিত হতো তাদের কাছে আমার বিপদ নেমে আসার পর, কিন' হৃদয় তাদের কঠিন হয়ে গিয়েছিলো, আর তারা যা করতো, শয়তান তাদের সামনে তা মনোহররূপে তুলে ধরেছিলো।’
অন্য আয়াতে-
‘আর পাকড়াও করেছিলাম তাদেরকে আযাব দ্বারা, কিন' তারা তাদের প্রতিপালকের প্রতি বিনীত হয়নি ও কাকুতি-মিনতি করেনি।’
উপরের আয়াতদু’টির আয়নায় ইউরোপের চিত্র ও চরিত্র অবলোকন করুন। বিশ্বযুদ্ধের কঠিন সংকটকালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শাসক ও রাষ্ট্রনায়ক জাতির উদ্দেশ্যে যেসব ভাষণ ও বক্তব্য-বিবৃতি দিতেন তাতে বিগলিত হৃদয়ে সাহায্যের জন্য আল্লাহর প্রতি আত্মনিবেদন ও কাকুতি-মিনতির কোন ভাব ও ছাপ আপনি দেখতে পাবেন না। একই ভাবে জাতি ও জনগোষ্ঠীর চরিত্র ও কর্মকাণ্ডেও এর কোন ছোঁয়া ও চিহ্ন খুঁজে পাবেন না। সবসময় তারা মত্ত ছিলো মওজ ও মজা, ফুর্তি ও স্ফূর্তি এবং গরম হৈহুল্লুড়ে; এমনকি তখনো যখন নেমে আসতো মৃত্যুর বিভীষিকা। পাশ্চাত্যের লেখক, সাহিত্যিক ও চিন-াবিদগণ এটাকে চরম প্রতিকূলতার মুখে অদম্য সাহস ও মনোবল বলে গর্ব ও গৌরব বোধ করেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে শীর্ষস'ানীয় জনৈক নেতা গর্বভরে বলেছেন, ‘ব্রিটিশ-জাতি কোন পরিসি'তি ও দুর্যোগের সামনে কখনো ভাঙ্গেনি এবং মচকায়ওনি। তারা সটান দাঁড়িয়ে থেকেছে মাথা উঁচু করে।’ প্রমাণরূপে তিনি বলেন- ‘সিঙ্গাপুরের আকাশ থেকে যখন ঝাঁকে ঝাঁকে জাপানী বোমা পড়ছিলো তখনো সেখানে বৃটিশদের নাচগান ও আনন্দ-বিনোদনে ছেদ পড়েনি এবং কোন অনুষ্ঠান বন্ধ হয়নি।’
কিন' আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসে নিবেদিত একজন মুমিনের দৃষ্টিতে এটা সাহস ও সাহসিকতা এবং মন ও মনোবলের দৃঢ়তা নয়, বরং এটা মুর্দাদিলের কঠিনতা, আত্ম-বিস্মৃতি ও ভোগস্ফূর্তির উন্মত্ততা।
ইউরোপপ্রবাসী জনৈক ভারতীয় ‘লন্ডনের একটি রাত’ শিরোনামে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিমানহামলা- কালীন স্মৃতিকথায় লিখেছেন-
‘দিন-রাতের লাগাতার বিমানহামলায় অতিষ্ঠ হয়ে আমি ও বন্ধুরা ঐ রাতে নাচগানের একটি জমকালো জলসার আয়োজন করলাম। আমরা যখন উদ্দাম আনন্দে উন্মত্ত তখন হঠাৎ বিমান হামলার সাইরেনে জলসা
স-ব্ধ হয়ে গেলো। বিহ্বলতা কাটিয়ে ওঠার পর একজন জানতে চাইল, ‘চলবে, না বন্ধ?’ সবার আগে ফুর্তিবাজ এক তরুণী বলে উঠলো, ‘মরতে হয় নেচে-গেয়ে হেসে-খেলেই মরি!’ ব্যস, নাচে-গানে, উদ্দাম আনন্দে জলসা আবার উন্মাতাল হয়ে উঠলো। জলসা তো জলসা, পুরো এলাকা যেন উল্লাসে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়লো।
লেখক আরো বলেন, এর পর তো রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিলো যে, সন্ধ্যায় সাইরেন বাজতো, বিমান আসতো, আলো নিভতো, কামান গর্জে উঠতো এবং অন্ধকার আকাশে আতশবাজির ফুলঝুরি শুরু হতো। তখন পেক্ষাগৃহে ছবিপ্রদর্শনের মাঝখানে পর্দায় লেখা ভেসে উঠতো, ‘বিমানহামলা চলছে, ছবিও চলবে, কেউ আশ্রয়- কেন্দ্রে যেতে চাইলে রাস-া বামে নীচের দিকে।’ কিন' কেউ উঠতো না, ছবির প্রদর্শন যথারীতি চলতে থাকতো।’
রঙ্গতামাশা ও ফুর্তিবাজির এই উন্মাদনা এবং গাফলত ও আত্মবিস্মৃতির এই নির্জীবতার নমুনা প্রাচীন গ্রীস ও রোমের সমাজজীবনেই শুধু পাওয়া যায়। ইতিহাসের পাতায় আছে, পাম্পেই নগরীর জেগে ওঠা আগ্নেয়গিরি যখন লাভা উদ্গীরণ শুরু করলো তখন একদিকে আকাশ থেকে অগ্নিবৃষ্টি হচ্ছে, অন্যদিকে গলিত লাভার প্রবাহ ধেয়ে আসছে। সময় তখন বিকেল। বিশহাজার দর্শক- ধারণক্ষমতার বিশাল এমফি থিয়েটার পরিপূর্ণ। হিংস্র পশুর দন--নখরের আঘাতে জীবন- মানুষের ছিন্নভিন্ন হওয়ার বীভৎস দৃশ্য সবাই পাশবিক আনন্দে উপভোগ করছে। ঠিক তখন হলো ভূমিকম্প। যে যেখানে ছিলো, ভস্ম হয়ে গেলো। যারা বের হতে পারলো তারা ধাক্কাধাক্কি ও ঠোকা- ঠুকিতে এবং পদপিষ্ট হয়ে খতম হলো। অল্পক’জন ভাগ্যবান শুধু নৌকা ও জলযানে করে প্রাণ বাঁচাতে পারলো। সুদীর্ঘ আঠারোশ বছর শহরটি পৃথিবীর মানচিত্র থেকে অপসৃত ছিলো। উনিশ শতকে এসে জানা গেলো, শহরটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি, গলিত লাভার নীচে চাপা পড়েছে শুধু। দীর্ঘ খননকার্যের পর কুদরতের ইনতিকাম ও প্রতিশোধের জীবন- নমুনারূপে পুরো শহরটি আবার যেমন ছিলো, পৃথিবীর মানচিত্রে ভেসে উঠলো। আলকোরআনের সতর্কবাণী-
‘জনপদের অধিবাসীরা কি এ বিষয়ে নির্ভয় যে, তাদের কাছে আসবে না আমার আযাব সকাল বেলা, যখন তারা খেলাধূলায় মশগুল থাকবে!’
