শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

রজব ১৪৩০ হিঃ (১২) | কিশোর পাতা

ধারাবাহিক

আমার ভ্রমণকাহিনী

লিখেছেনঃ মুহম্মদ

একটি ইঞ্জিন-নৌকা ভাড়া করা হলো। দুপুরের কিছু আগে সবাই এবং আম্মুর সঙ্গে আমি রওয়ানা হলাম ডিসি হিলের সৌন্দর্য দেখতে। মুনিরা নানু গতকাল চিটাগাং থেকে এসেছেন। তিনিও আছেন আমাদের সঙ্গে। মুনিরা নানু যেখানে থাকেন সেখানে সবকিছু যেন হাসতে থাকে। তার মনে যত কষ্ট থাকুক মুখে হাসি থাকবেই। তিনি চান, সবাই যেন খুশী থাকে, সবার মুখে যেন হাসি থাকে। এই যা! মুমিনা নানু রাগ করেছেন! না, না, আপনি তো আরো ভালো! আপনি হলেন চাঁদের (বুড়ির) মত! ইঞ্জিন-নৌকা কাপ্তাই লেকের শান্ত পানি কেটে এগিয়ে চললো। আমি ছোট্ট মানুষ। লোকালয়ের কোলাহল ছেড়ে লেকের নির্জনতায় হারিয়ে যেতে কার না ভালো লাগে! আমারও ভালো লাগছিলো। লেকের দু’পাশের সবুজের সৌন্দর্য ছিলো অপূর্ব, কিন্তু সে সৌন্দর্যের কথা লেখায় ফুটিয়ে তোলবো কীভাবে তা বুঝতে পারছি না। কারণ উপযুক্ত শব্দ ও ভাষা আমার জানা নেই। উঁচু পাহাড়, কিন্তু সবুজের চাদর দিয়ে যেন ঢাকা! সবুজের ছায়া পড়েছে লেকের পানিতে! নৌকার ভটভট আওয়াযটা না থাকলে পরিবেশটা আরো বেশী উপভোগ করার মত হতো। যদি পালের নৌকা হতো, পানিপথের এই ভ্রমণটা তাহলে কী মজারই না হতো! নদীর পারে দাঁড়িয়ে পালের নৌকা যেতে দেখেছি, মাঝি হাল ধরে বসে আছে, আর নৌকা তরতর করে চলছে দূরের কোন দেশে। দেখতে এত ভালো লাগে! যদি পালের নৌকায় চড়তে পারতাম। এখানে অবশ্য বাতাস নেই। পালে বাতাস না পেলে নৌকা চলে না। শুধু বৈঠার নৌকা হলেও ভালো হতো। আওয়াযটা তো থাকতো না। প্রকৃতির পরিবেশে নীরবতা যে কত আনন্দদায়ক তা এখন বোঝা গেলো। আব্বুর কথা, ‘মানুষ একসময় নির্জনতায় হাঁপিয়ে উঠতো, কোলাহলের জন্য মানুষ ব্যাকুল হয়ে থাকতো, ধীরে ধীরে মানুষ কোলাহল তৈরী করেছে। এখন নিজের তৈরী কোলাহলে সে নিজেই হাঁপিয়ে উঠেছে। মানুষ এখন আবার নির্জনতার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। মানুষ এখন বলে, এই সব নগর-সভ্যতা নিয়ে যাও, ফিরিয়ে দাও সেই অরণ্যের নির্জনতা।’ কথাগুলো ভারী ভারী হলেও মনে হয় এখন কিছুটা বুঝতে পেরেছি। একসময় আমরা পৌঁছে গেলাম ডিসি হিলে। সবাই যেখানে নামে, আমরা আরেকটু এগিয়ে একটি নির্জন স্থানে নামলাম। পাথুরে মাটির উপর নানু চাদর বিছালেন। আমরা তাতে আরাম করে বসলাম। মনে হলো পৃথিবীতে আমরা ছাড়া আর কোন মানুষ নেই। কী আশ্চর্য সুন্দর নির্জনতা! সবুজের কী অপূর্ব স্নিগ্ধতা। সবুজের মাঝে মনে হলো, আমরাও হয়ে গেছি সবুজ মানুষ! এখান থেকে একটুকুরো সবুজ যদি নিয়ে যাওয়া যেতো ঢাকায় আমাদের কামরাঙ্গীর চরে, মাদরাসাতুল মাদীনায়! মাদরাসাতুল