মুহররম.১৪৪০হিঃ (৩/৬)

কাশগর ও কায়রো

মরো’ মুসলিম মরেছে, তবু মরেনি!!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

ফিলিপাইনের মুসলিমপ্রধান দ্বীপজনপদ মিন্দানাও। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। এ অঞ্চলের মুসলিম জনগোষ্ঠী ‘মরো’ নামে পরিচিত। তাদের অবিসম্বাদিত নেতা নূর মিশৌরি। সম্প্রতি মিশৌরি ও ফিলিপাইনী প্রেসিডেন্ট দুতার্তে একটি সমঝোতায় উপনীত হয়েছেন। সে অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট দুতার্তে মরো মুসলমানদের আইনগত ও ভৌগোলিক স্বায়ত্তশাসনের স্বীকৃতি দিয়ে আইন পাস করেছেন এবং তাতে স্বাক্ষর করেছেন। তবে এটি কার্যকর হওয়ার জন্য গণভোটের মাধ্যমে জাতির অনুমোদন পেতে হবে, যা বছরের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। তবে আশা করা যায়, গণভোট আইনের পক্ষেই রায় প্রদান করবে।এ শুভ উপলক্ষে আমাদের পাঠকদের আমরা মরো মুসলিম জনগোষ্ঠীর ইতিহাস এবং তাদের দীর্ঘ জিহাদি ঐতিহ্যের সঙ্গে কিঞ্চিৎ পরিচিত করতে চাই। এটা তিক্ত সত্য যে, বিশ্বের বহু মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মত ফিলিপাইনের মরো মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কেও মুসলিম জাহান বলতে গেলে প্রায় বে-খবর।ফিলিপাইনে ইসলামের প্রথম আগমন ঘটে ১৩১০ খৃস্টাব্দে, মূলত আরব ব্যবসায়ী ও ছুফী সাধকদের মাধ্যমে। তুয়ান নামে এক সাধক সুলু দ্বীপে স্থায়ী-ভাবে বসবাস শুরু করেন। তাঁর ও তাঁর সন্তানদের নিরন্তর দাওয়াতি মেহনতের মাধ্যমেই সুলুতে ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটে। ক্রমে এর ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে জুলুসহ বিভিন্ন দ্বীপে। মিন্দানাও দ্বীপে ফিলিপাইনের প্রথম মসজিদ নির্মিত হয় ১৩৪০ সালে মালয় থেকে আগত ছুফী সাধক করিমুল মাখদূমের উদ্যোগে।একসময় সুলুতে ইসলামের অবস্থান এতই সুসংহত হয় যে, সুলু সালতানাত পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়।ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে মিন্দানাও দ্বীপেও ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে মুসলমানদের ব্যাপক আগমন ঘটে ফিলিপাইনে, আরো সুনির্দিষ্ট ভাবে মিন্দানাও দ্বীপে। ফিলিপাইনে ইসলাম ও মুসলিম শক্তির দ্রুত উত্থানের কারণে খৃস্টান শক্তি প্রমাদ গুণতে শুরু করে। ফলে স্পেনের নেতৃত্বে মুসলিম বিরোধী সামরিক অভিযান শুরু হয়। দীর্ঘ লড়াই শেষে ১৬৩৭ সালে মিন্দানাও এবং ৩৮ সালে সুলুর পতন ঘটে। এরপর স্পেন ও ডাচদের হাত থেকে ফিলিপাইনের দখল চলে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে।১৯৪৯ সালে ফিলিপাইনের স্বাধীনতা লাভের পর মুসলিম-প্রধান অঞ্চল নিয়ে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জোরালো দাবী ওঠে। আর সেখান থেকেই শুরু হয় ফিলিপাইনি সরকারের সঙ্গে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সঙ্ঘাত। অব্যাহত সরকারী দমন -নিপীড়নের ফলে রাজনৈতিক আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রামের রূপ ধারণ করে। এটা ১৯৭০ সালের শুরুর দিকের ঘটনা। সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়েই উচ্চ শিক্ষিত যুবক মুজাহিদ নূর মিশৌরির নেতৃত্ব সামনে আসে। ১৯৭২ সালে তিনি গঠন করেন ‘মরো ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট’।নিষ্ঠুরতম দমন নির্যাতন চালিয়েও যখন মুসলমানদের রাজনৈতিক আন্দোলন ও সশস্ত্র সংগ্রামের জোয়ার থামানো গেলো না তখন ম্যানিলা সরকার কূটচক্রান্তের আশ্রয় নেয় এবং তাতে যথেষ্ট সফল হয়। ১৯৮১ সালে হাশিম সালামাতের নেতৃত্বে মরো মুক্তিসংগ্রামে বিভক্তি দেখা দেয়। তিনি ‘মরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্ট’ নামে আলাদা দল গঠন করেন।ক্রমবর্ধমান হতাহতের ঘটনায় বিচলিত নূর মিশৌরি ১৯৯৬ সালে সরকারের সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেন। ফলে মিন্দানাওয়ের চারটি অঞ্চলে মরো মুসলিম স্বায়ত্ত-শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। নূর মিশৌরি হন স্বায়ত্তশাসিত সরকারের প্রধান। কিন্তু হাশিম সালামাত ও তার দল পূর্ণ স্বাধীনতার দাবীতে লড়াই অব্যাহত রাখে। প্রায় চল্লিশ হাজার যোদ্ধার এ দলটি যথেষ্ট শক্তিশালীও ছিলো।