মুহররম.১৪৪০হিঃ (৩/৬)

প্রথম পাতা

সম্পাদকীয়

جــزاك الله أحــسـنَ الجـــزاء، يـا تــقــي! يـا عثــمـانـي!!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

স্বতন্ত্র সভ্যতা ও সংস্কৃতির অধিকারী প্রত্যেক জাতির রয়েছে নিজস্ব বর্ষপঞ্জী ও ক্যালেন্ডার। খৃস্টানজগতের বর্ষপঞ্জী হলো খৃস্টাব্দ, যার গোড়াপত্তন বর্তমান খৃস্টধর্মের ‘ঈশ্বরপুত্র’ যিশুর জন্মদিনকে কেন্দ্র করে। ইসলামী উম্মাহরও রয়েছে নিজস্ব বর্ষপঞ্জী বা ক্যালেন্ডার, যার ভিত্তি ইসলামের নবীর জন্ম বা মৃত্যুদিবসকে কেন্দ্র করে নয়, বরং মহান হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং হিজরী তারিখ ও বর্ষপঞ্জী হলো আদর্শভিত্তিকও চেতনাকেন্দ্রিক। এ বর্ষপঞ্জীউম্মাহরঅন্তরে সর্বদা জাগরূক রাখে এ চেতনা ও প্রত্যয় যে, উম্মাহর সম্পর্ক হলো নবীজীবনের পায়গাম ও আদর্শের সঙ্গে। দ্বীন ও ঈমানের ডাকে এ উম্মাহ যে কোন ত্যাগ ও কোরবানির জন্য প্রস্তুত, এমনকি প্রয়োজনে আপন-পরিজন ও প্রিয় জন্মভূমি ত্যাগ করতেও সে দ্বিধাহীন, যেমন তাদের প্রিয় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেছেন। হিজরতের এ প্রাণচেতনাই হলো উম্মাহর আসল সম্পদ। এ প্রাণচেতনা ইসলামী উম্মাহর জীবনে চিরজাগরূক রাখাই হিজরী বর্ষপঞ্জী প্রবর্তনের বড় উদ্দেশ্য।আমরা জানি, হিজরী বর্ষের প্রবর্তন হয়েছে দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর যামানায় তাঁর ‘খেলাফতি উদ্যোগে’ এবং ছাহাবা কেরামের ইজমা ও সর্বসম্মতিতে। সুতরাং এটি উম্মাহর দ্বীন ও শরী‘আতের অংশ।একটা সময় ছিলো, ইসলামী জাহান ও মুসলিম উম্মাহর দ্বীন ও দুনিয়ার সর্ববিষয় হিজরী বর্ষপঞ্জী অনুসরণ করেই সম্পন্ন হতো, এমনকি যাবতীয় বৈদেশিক সম্পর্কও! কিন্তু আজ, কোথা রাখি লাজ!! ....***হিজরী তারিখ ও বর্ষপঞ্জীর প্রতি মুসলিম উম্মাহর -কী ব্যক্তিজীবন, কী সামাজিক ও জাতীয় জীবন- যে সীমাহীন গাফলত ও উদাসীনতা, যদিওি সবসময়ই তা অত্যন্ত বেদনা ও যন্ত্রণার বিষয়, তবে আজ এ গভীর রাতে হঠাৎ করেই সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে বড় বেদনাদায়ক একটা উপলক্ষ উপস্থিত হয়েছে। তাই অন্য লেখা স্থগিত করে এ লেখাটি শুরু করেছি।***যখন থেকে চিন্তার জগতে আমার পরিপূর্ণ বিচরণ, একটা প্রশ্ন দিলের মধ্যে কাঁটার মত নিরন্তর বিঁধেছে, বিঁধেই চলেছে! ব্যথায় শুধু ছটফট করেছি, নিজের ভিতরে। ব্যথার তাতে উপশম হয়নি এবং প্রশ্নের সেই জবাবটিও আসেনি যাতে, চিন্তার আগে, হৃদয়ের শান্তি হয়! যাতে বোধ ও বুদ্ধির আগে আত্মার প্রশান্তি হয়!