মাদীনাহর জন্য আল্লাহ যখন জায়গা দেবেন, আব্বুকে বলবো, মাদরাসাটা যেন হয় সবুজের গালিচার উপরে এবং সবুজের শামিয়ানার নীচে! সেখানেই আমরা দুপুরের খাবার খেলাম। আমার জীবনটা খুব ছোট নয়, সুদীর্ঘ পনের বছর। তো আমার এই সুদীর্ঘ পনের বছরের জীবনে এমন আনন্দের এবং এত তৃপ্তির আহার আর কখনো হয়নি। আমাদের পায়ের একেবারে কাছ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে কাপ্তাই লেক। চারপাশে আশ্চর্য সুন্দর সব দৃশ্য। তিন দিকে সবুজে ঢাকা পাহাড়। এখানে লেকটা মোড় নেয়ার কারণেই এমন মনে হচ্ছে। এ দৃশ্য কত যে সুন্দর তা না দেখলে বোঝা যাবে না। দূরে একটা পাহাড়ের উপর ছবির মত সুন্দর একটি বাড়ী। এটা হলো রাঙ্গামাটির জেলাপ্রশাসকের বাসভবন। একারণেই নাম হয়েছে ‘ডিসিহিল’। ইংরেজীতে ‘হিল’ মানে যে পাহাড়, জেনেছি কয়েক দিন হলো। আর পাহাড়ের আরবী যে ‘জাবালুন’, জেনেছি কয়েক বছর হলো। খেয়ে দেয়ে আমরা পাহাড়ে উঠলাম। ঘুরে ঘুরে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। নির্জনতার মাঝে হঠাৎ হঠাৎ নাম না জানা একটা দু'টো পাখী ডেকে ওঠে। যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ওরাও এই সুন্দর প্রকৃতির অংশ। যেন বলে, আমাদের কথা ভুলে যেয়ো না, আমরাও আছি এখানে। আমার তো ইচ্ছা করছিলো পাহাড়েই থেকে যেতে, সবুজের সাথে মিশে যেতে এবং পাখীদের সঙ্গে কথা বলতে, কিন্তু আমি জানি, পাহাড়ের বাসিন্দারা যেমন পাহাড় ছাড়া থাকতে পারে না, তেমনি আমরাও সমতল ছাড়া থাকতে পারবো না। মাটি ও ভূমির সাথে মানুষের এমনই সম্পর্ক। তাছাড়া একা একা কী আর থাকা যায়! ক্ষুধা পেলেই তো সব সৌন্দর্য হারিয়ে যাবে, আর মনে পড়বে আম্মুর কথা! তাই পাহাড়ের মায়া ত্যাগ করে ভালো ছেলের মত আম্মুর সঙ্গে ফিরে এলাম বাসায়। রাঙ্গামাটির আরেকটি বড় আকর্ষণ হলো শোভলং ঝর্ণা। আগের থেকেই কথা ছিলো, আজ দুপুরে আমরা নৌকায় ওঠবো। কিন্তু দুপুরটা হলো বিকেল শুরু হওয়ার পর! আব্বুর ভাষায়, পুরুষদের দুপুর, আর মেয়েদের দুপুর একসঙ্গে হয় না, কখনো হয়নি। যাই হোক আবার শুরু হলো আমাদের পানিপথের ভ্রমণ। আজ আমি আর বড় মামা নৌকার ছাদে উঠে বসলাম। অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো, আমি যেন কোন মুসলিম দেশের নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাযে করে নৌযুদ্ধে যাত্রা করছি। গতকাল প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করেছিলাম, আজ অর্জন করলাম নৌজিহাদের কল্পিত রোমাঞ্চের অনুভূতি। মুসলমানদের শত্রুর বিরুদ্ধে যারা জিহাদ করে তাদের অনুভূতি কেমন হয় কে জানে! আমার দৃঢ় ইচ্ছা, আমি দ্বীনের জন্য জিহাদ করবো। যদি কখনো সুযোগ আসে আমি হবো নৌবাহিনীর মুজাহিদ। লেকের একেবারে পাড় ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়। দুদিকেই সবুজ পাহাড়। মনে হয় স্রোতের কারণেই পাহাড়ের গোড়ায় পাথর ক্ষয় হয়ে হয়ে সুন্দর সুন্দর কারুকাজের মত দেখতে হয়েছে! দেখে শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। এ পাহাড়ে সে পাহাড়ে হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ে জুমচাষকারী একটা দু'টো চাকমা পরিবার। ভাবতে অবাক লাগে, পাহাড়েই তাদের জন্ম ও মৃত্যু, পাহাড়েই তাদের জীবন ও জীবিকা! পর্বত যেন এদের মা, আর এরা পর্বত-মাতার সন্তান। ইঞ্জিনের নৌকা এগিয়ে চলেছে নিজের গতিতে লেকের পানিতে সুন্দর ঢেউ তুলে। বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর দেখি, দুই পাড়ের পাহাড় যেন লেকটিকে চেপে ধরেছে। লেক যেন সরু হতে হতে একেবারে হারিয়ে গেছে। কিন্তু না, বাঁক পার হয়ে দেখা গেলো লেক একই রকমভাবে বয়ে চলেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম শোভলং ঝর্ণা এলাকায়। চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্যে এখানে অন্যরকম সৌন্দর্য। তিনদিকে পাহাড়ঘেরা একটি জায়গা; মাঝখানে পাহাড়ের উপর থেকে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এসেছে পানি খুব ক্ষীণ একটি ধারা। আমার তো বিশ্বাসই হতে চাইলো না; এটাই নাকি শোভলং ঝর্ণা! এই ঝর্ণার কথা কত যে শুনেছি। বইয়ের পাতায় ছবিও দেখেছি, তারপর কল্পনায় মনের পাতায় সেই ছবি এঁকে রেখেছি। কিন্তু কোথায় কল্পনা, কোথায় বাস্তব! আমি তো শুনেছি পাহাড়ের অনেক উুঁচ থেকে বিশালধারায় নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঝর্ণার পানি এবং সে দৃশ্য নাকি ভোলা যায় না। আমি তো মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম ঝর্ণার পানিতে গোসল করবো, এখন তো দেখি, ওযু করারও উপায় নেই! মোমেনা নানুর কাছ থেকে জানা গেলো রহস্য। ঝর্ণার আসল রূপ দেখা যায় বর্ষার সময়; এ মৌসুমে নাকি ঝর্ণা শুকিয়ে থাকে। ঝরঝর ঝর্ণা তো দেখা হলো না; ‘শুকশুক’ ঝর্ণা দেখেই ভাবলাম, যাক কিছু একটা তো দেখা হলো। একেবারে না দেখার চেয়ে তো ভালো। তবে মনে মনে বললাম, হে শুকনো ঝর্ণা আমি আবার আসবো তোমার ভরা রূপ দেখার জন্য, তখন যেন আবার ফাঁকি দিয়ো না! শুকনো ঝর্ণা দেখে যখন আমার মন খারাপ তখন হঠাৎ মক্কা শরীফ থেকে আব্বুর ফোন এলো এবং আমার মনের ভিতরে যেন আনন্দের ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হলো। আব্বু আমার পড়ার খোঁজ-খবর নিলেন এবং আমাদের সবার জন্য দু‘আ করছেন, জানালেন। ফোনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলো, কিন্তু হৃদয়ের যোগাযোগ বন্ধ হলো না। রাঙ্গামাটির সফরেও অনেকবার আমি কল্পনায় চলে গেছি আব্বুর সঙ্গে বাইতুল্লাহর সফরে। এখনো তাই হলো। কল্পনায় আমি চলে গেলাম কয়েক বছর আগের শৈশবের সেই সৌভাগ্যের দিনগুলোতে, যখন আব্বু-আম্মু ও ছোট আপুর সঙ্গে আমিও আল্লাহ ঘর যিয়ারাত করেছিলাম। মনটা তখন আমার অন্যরকম এক আনন্দে পরিপূর্ণ হলো। আমি দু‘আ করলাম, হে আল্লাহ! তুমি আব্বুর হজ্জ কবুল করো এবং আমাকে আবার তোমার ঘর যিয়ারাত করার এবং হজ্জ করার তাওফীক দান করো, আমীন। শোভলং ঝর্ণা থেকে আমরা গেলাম শোভলং বাজার দেখতে। ঝর্ণা থেকে বাজার খুব দূরে নয়। ইঞ্জিনের নৌকায় অল্প সময় লাগে। এখানেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কোন কমতি নেই। আসলে রাঙ্গামাটি মানেই তো প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্য! আব্বুর কথা মনে পড়লো, তিনি কোথায় যেন লিখেছেন, ‘প্রকৃতি অকৃপণভাবে যত সৌন্দর্যই সাজিয়ে রাখুক তাতে কী হবে, যদি সেই সৌন্দর্য দেখার চোখ না থাকে এবং তা অনুভব করার মত হৃদয় না থাকে! প্রকৃতির সৌন্দর্য অবলোকন করার মাধ্যমে যদি প্রকৃতির স্রষ্টাকে না চেনা যায় তাহলে কী লাভ প্রকৃতির সৌন্দর্য অবলোকন করে! শুধু চোখের এবং মনের আনন্দলাভ কি কোন লাভ!’ সত্যি, আব্বুর কথা কত মূল্যবান! আব্বুর একথাগুলো মনে ছিলো। তাই রাঙ্গামাটিতে আমি প্রকৃতির সৌন্দর্যের মাঝে হারিয়ে যাইনি। যত দেখেছি তত বেশী আল্লাহর শোকর আদায় করেছি। আলহামদু লিল্লাহ। এখানে সবচে’ আকর্ষণীয় হলো বিরাট একটা পাহাড়ে ওঠার জন্য কেটে কেটে তৈরী করা সিঁড়ি। কিছু কিছু লোক সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করে করে পাহাড়ে ওঠছে। দেখে আমারও ইচ্ছে হলো। তার উপর হলো কী! অনেক নীচে থেকে দেখলাম, আমার চেয়ে কিছুটা বড় একটি মেয়ে হেসে খেলে পাহাড়ে উঠে যাচ্ছে। কী লজ্জার কথা! আমি ছেলে হয়ে কিনা পাহাড়ের গোড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ের পাহাড়ে ওঠা দেখছি! আসলে তখন আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে, মেয়েটিকে ছাড়িয়ে যাওয়া আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব হবে না। কারণ সে তো আমাকে দেখে উঠেনি, নিজে থেকে উঠেছে, আর আমি তাকে দেখে উঠছি! মাকামা কিতাবে নাকি আছে, ‘ওয়াল ফাযলু লিল মুতাকাদ্দিমি’- যে আগে করে শ্রেষ্ঠত্ব তো তার! যাক, আমি মন খারাপ করবো না। ওতো আমার ছোট আপুর মত। আমার আগে পাহাড়ে ওঠছো তাতে আপত্তি নেই,কিন্তু বোরকা পরলে তোমার কী ক্ষতি ছিলো! পর্দা করা যে শরিয়াতের হুকুম জানো না! শুধু এই একটি মেয়েকে আর দোষ দেই কেন! আম্মুদের মত দু’একজন ছাড়া পর্দা তো কোথাও দেখা যায় না। হঠাৎ আমার মনে হলো, পর্দা