যুদ্ধের বিভীষিকার সময়, যখন মাতালেরও নেশা কেটে যায় এবং পাষাণ হৃদয়ও বিগলিত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে, তখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী মিস্টার চার্চিল যেভাবে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উদ্যাপন করেছেন তার বিবরণ রয়টারের সংবাদদাতার মতে-
‘ওয়াশিংটন। পয়লা জানুয়ারী, ১৯৪২। গত রাতে বিদায়ী বছর ও নতুন বছর যখন এক বিন্দুতে, মিস্টার চার্চিল তখন সরকারি ট্রেনে কানাডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পথে। মিস্টার চার্চিল স্যার সারলিস বারটালকে সঙ্গে করে অকস্মাৎ ট্রেনের রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলেন। মুখে সিগার, হাতে শ্যাম্পেন। সফরসঙ্গীরা দেখে অবাক! কারণ যুদ্ধ তখন ঘোরতর। মিস্টার চার্চিল মৃদু হেসে গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘বিদায়ী বছর ১৯৪১-এর নামে পান করছি; সেই বছর যা আমাদের নিয়ে এসেছে পরিশ্রম, ক্লানি- ও বিজয়ের দিকে।’ তখনই ঘড়িতে বিদায়ী বছর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো এবং নতুন বছর প্রথম শ্বাসটি গ্রহণ করলো। সবাই চার্চিলকে অভিনন্দন জানালো। আর তিনি দুই সফর- সঙ্গীকে দু’হাতে ধরে নৃত্যের তালে তালে গান গাইলেন। পরে দরজার দিকে অগ্রসর হয়ে বললেন, আপনারা আনন্দিত থাকুন। ঈশ্বর আমাদের বিজয় দান করুন। সকলে তখন তুমুল করতালি ও উদ্দাম নৃত্যের মাঝে গান গাইতে লাগলো, আর মিস্টার চার্চিল ভি চিহ্ন প্রদর্শন করে উৎফুল্লচিত্তে আপন কম্পার্টমেন্টে ফিরে গেলেন।’
ধর্মহীন এই বস'বাদী স্বভাব ও প্রবণতার সঙ্গে ধর্মের শিক্ষা ও ধর্মীয় চিন-া-চেতনাকে তুলনা করে দেখুন। আল্লাহকে যারা বিশ্বাস করে এবং ভয় করে যুদ্ধবিগ্রহ ও বিপদ-দুর্যোগের সময় তাদের আচরণ ও কর্মপন'া কত ভিন্ন তা কিছুটা হলেও বোঝা যায় কোরআনের এই আয়াতে-
‘হে ঈমানদারগণ, যখন তোমরা কোন দুশমনদলের সম্মুখীন হও তখন অবিচল থেকো, আর আল্লাহকে বেশী করে স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’
ছাহাবা কেরাম বলেন, ‘যখন কোন পেরেশানির বিষয় ঘটতো, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সঙ্গে সঙ্গে নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন। সীরাতে ইবনে হিশামে গাযওয়ায়ে বদরপ্রসঙ্গে আছে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাহাবা কেরামের সারি সোজা করলেন, তারপর ‘আরীশ’-এ দাখেল হলেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে শুধু আবু বকর (রা) ছিলেন, অন্য কেউ ছিলো না। তিনি তখন জারজার কাঁদছিলেন এবং আল্লাহ তা‘আলা বিজয়ের যে ওয়াদা করেছেন তা পূর্ণ করার মিনতি জানাচ্ছিলেন। তাঁর একটি নিবেদন ছিলো-
‘হে আল্লাহ, যদি আজ এই জামা‘আত হালাক হয়ে যায় তাহলে তো তোমার ইবাদত হবে না!’
বিভিন্ন ঐতিহাসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও স্বভাবগত অনিবার্য কারণে ইতিহাসের প্রাচীনতম সময় থেকেই জড়বাদ ও বস'বাদই হয়ে পড়েছিলো পাশ্চাত্যের জীবন ও সভ্যতার প্রতীক। ইউরোপের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নবউত্থান সেটাকে নতুন গতি ও শক্তি দান করেছে মাত্র। প্রাচ্য ও পাশ্চাতের বহু বিদগ্ধ পণ্ডিৎ পাশ্চাত্যসভ্যতার এ বস'বাদী বৈশিষ্ট্যটি সম্যক অনুধাবন করতে পেরেছেন। প্রাচ্যের বিদগ্ধ জ্ঞানী ও দূরদর্শী পর্যটক আব্দুর রহমান আলকাওয়াকিবী বর্তমান শতাব্দীর শুরুতে রচিত طبائـع الاستبداد গ্রনে' লিখেছেন-
‘পাশ্চাত্যের জীবন আগাগোড়া বস'বাদী জীবন। মানুষ সেখানে নিছক বস'বাদের পূজারী। স্বভাবে কঠোর, আচরণে কঠিন, সম্পর্কে বিষয়ী, অতি আত্মকেন্দ্রিক এবং অতি প্রতিশোধপরায়ণ। প্রাচ্যের খৃস্টবাদ যে সকল উচ্চতর মানবিক গুণ ও বৈশিষ্ট্য এবং ভাব ও আবেগ তাকে দান করেছিলো তার কিছুই যেন এখন অবশিষ্ট নেই। যেমন, জার্মানরা স্বভাবে প্রকৃতিতে খুবই নিষ্ঠুর। তারা মনে করে, দুর্বলের বেঁচে থাকার অধিকার নেই; মৃত্যুই তার প্রাপ্য। তাদের দৃষ্টিতে সকল মহত্ত্বের মূলে হচ্ছে ‘শক্তি’, আর শক্তির উৎস সম্পদ। জ্ঞান ও বুদ্ধিচর্চায় তারা আগ্রহী এবং গৌরব ও মর্যাদা অর্জনে বদ্ধপরিকর, তবে সম্পদ লাভের জন্য।
ল্যাটিন ও ইটালীয়রা স্বভাবতঃ আত্মতুষ্ট ও রগচটা। তারা ভাবে, বুদ্ধির পরিচয় হলো বাধাবন্ধন- হীনতায়, জীবনের সার্থকতা হলো লজ্জাহীনতায় এবং মর্যাদা হলো পোশাক-সৌন্দর্যে, আর প্রতিপত্তি হলো প্রাধান্য অর্জনের মধ্যে।’
পাশ্চাত্যের স্বভাব ও প্রকৃতি এবং ভাবধারা ও মনস-ত্ত্বের এটি হচ্ছে সবচে’ নির্ভুল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও নিখুঁত চিত্রাঙ্কন। আমরা মনে করি, মরহূম আলকাওয়াকিবী নিছক উদাহরণ হিসাবে জার্মান-ইটালী দুই জনগোষ্ঠীর কথা বলেছেন, অন্যথায় কিছু পার্শ্ববিষয় ও কিছু জাতীয় বৈশিষ্ট্য বাদে বস'পূজা, সম্পদলিপ্সা, আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা, আচরণের কঠোরতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের সকল জাতি অভিন্ন।
আধ্যাত্মিকতায়ও বস'বাদ!
এই যে বস'বাদী চেতনা, এটা আপনি ইউরোপের ঐ সকল রাজনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক ব্যবস'ার মধ্যেই দেখতে পাবেন, যা এ যুগে ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর হাতে অসি-ত্ব লাভ করেছে; এমনকি যে আধ্যাত্মিক আন্দোলন সমপ্রতি ইউরোপে বিরাট চমক ও আলোড়ন সৃষ্টি করেছে সেটারও মূল প্রাণ হচ্ছে সেই একই বস'বাদী মানসিকতা। অন্যসব শিল্প ও বিজ্ঞানের মত এটাও হয়ে পড়েছে নিছক একটি আর্ট ও সাইন্স, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মা- জগতের রহস্য ও বিস্ময় উদ্ঘাটন এবং আত্মিক বিনোদনরূপে ‘মৃত-আত্মা’র সঙ্গে যোগাযোগ স'াপন ও কথপোকথন, যা প্ল্যানচেট নামে ইউরোপে এখন খুবই জনপ্রিয় একটি আদিভৌতিক বিজ্ঞান, যাতে রয়েছে হিমালয়ের উচ্চতা জয় করার মত অভিযান-রোমাঞ্চ। হৃদয় ও আত্মার সংশোধন, আল্লাহর ভয় ধারণ, সততা ও পুণ্যের পথ অবলম্বন, মৃত্যুর প্রস'তি গ্রহণ এবং আল্লাহর প্রতি আত্মনিবেদনের মাধ্যমে জীবনের বেদনা ও যন্ত্রণা এবং বিপদ-প্রতিকূলতার মুখে ধৈর্য ও সৈ'র্য্যের শিক্ষা গ্রহণ করার সঙ্গে এর দূরতম সম্পর্কও নেই। পক্ষান-রে ইসলামী প্রাচ্যের তাসাওউফ ও আধ্যাত্মবাদের মূল প্রেরণাই হচ্ছে আত্মসংযম ও আত্মসংশোধনের মাধ্যমে স্রষ্টার নৈকট্য অর্জন।
একই ভাবে পাশ্চাত্যের মানুষ যেসকল কাজে প্রাণ ও সম্পদ বিসর্জন দেয়, দু’একটি ব্যতিক্রম বাদে সেগুলোর পিছনেও বস'বাদী চিন-া-চেতনা ও জাগতিক লক্ষ্য- উদ্দেশ্য ক্রিয়াশীল থাকে। যেমন স'তি ও সুখ্যাতি অর্জন করা, জাতির গর্ব ও গৌরবের পাত্র হওয়া এবং ইতিহাসের পাতায় অমরত্ব লাভ করা, এমনকি লোকলজ্জা ও নিন্দাভয়ও এর কারণ হতে পারে। পক্ষান-রে ইসলামী প্রাচ্যে যে কোন ত্যাগ ও আত্মত্যাগের উদ্দেশ্য হয় আল্লাহর সন'ষ্টি ও আখেরাতের মুক্তি। তাই একজন মুসলিম সবসময় এ আশঙ্কায় থাকে যে, তার আমল যেন কোন জাগতিক চাহিদার দোষে দূষিত এবং রিয়া ও যশলিপ্সার কলঙ্কে কলঙ্কিত না হয়ে পড়ে। তাহলে তো ধ্বংস ও বরবাদিই হবে একমাত্র পরিণতি। তার চিন-ায় সর্বদা জাগরূক থাকে আল্লাহ তা‘আলার এ সতর্কবাণী-
‘আমি কি তোমাদের অবহিত করবো ঐ লোকদের সম্পর্কে যারা আমলের দিক থেকে অধিকতর ক্ষতিগ্রস-! (ওরা তারাই) দুনিয়ার জীবনে যাদের কর্মপ্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে, অথচ তারা ভাবে যে, তারা উত্তম আমল করছে। ওরাই তারা যারা অস্বীকার করেছে তাদের প্রতিপালকের আয়াতসমূহ এবং (অস্বীকার করেছে) তাদের প্রতিপালকের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি। ফলে বরবাদ হয়ে গেছে তাদের আমল। তাই কেয়ামতের দিন তাদের (আমলকে) আমি কোনই মূল্যদান করবো না।’
আরো তাদের সামনে থাকে এই আয়াত-
‘এবং দুনিয়াতে এরা যে কোন আমল করেছে, আমি সেগুলোর দিকে অগ্রসর হবো, অনন-র বানিয়ে দেবো সেগুলোকে উড়ন- ধূলিকণা।’
নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া- সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো যে, কেউ লড়াই করে বীরত্বের কারণে, কেউ লড়াই করে জোশ ও জাযবার কারণে, আর কেউ লড়াই করে খ্যাতি ও সুখ্যাতির জন্য। এগুলোর কোনটি আল্লাহর রাস-ায় বলে গণ্য হবে? তিনি বললেন, যে লড়াই করবে শুধু এ জন্য যে, আল্লাহর কালিমা বুলন্দ হোক, সেটাই শুধু আল্লাহর রাস-ায় বলে গণ্য হবে।
হযরত ওমর (রা.) এভাবে দু‘আ করতেন-
‘হে আল্লাহ, আমার সব আমলকে তুমি নেক আমল বানিয়ে দাও এবং আমার সব আমলকে তুমি তোমার সন'ষ্টির জন্য খালিছ করে নাও। তাতে তোমার গায়রের কোন হিছ্ছাই রেখো না।’
এছাড়া যুগে যুগে উম্মাহর নেককার লোকদের যে প্রাণান- প্রচেষ্টা ছিলো নিজেদের আমল-ইবাদাত, দান-ছাদাকা ও সদাচার গোপন রাখার, সেসব কাহিনীতে তো ইতিহাসের পাতা ভরপুর!
অর্থনীতির সর্বগ্রাসিতা
জড়বাদী চিন-া ও বস'বাদী চেতনা ইউরোপে এমনই এক সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করেছিলো যে, এরই যুপকাষ্ঠে তারা নিজেদের হৃদয় ও আত্মা এবং প্রাণ ও প্রাণসত্তাকে বলি দিয়েছিলো। ফলে জীবনের সর্বক্ষেত্রে বস'গত মূল্যবোধ ছাড়া আর সবকিছু তারা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছিলো। তাসাওউফের পরিভাষা ‘ফানা ফিল্লাহ’-এর অনুকরণে বলা যায়, ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী এক্ষেত্রে ‘ফানা ফিল মাদ্দাহ’-এর স-রে উপনীত হয়েছিলো। এককথায় অর্থনীতিই ছিলো তাদের জীবনের সর্বেশ্বরবাদ বা ‘ওয়াহদাতুল অজূদ’। উদাহরণ হিসাবে আমরা সমাজতান্ত্রিক দর্শনের জনক কালমার্ক্স-এর কথা বলতে পারি। তিনি মনে করেন, অর্থব্যবস'াই হলো সমাজব্যবস'ার মূল প্রাণ। এছাড়া ধর্ম, দর্শন, সভ্যতা, শিল্প ও ললিতকলা ইত্যাদি, জীবনের অঙ্গনে আর যা কিছু আছে সব এই অর্থব্যবস'ারই প্রতিবিম্ব ও প্রতিক্রিয়া মাত্র। তিনি বলেন, মানব-ইতিহাসের প্রতিটি যুগে, প্রতিটি অধ্যায়ে পণ্য উৎপাদনের নিজস্ব পন'া ও পদ্ধতি ছিলো এবং সে আলোকেই সামাজিক সম্পর্ক- সমূহ নির্ধারিত হয়েছে। কিন-ু কিছু দূর গিয়ে সম্পর্কগুলো উৎপাদনব্যবস'ার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ থাকে না, (বৈষম্যপূর্ণ হয়ে যায়)। তখন একদল (স্বাভাবিকভাবেই ক্ষতিগ্রস- দল) সামাজিক সম্পর্কগুলোকে নতুন বিন্যাস- দানের প্রচেষ্টা চালায়, ইতিহাসে যা বিভিন্ন বিপ্লব ও বিদ্রোহ নামে পরিচিত, কিন' ঐতিহাসিকরা এসকল বিপ্লব ও বিদ্রোহের রূপ ও স্বরূপ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কেননা যারা এসকল বিপ্লব-বিদ্রোহ সঙ্ঘটন করেছেন, বা তাতে অংশ নিয়েছেন, হয়ত তারাও সেগুলোর উদ্দেশ্যটি অনুধাবন করতে পারেননি। তবে পরবর্তীকালে আমাদের পক্ষে এই ধাঁধার সমাধান বের করা সম্ভব। অর্থাৎ আমরা বুঝতে পারি যে, সমগ্র রাজনৈতিক বিবর্তন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস'ার অব্যাহত পরিবর্তন ও সংশোধন, এগুলো মূলত সামাজিক সম্পর্ক-সমূহের পুনর্বিন্যাসেরই নব নব রূপ, যার অভ্যুদয় ঘটেছে শুধু এজন্য যে, নতুন উৎপাদন ব্যবস'া -গুলোর সঙ্গে এই সম্পর্কগুলোকে যেন নতুনরূপে সুসঙ্গত ও সুবিন্যস- করা যায়। আর যেহেতু পণ্য উৎপাদনের ব্যবস'াসমূহ এবং তার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সামাজিক সম্পর্কসমূহ- এ দু'য়ের মধ্যে পার্থক্য ও ভিন্নতা অব্যাহত রয়েছে সেহেতু এ দু'য়ের মধ্যে সঙ্গতি- বিধানের প্রয়াস-প্রচেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে। তবে পার্থক্য যখনই সীমা ছাড়িয়ে যায় এবং বিভেদ তীব্র হয়ে ওঠে তখন প্রতিক্রিয়াটিও বিপ্লব-বিদ্রোহের রূপ ধারণ করে। কিন' বিভেদ ও পার্থক্য স্পষ্ট না হলেই তার অসি-ত্ব অস্বীকার করা সঙ্গত হবে না।
পণ্য-উৎপাদনের বিভিন্ন ব্যবস'া এবং বিভিন্ন সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে এই যে পার্থক্য ও বিভেদ, তা শ্রেণীসঙ্ঘাতের মধ্যে প্রকাশ পায়। কেননা সমাজের সকল শ্রেণী মূলত অর্থনৈতিক ব্যবস'ারই বিভিন্ন অঙ্গ।’