আমার প্রশ্ন ছিলো, হিন্দুস্তানের মুসলমানদের এমন সাধের, এমন স্বপ্নের পাকিস্তান কেন দু’টোকরো হলো? পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য যে জনগোষ্ঠীর সবচে’ বেশী ত্যাগ ও কোরবানি, তারাই কেন পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হলো? এ প্রশ্নের গুরুত্ব তারা বুঝবে না, যারা ইতিহাস জানে না; কী ঘটেছিলো ‘সাতচল্লিশের’ আগে পরে? লাখ লাখ মুসলমান জানমাল ও ইয্যত আবরুর কী কঠিন...? এই ভূখ-ের যারা অধিবাসী, ত্যাগ ও কোরবানির ক্ষেত্রে কী ছিলো তাদের ভূমিকা ও অবদান?প্রশ্নটা আমার একার ছিলো না। এ উপমহাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত যাদের কাছে প্রিয়, তাদের সবার মনেই এ প্রশ্ন ছিলো। বহু বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক এবং আলেম-ওলামা এ প্রশ্নের জবাব খুঁজেছেন। যুক্তিসমৃদ্ধ ও তথ্যপূর্ণ বিভিন্ন জবাব তাদের কাছ থেকে এসেছে। তাতে রাজনৈতিক বঞ্চনা, অর্থনৈতিক শোষণ ও বৈষম্য, ভৌগোলিক অস্বাভাবিকতা এবং ধর্ম তথা ইসলামের আদর্শ ও মুসলিম চেতনার প্রতি অবজ্ঞা, সবই আলোচনায় এসেছে। প্রতিটি সিদ্ধান্তের পিছনে বুদ্ধি ও যুক্তির প্রবল সমর্থনও রয়েছে এবং তা অবাস্তব নয়। কিন্তু ঐ যে বললাম, হৃদয় ও আত্মার প্রশান্তি হয়, এমন উত্তর কারো কাছ থেকেই আসেনি।আল্লামা তাক্বী উছমানীকে আল্লাহ তা‘আলা উত্তম থেকে উত্তম বিনিময় দান করুন। তাঁর কাছ থেকে আজ মেঘলা আকাশের পূর্ণিমার এই নির্জন রাতে (পরোক্ষভাবে হলেও) সেই উত্তরটি পেয়েছি, হৃদয় ও আত্মার যাতে প্রশান্তি হয়।আমাদের ছাত্র জীবনের শুরুতে যখন এই ভূখ- পাকিস্তানের অংশ ছিলো, তখন স্কুল কলেজ এবং মাদরাসার পরীক্ষায় একটা সাধারণ প্রশ্ন ছিলো, পাকিস্তান কবে স্বাধীন হয়েছে? পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার তারিখ লেখো, ইত্যাদি। উত্তর সবারই জানা ছিলো, ১৯৪৭ সালের ১৪ই অগাস্ট।***সন্ধ্যা থেকে তরজমা করছি আল্লামা তাক্বী উছমানীর স্মৃতিমূলক লেখা ‘ইয়াদেঁ’। কীভাবে এ তরজমার চিন্তা আমার মাথায় এলো, আর কলম হাতে উঠলো সেও বড় শিক্ষণীয় বিষয়। যদি সময় ও সুযোগ হয় সে প্রসঙ্গে কিছু বলার ইচ্ছা আছে। আসলে আসমানের ইশারা ছাড়া কিছু হয় না, গাছের পাতা যেমন নড়ে না, তেমনি কলমের কালিও ঝরে না। বহুবছর আলবালাগ দেখি না, জানতামই না তাক্বী উছমানী এমন কিছু লিখছেন। সর্বোপরি আমার দিলের ‘হাশিয়ায়ও’ ছিলো না, এর তরজমা করার কথা। আরো জরুরি বহু কাজ পড়ে আছে আমার! কিন্তু ...। থাক সে প্রসঙ্গ অন্য সময়ের জন্য।এখন যা বলতে চাই তা হলো, একমুহূর্ত আগেও কল্পনায়ও ছিলো না, আমার চিন্তার জগতে কত বড় একটা ‘ঝাঁকুনি’ অপেক্ষা করছে! এমন ঝাঁকুনি যা অস্তিত্বকেই নাড়া দিয়ে যায়; উর্দূতে বলে, ‘অজূদ কো হিলাা ক্যর র‌্যখ েেদতাা হ্যয়’।