শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা
মাসিক আল-কলম-পুষ্প
রমযান ১৪৩০ হিঃ (১৩) | কচি ও কাঁচা
ছোটদের জন্য গল্প
লিখেছেনঃ
খালেদ সাইফুল্লাহ, মাদরাসাত
বছরা শহরের এক প্রান্তে ছোট্ট একটি বাড়ীর এক দেয়ালের ফোকরে বাসা বেঁধেছিলো একজোড়া পাখী। সুখের সংসার ছিলো পাখীদম্পতির। একদিন ওরা শস্যক্ষেতে গেলো শস্যদানা কুড়িয়ে খাওয়ার জন্য, এমন সময় এক ভয়ানক শব্দ শুনে ওরা শংকিত হয়ে পড়লো। বোঁ বোঁ শব্দটা বাড়তেই থাকে, বাড়তে থাকে পাখীদু'টোর ভয়ও। ওরা একটা বড় গাছের ডালে গিয়ে আশ্রয় নিলো। যেখানে যত পাখী ছিলো, সব এসে আশ্রয় নিলো বড় গাছটাতে। সবাই যেন কিচির মিচির করা ভুলে গিয়েছে। সবার চেহারায় ভয়, আতংক। কিচির মিচির করলেও বোঁ বোঁ শব্দে তা চাপা পড়ে যেতো। একটা বিরাট পাখী দেখতে পেলো ওরা আকাশে। এরকম পাখী আগে কখনো দেখেনি। পাখীদের জরুরি সভা বসলো। কেউ বললো, এটা শস্যভোজী পাখী, ভয়ের কিছু নেই। কেউ বললো, না, এটা হলো রাক্ষুসে পাখী; ধরবে, আর গিলে খাবে। যদি বাঁচতে চাও এ দেশ ছেড়ে পালাও। দেখছো না, মানুষেরা দলে দলে শহর ছেড়ে পালাচ্ছে।
প্রায় সবপাখী পালিয়ে গেলো, যার যেখানে আত্মীয় স্বজন ছিলো। পাখীদু’টি কোথাও গেলো না। ওরা ভাবলো, যত রাক্ষুসে পাখীই হোক, এটা তো আমাদের দেশ। ভয় পেয়ে দেশ ছেড়ে পালাবো কেন?
পুরুষ পাখীটি বললো, আমাদের পাখীদের তো বুদ্ধি কম। ছোট্ট প্রাণী, ভয়টয় পেতেই পারে। কিন্তু শহরের মানুষগুলোর কাণ্ড দেখো! এতো সুন্দর শহর, এমন সাজানো সংসার ফেলে পালাচ্ছে! ক্ষেতের শস্যগুলো পাকতে শুরু করেছে, সব ছেড়ে ছুড়ে কোথায় যাচ্ছে ওরা!
স্ত্রীপাখীটি বললো, যাই বলো, ভালোই হলো, ক্ষেতের সবশস্য এখন আমাদের।
পুরুষপাখীটি বললো, ছি! এমন করে ভাবতে নেই। পরের দুঃখে খুশী হতে নেই। ওরা এত কষ্ট করে জমি চাষ করে ফসল বোনে বলেই না আমরা শস্যদানা পাই।
স্ত্রীপাখীটি প্রতিবাদ করে বললো, মানুষগুলোকে ভালো বলো তুমি! ওরা আমাদের শিকার করে না! নিষ্ঠুরের মত গুলি করে মারে না! মনে নেই, ইয়া বড় একলোক আমাদের পড়শী পাখীটাকে গুলি করে গাছের ডাল থেকে ফেলে দিলো! উহ, পাখীটা মাটিতে পড়ে কেমন তড়পাচ্ছিলো!
পুরুষপাখীটির মনে পড়লো সেই ঘটনা। তারও দুঃখ হলো, তবু সে ভাবলো। মানুষের মধ্যে ভালো মন্দ সব রকমই আছে। তবু তো ওদের ক্ষেত থেকেই আমাদের খাদ্য আসে। তাই স্ত্রীপাখীটিকে বোঝাতে চেষ্টা করলো, মানুষ যাই করুক, আমরা ওদের অকল্যাণ চাইতে পারি না।
স্ত্রীপাখীটি জিজ্ঞাসা করলো, আচ্ছা, ঐ যে শিকারী লোকটা মাটিতে ছটফট করতে থাকা পড়শী পাখীটাকে তুলে নিয়ে গেলো; পাখীটার কী হবে গো?
পুরুষপাখীটি বিষণ্ন কণ্ঠে বললো, কী আর হবে, জবাই করে কেটেকুটে খেয়ে ফেলবে!
স্ত্রীপাখীটি শিউরে উঠে বললো, কী নিষ্ঠুর এই মানুষগুলো!
স্ত্রীপাখীটি পুরুষপাখীর আরো কাছে এসে বসলো। সত্যি ওর খুব ভয় করছে। পুরুষপাখীটি ভাবছে, বোঁ বোঁ করে আকাশ থেকে নেমে আসা অদ্ভূত পাখীটার কথা। কোত্থেকে এলো পাখীটা, আবার কোথায় চলে গেলো! আমাদের কোন ক্ষতি করবে না তো!
আর স্ত্রীপাখীটির চিন্তা শিকারী মানুষটিকে নিয়ে। মানুষ আমাদের এভাবে মারে কেন? আমরা তো ওদের কোন ক্ষতি করি না। ওদের ক্ষেত থেকে শস্যদানা কত আর খাই! আসলে মানুষ বড় নিষ্ঠুর। ওরা তো অনেক মানুষও শিকার করে!
স্ত্রীপাখীটি পাখীটিকে ভয় ভয় কণ্ঠে বললো, আচ্ছা ঐ শিকারী মানুষটা যদি আমাকে শিকার করে নিয়ে যায়!?
পুরুষপাখীটি ধমক দিয়ে উঠলো, কী সব অলুক্ষণে কথা! তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো ভেবেছো!
***
কিছুদিন থেকে ঐ ভয়ঙ্কর পাখীটা আর আসে না। ধীরে ধীরে পালিয়ে যাওয়া মানুষগুলো শহরে ফিরে আসতে লাগলো এবং আশ্চর্য, দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া পাখীরাও ফিরে এলো। গাছের ডালে ডালে আবার পাখীদের কিচির মিচির শোনা যেতে লাগলো, যদিও মাঝে মধ্যেই শিকারী মানুষ এসে দু’চারটে পাখী শিকার করে। পাখীদের খুব কষ্ট হয়, মানুষের প্রতি তাদের মন খারাপ হয়ে যায়, তবে এটা তারা নিজেদের ভাগ্য বলেই মেনে নেয়। তাই দুঃখ ভুলে গিয়ে তারা আগের মতই কিচির মিচির করে এলাকাটা মুখরিত করে রাখে। স্ত্রীপাখীটির মনে কিন্তু ভয় বাসা বেঁধেই থাকে। মানুষকে একদম বিশ্বাস করতে পারে না। একদিন পুরুষপাখীটিকে বলে, আমার কেন যেন খুব ভয় করছে। এককাজ করো। মানুষের ঘর ছেড়ে দিয়ে চলো আমরা গাছের ডালে বাসা বাঁধি। মানুষেরা কখন কী করে বসে! ওদের মোটেও বিশ্বাস নেই।
পুরুষপাখীটি সেকথায় কান দেয় না। স্ত্রীপাখীটি কী আর করে, সে শুধু বাচ্চাগুলোকে আগলে বসে থাকে, আর তার ভিতরটা ভয়ে টিপ টিপ করতে থাকে।
আরো কিছু দিন পর একভোরে সূর্য ওঠার আগেই পুরুষপাখীটি বাসা ছেড়ে বের হয়েছে খাদ্য আনতে। মাপাখীটি উড়ু উড়ু বাচ্চাদু’টিকে খেলার ছলে আত্মরক্ষার কৌশল শেখাচ্ছিলো। বাবা খাদ্য নিয়ে এলে বাচ্চাদের খাওয়াবে। এমন সময় শোনা গেলো বহু দিন আগের সেই বোঁ বোঁ শব্দ। মাপাখীটি ভয়ে আতংকে কী করবে বুঝে উঠতে পারলো না। বাচ্চাদু’টি নিয়ে সে বাসার দিকে উড়ে গেলো। আর ছোট্ট মাথাটা বের করে রাক্ষুসে পাখীটাকে দেখতে চেষ্টা করলো।
শস্যক্ষেতে দানা সংগ্রহে ব্যস্ত পুরুষপাখীটিও দেখলো, তবে কেন যেন এবার তেমন ভয় পেলো না। সে আকাশের দিকে তাকালো। একি! পাখীটা আকাশ থেকে ডিম পাড়ছে! এ আবার কোন নিয়ম! মাটিতে পড়ে ডিমটা ভেঙ্গে যাবে না! আমাদের মত তা দিয়ে বাচ্চা ফোটাতে পারে না!
বুম-ম-ম! বিকট শব্দে পাখীটি মূর্ছা গেলো। বেলা গড়িয়ে সূর্য যখন অস্ত যায় যায় তখন পাখীটির জ্ঞান ফিরলো। নিজেকে খুব দুর্বল মনে হলো। অনেক্ষণ সে কিছুই মনে করতে পারলো না। পরে ধীরে ধীরে সব মনে পড়লো। রাক্ষুসে পাখীটা আকাশ থেকে ডিম পেড়েছিলো। সেই ডিম ফেটে ...! পুরুষপাখীটির হাসি পায়। এত বিরাট পাখী, আর কী তার বুদ্ধি! হঠাৎ মনে পড়ে বাচ্চা দু’টির কথা, আর ওদের মায়ের কথা। কয়েকটি দানা মুখে নিয়ে পাখীটি উড়াল দেয়। কষ্ট হয়, তবু উড়তে থাকে। কিন্তু কোথায় সেই বাড়ীটা! সব যে ধ্বংসসতূপ! সে চিৎকার করে স্ত্রীকে ডাকে। নাম ধরে বাচ্চাদের ডাকে! কোথাও সাড়া নেই। শেষে সে ধ্বংসসতূপটার ভিতরে ঢোকে। মানুষগুলোর লাশ পড়ে আছে! দেখে সে খুব কষ্ট পায়। মানুষ না হয় পাখীদের শিকার করে, কিন্তু রাক্ষুসে পাখীটা মানুষের উপর যুলূম করতে গেলো কেন? মানুষ খারাপ বলে কি আমাদেরও খারাপ হতে হবে!
কিন্তু বাচ্চাগুলো কোথায়?! ওদের মাই বা কোথায়?! পাখীটি আবার ডাকে, গলায় যতটা জোর আছে তত জোরে ডাকে। সাড়া নেই। শেষে দেখতে পায় একটি ইটের নীচে তার বাসাটা চাপা পড়ে আছে। বাচ্চাদু’টিকে দেখা যায় না, স্ত্রীপাখীটির শুধু লেজটা দেখা যাচ্ছে! পাখীটি ব্যথায় ছটফট করতে থাকে। ডানা ঝাপটায়। ঠোঁট দিয়ে বুকের পালক ছিঁড়ে। তখনো তার ধারণা, মানুষেরা এত খারাপ নয়, যত খারা আকাশ থেকে নেমে আসা ঐ রাক্ষুসে পাখীটা!