শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

রমযান ১৪৩০ হিঃ (১৩) | কিশোর পাতা

পড়ার স্বপ্ন এবং স্বপ্নের পড়া

লিখেছেনঃ সাফ্‌ফানা

আমার চারপাশে ঘুমের কুয়াসা। তার মাঝে আমি জেগে আছি একা। হাতে কিতাব, মনে প্রতীক্ষা; আব্বু পড়াবেন, আগের মত নিকট থেকে নয়, দূর থেকে, আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে। একটা সময় ছিলো, আব্বু আমাকে পড়াতেন কাছে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে; আমাকে অনেক স্বপ্ন দেখিয়ে এবং আব্বুর বুকে লালিত স্বপ্নের কথা বলে। আব্বুর স্বপ্ন ছিলো, আমাকে অনেক পড়াবেন, অনেক শেখাবেন; অনেক দেখাবেন, অনেক বোঝাবেন; আমার হাতে কলম তুলে দেবেন, আমাকে কলমের হাতে...! আববুর স্বপ্ন ছিলো, আমাকে তিনি মনের মত গড়ে তোলবেন। আব্বু অনেক চেয়েছেন আমাকে পড়ার স্বপ্ন দেখাতে, কিন্তু আমি পড়ার স্বপ্ন দেখতে পারিনি। হায়, কী সুবর্ণ সময়গুলো গলে গলে ক্ষয় হয়ে গেছে জীবনপ্রদীপ থেকে। আব্বু এখনো পড়ান আমাকে, তবে দূর থেকে কানের কাছে যন্ত্র ধরে। তখন যন্ত্রটাকে আমার মনে হয় অনেক আপনার; কাগজের মত, কলমের মত এবং কিতাবের মত আপনার। কারণ সে যে আমার ইলম অর্জনের মাধ্যম। *** প্রতীক্ষার মুহূর্তগুলো ধীরে ধীরে বর্তমান থেকে অতীতের গহ্বরে চলে যাচ্ছে, আব্বুর ‘ডাক’ আসছে না। শেষ পর্যন্ত আব্বুর ‘ডাক’ এলো না এবং আজকের মত আমার পড়া হলো না। এখন পড়ার এবং লেখার প্রবল আকুতি জাগে মনে, কিন্তু আমার জীবনে আকাশের সীমানা এখন সুদূর বিস্তৃত নয়। আর কিছু না হোক, একজন মা, যত সামান্যই হোক, তার হৃদয়-আকাশের সবটুকু নিজের দখলে থাকে না। আকাশের অনেকটুকু জায়গা তাকে ছেড়ে দিতে হয় সন্তানকে ছুঁয়ে যাওয়া নতুন নতুন স্বপ্নের জন্য। আমার চাঁদের টুকরো সন্তান এখন ঘুমিয়ে আছে; হয়ত ফিরেশতাদের সাথে খেলা করছে! তাই কিছু সময়ের জন্য আমার হৃদয়-আকাশের এই অংশটুকু ছিলো আমার নিজের জন্য। আমি এখন পড়তে পারতাম, যে পড়ার স্বপ্ন আব্বু দেখতেন, যে পড়ার স্বপ্ন আব্বু আমাকে দেখাতেন, অথচ আমি দেখতে পারিনি! একসময় ছিলো আব্বুর প্রতীক্ষা আমার জন্য, অনেক নিকট থেকে! এখন আমার প্রতীক্ষা আব্বুর জন্য, অনেক দূর থেকে! আজ পড়া হলো না, আব্বুর ‘ডাক’ এলো না। তবে মুমিনের সান্ত্বনা এই যে, সে জানে সবকিছু আল্লাহর ফায়সালা। রাত আরো গভীর হলো,তবু ইচ্ছে হলো না কিতাবের সঙ্গ ত্যাগ করে নিদ্রার সঙ্গ গ্রহণ করি, যদিও ক্লান্তি ও শ্রান্তির দাবী ছিলো জোরালো। কিতাব হাতে এসে বসলাম আমার ছোট্ট বাগানে। এখন বিষণ্ন সময়ে কিতাবের সঙ্গ আমার ভালো লাগে, এমন ভালো লাগা যা আমি হৃদয় দিয়ে অনুভব করি, শব্দ দিয়ে প্রকাশ করতে পারি না। আমি বসলাম একটি গাছের পাশে। ছোট্ট শিশুর মত গাছটি, আমার সন্তানের চেয়ে একটু বড় হবে বয়সে। গাছটি আমার কাছে আমার সন্তানের মত, কচি পাতগুলোতে যখন হাত বুলাই, অনুভূতিটা ঠিক এমনই হয়; অন্তরে তখন প্রশান্তির ছায়া পড়ে। বাগানে এখন ফুল নেই, তবু মনে হলো অনেক ফুল আছে এবং আছে অনেক সুবাস; হয়ত এজন্য যে, কিতাবটি আমার সঙ্গে আছে। আব্বু বলতেন, নতুন কিতাবের নিজস্ব একটি ঘ্রাণ আছে, আবার পুরোনো কিতাবেরও আছে আলাদা একটি সুবাস। সেই ঘ্রাণ এবং সেই সুবাস এখন পাই, হৃদয় যখন নিবেদিত হয় কিতাবের প্রতি। *** আজ পূর্ণিমার রাত, ভেবেছিলাম, চাঁদের আলোতে পড়বো। একসময় আব্বু পড়তেন চাঁদের আলোতে। আব্বুর জীবনে তখন আমরা কেউ ছিলাম না; আপু না, আমি না, ছোট্ট ভাইটি না; আম্মুও না। তখন আব্বুও ছিলেন না। ছিলো একজন তরুণ, আগামী জীবনের আব্বু! সেই তরুণ প্রদীপের আলোতে যেমন বই পড়তো, তেমনি পড়তো কখনো চাঁদের আলোতে। আব্বু নিষেধ করে বলেন,চাঁদের আলোতে বই পড়ে আমি ভুল করেছিলাম, তুমি সে ভুল করো না। চোখের প্রতি অবিচার আমি করেছি, তুমি করো না। তবু মাঝে মধ্যে পূর্ণিমার আলোতে পড়তে আমার ভালো লাগে; আব্বুর সেই প্রাচীন জীবনখণ্ডটুকুর সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করি। নিজেকে তখন সমৃদ্ধ মনে হয়, আর মনে হয়, এভাবে হয়ত আমার সন্তানের জন্যও কিছু সঞ্চয় গড়ে ওঠে। কিন্তু আকাশে এখন চাঁদের মুখে মেঘের ছায়া! মেঘের ছায়া কি লজ্জাবতী চাঁদের ওড়না! না চাঁদেরও মনে আছে কোন বিষণ্নতা! চাঁদের প্রদীপে আজ একটু যদি আলো থাকতো, ভালো লাগতো। বসে বসে শুধু দেখলাম মেঘের আড়ালে চাঁদের লুকিয়ে যাওয়া, আবার মেঘের ফাঁকে একটু উঁকি দেয়া। জানি না, এটা কি মেঘের সঙ্গে চাঁদের লুকোচুরি খেলা, না চাঁদের প্রতি মেঘের ঈর্ষাকতারতা! আমি জানি, যখন চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকি, আমার চোখের তারায় ভাসে চাঁদের প্রতিচ্ছবি, কিন্তু আমি তা দেখতে পাই না। এখন হঠাৎ মনে হলো, আমি যেন চাঁদের আয়নায় দেখতে পেলাম আমার হারিয়ে যাওয়া অতীতের ছবি! জীবনের অতীত বড় অদ্ভুত; মুছেও ফেলা যায় না, ফিরিয়েও আনা যায় না। অতীত শুধু দূর থেকে, সময়ের পর্দার আড়াল থেকে মনে করিয়ে দেয় সুখের এবং দুঃখের মুহূর্তগুলো। আশ্চর্য, তখন দুঃখের স্মৃতিগুলো যেমন কষ্ট দেয়, তেমনি কষ্ট দেয় সুখের মুহূর্তগুলোও! চাঁদটা আবার হারিয়ে গেলো মেঘের আড়ালে। একটি বর্ণনাতীত বেদনার অনুভূতি নিয়ে আমি ফিরে এলাম ঘরে। আমার চাঁদের টুকরো ঘুমিয়ে আছে। আমি তাকিয়ে থাকলাম মমতা ও মুগ্ধতার দৃষ্টিতে! আমার আকাশটুকু আবার চলে গেলো ওর দখলে। অপূর্ব এক ভালো লাগা আমার সর্বসত্তাকে যেন প্রলেপ বুলিয়ে দিলো, আর তখনই ঘুম আমাকে নিয়ে গেলো স্বপ্নের রাজ্যে। সেখানে ফিরে পেলাম আমি আমার অতীতকে। আব্বু আমাকে পড়ালেন কাছে বসিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে। পড়া তো নয় যেন জান্নাতের বাগান থেকে ফুল তুলে আনা! জান্নাতের গাছ থেকে ফল পেড়ে আনা! সেখানে আকাশ ছিলো, পূর্ণিমার চাঁদ ছিলো, কিন্তু মেঘ ছিলো না। এমন সুন্দর অপার্থিব দৃশ্য! যদি এঁকে রাখা যেতো কাগজের পাতায় কলমের তুলি দিয়ে! হৃদয়ের গভীরে ভাবের অপূর্ব এক তরঙ্গদোলা অনুভব করলাম। আব্বুকে বললাম, আব্বু! এই যে আকাশের বুকে পূর্ণিমার চাঁদ এবং আমার বুকে তার ছায়াপাত! এই যে কোমল জোসনার স্নিগ্ধ স্পর্শ এবং আমার হৃদয়ে ভাবের তরঙ্গ! তোমার কলম দিয়ে আমাকে তা লিখে দাও! আমি দেখতে চাই তোমার কলমে আঁকা চাঁদের জোসনার ছবি এবং আমার হৃদয়ের ভাব ও ভাবনার প্রতিচ্ছবি! আব্বু লিখলেন, আমি কাছে বসে দেখলাম এবং অবাক হলাম কাগজের পাতায় আমার হৃদয়ের নিখুঁত ছবিটি দেখে। আব্বু যেন তার বুকে আমার হৃদয়টিকে ধারণ করে তারপর লিখেছেন। ঘুম থেকে জেগেও অনুভব করলাম স্বপ্নের স্নিগ্ধতা। একদিন আমার হৃদয়ে পড়ার স্বপ্ন জাগেনি, কিন্তু আজ আমার হৃদয় স্বপ্নের পড়া ধারণ করতে পেরেছে। মানুষ যখন পড়ার স্বপ্ন এবং লেখার স্বপ্ন দেখে তখন সে স্বপ্নের জগতেও পড়তে পারে এবং লিখতে পারে। আজকের এই মধুর ও পবিত্র স্বপ্নটুকুর জন্য আমার প্রতিপালকের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আর কৃতজ্ঞ আব্বুর কলমে আমার হৃদয়ের ছবি আঁকার জন্য। শুধু এই টুকু মনে আছে, আব্বু লিখেছিলেন, হৃদয় থেকে হৃদয় এবং সিনা থেকে সিনা...।