এই চিন-াধারা থেকে কার্লমার্ক্স র্ সিদ্ধান- গ্রহণ করেন যে, মানব- জাতির শৈশবযুগটুকু বাদ দিলে তার সুদীর্ঘ ইতিহাস সমাজে শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়।
মোটকথা এভাবে ভদ্রলোক অর্থনৈতিক জীবন ছাড়া মানুষের জীবনের অন্যান্য দিকের অসি-ত্বই অস্বীকার করে বসেছেন। ধর্ম ও চরিত্র, হৃদয় ও আত্মা, এমনকি বিবেক-বুদ্ধিকেও তিনি গুরুত্ব দিতে প্রস'ত ছিলেন না। কখনো তিনি স্বীকার করেননি যে, অর্থনীতির বাইরে এগুলোর কোন একটি কখনো ইতিহাসের কোন অনুঘটকরূপে ভূমিকা পালন করেছিলো। তার মতে ইতিহাসে যত যুদ্ধ ও বিপ্লব ঘটেছে সেগুলো আর কিছু ছিলো না, ছিলো শুধু বৃহৎ ও পূর্ণ উদর থেকে ক্ষুদ্র ও শূন্য উদরের প্রতিশোধ গ্রহণের প্রচেষ্টা এবং অর্থনৈতিক ব্যবস'া ও পণ্য-উৎপাদনের ব্যবস'াসমূহের মধ্যে নতুন বিন্যাস প্রতিষ্ঠার নিরন-র সংগ্রাম। এমনকি ধর্মীয় যুদ্ধগুলোও তার মতে বিভিন্ন অর্থনৈতিক শ্রেণীর পরস্পর সঙ্ঘাত ছাড়া আর কিছু ছিলো না, যেখানে একটি শ্রেণী সম্পদের উৎস ও উৎপাদনব্যবস'া কুক্ষিগত করে রেখেছিলো, আর অন্য শ্রেণী হয়ে উঠেছিলো তার প্রতিদ্বন্দ্বী এবং কোমর বেঁধে নেমেছিলো ‘সম্পদ ও সম্পর্ক’ পুনর্বিন্যস- করার মাধ্যমে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায়। ফলে সঙ্ঘাত ও সঙ্ঘর্ষ হয়ে উঠেছে অনিবার্য, কিন' তার স্বরূপ চাপা পড়ে গিয়েছে ধর্মযুদ্ধের আড়ালে।
তাহলে বলতে হয়, কালমার্ক্স-এর দৃষ্টিতে বদর, অহুদ ও কাদিসিয়া, ইয়ার্মুক এবং এজাতীয় আরো যত যুদ্ধের বিবরণ ইতিহাস সংরক্ষণ করেছে সেগুলো অর্থনৈতিক শ্রেণী -সংগ্রাম ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। (কিন' তাতে তার মসি-ষ্কের সুস'তা সম্পর্কে সন্দেহ উপসি'ত হতেই পারে।)
তো এই হচ্ছে আপনার পশ্চিমা বস'বাদী আধ্যাত্মিকতা এবং ‘অর্থনৈতিক সর্বেশ্বরবাদের’ দর্শন।
তাসাওউফের পরিভাষায় বিষয়টিকে আমরা এভাবেও উপস'াপন করতে পারি যে, প্রাচ্যের উপর যেহেতু আধ্যাত্মিক চেতনা ও ঈশ্বরচিন-ার একক প্রভাব ছিলো সেহেতু এক্ষেত্রে যারা ‘বিভোর ও বিলুপ্ত’ স-রে চলে গিয়েছিলেন তারা আল্লাহ ছাড়া সকল ‘অসি-ত্ব’ অস্বীকার করে বসেছিলেন। বিলুপ্ত চেতনা ও আচ্ছন্নতার অবস'ায় তাদের শ্লোগান ছিলো ‘লা-মাওজূদা ইল্লাল্লাহ’; পক্ষান-রে ইউরোপের চিন-ানায়কদের উপর যেহেতু বস'বাদের অপ্রতিহত প্রভাব ছিলো সেহেতু তারা অর্থনৈতিক বাস-বতা ছাড়া জীবনের অন্য সবকিছুর
অসি-ত্ব অস্বীকার করেছিলো। তাদের যেন শ্লোগান ছিলো ‘লা-মাওজূদা ইল্লাল মাদ্দাহ’।
প্রাচ্যের সুফীবাদীরা মানুষকে ভাবতেন পৃথিবীতে আল্লাহর ছায়া। তাই আচ্ছন্ন চেতনার সময় কেউ কেউ চিৎকার করে বলে উঠেছেন ‘আনাল হক’। পক্ষান-রে পাশ্চাত্যের বস'পূজারীরা মানুষকে নিছক বুদ্ধিমান সামাজিক পশু ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেনি। তাই সেখানে আজ দিকে দিকে একই শ্লোগান, আনাল হক-এর পরিবর্তে ‘আনাল হায়ওয়ান’!