তাক্বী উছমানীর শৈশবে পাকিস্তানপ্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে যে ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়েছিলো, সঠিক ভাবে বললে, হিন্দুদের হাতে যে লোমহর্ষক মুসলিমনিধনযজ্ঞ ঘটেছিলো সে প্রসঙ্গে তিনি তাঁর স্মৃতি থেকে বলছিলেন। তরজমা করতে করতে যেখানে এসে থামলাম, আর থমকে গেলাম এবং আমার মনে হলো, কিছু সময়ের জন্য ঘড়ির কাঁটাও থেমে গিয়েছিলো। আপনিও দেখুন-‘পাকিস্তান হওয়ামাত্র সারা হিন্দুস্তানে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লো। পূর্বপাঞ্জাবে মুসলমানদের উপর যেন ভয়াবহ কেয়ামত ঘটে গেলো। ...হঠাৎ খেয়াল হলো, তন্দ্রাচ্ছন্নতার কারণে আগের অনুচ্ছেদটার তরজমা ছুটে গিয়েছে। বেশ লজ্জিত হলাম। এমন তো সাধারণত হয় না! যাক, আগের অনুচ্ছেদটায় ফিরে গেলাম। আর তখনই থমকে গেলাম। আমার চারপাশের সবকিছু, এমনকি সময়ও যেন থমকে গেলো! একি শুনছি! একি বলছেন তিনি!!যারা তাক্বী উছমানীর লেখার এ অংশটি এখনো পড়েননি, বা এমনভাবে পড়েছেন, সচরাচর যেমন আমরা পড়ি, তাদের অবগতির জন্য বলছি; এতদিন আমরা সবাই জানি, বিশিষ্ট-সাধারণ, আলেম-গায়র আলেম, সবাই জানি, পাকিস্তানের জন্মতারিখ ১৪ই অগাস্ট ১৯৪৭! কিন্তু না, সেদিনের ছোট্ট শিশু তক্কু, আজকের আল্লামা তাক্বী উছমানী বলছেন-‘পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে রামাযানুল মোবারাকের পবিত্র মাসে। এখানেই শেষ নয়, তারিখটি ছিলো সাতাইশে রামাযান, শবেকদর!! আরো আছে, সময়টি ছিলো জুমুআতুল বিদার পবিত্র রাত!অনেক্ষণ পর যখন আচ্ছন্নতা দূর হলো, আমি নিজে যেমন জেগে উঠলাম, আমার চারপাশের সবকিছুও জেগে উঠলো, আর মনে হলো, সময় আবার নিজের গতিতে চলতে শুরু করেছে।আমার এত দিনের যে প্রশ্নটি ছিলো, পাকিস্তান কেন ভেঙ্গে গেলো? সেই প্রশ্নের এমন জবাব পেয়ে গেলাম যাতে হৃদয় ও আত্মা আশ্বস্ত হয় এবং প্রশান্তি লাভ করে। প্রশ্নের জবাব পেলাম, আর দিলের ভিতরে শুরু হয়ে গেলো কষ্টের তোলপাড় ও বেদনার ঝড়!সবকিছু কি কাকতালীয় ছিলো?! নিগূঢ় কোন রহস্য ছাড়া এমনিতেই ঘটেছিলো?! কুদরতের পক্ষ হতে কি আমাদের জন্য তাতে ছিলো না কোন আসমানী ইশারা, ছিলো না অদৃশ্যের কোন তাৎপর্যপূর্ণ সঙ্কেত?!এমন কি মনে হয় না, সবার অগোচরে, এমনকি শত্রুদেরও ধরাছোঁয়ার বাইরে কুদরতের পক্ষ হতে এটি ছিলো আলাদা একটি আয়োজন মুসলিম উম্মাহর ভাগ্য পরির্বতনের জন্য!এমনকি মনে হয় না যে, প্রিয় জন্মভূমি পাকিস্তানের জন্য হাজার হাজার মুসলিম নারী-পুরুষ ও শিশু-বৃদ্ধ জানমালের যে কোরবানী ও নাযরানা পেশ করেছে এবং জনসংখ্যা ও গণহত্যার দিক থেকে পৃথিবীর যে বৃহত্তম হিজরত, তারই প্রতি করুণা করেই কুদরত পাকিস্তানের শুভজন্মের জন্য এমন একটি মাস, এমন একটি দিন এবং এমন একটি রাত নির্বাচন করেছিলেন! আমাদের শত্রুরা নিশ্চয় বেছে বেছে এটা নির্ধারণ করেনি; আমাদের নেতরাও কি আর এমন দাবী করেছিলেন! সবকিছু হয়েছে তাকদীরের ইশারায়।