কি শুধু মেয়েদের জন্য? ছেলেদের জন্য কি পর্দা নেই? আমি শুধু শুধু কেন তাকিয়ে আছি মেয়েটির দিকে? তাতে আমার পর্দা নষ্ট হচ্ছে না? চিন্তাটা মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গে আমি নযর নীচু করে ফেললাম এবং পাহাড়ে ওঠা শুরু করলাম। পাহাড়ে ওঠা কত কঠিন, আমার জানা ছিলো, এখন আরো ভালো করে জানা হলো। সিঁড়ি বেয়ে ওঠা, আর পাহাড় বেয়ে ওঠা এক নয়, তবু মনে হলো, আমার ভিতরের ছোট্ট ‘প্রাণপাখীটা’ বুঝি ওড়েই যাবে। ‘দেহের পিঞ্জিরায় বাস করে প্রাণপাখী’ কথাটা কোথাও পড়েছি, এমন মনে পড়ছে না; তবু প্রাণপাখী কথাটা মনে হলো। নাঈম যদি সঙ্গে থাকতো তাহলে ওকে বলতাম, দেখো, আমার প্রাণপাখীটা ওড়ে যাবে মনে হচ্ছে! সিঁড়ির আড়াইশটা ধাপ পাকা। সেগুলো তো কোন মতে পার হলাম। এর পর শুরু হলো খুব কঠিন পথ। এখানেও কেটে কেটে সিঁড়ির ধাপের মত করা হয়েছে, তবে খুব ঝুঁকিপূর্ণ। খুব সাবধানে উঠতে হয়। সাবধানেই উঠছিলাম, তারপরো একদু’বার পা পিছলে যেতে নিয়েছিলো! পিছলে গেলে কী হতে পারতো তা বলার দরকার নেই। শুধু বলতে পারি, আমার সুযোগ হতো না ভ্রমণকাহিনী লেখার, আর তোমাদের কষ্ট স্বীকার করতে হতো না ভ্রমণকাহিনী পড়ার। উঠতে উঠতে একসময় এমন ক্লান্ত হলাম যে বসেই পড়লাম। একি! বসার পর যে আর উঠতে পারছি না! হাঁটু যেন ভেঙ্গে আসে! তাহলে কী এখানেই পড়ে থাকবো! বড় মামা বললেন, ভয় নেই; কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিলেই দেখবে দাঁড়াতে পারছো, আর দাঁড়ালেই দেখবে হাঁটতে পারছো! বড়মামাকে তখন ডাক্তার ডাক্তার মনে হলো, কিছুটা আস্বস্ত হয়ে বসে থাকলাম। চারদিকে তাকিয়ে অপূর্ব এক অনুভূতি হলো। কোথাও কোন সাড়াশব্দ নেই! এমনকি পাখীদেরও কোন শব্দসাড়া নেই। শুধু নির্জনতা, আর নির্জনতা! শুধু সবুজ, আর সবুজ! এত উচ্চতা থেকে বহু দূর পর্যন্ত সবকিছু দেখা যায়। সুবহানাল্লাহ! কী অপূর্ব আল্লাহর সৃষ্টি। এজন্যই তো আল্লাহর সৃষ্টিকে দেখা এবং আল্লাহকে চেনার জন্য আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করা হলো ইবাদত। সফরের অনুমতি দেয়ার সময় আব্বু আমাকে একথাগুলো বলে দিয়েছিলেন। তাই আমি বসে বসে আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করতে লাগলাম। তাতে আমার মনটা যেন অনেক নরম হলো এবং অনেক সুন্দর হলো, আত্‌তারীকু ইলাল কোরআনে পড়া সেই আয়াতটি মনে পড়লো, ‘রাব্বানা, মা-খালাকতা হাযা বাতিলা’- হে আমাদের প্রতিপালক, এসব আপনি অযথা সৃষ্টি করেননি। (এসব সৃষ্টির পেছনে নিশ্চয় আপনার বিরাট কোন উদ্দেশ্য ও হিকমত রয়েছে। আপনার সৃষ্টির মাধ্যমে আপনার বান্দারা যেন আপনাকে চিনতে পারে সেজন্যই তো আপনি এসব সৃষ্টি করেছেন!)। আমার ভেতর থেকে তখন কে যেন বলে উঠলো, হে আল্লাহ, আপনার সৃষ্টির সৌন্দর্য দেখে আমি খুব মুগ্ধ হয়েছি। আপনার শোকর হে আল্লাহ! পাহাড়ের উপর থেকে নীচের ঘর-বাড়ীগুলো খুব ছোট মনে হচ্ছিলো। পাহাড়ের মাঝে হারিয়ে যাওয়া কাপ্তাই লেক দেখা যাচ্ছিলো বহু দূরে যেন লম্বা একটা রূপালী ফিতা! এতক্ষণ শুনতে পাইনি; এখন হঠাৎ হঠাৎ শোনা যাচ্ছে অচেনা পাখীর মন কেমন করা অচেনা সুর। মনে হলো পাখীটির মনে খুব দুঃখ! পাখীটিকে কি তার সঙ্গী ছেড়ে চলে গেছে! মনে হয় না, পাখীরা তো মানুষের মত নয়! হয়ত পাখীটি তার সঙ্গীকে হারিয়ে ফেলেছে, তাই এখন করুণ সুরে ডাকছে। যেন বলছে, এসো---ও--ও-ও! হঠাৎ মনে হলো দূর থেকে আরেকটি পাখীর একই রকম সুর ভেসে এলো! মনে হলো সঙ্গীটি করুণ সুরে ডাকা পাখীটির ডাক শুনতে পেয়েছে। তাই উত্তর দিয়ে বলছে, আসছি---ই--ই-ই! হয়ত সবটাই মনের কল্পনা। তবু কল্পনা করতে আমার ভালো লাগলো। মনে মনে আমি কামনা করলাম, পাখীটি যেন তার সঙ্গীকে খুঁজে পায়। পাখীরাও মনে হয় নিঃসঙ্গতায় কষ্ট পায়। নিঃসঙ্গ পাখীটির করুণ সুরে পাহাড়ের নির্জনতা যেন আরো কোমল, আরো মধুর হলো! সব মিলিয়ে ক্লান্ত দেহে বসে বসে প্রকৃতির প্রতিটি সৌন্দর্য এবং আনন্দের প্রতিটি মুহূর্ত বেশ উপভোগ করছিলাম। একসময় মনে হলো, আম্মু এবং নানুরা হয়ত চিন্তা করছেন। আরো বসে থাকলে দেরী হয়ে যাবে, আর আম্মু চিন্তা থেকে দুশ্চিন্তায় পড়ে যাবেন। পাহাড় থেকে নামার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। অবাক হয়ে দেখি, আগে তো উঠতেই পারছিলাম না, এখন এমন সহজভাবে উঠে দাঁড়ালাম যে মনেই ছিলো না, একটু আগের উঠতে না পারার কারণে মন খারাপ হওয়ার কথা। নীচে নামতে তেমন কষ্ট হলো না এবং বেশী সময়ও লাগলো না। আব্বু তার সফরনামায় পাহাড় থেকে ওঠা এবং নামা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘উন্নতির পথে আরোহণ করা এবং ধাপে ধাপে উপরে ওঠা খুব কঠিন, কিন্তু অধঃপতনের পথে নেমে যাওয়া খুব সহজ।’ আল্লাহ যেন আব্বুর উপদেশ মেনে চলার তাওফীক দান করেন। আমি যেন সবসময় উন্নতির পথে উপরে ওঠার চেষ্টা করতে পারি। অধঃপতন থেকে আল্লাহ যেন আমাকে এবং সাবইকে হেফাযত করেন, আমীন। পাহাড়ের গোড়ায় এসে দেখা গেলো সত্যি সত্যি আম্মুর দুশ্চিন্তা শুরু হয়ে গেছে। আমাকে দেখে আম্মুর মুখে হাসি ফটলো। আম্মুর মুখের এই হাসি সবসময় আমার দেখতে ইচ্ছে করে। আম্মুকে যখন কথাটা বলি, আম্মু বলেন, তুমি ভালোভাবে লেখা-পড়া করবে ভালো ভালো কাজ করবে, তাহলে আমার মুখে সবসময় আরো সুন্দর হাসি দেখতে পাবে। মুমিনা নানুর বাসায় ফিরে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। একটা কথা বলতে ভুলে গেছি, আছরের নামায আমরা পাহাড়ের উপর পড়েছিলাম এবং আমাদের খুব ভালো লেগেছিলো প্রকৃতির কোলে দাঁড়িয়ে আল্লাহর ইবাদত করতে। সময় যে দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যায়, এটা বোঝার জন্য বড় মানুষ হতে হয় না এবং অনেক বড় জ্ঞানী হওয়ারও প্রয়োজন পড়ে না। ছোটরাও বুঝতে পারে, কীভাবে সময় বয়ে যায় এবং দিনগুলো পার হয়ে যায়। রাঙ্গামটিতে আমার জীবনের আনন্দের দিনগুলোও দেখতে দেখতে ফুরিয়ে গেলো। আজ রাঙ্গামাটিতে আমাদের শেষ রাত। আগামীকাল আমরা যাবো চিটাগাং শহরে আম্মুর বড় মামার বাসায়। মুমিনা নানুও আমাদের সঙ্গে যাবেন। অনেক রাত পর্যন্ত চোখের পাতায় ঘুম ছিলো না। চোখের সামনে শুধু ভাসতে লাগলো রাঙ্গামাটির সবুজ সবুজ পাহাড়। কাপ্তাই লেকের নৌকাভ্রমণ, আর ঝুলন্ত পোল। জানি না এই সুন্দর সবুজ প্রকৃতির কোলে আর ফিরে আসতে পারবো কি না! বারবার মনে পড়তে লাগলো পিছনের পাহাড় থেকে নেমে আসা সন্তু নামের সেই চাকমা ছেলেটির কথা। ছেলেটি বলেছিলো তার সঙ্গে পাহাড়ের উপরে তাদের বাড়িতে যেতে। ছেলেটিকে বলেছিলাম, তোমার কথা আমার মনে থাকবে। সে খুব খুশী হয়েছিলো। ছেলেটির সঙ্গে হয়ত আর কখনো দেখা হবে না। এই সবকথা ভাবতে ভাবতে কখন একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম টের পাইনি। সুখ বলো, দুঃখ বলো, ঘুম যখন আসে তখন মন থেকে সব মুছে যায়। সকাল থেকেই আম্মুদের আয়োজন শুরু হলো। নাস্তার পর দেখতে দেখতে ঘড়ির কাঁটা নয়টার ঘর পার হয়ে গেলো। আমাদের ভাগ্য ভালো ছিলো, ঘড়ির কাঁটা তখন ঠিক সময় মত চলছিলো; একঘণ্টা আগেও না, একঘণ্টা পিছনেও না। তাই আমরা ঠিক সময় মত বাস স্টেশনে পৌঁছে গেলাম এবং বাসও ঠিক এগারটায় যাত্রা শুরু করলো। যে পথ দিয়ে আমরা রাঙ্গামাটি এসেছিলাম সে পথ দিয়েই রাঙ্গামাটি থেকে বিদায় নিলাম। সেই আঁকাবাঁকা, উঁচুনীচু পাহাড়ী পথ। আসার সময় ছিলো সন্ধ্যারাত। তাই পথের চারপাশের সৌন্দর্য দেখা হয়নি। এখন দিনের আলোতে দেখতে পেলাম। একবার দেখলাম, বাসটা যেন অনেক কষ্টে নিজেকে টেনে টেনে পাহাড়ের উপর তুলছে। সরু রাস্তার পাশেই গভীর খাদ। তাকাতেই ভয়ে শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। একটু এদিক সেদিক হলেই বাসটা গিয়ে পড়বে সেই গভীর খাদে। তবে আল্লাহর শোকর বাসটা এদিকও হলো না, সেদিকও হলো না। আমরা নিরাপদেই ঐ সরু পথটা পার হলাম। জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম পাহাড়ের কোলে রাঙ্গামাটি শহরটাকে। ছেড়ে যেতে অনেক কষ্ট হচ্ছিলো। কিন্তু কী আর করা, যেতে তো হবেই। দুঘন্টার কিছু বেশী সময় লাগলো। আমরা চিটাগাং শহরে প্রবেশ করলাম। আম্মুর বড় মামা, আমার হলেন নানা। এখানে আমরা মাত্র একদিন থাকবো, আগামীকালই রওয়ানা হবো ঢাকার উদ্দেশ্যে।