ডারউইনের বিবর্তনবাদ ও তার প্রভাব
এভাবে খৃস্টীয় উনিশ শতকে ইউরোপে একে একে এমন সব বাদ-মতবাদ ও জ্ঞান-গবেষণা আত্মপ্রকাশ করতে লাগলো যা দ্বারা মানুষ ও তার জীবন সম্পর্কে উপস'াপিত ‘জৈব দৃষ্টিকোণ’টি আরো জোরালো ও সংহত হলো। মড়ার উপর খাড়ার ঘা-রূপে তখন এলো ডারউইনের বিবর্তনবাদ। ১৮৬৯ খৃস্টাব্দে প্রকাশিত ঙৎরমরহ ঙভ ঝঢ়বপরবং গ্রনে' ডারউইন প্রমাণ করতে চাইলেন যে, প্রকৃতপক্ষে মানুষ হচ্ছে তার চেয়ে নিম্নস-রের প্রাণী থেকে উন্নতিপ্রাপ্ত একটি প্রাণীমাত্র। বহু লক্ষবছরে সে তার বিবর্তনধারা অতিক্রম করেছে এবং এক প্রাণীর স-র থেকে অন্য প্রাণীর স-রে উপনীত হয়েছে। যেমন অসড়বনধ থেকে বানর এবং বানর থেকে ক্রমান্বয়ে মানবরূপ লাভ করেছে। আর এই মানবরূপই হচ্ছে তার শ্রেণীগত উৎকর্ষের সর্বোচ্চ স-র। ডারউইনের বিবর্তনবাদই তখন সমাজ ও শিক্ষাঙ্গন সবত্র আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়লো। সমগ্র ইউরোপে এমন আলোড়ন সৃষ্টি হলো, যার তুলনা বাদমতবাদের ইতিহাসে সত্যি বিরল। বস'ত বিবর্তনবাদ ছিলো মানুষ ও তার জীবন সম্পর্কে চিন-া করার সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারা, যার মাধ্যমে প্রাণীজগতের অভ্যাস ও বৈশিষ্ট্য এবং বিকাশ ও বিবর্তন সম্পর্কে জানার এবং জ্ঞান-পরিধি বৃদ্ধি করার অদম্য কৌতূহল ও স্পৃহা সৃষ্টি হয়েছিলো। বলা যায়, মানুষ যেন মানুষকে বাদ দিয়ে বানর নিয়েই বেশী করে গবেষণায় মেতে উঠেছিলো। বিবর্তনবাদ ইউরোপের চিন-া-চেতনায় এ বিশ্বাস বদ্ধমূল করে দিয়েছিলো যে, বিশ্বজগত কোন ঐশী ব্যবস'া এবং অতিপ্রাকৃতিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ ছাড়া সম্পূর্ণ নিজস্ব শক্তিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলছে। শাশ্বত প্রাকৃতিক সূত্রসমূহ ছাড়া বিশ্বজগতের উদ্ভব ও বিকাশ এবং গতি ও পরিণতি অর্জনের পিছনে অন্য কোন সূত্র নেই, বরং প্রতিটি সৃষ্টি ‘ঊর্ধ্বজাগতিক বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার নিয়ন্ত্রণ ছাড়া ‘ক্রমস্বভাব প্রক্রিয়ায়’ প্রাণের প্রাথমিক স-র থেকে পরবর্তী স-রে উন্নীত হয়ে এসেছে। সুতরাং মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী মহাপ্রাজ্ঞ কোন স্রষ্টার সৃষ্টি নয়, বরং প্রকৃতির স্বভাব প্রক্রিয়ার ফল, যার মূল কথা হচ্ছে, অসি-ত্বের সংগ্রাম, যোগ্যতরের বিজয় এবং প্রকৃতির নির্বাচন, যা সৃষ্টিজগতের সর্বত্র এবং বাক, বুদ্ধি ও বোধের অধিকারী অধিক উন্নত প্রাণী মানুষের ক্ষেত্রেও সমান কার্যকর। নৈতিক ও চিন-া- নৈতিক ফলাফলের দিক থেকে এবং সূচনা ও পরিণতিসম্পর্কিত মৌলবিশ্বাসের দিক থেকে, সর্বোপরি বাস-ব প্রভাবের দিক থেকে বিবর্তনবাদ যে ধর্মের সঙ্গে আগাগোড়া সঙ্ঘর্ষপূর্ণ তা তো বলাই বাহুল্য; বরং এ ছিলো এক নতুন ধর্ম, যা অন্যসব ধর্মের মূলে কুঠারাঘাত করেছিলো। সুতরাং ধর্মনেতাগণ যদি ইউরোপের বুকে ধর্মের ভবিষ্যত সম্পর্কে শঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং বিবর্তনবাদের বিরোধিতায় কোমর বেঁধে নেমে পড়েন তাতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই।
প্রফেসর জোড লিখেছেন-
‘এখন আমাদের পক্ষে কল্পনা করাও কষ্টকর যে, ডারউইন যখন
ঙৎরমরহ ঙভ ঝঢ়বপরবং গ্রনে' তার মতবাদ প্রচার করলেন তখন আমাদের পূর্বপুরুষগণ কেমন স-ব্দ-বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। ডারউইন তার গবেষণার ফলাফল দ্বারা প্রমাণ করলেন- কিংবা ভাবলেন যে, তিনি প্রমাণ করেছেন- যে, পৃথিবীনামক গ্রহে প্রাণীর বিবর্তন প্রক্রিয়া অসড়বনধ ও ঔবষষু ভরংয এর প্রাথমিক উদ্ভব থেকে চূড়ান- ও সর্বোচ্চ স-র পর্যন- অব্যাহতভাবে চলে এসেছে, আর আমরা হলাম প্রাণের বিবর্তনের সর্বোন্নত ও সর্বোচ্চ স-র।
এর বিপরীতে ভিক্টোরিয়া যুগের লোকদের বলা হয়েছিলো, মানুষ স্বয়ং স্বতন্ত্র একটি সৃষ্টি এবং প্রকৃতপক্ষে সে ফিরেশতার স-র থেকে অবনমিত একটি শ্রেণী। অথচ ডারউইনের মতবাদ যদি ঠিক হয় তাহলে মানুষের পরিচয় ‘একটি উন্নত বানর’ ছাড়া আর কিছুই থাকে না। বলাবাহুল্য, ভিক্টোরিয়া যুগের মানুষের পক্ষে এটা মেনে নেয়া কঠিন ছিলো যে, মানুষ হবে অবনমিত ফিরেশতার পরিবর্তে উন্নতিপ্রাপ্ত বানর। এই মতবাদ তাদের কাছে ছিলো মৃত্যুর চেয়ে অসহনীয়। তাই তারা মানুষকে বিবর্তনবাদের কলঙ্ক থেকে উদ্ধারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন উপায় ও পন'া গ্রহণের চেষ্টা করেছিলো। কিন' উপায় ছিলো না। বৈজ্ঞানিক গবেষণার দিক থেকে বড় ধরনের দুর্বলতা ও শূন্যতা থাকা সত্ত্বেও আমজনতা ও বিজ্ঞানীদের এক বিরাট অংশ বুঝে, না বুঝে ডারউইনের বিবর্তনবাদ মেনে নিয়েছিলো। অথচ বিজ্ঞানেরই মূল কথা হলো, চূড়ান- গবেষণা ও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া ছাড়া কোন ধারণাকে সত্যের মর্যাদা দেয়ার সুযোগ নেই। কিন' বিবর্তনবাদের ক্ষেত্রে মানুষ বিজ্ঞানের মূল শিক্ষাই যেন ভুলে গেলো এবং ‘প্রমাণ ছাড়াই প্রমাণিত’ বলে মেনে নিলো। আসল কথা, ধর্মের প্রতি সৃষ্ট বিদ্বেষের কারণে মানুষের চিন-া ও মনমসি-ষ্ক এধরনের মতবাদ গ্রহণ করার জন্য সম্পূর্ণ প্রস'ত ছিলো। কারণ ধর্ম ও ধর্মনেতাদের বিরোধিতার জন্য এর মধ্যে তারা জোরালো ভিত্তি পেয়ে গিয়েছিলো। এভাবে এ সত্য আবারও প্রমাণিত হলো যে, মানুষ যতই বিজ্ঞানমনস্কতা ও মুক্তবুদ্ধির গর্ব করুক আসলেই সে আবেগ-অনুভূতির দাস। সুতরাং জীবন ও জগত সম্পর্কে তার কোন সিদ্ধান-ই আস'াযোগ্য নয়, যতক্ষণ না অকাট্য কোন প্রমাণ (আসমানি অহি) তাকে সমর্থন করে।
বিবর্তনবাদের পক্ষে মানুষের চিন-ার গতি এমনই বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত ছিলো এবং প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও প্রকাশনার এমন সর্বপ্লাবী ঢল নেমেছিলো যে, তার মুকাবেলা করা সম্ভবই ছিলো না। ফলে এক অসম যুদ্ধে ধর্ম ও গীর্জাকে আত্মসমর্পণ করতেই হলো। এমনকি ১৮৮৩ খৃস্টাব্দে ডারউইনের মৃত্যুতে ব্রিটিশ গীর্জাকে শোক প্রকাশ করতে হলো এবং তাকে সেই সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হলো যা গীর্জা কোন মানুষকে দিতে পারে। অর্থাৎ ধর্মনেতাদের সমাধিস'লে তার সমাধি-ব্যবস'া অনুমোদন করতে হলো।
চিন-া-চেতনা, নীতি-নৈতিকতা, শিল্প-সাহিত্য, জীবন, সভ্যতা ও রাজনীতি সর্বত্র বিবর্তনবাদের প্রভাব ছিলো অত্যন- সুদূরপ্রসারী। ‘প্রকৃতির কোলে নগ্ন-স্বাধীন জীবনযাপনের স্বভাবযুগ’-এ ফিরে যাওয়ার যে একটা জোরদার প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিলো, মূলত সেটা ছিলো বিবর্তনবাদেরই একটি প্রকাশ। ইউরোপের জীবন ও সভ্যতা এবং কর্ম ও চরিত্রের আরো বহু বিষয় আসলে এ চিন-া ও বিশ্বাসেরই অনিবার্য ফল ছিলো যে, মানুষ একটি উন্নত প্রাণী। পারিবারিক জীবন বিপর্যস- হওয়ারও কারণ ছিলো এটি; ব্রিটিশ চিন-াবিদ মিস্টার শেপার্ড যেমন বলেছেন, ইংলেন্ডে এমন একটি প্রজন্ম আত্মপ্রকাশ করেছে যারা পারিবারিক জীবনের ধারণা সম্পর্কেই অজ্ঞ; পশুপালের অবাধ জীবন ছাড়া অন্য কোন জীবনের সঙ্গে যারা পরিচিতই নয়।
বস'বাদের অমার্জনীয় অপরাধ
ইউরোপের এই সর্বগ্রাসী বস'বাদ ও ধর্মহীন শিক্ষা, যাতে চরিত্র ও নৈতিকতা এবং আল্লাহভীতি ও পরকালচিন-ার চিহ্নমাত্র ছিলো না, এসবের ফল এই ছিলো যে, রাজনীতি ও রাষ্ট্রপরিচালনার স্নায়ুকেন্দ্রগুলোতে যারা অবস'ান করতো, কখনো কখনো তারা এমন সব অপরাধে লিপ্ত হতো যা নিকৃষ্টতম অপরাধীদের পক্ষেও কল্পনা করা সম্ভব হতো না। নির্দ্বিধায় যে কোন নীচতায় তারা নামতে পারতো শুধু এজন্য যে, তাতে দেশের বা সমপ্রদায়ের রাজনৈতিক স্বার্থ ছিলো, কিংবা ব্যক্তিগত লাভালাভের প্রশ্ন ছিলো।
ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী জনগোষ্ঠীর কালো থাবা যেখানে যেখানে পড়েছে সেখানেই রয়েছে নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার অসংখ্য উদাহরণ; তবে এখানে আমরা শুধু উল্লেখ করবো ভারতবর্ষ ও মুসলিম মধ্যপ্রাচ্যের কথা। ভারতবর্ষে ব্রিটিশজাতির আগমন কীভাবে হয়েছিলো। শঠতা, ধূর্ততা ও নিষ্ঠুরতার কত শত কাহিনীর জন্ম হয়েছিলো, কত রক্তগঙ্গা প্রবাহিত হয়েছিলো, ইজ্জত-আবরু কী নৃশংসরূপে লুণ্ঠিত হয়েছিলো, সে কাহিনীও থাক। শুধু সেই সময়ের এক দু’টি ঘটনা বলি, যখন ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার আগে শেষ আক্রোশ মিটিয়েছিলো।