কিন্তু আমদের কী হলো? দুনিয়ার লোকেরা জানে ১৯৪৭, রাজনীতির কর্ণধাররা মানে ১৪ই অগাস্ট। ঠিক আছে! তাদের কাছে এর চেয়ে বেশী আশাই বা কী করা যায়! কিন্তু আমাদের কী হলো! আমরা কেন পাকিস্তানের ইতিহাস থেকে, পাকিস্তানের জাতীয় দিবস থেকে হিজরী তারিখ এভাবে ঝেড়ে মুছে ফেলে দিলাম! আমরা কেন নিজেরা জাগ্রত হলাম না এবং গণজাগরণ সৃষ্টি করলাম না যে, হিন্দুস্তানের মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান হচ্ছে রামাযানের আমানত, জুমু‘আতুল বিদার আমানত এবং শবেকদরের আমানত? এ আমানতের যেন খেয়ানত না হয়!!তদানীন্তন পাকিস্তানের আলেমসমাজ অনেক কিছু করেছেন, তাঁদের ত্যাগ ও কোরবানি অন্য কোন শ্রেণীর চেয়ে কম ছিলো না। তাঁরাও দেশ ছেড়েছেন; তাঁরাও হিজরত করেছেন (এবং তা দেশের জন্য নয়, দ্বীন ও ঈমান রক্ষার জন্য)। তাঁদেরও জান গিয়েছে, মাল গিয়েছে, সহায়-সম্পদ সবই গিয়েছে, এমনকি তাঁদেরও ...!!কিন্তু এই ফিকরী তাসাহুল ও চৈন্তিক ঔদাসীন্য-এর কী জবাব? চিন্তার এ অচৈতন্যের কী ব্যাখ্যা?পাকিস্তানের তখনকার গণচেতনার উপর তো আলেমসমাজের অপ্রতিহত প্রভাব ছিলো! শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূল, সমগ্র আলিমসমাজ কেন ‘ইংরেজি’ তারিখের  মোকাবেলায় হিজরী তারিখকে প্রতিষ্ঠিত করার জিহাদে অবতীর্ণ হলেন না? খুব কি কঠিন ছিলো? না, তেমন কঠিন কিছু ছিলো না। তবু করেননি। কেন করেননি?!আমি ক্ষুদ্র মানুষ। আমার বিচরণের পরিধি খুবই সামান্য; চিন্তার জগত অতি সঙ্কুচিত; জানি না আমার কিছু বলার অধিকার আছে কি না। কিন্তু ‘আত্মা কি আওয়ায’ এবং হৃদয়ের আর্তনাদ কীভাবে উপেক্ষা করা সম্ভব!!আমার দৃঢ় বিশ্বাস, পাকিস্তান দু’টোকরো হয়েছে, এর পিছনে নিশ্চয় অনেক কারণ রয়েছে। তবে খুব বড় একটা কারণ হলো, পাকিস্তানের জন্মতারিখের ভিত্তি করা হয়েছে ১৩৬৬-এর পরিবর্তে ১৯৪৭ এবং রামাযানের পরিবর্তে অগাস্ট এবং শবে কদরের পরিবর্তে ১৪ তারিখের রাত। আমার সবসময়ের অনুভূতি, আমরা যখন ব্যক্তিগত পর্যায়ে হিজরী তারিখের প্রতি অবহেলা প্রদর্শ করি তখন ব্যক্তিজীবনে বিভিন্ন ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হই। এ অবহেলা যখন জাতীয় পর্যায়ে হয় তখন নেমে আসে জাতীয় বিপর্যয়। এটা আমার বিশ্বাস ও প্রত্যয় যে, হিজরী তারিখের প্রতি সমবেদনা ও সম্মাননা প্রদর্শনের মাধ্যমে ব্যক্তিজীবনে ও জাতীয় জীবনে আমরা বড় বড় সৌভাগ্য অর্জন করতে পারি।এ প্রেরণা ও আত্মচেতনা আমি আজ গভীর রাতের এই নির্জনতায় নতুন করে অর্জন করলাম আল্লামা তাক্বী উছমানীর ‘ইয়াদেঁ- এর তরজমা উপলক্ষে। সতুরাং হে তাক্বী উছমানী আপনাকে জাযাকুমুল্লাহু আহসানাল জাযা। *



শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা