শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

শাবান ১৪৩১হিঃ (১৭) | তোমাদের পাতা

রাণীর বাংলো দেখতে গিয়ে

লিখেছেনঃ নূরুল হাসান বিন আব্দুল ওয়াদুদ

এবার বন্ধে আমরা দু’বন্ধু সিদ্ধান- নিলাম, ভীরু বাঙ্গালীর মত আর ঘরে বসে থাকবো না; বেড়াতে যাবো কুমিল্লার ময়নামতিতে, যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বহু প্রত্নতাত্ত্বিক দর্শনীয় বস'। তার মধ্যে একটি হলো রাণীর বাংলো। ময়নামতিতে আছে ছোট ছোট অনেক পাহাড়। ফলে সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হয়ে ওঠে পর্যটকদের জন্য অতিরিক্ত প্রাপ্তি। বাসযোগে আমরা কুমিল্লা ক্যান্টনম্যান্ট বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলাম। সেখান থেকে সি,এন,জিতে করে রওয়ানা হলাম ময়নামতির উদ্দেশ্যে। সেনানিবাস এলাকা থেকে দু’কিলোমিটার উত্তরে ময়নামতি। তাই আমাদের সি,এন,জি উত্তরের পথ ধরে এগিয়ে চললো। সারাটা পথ দু’পাশ থেকে সবুজ গাছ ছায়া দিয়ে রেখেছে। ছায়ায় ছায়ায় অল্পক্ষণেই আমরা পৌঁছে গেলাম রাণীর বাংলোর প্রবেশপথের সামনে। পায়ে চলা পথটিও মনোরম। যেদিকে চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। আমরা যেন সবুজের এক স্বপ্নরাজ্যে এসে পড়েছি! উঁচু-নীচু টিলাগুলো যেন সবুজের চাদর মুড়ি দিয়ে রেখেছে। রাণীর বাংলো একটি পাহাড়ের চূড়ায় অবসি'ত। ঊর্ধ্বমুখী পথ বেয়ে একসময় আমরা বাংলোর চত্বরে প্রবেশ করলাম। লোকশ্রুতি এই যে, আগরতলার মহারাজা কুমার কিশোর মানিক্য তার স্ত্রী রাণী ময়নামতির জন্য এখানে একটি আনন্দমহল তৈরী করেছিলেন, যা এখন রাণীর বাংলো নামে পরিচিত। মহলের সেই সৌন্দর্য এখন আর নেই। এমনকি অযত্নে অবহেলায় এখন তা প্রায় ধ্বংসসতূপ। আমরা ঘুরে সব দেখছিলাম, আর দেহ-মনে আশ্চর্য এক রোমাঞ্চ অনুভব করছিলাম। ভিতরে কয়েকটি সুড়ঙ্গ দেখতে পেলাম। এই সুড়ঙ্গগুলোর সঙ্গে নাকি অনেক রহস্য জড়িয়ে আছে। ভিতরে গেলে নাকি কেউ ফিরে আসে না। সত্য হোক, মিথ্যা হোক, এখন আর কেউ ভয়ে সুড়ঙ্গের ভেতরে যায় না। আশেপাশের অন্যান্য টিলা থেকে রাণীর বাংলোর টিলাটি বেশ উঁচু, তাই এখান থেকে বহু দূর পর্যন- দেখা যায়। সে বড় অপূর্ব দৃশ্য! সেই দূর দিগন- পর্যন-, যেখানে গিয়ে আকাশ পৃথিবীতে নেমে এসেছে সবুজ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। উপরে যেন নীল সামিয়ানা, আর নীচে সবুজ গালিচা। টিলাগুলো যেন সবুজ সাগরের সবুজ ঢেউ। ধ্বংসাবশেষের উপর থেকে নেমে যখন উন্মুক্ত চত্তরে এসে বসলাম তখন আশ্চর্য এক তন্ময়তা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো, হঠাৎ যেন সময়ের সীমারেখা মুছে গেলো। বর্তমানের ধ্বংসাবশেষের স'ানে জেগে উঠলো অতীতের সেই সুন্দর প্রাসাদ এবং জীবন- হয়ে উঠলো প্রাসাদের বাসিন্দারা। ঐ যে রাণী তার সহচরীদের নিয়ে বাগানে পায়চারি করছে। তাদের কলহাস্যে বাগান যেন মুখরিত। রাণী ও তার সহচরীরা লুকোচুরি খেলছেন, খেলতে খেলতে একসময় অদৃশ্য হয়ে গেলেন ঝোপঝাড়ের আড়ালে, আর আমি জেগে উঠলাম আমার তন্ময়তা থেকে। কোথায় আজ রাজা ও রাণী! কোথায় সেই প্রাসাদ ও তার জৌলুস! কোথায় রাজদণ্ড ও রাজপ্রতাপ! কালের করাল গ্রাসে সব কিছু ধ্বংস হয়ে যায়, এমনকি ধ্বংসাবশেষও এক সময় নিশ্চি‎হ্ন হয়ে যায়। তবু দুনিয়ার মোহজাল থেকে মানুষের মুক্তি নেই। মৃত্যু যেন শুধু পূর্ববর্তীদের জন্য, আর পরবর্তীদের জন্য, তাদের জন্য নয়। এই সব ভাবতে ভাবতে মনটা বিষাদে ভারাক্রান- হয়ে উঠলো। এই ধ্বংসাবশেষ থেকে আমি যেন আজ দুনিয়ার ক্ষণস'ায়িত্বের শিক্ষা নিয়ে যেতে পারি এই কামনা করে ধীরে ধীরে নীচে নেমে এলাম। সন্ধ্যার আঁধার তখন ঘনিয়ে এসেছে।