যে আইনের মাধ্যমে মিন্দানাও পূর্ণ স্বায়ত্ত শাসন অর্জন করেছে, ফিলিপাইনি ভাষায় তার নাম ‘বাংসোমোরো’ ( মরো জাতির দেশ)। এত দিন পর্যন্ত মিন্দানাওয়ের স্বায়ত্ত শাসন ছিলো ন্যূনতম পর্যায়ের। প্রকৃতপক্ষে শাসনকার্য নিয়ন্ত্রণ করা হতো কেন্দ্র থেকে। ফলে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মিন্দানাওয়ের কোন অধিকারই ছিলো না। এখন ‘বাংসোমোরো’ আইনের ফলে মিন্দানাও মুসলিম কর্তৃপক্ষ নিজস্ব পার্লামেন্ট ও সরকার পরিচালনা করতে পারবে। স্থানীয় রাজস্ব (সিংহভাগ) ও প্রাকৃতিক সম্পদ স্থানীয় মরো সরকারের নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় উন্নয়নেই ব্যবহৃত হবে। রাজস্বের নির্দিষ্ট অংশ কেন্দ্রকে প্রদান করতে হবে। বিচার ব্যবস্থার ইসলামায়নের অধিকার সরকারের থাকবে। তবে চুক্তির বড় একটি শর্ত হলো  মরো সরকারকে ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্ট-এর বাহিনীটি ভেঙ্গে দিতে হবে।আশার বিষয় এই যে, এমআই এলএফ কর্তৃপক্ষ প্রস্তাবিত ও স্বাক্ষরিত আইনটির প্রতি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন। বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড গাজালী জাফর বলেন, সর্বোৎকৃষ্ট না হলেও সূচনা হিসাবে এ আইন উত্তম। আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা সরকারের সঙ্গে রয়েছি, যাতে আমাদের জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে আমরা কাজ করতে পারি। এমআইএলএফ-প্রেসিডেন্ট ইবরাহীম মুরাদ বলেন, আশা করি বর্তমান আইনের ফলে আন্দোলনরত সব দল স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসবে এবং অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।জাতিসঙ্ঘের মহাসচীব বলেছেন, ‘এটি এ অঞ্চলে শান্তির পথ একটি মাইলফলক।’সবচে’ বড় কথা, মিন্দানাওবাসী এ স্বায়ত্ত শাসনকে শান্তির পক্ষে বড় পদক্ষেপ ও বিজয় মনে করছেন। বস্তুত উভয় পক্ষ বুঝতে পেরেছেন, চূড়ান্ত বিচারে অস্ত্র কোন সমাধান নয়, আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমেই সমাধানের পথ তৈরী হয়।প্রাথমিক তথ্য ঃফিলিপাইন হচ্ছে সাত হাজার একশ দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত একটি সমুদ্রবেষ্টিত দেশ, যার আয়তন দুই লাখ নিরানব্বই হাজার চারশ বর্গ-কিলোমিটার। দেশটির রাজধানী ম্যানিলা। জনসংখ্যা ১০ কোটি ৯৮ লাখ। জনসংখ্যার ৮১ শতাংশ রোমান ক্যাথলিক। ১১ শতাংশ মুসলিম এবং ইসলামই দেশটি দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম।ফিলিপাইনের মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর মরো নামটি আরোপ করে মূলত স্পেনীয়রা। স্পেনের খৃস্টান জনগোষ্ঠী সেখানকার মুসলিমদের মূর বলে আখ্যায়িত করতো। মূলত স্পেনীয় শাসনের সময় থেকেই এ নামের উদ্ভব।ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলের মিন্দানাও দ্বীপপুঞ্জে মরো মুসলিম জনগোষ্ঠীর বাস। এটি ফিলিপাইনের দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীপপুঞ্জ, যার আয়তন ৯৭ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার। এর রাজধানী সুলু। ২০১৮ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী মিন্দানাও-এর জনসংখ্যা দুই কোটি ৫৫ লাখ ৩৭ হাজার। ৯৮ ভাগই মুসলিম।সরকারের সঙ্গে মরো জনগোষ্ঠীর লড়াই ছিলো মূলত ধর্মভিত্তিক। ফিলিপাইনের সাবেক একনায়ক প্রেসিডেন্ট মার্কোসই মূলত যুদ্ধাবস্থা অব্যাহত রাখার জন্য দায়ী ছিলেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট দূতার্তে শুরু থেকেই শান্তি ও সমঝোতার পক্ষে কাজ করেছেন। মূলত তারই উদ্যোগে বাংসোমোরো আইন বাস্তবতার মুখ দেখতে পেয়েছে। গণভোটের রায় পক্ষে পাওয়ার জন্য তিনি আন্তরিকভাবেই কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা মরো মুসলিম জনগোষ্ঠীর সৌভাগ্য কামনা করি।

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা