শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

রমযান ১৪৩০ হিঃ (১৩) | তোমাদের পাতা

ঝরে গেলো একটি গোলাব

লিখেছেনঃ ফারুক বিন মুজিব

ঝরে গেলো একটি গোলাব ১১-৩-৩০ হিঃ মোতাবেক ৯-৩-০৯ খৃঃ সোমবার ভোর রাত চারটা পনেরো মিনিটে ছুবহে ছাদিকের একটু আগে দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার প্রধান মুফতি হযরত মাওলানা আহমাদুল হক ছাহেব ইনতিকাল করেছেন। (ইননা লিল্লাহি ওয়া ইন্‌না ইলাইহি রাজিঊন) । সারা জীবনের ক্লান্তিহীন মুসাফির অবশেষে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন। ফিতনা-ফাসাদের দুনিয়া থেকে মুক্তি লাভ করে আখেরাতে আল্লাহর রহমতের ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। ছুবহে ছাদিকের আলোই সত্য আলো, ছুবহে কাযিবের আলো আমাদের চোখের ধোকায় আলো হলেও তা মিথ্যা আলো। কিন্তু আজ! একজন কামিল মুমিন এবং ওলী ছাদিকের চিরবিদায়ের যুগপৎ শোকে বিপর্যস্ত এবং আনন্দে উদ্বেলিত মুহূর্তে আজ যেন ছুবহে ছাদিকেরই ছিলো জয়জয়কার! আজ যেন ছুবহে কাযিবের অস্তিত্বই ছিলো না আকাশে। একটি পবিত্র আত্মা ও পাক রূহের ইস্‌তিকবালের জন্য নূরানী ফিরেশতাদের আগমনে সবকিছু যেন আলোকিত ছিলো। তাই ছাদিক ও কাযিবের মধ্যবর্তী অন্ধকার আজ দেখা যায়নি। মওতুল আলিমি মওতুল আলামি, কথাটা কত ধ্রুব সত্য তা আজ নতুন করে প্রমাণিত হতে চলেছে। শর ও বাতিলের মুকাবেলায় ইসলামের যত দুগ, তিনি ছিলেন সেগুলোর পাহারাদার। কে জানে, এখন এ দুর্গগুলো অনিরাপদ হয়ে যায় কি না! নতুন কোন মুহাফিয কি আসবে এগিয়ে তাঁর শূন্যস্থান পূরণের জন্য! পারবে এগিয়ে আসতে! ওমরের ইনতিকালে ফিতনার দরজা ভেঙ্গে যাবে, এ নববী বাণী কিন্তু সত্য হয়েছে যুগে যুগে উম্মাহর শ্রেষ্ঠ আলিমের মৃত্যুতে। তাঁর জানাযা যে কামরায় রক্ষিত ছিলো সেখানে গেলাম। নীরব, শান্ত, তবে অশ্রুপূর্ণ আশ্চর্য এক পবিত্রতা যেন আমাকে স্পর্শ করলো। ওলামায়ে কেরামের নূরানী জামা‘আত সফেদ পোশাকে সফেদ কাতারে দাঁড়িয়ে আছেন সারা জীবনের জাগ্রত মুসাফিরের ঘুমন্ত রূপটি একঝলক দেখার জন্য। আমারও সুযোগ হলো দেখার, দেখলাম। কী দেখলাম যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে, বলতে পারবো না। দু’দিন আগে কঠিন অসুখের কারণে কষ্টের যে সামান্য ছাপ ছিলো মুখমণ্ডলে, আজ তার চি?হ্নমাত্র নেই। মৃত্যুর শান্তি যেন তা মুছে দিয়েছে। এতদিন যেন বিচ্ছেদের কাতরতা ছিলো, এখন যেন আসন্ন মিলনের আনন্দ-উদ্ভাস। মিলনের পূর্বে মিলনমোহনায় উপস্থিতির আলোক-উচ্ছ্বাস! সবাই কাঁদছেন, প্রতিটি চোখে অশ্রু আছে, যা নেই তা হলো কান্নার আওয়ায এবং অশ্রুর অসংযম। এ যেন মৃত্যুশোকের প্রকাশকালে প্রিয় নবীর যে কান্না ও অশ্রুবর্ষণ, তার প্রতিচ্ছবি! ফজরের আযান হলো। জামা‘আত শুরু হলো। সেই জামা‘আতের নূরানিয়াত, আহ! মনে হলো বহু দিন পর, তিনিও আজ শামিল এ জামা‘আতে। ইমামের তিলাওয়াতে বেদনার সুর। ইযাশ্‌-শামসু কুওয়িরাত ওয়া ইযান্‌নুজূমুন কাদারাত... তাই তো! বাংলাদেশের আকাশে ইলমের সূর্য তো আজ ...! আকাশের তারকারা তো আজ ...! নামাযের পর অনুচ্চ কান্নার আওয়াযের মাঝে ঘোষিত হলো তাঁর মৃত্যুর শোকসংবাদ এবং জানাযা ও দাফনের খবর। সূর্য উঠেছে এবং বেশ উপরে উঠেছে, কিন্তু আজ সেই ঝলমলে আলো নেই। চারদিকে যেন ঘন ভারী কুয়াসা! আশ্চর্য, চৈত্র মাসে এমন কুয়াসা! একসাথী ভাই বললেন, এটা কুয়াসা নয় বন্ধু! এটা ‘বাকাতিস্‌সামাউ’-আকাশের কান্নারই একটি রূপ। আজ কাঁদবে না তো আকাশ কবে কাঁদবে তাঁর ইলমি বাগিচার ফুলের সুবাস যারা পেয়েছেন এবং নিজেদের মাঝে ধারণ করে ধন্য হয়েছেন তাদের তো সংখ্যাশুমার নেই। তারা অনেকদিন কাঁদবেন এবং চোখের পানিকে কলমের কালি বানিয়ে অনেক কিছু লিখবেন, অনেক কবিতা, অনেক শোকগাঁথা, অনেক স্মৃতিকথা এবং তাঁর আখলাক ও যিন্দেগির অনেক পর্যালোচনা। আমিও কাঁদছি, আমারও চোখে পানি, কিন্তু সেই পানির তো কলমের কালি হওয়ার যোগ্যতা নেই। তাই তার জানাযা পৃথিবীর উপর থাকতে থাকতেই আমি আমার কলমের কালো দিয়েই তার আখলাকের দু’একটি খণ্ড চিত্র আঁকতে চাই। তাঁর পোশাক ছিলো যেমন শুভ্র পরিষ্কার মানুষের সঙ্গে মুআমালা ও লেনদেন ছিলো তেমনি সাফসুতরা ও পরিষ্কার। একজনও মানুষ এখন পাওয়া যাবে না যে বলবে, তাঁর কাছে আমার পাওনা আছে, কিন্তু একথা বলার মানুষ অসংখ্য যে, আমার কাছে তাঁর অনেক পাওনা আছে। যত দিন শক্তি ছিলো, না, বলা ভালো, যত দিন শক্তির শেষ বিন্দুটুকু ছিলো, তত দিন তিনি কোন তালিবে ইলমের খিদমত নেননি, এমনকি একান্ত ব্যক্তিগত ছোটখাটো খিদমতের ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন কঠিন সংযমী। শেষ দিকে যখন হাঁটতে তাঁর খুব কষ্ট, অযু করার যে ‘জলচৌকি’ তা তিনি নিজে বহন করে নিতেন এবং আনতেন। সময় যে জীবনের মূল্যবান সম্পদ এযুগে সেটা বোঝার এবং বোঝাবার জন্য তিনি ছিলেন বাস্তব নমুনা। শুধু নিজের নয়, অন্যের সময়ও যেন নষ্ট না হয়, প্রত্যেকের সময় যেন তার জীবন গড়ার কাছে ব্যয় হয় সে জন্য তিনি সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। এককথায় নিজের এবং অন্যের সময়ের জন্য তিনি ছিলেন একটি জীবন্ত ঘড়ি। তার ছোহবতে থেকে সকলে নিজ নিজ সাধ্য মোতাবেক সময় সম্পর্কে সচেতনতা অর্জন করতো। নম্রতা ও কঠোরতার একত্র সমাবেশ তার জীবনে যেমন দেখা গেছে তেমন আর কারো জীবনে নয়। উপদেশ দিতেন নরম ভাষায়, মুখের হাসি বজায় রেখে, কিন্তু ভুল আচরণ দেখে নীরব থাকা ছিলো তাঁর স্বভাবে। আপন নীতি ও উছূল থেকে তাঁকে বিচ্যুত করা যেতো না কখনো, তবে নীতিবিরুদ্ধ কথা ও কাজ তিনি প্রত্যাখ্যান করতেন সংযত দৃঢ়তার মাধ্যমে। প্রতিটি আচর এবং উচ্চারণ ছিলো তার পরিমিত। কেউ যেন তাঁর সম্পর্কে কোন রকমের ভুল ধারণার স্বীকার না হয় সে বিষয়ে তিনি ছিলেন সদাসতর্ক। কারণ তিনি তো ব্যক্তি ছিলেন না, ছিলেন দ্বীনের প্রতিনিধি, ইলমে নববী এবং আমলে নববীর ওয়ারিছ। স্বয়ং নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে দেখা যায় এধরণের সতর্কতা, নবীর ওয়ারিছগণ সেটারও বিরাছাত ধারণ করেছিলেন। একবার এক গ্রাম্য লোক তাঁকে একটি বকরী হাদিয়া দিলো। তিনি সেটা মাদরাসায় রশিদের মাধ্যমে জমা দেয়ার ব্যবস্থা করতে বললেন। খাদেম বললো, হুজুর, এটা তো আপনার জন্য হাদিয়া! তিনি বললেন, তা ঠিক, কিন্তু কারো ভুল ধারণা সৃষ্টি হতে পারে। তাঁর নামায কেমন ছিলো তার বিবরণ তো আমি দিতে পারবো না। তবে আসাতেযা কেরামের মুখে অনেকবার শুনেছি, তাঁর নামায হলো নববী নামাযে ছায়া। যতক্ষণ নামাযে থাকতেন ততক্ষণ তিনি আত্মসমাহিত থাকতেন, ঊধ্বজগতে পরম সত্তার সান্নিধ্যে। নামায তিনি পড়তেন না, আদায় করতেন। নামায থেকে তিনি বের হতেন না, শুধু সালাম ফেরাতেন। গোসল ও কাফন তো হয়ে গেছে অনেক আগে। তাঁর আশিক ও প্রেমিক তালিবানে ইলমের জামাতও শোকের সাগরে ভাসতে ভাসতে এসে হাযির হয়েছেন, তবে ভক্ত ও মুহিব্বীনের ঢল এখনো অব্যাহত। কিন্তু আর তো বিলম্ব করা সম্ভব নয়। বিকের তিনটায় জানাযার প্রস্তুতি নেয়া শরু হলো। জানাযা হওয়ার কথা ছিলো মাদরাসা-মাঠে। কিন্তু দেখা গেলো এক্ষেত্রে আমাদের ধারণা ছিলো ভুল। লাখো মানুষের এ সমুদ্র মাদরাসা-মাঠে কীভাবে সংকুলান হবে? সামনে-পিছনে গায়ে গায়ে লেগে দাঁড়ালেও তো সম্ভব হবে না! তখন জানাযা মাদরাসার সামনের বড় রাস্তার পশ্চিমে নেয়া হলো। কাতার গুলো হলো এমন যে, মাঝখানে বলতে গেলে কোন ফাঁক ছিলো না। তারপরো কাতারে দাঁড়তে পারেনি বহু মানুষ। এটা ছিলো স্মরণকালের অন্যতম বৃহৎ জানাযার জামা‘আত। বিদায়ের সময়ও তিনি তাঁর মাকাম ও মর্তবার প্রতি একটি গায়বি ইশারা যেন পাওয়া গেলো। জানাযার জামা‘আতের সম্ভাব্য ব্যাপকতার কথা চিন্তা করে মাইক ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিলো, যা মরহূমের ইজতিহাদের খিলাফ ছিলো। কিন্তু আল্লাহর কী শান! জামা‘আতের কিছুক্ষণ আগে মাইক-বিকল হয়ে গেলো। জানাযার আয়োজকদের তখন কিংকর্তব্য বিমূঢ় অবস্থা। তখন কোন উপায় ছিলো না। আল্লাহর উপর ভরসা করে জামেয়া প্রধান জানাযার নামায শুরু করলেন। তাকবীরের সঙ্গে সঙ্গে সব আওয়ায থেমে গেলো, সবকিছু নীরব হয়ে গেলো, একটা আসমানী প্রশান্তি যেন জামা‘আতকে আচ্ছাদিত করে ফেললো। জানাযার শুরু থেকে শেষ কাতার পর্যন্ত সে তাকবীর শুধু স্পষ্ট নয়, সুস্পষ্টভাবে শোনা গেলো। কেউ জানে না, কী এর ব্যাখ্যা, তবে মাইক ছাড়া এবং কোনরকম পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া জানাযার লক্ষ মানুষের জামা‘আত সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে সমাপ্ত হলো। জানাযা শেষে শোকার্ত মানুষের শোকসাগরের ঢেউ মাকবার-অভিমুখী হলো। জানাযা যারা বহন করে নিয়ে ছলেছিলেন, তাদের দিকে শুধু গিবতার নযরে তাকিয়ে থাকলাম, আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, আপনার নূরানী শিক্ষা ও আলোকিত আদর্শ যেন বহন করতে পারি চিরজীবন। মাদরাসার নিকটবর্তী মাকবারায়ে হাবীবিয়া, প্রতিরাতে জোনাকিরা যাকে তাদের আলোকসজ্জা দ্বারা সাজিয়ে রাখে, যেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন আল্লাহর বহু পেয়ারা বান্দা এবং দারুল উলুমের আকারীনের নূরানী জামা‘আ তাঁকেও সেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হলো। হে আল্লাহ, পরবর্তীদের তাওফীক দান করো পূর্ববর্তীদের নূরানী তরীকা অনুসারে জীবন গড়ার এবং জীবনের দায়িত্ব যথাযথরূপেপালন করে তোমার প্রিয়পাত্র হওয়ার, আমীন।