মানবজাতির ইতিহাসে নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতার অন্যতম চমকপ্রদ ঘটনা এই যে, ভারতবর্ষের ‘বেঙ্গল প্রভিন্স’-এ ব্রিটিশ সরকার একটি কৃত্রিম মহাদুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছিলো এবং তা এভাবে যে, একদিকে কৃষকদের ধান কেটে আনার জন্য নৌকা ব্যবহার করার সুযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিলো, অন্যদিকে সেনাবাহিনীর জন্য বিপুল পরিমাণ চাল মজুদ করা হয়েছিলো, অথচ ধানচালই ছিলো প্রদেশটির প্রধান খাদ্য। ক্ষুধায় অনাহারে মানুষ যখন দলে দলে মরছে, গুদামে তখন বিপুল খাদ্যশস্য নষ্ট হচ্ছে! চিন-াশীল সকলেই একমত যে, তখন ঐ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের প্রাকৃতিক কোন কারণ ছিলো না এবং অনাহারে মৃত্যুর কোন সম্ভাবনা ছিলো না, যদি ব্রিটিশ সরকার সামান্য কর্মতৎপরতার পরিচয় দিতো। কারণ খাদ্যের মজুদ ছিলো প্রচুর, রেল ও যোগাযোগ ব্যবস'া ছিলো সনে-া -ষজনক। তাছাড়া ভারতবর্ষ ছিলো এমনই উর্বর দেশ যে, অন্যান্য দেশেও খাদ্যসরবরাহ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো।
এসব কেন করা হয়েছিলো? শুধু এই ধারণা ও কল্পনার উপর যে, ক্ষুধা-অনাহারে উৎপীড়িত মানুষ ব্রিটিশবাহিনীতে ভর্তি হতে উৎসাহিত হবে। তাছাড়া প্রমাণ করা যাবে যে, দেশ পরিচালনার যোগ্যতা ভারতের স'ানীয় প্রশাসনের নেই, এখনো ব্রিটিশ- শাসনের প্রয়োজন রয়েছে এবং স্বরাজচিন-া আগাগোড়া একটি ঝুঁকিপূর্ণ চিন-া।
১৯৪৭ সনে বিভাগপরবর্তী ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল ছিলেন লর্ড মাউন্ট বেটন। তখন দিল্লী ও পূর্বপাঞ্জাবে পর্দার আড়ালে মুসলিমনিধনের যে, ভয়াবহ ষড়যন্ত্র দানা বেঁধে উঠছিলো লর্ড বেটন সে সম্পর্কে চোখ বন্ধ করে রেখেছিলেন। তার কাছে লাগাতার খবর আসছিলো এবং প্রশাসন ও গোয়েন্দা বিভাগের অভিজ্ঞ ও মানবতাবাদী লোকেরা তাকে সম্ভাব্য সামপ্রদা- য়িক দাঙ্গার ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করে আসছিলেন, কিন-ু তিনি ছিলেন ‘জাগ্রত নিদ্রায়’। কারণ মুসলিম সমপ্রদায়ের উপর তিনি এ জন্য ক্ষিপ্ত ছিলেন যে, ভারতের মত পাকিস-ান তাকে গভর্নর জেনারেল পদে গ্রহণ করতে রাজী হয়নি, (কারণ তার ভারতপ্রীতি ও নেহরুপত্নির প্রতি দুর্বলতা ছিলো সুবিদিত)। ব্যক্তিগত প্রতিশোধ স্পৃহা ছাড়াও লর্ড মাউন্ট বেটন দাঙ্গা ও গৃহযুদ্ধ থেকে প্রমাণ করতে চাচ্ছিলেন যে, ভারতবাসী এখনো স্বাধীনতার উপযুক্ত নয় এবং ভারতবর্ষে ব্রিটিশশাসনের প্রয়োজন ছিলো। ভারতের উভয় অংশ গণনিরাপত্তা ও শানি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য এখনো ইংরেজজাতির উপর নির্ভরশীল। বলাবাহুল্য যে, এই একটি লোকের ধর্মভয়শূন্য হৃদয়ের কারণে তখন এমন ভয়াবহ মানবনিধনযজ্ঞ সঙ্ঘটিত হতে পেরেছিলো, যার নমুনা মানবজাতির না অতীতে আছে, না আগামী বহু শতাব্দী তার নমুনা ‘প্রসব’ করতে সক্ষম।
রেডক্লিফের নামও এখানে আসতে পারে, যাকে ভারতে হিন্দু-মুসলিম উভয় পক্ষ পাঞ্জাবের কিছু শহর সম্পর্কে মধ্যস'তাকারী মেনেছিলো যে, সেগুলো ভারতের অন-র্ভুক্ত হবে, না পাকিস-ানের? কিন' তিনি বিশ্বাসভঙ্গ করে অন্যায় সিদ্ধান- চাপিয়ে দিয়েছিলেন। ফল হয়েছিলো ফিরোযপুর ও গুরুদাসপুর থেকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর গণবিতাড়ন এবং জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, (আর ইজ্জত-আবরু তো ইংরেজ সভ্যতার কোন বিষয়ই নয়)।
অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে ট্রুম্যান-এর ভূমিকা ছিলো আগাগোড়া ন্যাক্কারজনক। ইহুদিবাদকে তিনি সমর্থন করেছেন সম্পূর্ণ অন্ধ সেজে যুক্তি ও বিবেকের টুঁটি চিপে ধরে। ফিলিসি-নে ইসরাইলী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকাই ছিলো প্রধান। আরবদের সম্পূর্ণ ন্যায়ানুগ দাবী তিনি উপেক্ষা করেছিলেন, কারণ আর কিছু নয়, ভোটের হিসাব-নিকাশ। নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য তার প্রয়োজন ছিলো ইহুদীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মিডিয়া শক্তির সমর্থনের।
আরব ইসলামী দেশ আলজিরিয়ার স্বাধীনতাযুদ্ধে ফ্রান্স যে মানবতা- বিরোধী অপরাধ করেছে, বিশ্বইতিহাসে অবশ্য তার নযির আছে, তবে খুব বেশী নেই। কিন' আমেরিকার সমর্থন ছিলো পাশবিক শক্তি ব্যবহারকারী দখলদার দেশ ফ্রান্সের প্রতি। আলজিরিয়ার মাটিতে অসহায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর দিয়ে বর্বরতা ও পাশবিকতার যে ভয়াবহ ঝড় বয়ে গিয়েছিলো তাতে আমেরিকা ও ইউরোপ ছিলো সম্পূর্ণ নির্বিকার। এসব ঘটনা এবং আরো বহু ঘটনা জ্বলন-ভাবে প্রমাণ করে যে, ইউরোপ-আমেরিকার নেতৃবর্গের চরিত্র ও নৈতিকতা বলতে কিছু ছিলো না (এখনো নেই)! বস'ত তাদের রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি আবর্তিত হয় স্বার্থকে কেন্দ্র করে, নীতি ও আদর্শকে কেন্দ্র করে নয়।
(চলবে, ইনশাআল্লাহ)